এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • বিসর্জন

    শুদ্ধপ্রসাদ বাগচী লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ২৯ মার্চ ২০১০ | ১১৬৩ বার পঠিত
  • এইরকম একপিস নাম দেখেই বাঙালী ইন্টেলেকচুয়াল (আঁতেল বললে যাদের গায়ে দগদগে ফোস্কা পড়ে যায় এবং বার্ণলের বদলে কাঁচা কয়েকখানা চারাক্ষর না দিলে তার জ্বালা মেটেনা)এবং ততোধিক ইন্টেলেকচুয়াল অবাঙালী জনগণ যারা বাঙলাদেশের কাল্‌চর নিয়ে সম্যক পড়াশোনা করেছেন, একবাক্যে হাত তুলে 'আমি বলবো স্যর' টাইপের হুলিয়া বানিয়ে ফেলবেন, এ নিয়ে কোনো সংশয় থাকা উচিত না। এইসব জরুরী পয়েন্ট আগে থাকতেই ক্লিয়ার করে রাখা ভালো। নইলে পরে গিয়ে একহাতে বীয়র আর আরেকহাতে কে এফ সি-র প্যাকেট ঝুলিয়ে আমরণ অনশনের হুমকি দিলে এ বান্দা দায়িত্ব নেবে না। তবে কিনা এইখানে একটু হলেও আলতো কেলো আছে। রোজ সকালে উঠে একগ্লাস গরম দুধের সাথে এক চিমটে রবীন্দ্রনাথ গুলে খেলেও আপাতত এইখেনে আমরা গুরুদেবকে একটু রেস্ট দেবো। না মানে গুরু-র কলামে গুরু-র কলম আসাটা ভারী যুক্তিগ্রাহ্য ঠিকই এবং সামাজিক কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। তাও একটুকু রিস্ক নিয়ে আমরা নন্দন ছেড়ে আউট্রাম ঘাটের দিকে গুটি গুটি হাঁটা দেবো বাঙলাদেশের পছন্দের লিস্টিতে দুইনম্বর বিসর্জনের পানে। যাকে আমজনতায় ভাসান বলেও অভিহিত করে থাকে। আর জামজনতায় কি বলে সে নিয়ে আপাতত কারুর ইন্টারেস্ট-ও নেই।

    আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি এই তোফা সময়টা যখন আমেরিকায় নানান বিজাতীয় গাছের পাতায় হলদে-সবুজ রঙ ধরে, তখন বাঙলাদেশের আপামর জনসাধারণ ঢাকের বাদ্যির সাথে কোঁচা, আঁচল ও পাজামার দড়ি দুলিয়ে ওরাঙওটাঙ-এর ন্যায় নাচনকোঁদন-এর প্রস্তুতি নেন। যদিও নাচনেওয়ালা বলে বাজারে বদনাম রটে শুধু মধু-বিধুর মতন ফেকলু পার্টিদের।
    (বিধি, বাম নহে, সম্মত সতর্কীকরন: এইস্থানে "পার্টি' শব্দটি কোনরূপ গোষ্ঠিসমুদয়কে আওয়াজ দেবার জন্য ব্যবহৃত হয় নাই।)

