আজ থেকে ২৯ বছর আগে ১৯৮৩-তে পশ্চিম বাংলার জুনিয়র ডাক্তাররা স্লোগান তুলেছিল—‘স্বাস্থ্য কোন ভিক্ষা নয় স্বাস্থ্য আমাদের অধিকার’।
আমাদের দেশে স্বাস্থ্যের অধিকার অধিকার হিসেবে স্বীকৃত নয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-র সংজ্ঞা অনুযায়ী ‘স্বাস্থ্য কেবল অসুস্থতার অনুপস্থিতি নয়, স্বাস্থ্য মানে শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক ভাবে ভালো থাকা’।
আমরা ভালো নেই
অথচ খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের মতই প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা। জমির অধিকার, জলের অধিকার, কর্ম-সংস্থানের অধিকারের মত স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাপরিষেবার অধিকারও জীবনের বিষয়, কখনও কখনও বাঁচা-মরার প্রশ্ন।
কিন্তু বাকী বিষয়গুলোর মত চিকিৎসাপরিষেবার অপ্রতুলতা সব সময় মানুষকে প্রভাবিত করে না। কারণ বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিন খাদ্য-জল-বাসস্থান দরকার, চিকিৎসার দরকার হয় না সব সময়। কিন্তু চিকিৎসার অপ্রতুলতায় মানুষ যখন প্রভাবিত হন তখন তাঁর ক্ষোভ চিকিৎসক-চিকিৎসাকর্মী-চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানের ওপর ফেটে পড়ে, অনেক সময় অন্যায্য ভাবেও।
আরও কিছু তথ্য মনে রাখার মত
দেশবাসীর দুর্দশা কমাতে মহানুভব ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ নিঃশুল্ক ডাক্তারখানা বা হাসপাতাল খুলেছেন, কোন রাজনৈতিক দল বা অ-রাজনৈতিক সংগঠন বন্যা-খরা-মহামারীর সময় চিকিৎসা ত্রাণ চালিয়েছেন—এমনটা দেখা গেলেও স্বাস্থ্যের দাবী নিয়ে আন্দোলনের ইতিহাস বেশী দিনের নয়, বছর ৩০-৩৫ এ ধরনের আন্দোলনের বয়স।
বামপন্থী দলগুলোও স্বাস্থ্যের বিষয়গুলোকে আন্দোলনের বিষয় হিসেবে নিয়েছেন এমনটা নয়—অথচ বহু ডাক্তার বামপন্থী দলগুলোর সদস্য বা সমর্থক হিসেবে ছিলেন বা আছেন। তাঁদের কাছ থেকে উচ্চ হারে লেভি নেওয়া, তাঁদের দিয়ে সংগঠনের সদস্য-সমর্থকদের বিনামূল্যে চিকিৎসা করানো, কখনও সখনও তাঁদের দিয়ে আন্দোলনের সময় বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় চিকিৎসা শিবির চালানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে দলগুলো। তাঁদের স্বাস্থ্য আন্দোলনের সংগঠক হিসেবে ব্যবহার করা হয় নি বললেই চলে।
স্বাস্থ্য ভিক্ষা নয়, অধিকার—সেই অধিকার অর্জনের জন্য সংগ্রাম করতে হবে—এই ধারণা থেকে আন্দোলন সংগঠিত হতে থাকে ৭০ দশকের মাঝামাঝি, ৮০-র দশকের শুরু থেকে। ভারতের নানা কোণে চলা এই সব আন্দোলনগুলো নিয়ে এই আলোচনা—উদ্দেশ্য আন্দোলনগুলোর ইতিবাচক-নেতিবাচক দিকগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’-এর লক্ষ্যে এগিয়ে চলা।
জনস্বাস্থ্য আন্দোলন মানুষের স্বাস্থ্যের অবস্থার উন্নয়নকল্পে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগানোর পক্ষে, কিন্তু জনস্বাস্থ্য আন্দোলন সাধারণ ভাবে মনে করে—
ভারতে এ যাবৎ চলে আসা স্বাস্থ্য আন্দোলনগুলোকে যদি আমরা পর্যালোচনা করি, তাহলে কয়েকটা সুস্পষ্ট ধারা দেখা যায়—
একেক করে এগুলো নিয়ে আলোচনা করা যাক।
গণবিজ্ঞান আন্দোলনের স্বাস্থ্য সচেতনতার প্রয়াস
গণবিজ্ঞানের পাশাপাশি জনস্বাস্থ্য সচেতনতার উল্লেখযোগ্য কাজ যে সংগঠনগুলো করেছে, তাদের মধ্যে আছে—
আশির দশক ছিল এই সংগঠনগুলোর কাজের গৌরবোজ্জ্বল সময়। সে সময়ে এই সংগঠনগুলো মিলে গড়ে তোলে গণবিজ্ঞান সমন্বয় কেন্দ্র, পশ্চিমবঙ্গ। পরবর্তী কালে সিপিআইএম-প্রভাবিত সরকারী মদতপুষ্ট পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ-এর সামনে এগুলো ক্ষীণবল হয়ে পড়ে।
ওষুধনীতি নিয়ে প্রচার
১৯৭৫-এ জয়শুকলাল হাথীর নেতৃত্বাধীন সংসদীয় কমিটি প্রকাশিত রিপোর্টে বলে ১১৭টা মাত্র ওষুধ ভারতের জন্য অত্যাবশ্যক। কমিটি এই ওষুধগুলোর উৎপাদন নিশ্চিত করার সুপারিশ করে, ওষুধের ব্রান্ড নাম বা বাজারী নামের বদলে জেনেরিক নাম বা বৈজ্ঞানিক নাম ব্যবহারের সুপারিশ করে। যাতে জীবনদায়ী ও অত্যাবশ্যক ওষুধগুলো মানুষের আয়ত্বের মধ্যে থাকে তাই মূল্য-নিয়ন্ত্রণের সুপারিশ করা হয়। হাতি কমিটি চেয়েছিল পাব্লিক সেক্টর যেন ওষুধ উৎপাদনে মুখ্য ভূমিকা নেয়। দেশীয় ওষুধ-কোম্পানীগুলোর বিকাশের জন্য কিছু ওষুধ-উৎপাদন কেবল দেশীয় কোম্পানীগুলোর জন্য সংরক্ষিত রাখার কথা বলা হয়। ওষুধ-শিল্পে বহুজাতিক কোম্পানীগুলোর ভূমিকার নিন্দা করে কমিটি, ওষুধ-কোম্পানীগুলোতে বিদেশী বিনিয়োগের মাত্রা তৎক্ষণাৎ কমিয়ে ৪০% করা এবং তারপর কমিয়ে ২৬% করার কথা বলা হয়, এমনকি বিদেশী ওষুধ-কোম্পানীগুলোর জাতীয়করণের পক্ষে ছিল হাতি কমিটি।
আশির দশকের শুরুতে প্রতিবেশী বাংলাদেশের সামরিক স্বৈর সরকার এক জনমুখী পদক্ষেপ নেয়, বাংলাদেশের বাজার থেকে অপ্রয়োজনীয়, ক্ষতিকর সব ওষুধ নিষিদ্ধ করে। প্রায় একই সময় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অত্যাবশ্যক ওষুধের প্রথম তালিকা প্রকাশ করে, সে তালিকায় ওষুধ ছিল শ’দুয়েক। এই ওষুধগুলো দিয়ে পৃথিবীর সমস্ত মানুষের প্রায় সমস্ত রোগ চিকিৎসা সম্ভব। অত্যাবশ্যক ওষুধের তালিকা ছিল ১৯৭৭-এ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-ঘোষিত ‘২০০০ সালের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্য’-এর লক্ষ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। অথচ ভারতের বাজারে তখন হাজার ষাটেক ওষুধের ফরমুলেশন।