    এইখানে খেয়াল রাখতে হবে যে এইসব নানাবিধ মোচ্ছবের আয়োজন বছরের গোড়ার দিক থেকেই শুরু হয়। মা-মাসীমারা তক্কে তক্কে থেকে কোথায় কবে কত পার্সেন্ট সেল দিলো, এসব গূঢ় তথ্য ঠিক ম্যানেজ দিয়ে ফেলেন। এতে করে বাবা-কাকাদের পকেট দেদার হাল্কা হয় ঠিকই, কিন্তু দেশের ও দশের কল্যাণসাধনে তাঁরা এইসব ছুটকো ব্যপারগুলো জাস্ট কাটিয়ে দেন। এর সাথে পুজোকমিটির দাদাদের পাগলের মতন মাথা চুলকোনো, ফাঁক পেলে এরতার নজর এড়িয়ে পাছাও, আর পাড়ার ভাই-দের চাঁদা চাইবার নামে "দাদা" পদে উন্নীত হবার আকুল প্রচেষ্টা, সব মিলেজুলে কোনদিন মাঠে, ঘাটে, বাসে, ট্রামে, নন্দীগ্রামে দমাদম নানাবিধ পোস্টার, বাঁশ ও লাশ পড়ে যায়। তারপর শালা আর পায় কে! অটোয়ালা থেকে ইনস্যুরেন্স এজেন্ট, প্রাইভেট টিউটর থেকে ছোকরা মাস্তান, নাচের দিদিমণি আর ছেনাল পাব্লিক সব গা ঘষাঘষি করে নানাবিধ বাওয়ালিতে মেতে থাকে পাঁচদিন। নতুন জামার আড়ালে তীব্র আমোদগেঁড়েমি ও ত্‌ৎসহ হারামিপনার জমাট আবহে কারুর কিঞ্চিৎ গুরুপাক হলেও, মোটের ওপর তামাশাটা মন্দ দাঁড়ায়না। তার সাথে ভক্তিভাবের ভ্যাদভেদে গুমোট হাওয়ায় ছোটখাটো বেহেড ঢ্যামনামি ও এগরোল, ফুচকা, আইসক্রীম আর অবাধ্য জীভ বেয়ে গড়িয়ে পড়া প্রেম-লালা-ভালবাসা মাখামাখি কিছু লাভ স্টোরি।
    মাঝখান দিয়ে যারা বুদ্ধিমান তারা টুক করে সাইড হয়ে গিয়ে আস্তিন ফাস্তিন গোটাতে থাকে বিসর্জনের জন্য। সেখানেও আবার হরেক ফ্যাকড়া। কারুর বেলুন চাই, কারুর হিমেশ। কোন হতভাগা ভীড়ের মধ্যে অসুরের খাঁড়া ঝেড়ে দিলো, তো ওদিকে সিঁদুর খেলার নামে কোথায় একটু হাতের সুখ। ঢাকীদের সাথে প্যান্ডেলের পেছনে সিদ্ধি, নিদেনপক্ষে বাঙলু, বাড় খেয়ে বাপ-জ্যাঠাদের সামনেই ফেট্টিসহ নাচ, কনস্টেবলকে মুরগি করে বুড়ীমার চকলেট, এসবের কথা নেহাত উহ্যই থাক। ম্যাটাডোর( স্পেনের নয়, হলে মন্দ হত না যদিও, মানে যেভাবে ঠাকুর দেখার লাইনে গুঁতোগুঁতি চলেই আসছে ফিবছর)-এর ওপর ফুল ফ্যামিলি মা দুগ্গা কি করছেন, সেদিকে কারুরই খুব একটা নজর থাকেনা বোধহয়। এমনকি ঘোমটা দেওয়া নতুন বউদিরাও ঝুঁকে পড়ে পাড়ার নিয়মিত জিমে যাওয়া দেওরটিকে অল্প ঝাড়ি মেরে নেন। এইসমস্তই ভাসানের মিছিলের স্পেশালিটি। সারাবছর শহর জুড়ে আরো নানান মিছিল বেরোয় ঠিকই, কিন্তু সেখানে অন্য খেল। কাজেই পথচারী মানুষজন. গোরু-মোষ ও বাস ড্রাইভাররা এই সুযোগে চট করে ভুলভাল টাইমপাসমূলক কাজকম্মো কাটিয়ে দিয়ে ভাসান ব্যাপারটা যতক্ষণ থাকে উপভোগ করে নেন। কারণ এ মিছিলের দৌড় গঙ্গার ঘাট অবদি-ই। তারপরেই ফুস! এবং খানিক বাদে ভুস! মাঝের সময়টা প্রতিমা কিভাবে তুলতে হবে তার মেড ইজি