জনমুখী জাতীয় ওষুধনীতির দাবীতে গড়ে ওঠে অল ইন্ডিয়া ড্রাগ একশন নেটওয়ার্ক (AIDAN)। নানা রাজ্যে AIDAN-এর শাখা সংগঠনগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ড্রাগ একশন ফোরাম, পশ্চিমবঙ্গ (DAF-WB)। ড্রাগ একশন ফোরাম স্লোগান তোলে ‘মানুষের জন্য ওষুধ না ওষুধের জন্য মানুষ’। একই নামে ফোরামের এক পুস্তিকা প্রচুর জনপ্রিয় হয়। পুস্তিকাটার হিন্দী অনুবাদও করা হয়, পার্শ্ববর্তী রাজ্য বিহারে প্রচারের জন্য। ডাক্তারদের ওষুধের যুক্তিসঙ্গত ব্যবহারে শিক্ষিত করতে এক দ্বিমাসিক জার্নাল বার করা হতে থাকে—ড্রাগ ডিজিজ ডক্টর (DDD)। ৯০-এর দশকের মাঝামাঝি অবশ্য DAF দুর্বল হয়ে পড়ে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের ব্যক্তিত্বের সংঘাতে।
ইস্ট্রোজেন-প্রোজেস্টেরন-এর উচ্চমাত্রায় মিশ্রণের বিরুদ্ধে জনস্বার্থ মামলা করে AIDAN। AIDAN-এর জনস্বার্থ মামলার চাপে সরকার ৭০টারও বেশী ক্ষতিকর ওষুধ নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হয়।
যুক্তিসঙ্গত জেনেরিক ওষুধ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কিছু উদ্যোগও শুরু হয়েছিল এই আন্দোলনের পাশাপাশি। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বরোদার LOCOST এবং কলকাতার কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট মেডিসিনাল ইউনিট (CDMU)। LOCOST নিজস্ব কারখানায় জেনেরিক নামের কিছু অত্যাবশ্যক ওষুধ তৈরী করে। CDMU ওষুধ কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে দর কষাকষি করে ওষুধ কিনে কম দামে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকে সরবরাহ করে।
AIDAN-এর প্রধান দুর্বলতা হল গণ আন্দোলনের সঙ্গে ওষুধনীতির আন্দোলনকে যুক্ত করার চেষ্টা না করে আদালতে মামলা আর সরকারী দপ্তরে আবেদন-নিবেদনে নিজেকে সীমিত রাখা।
নারীবাদী আন্দোলনের স্বাস্থ্য প্রচার
হায়দরাবাদের স্ত্রীশক্তি সংগঠন, দিল্লীর সহেলীর মত নারীবাদী সংগঠনগুলো Depo-provera, NET-EN, Nor-plant—এর মত ক্ষতিকর জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিগুলো বিরুদ্ধে জোরদার প্রচার চালিয়ে সরকারকে জাতীয় পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচীতে এগুলো অন্তর্ভুক্ত করায় সফল ভাবে বাধা দেয়। মহিলাদের জননস্বাস্থ্যের বিষয়গুলোকে ধোয়াশামুক্ত করার প্রয়াস, স্ত্রীভ্রূণ-হত্যার বিরুদ্ধে প্রচার এদের উল্লেখযোগ্য অন্য কাজ।
এই সংগঠনগুলোর মূল দুর্বলতা হল—এরা ফান্ডিং এজেন্সির ফান্ড নিয়ে কাজ করে এবং এদের কাজ ছোট-ছোট এলাকায় সীমিত।
ভূপালের গ্যাসপীড়িতদের আন্দোলন
ভারতের স্বাস্থ্য আন্দোলনের ইতিহাসে আলাদাভাবে উল্লেখ্যের দাবী রাখে ভুপালের গ্যাসপীড়িতদের আন্দোলন। ২-৩ ডিসেম্বর, ১৯৮৪-তে ইউনিয়ন কার্বাইডের গ্যাসকান্ডের পর গ্যাসপীড়িতরা যে আন্দোলন শুরু করেন তাতে ছিল তথ্যের অধিকারের দাবী—বিষগ্যাসে কি কি উপাদান ছিল, মানব ও মানবেতর প্রাণীর শরীরে তাদের কিইবা প্রভাব, বিষের প্রতিষধকই বা কী সে সম্বন্ধে গ্যাসপীড়িতরা জানতে চান। আর ছিল যথাযথ চিকিৎসা, বিষের উচিত প্রতিষেধকের দাবী। গ্যাসপীড়িতদের যে সংগঠন এই আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল তা হল জাহরিলী গ্যাস কান্ড সংঘর্ষ মোর্চা (ZGKSM)। এই সংগঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিলেন বিজ্ঞান শিক্ষা নিয়ে মধ্যপ্রদেশে কর্মরত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কয়েকজন কর্মী ও এসইউসিআই-এর কিছু সংগঠক। এছাড়া ছিল সিপিআই-প্রভাবিত নাগরিক রাহত আউর পুনর্বাস কমিটি (NRPC)। স্বাস্থ্য নিয়ে সমীক্ষার কাজ করে চিকিৎসকদের সংগঠন মেডিকো ফ্রেন্ডস সার্কেল (MFC)।
১৯৮৫-র ৩রা জুন গ্যাসপীড়িতরা ইউনিয়ন কার্বাইড প্রাঙ্গণকে মুক্তাঞ্চল ঘোষণা করে সেখানে এক ক্লিনিকের কাজ শুরু করেন। ZGKSM ও NRPC ছাড়া বম্বের ট্রেড ইউনিয়ন রিলিফ ফান্ড (TURF) ও ইউনিয়ন কার্বাইড কর্মচারী সংঘ (UCKS) যৌথভাবে জনস্বাস্থ্য কেন্দ্র নামে এই ক্লিনিক চালাত।
এই ক্লিনিকে ডাক্তার হিসেবে কাজ করতেন মূলত পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা DAF-WB ও মেডিকাল কলেজ ডেমোক্রাটিক স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন (MCDSA)-এর সঙ্গে যুক্ত জুনিয়র ডাক্তাররা। তাঁরা গ্যাসপীড়িতদের বিষের প্রতিষেধক সোডিয়াম থায়োসালফেট ইঞ্জেকশন লাগাতেন এবং রোগীদের উপসর্গের পরিবর্তন নথিভুক্ত করতেন। ইউনিয়ন কার্বাইডের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ যোগাড় হচ্ছিল, তাতে সন্ত্রস্ত হয়ে ইউনিয়ন কার্বাইডের দোসর সরকার আক্রমণ নামিয়ে আনে সপ্তাহ তিনেকের মাথায়। ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মীরা গ্রেপ্তার হন, স্বাস্থ্য কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়। আবার মাস দেড়েক বাদে DAF, MFC, মেডিকাল সার্ভিস সেন্টার, শহীদ হাসপাতালের সিনিয়র ডাক্তাররা পর্যায় ক্রমে জনস্বাস্থ্য কেন্দ্র চালান কয়েক মাস। এর মাঝে ZGKSM-NRPC-র বিরোধে জনস্বাস্থ্য কেন্দ্র ভেঙ্গে তৈরী করতে হয় জনস্বাস্থ্য কেন্দ্র, ভূপাল।