গাইড থেকে দনাদ্দন বুলি কপচানো, গামবাট ক্যামেরা হাতে দাড়িগোঁফওয়ালা কিম্বা কেপ্রিপরিহিতাদের শৈল্পিক ভ্যানতাড়া। কিন্তু আসলটা হল ঐ ভুস! প্রতিমা তো ডুবে গেলো। তার মানেই কি বুক চাপড়ে 'ওগো আমার কাজলা দিদি কই' অথবা ধূধূ ইডেনে 'ইস! শচীন যদি মাইরি আর কয়েকটা ওভার খেলে দিতো!' নাকি? আরে: রামো:! সবে তো যাকে বলে গিয়ে একনম্বর পাওয়ারপ্লে( খান্না সিনেমাগামী পাব্লিক আবার অন্যকিছু ভেবে বসে না যেন)। পরপর লাইন দিয়ে আসবেন ঠাকুর-দেবতারা, উপরে উল্লিখিত সমস্তকিছুর রিপিট শো হবে, নানান রকম মাত্রাপরিবর্তনে। শেষে গিয়ে আবার ফুস! আবার ভুস! পাতি কথায় আবার বিসর্জন। পরের শীতেও ফ্যান চালানোর মতন ইনএভিটেবল বিসর্জন। না হলে পরেরজন এϾট্র নেবেন কি করে?
    বাঙলাদেশের পুজোপার্বণের মহানাটকীয় স্ক্রিপ্ট-এ কোথাও কিউ মিস হয়ে গেলে, প্রম্পটাররা চিল্লে গলার ইয়ে মেরে দেবে তবু একটুখানি চেঞ্জ-ও তো আর করা চলবে না। তাই লেখার শুরুতে কেউ পাকামো মেরে প্রশ্ন করতো যদি 'কিন্তু আরবিট রঙীন বেলুন, হাতধরাধরি, ইতিউতি ঢুকুঢুকু, ফুল বেলপাতা ছেড়ে বিসর্জন কেন? খামোখা ফাংশন থাকতে তার ডেরিভেটিভের পশ্চাদ্দেশে কাঠি না করলেই বা কি হত?' তার উত্তর: কিস্যু না! কারুর একটি কুঞ্চিত কেশ-ও উৎপাটিত হত না। কিন্তু তাই বলে আসলে বিসর্জনটাই ফাংশন, পুজোটা তার ডেরিভেটিভ জাতীয় ফান্ডা মারার ইয়্যাত্তবড়ো একটা চান্স কি ছেড়ে দেওয়া যায় নাকি! হুঁ হুঁ এতকাল খালি ক্লকওয়াইজ মোশান-ই দেখেছো, গোল চক্করের ঠ্যালা তো বোঝনি! এবার লাও। এই চক্করে ভগবান-ও ভূত হন( না মানে, ঐ ভাসান গেলে ভূত হওয়া ছাড়া খুব একটা উপায়-ও থাকে না কিনা) আর এ তো সবে সাধারণ বাঙালী।

    টীকা: জনতা হেবি খচে যেতে পারে আন্দাজ করে এইখানে সুবিধে মতন গুরুদেবের এϾট্র।
    তাই তো বহুদিন আগেই রবীন্দ্রনাথ পুজো-বিসর্জন ইত্যাদি নিয়ে লিখে গেছেন "শুধু যাওয়া আসা, শুধু স্রোতে ভাসা'। তাই সবাই "ও গো, ভাসান হয়ে গেলো গো' মড়াকান্না না কেঁদে উঠে বসুন। হর্লিক্স খেতে খেতে চট করে জর্জ বিশ্বাসের গলায় গানটা শুনে নিয়ে নতুন জামা, ভেঁপু, রোদচশমা, মেকাপ কিট ও রোদচশমা রেডি করে ফেলুন। দেখে নিন আয়না, বোরোলীন ও বান্ধবী সব ঠিকঠাক আছে কিনা। ঠাকুর চলে গেলেন তো কি, ঠাকুর আসছেন। আবার। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে, চলিবে-ও। এমনই বিসর্জনের মহিমা!

                         আসছে বছর আবার হবে

    ২৯শে মার্চ, ২০১০
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ২৯ মার্চ ২০১০ | ১১৬৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু মতামত দিন