এরপর ZGKSM এস ইউ সি আই-এর কুক্ষিগত হয়, স্বেচ্ছাসেবীদের মোর্চায় একঘরে করে দেওয়া হয়। শেষে ZGKSM ইউনিয়ন কার্বাইডের সঙ্গে ভারত সরকারের অন্যায় চুক্তি সমর্থন করে গ্যাস-পীড়িতদের আস্থা হারায়। গ্যাস-পীড়িতদের নেতৃত্ব দিতে এবার এগিয়ে আসে গ্যাসপীড়িত মহিলা উদ্যোগ সংগঠন। ZGKSM-এর সহযোগী বুদ্ধিজীবীদের একাংশ গঠন করেন ভূপাল গ্রুপ ফর ইনফরমেশন এন্ড একশন। পরে গঠিত হয় সম্ভাবনা ট্রাস্ট।
সম্ভাবনা ট্রাস্ট এলোপ্যাথি, আয়ুর্বেদ, যোগের সমন্বয়ে গ্যাস-পীড়িতদের চিকিৎসা ও চিকিৎসা-সংক্রান্ত গবেষণার কাজ চালাচ্ছে—তার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আমাদের অজানা। এছাড়া সম্ভাবনা ট্রাস্ট কোন ফান্ডিং এজেন্সির অর্থগ্রহণ না করলেও, প্রায় পূর্ণত দান (অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিদেশী বন্ধুদের দান)-এর ওপর নির্ভরশীল, এটাও এর দুর্বলতার দিক।
ডাক্তারদের সংগঠন—মেডিকো ফ্রেন্ডস সার্কেল
সত্তর দশকের প্রথমার্ধে জয়প্রকাশের আদর্শে অনুপ্রাণিত কিছু ডাক্তার এই সমন্বয় গড়ে তোলেন। বছরে দুবার অর্ধবার্ষিক ও বার্ষিক সভায় এরা স্বাস্থ্যনীতি-সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। MFC Bulletin নামে এক বুলেটিনের মাধ্যমে মতামত আদান-প্রদান করেন।
এঁদের উল্লেখযোগ্য কিছু প্রকাশনা—
MFC-র উদ্যোগে ভূপালের গ্যাসপীড়িতদের স্বাস্থ্য-সমীক্ষা হয় ১৯৮৬ এবং ১৯৮৯-এ।
গুজরাটের দাঙ্গা-পরবর্তী ত্রাণ-শিবিরগুলোতে এঁদের উদ্যোগে চিকিৎসা-ত্রাণের ব্যবস্থা করা হয়।
MFC-র দুর্বলতার দিক হল প্রথম অবস্থায় এর সদস্যরা প্রায় সবাই গণ-সংগঠন গণ-আন্দোলনের কর্মী হলেও এখন তাঁরা প্রায় সবাই ফান্ডেড এন জি ও-র কর্মী বা কর্মকর্তা।
মেডিকেল ছাত্র ও জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন
এই পর্যায়ে পশ্চিমবঙ্গের মেডিকেল ছাত্র ও জুনিয়র ডাক্তারদের কথা বলব। (এই বিষয়ে বিস্তারে বলব পরে কোনও এক লেখায়।
এই আন্দোলনকে ভাঙ্গতে ABJDF ভেঙ্গে শাসক দলে পেটোয়া জুনিয়র ডক্টরস’ কাউন্সিল গড়ে তোলা হয়, JDC-র সদস্যদের মেডিকেল কলেজগুলোতে বসিয়ে দেওয়া হয় আন্দোলন ভাঙ্গার দায়িত্ব দিয়ে। সরকারী ডাক্তারদের একমাত্র সংগঠন হেলথ সার্ভিস এসোসিয়েশন (HSA) ABJDF আন্দোলনকে সমর্থন করায় ট্রান্সফার-প্রোমোশনের লাঠি ও গাজর দেখিয়ে তৈরী করা হয় এসোসিয়েশন অফ হেলথ সার্ভিস ডক্টরস (AHSD)।
তাহলেও এ আন্দোলন ব্যর্থ হয় নি, সাময়িক ভাবে হলেও সরকার সরকারী হাসপাতালে ওষুধ সরবরাহ বাড়াতে, পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুবিধা বাড়াতে বাধ্য হয়।
এছাড়া আরেকটা দিকও উল্লেখ করার মত—শহীদ হাসপাতাল, বেলুড় শ্রমজীবী হাসপাতাল, শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের মত জনস্বাস্থ্য কর্মসূচীগুলোর সংগঠকের ভূমিকা যাঁরা পালন করছেন, তাঁরা প্রায় সবাই-ই ABJDF আন্দোলনের ফসল।
এই আন্দোলনই স্লোগান তুলেছিল—স্বাস্থ্য কোনও ভিক্ষা নয়, স্বাস্থ্য আমাদের অধিকার।
পেশাগত রোগ নিয়ে প্রচার ও আক্রান্তদের চিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণের দাবীতে আন্দোলন ও প্রচার আন্দোলন
এই সংগঠনগুলো পত্র-প
ত্রিকা বার করে জনসচেতনতা তৈরী করা, আদালতে মামলা করে ক্ষতিপূরণ আদায় করার মত কাজ করে।
জনস্বাস্থ্য অভিযান
১৯৭৭-এ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘২০০০ সালের মধ্যে সকলের জন্য স্বাস্থ্য’-এর লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছিল। ২০০০-র সালের দোরগোড়ায় পৌঁছে যখন দেখা গেল সকলের জন্য স্বাস্থ্য তো দূরের কথা বরং সরকারী স্বাস্থ্য পরিষেবা দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে, চিকিৎসা ব্যবসায় বেসরকারী পুঁজির রমরমা বাড়ছে তখন ২০০০ সালে স্থাপিত হল জনস্বাস্থ্য অভিযান। এতে MFC-র সদস্য বেশ কিছুজন সংগঠক হিসেবে থাকলেও মূল রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ছিল সিপিআইএম তার নানা গণ-সংগঠনের আড়ালে। (যেজন্য পশ্চিমবঙ্গে বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্য আন্দোলনে কর্মরত অনেক সংগঠনের কোনটাই জনস্বাস্থ্য অভিযানে স্থান না পেয়ে কেবল স্থান পায় সরকারী গণ-বিজ্ঞান সংগঠন পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ।)
২০০০-এর ডিসেম্বরে যুবভারতীতে ২ দিনের পিপলস হেলথ এসেম্বলীতে সারা ভারতের প্রতিনিধিরা আলাপ-আলোচনা করেন। তারপর ঢাকায়।
পরবর্তী কালে সরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরকারী ব্যবস্থার ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে জনশুনানীর আয়োজন করে।
জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশন (NRHM)-এর ওপর নজরদারীকেও এরা কাজ হিসেবে নিয়েছে।
NRHM-এর অন্তর্গত গ্রামীণ স্বাস্থ্যকর্মী প্রশিক্ষণের এক পাইলট প্রোজেক্ট ছত্তিশগড়ে চালান জনস্বাস্থ্য অভিযানের অন্যতম সংগঠক ডা বিনায়ক সেন। সেই স্বাস্থ্যকর্মীরা মিতানিন নামে পরিচিত।
জনস্বাস্থ্য অভিযানের অন্যান্য ঘটকরা অনেকে NRHM-এর গ্রামীণ মহিলা স্বাস্থ্যকর্মী ASHA (Accreditated Social Health Activist) ট্রেনিং-এর কাজে লিপ্ত আছেন।
জনস্বাস্থ্য অভিযান ব্যবস্থা পরিবর্তনের ঘোষিত লক্ষ্যে ব্যবস্থার সঙ্গে লিপ্ত হওয়ার যে পন্থা নিয়েছে তাতে ব্যবস্থার জনমুখী পরিবর্তন হবে, না ব্যবস্থা জনস্বাস্থ্য অভিযানকে গিলে খাবে তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
(চলবে)