এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  রাজনীতি

  • যাঁরা বদলে দিতে পারেন (পর্ব ২)

    সায়ন্তন মাইতি লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | রাজনীতি | ০৬ জুলাই ২০১৫ | ৩৪৩২ বার পঠিত
  • তাহলে সাক্ষরতা অভিযানের জন্য তাত্ত্বিক বই ছেড়ে গল্প-উপন্যাসের কথায় আসছি  । কাহিনীর সিরিঞ্জে তত্ত্বের স্যালাইন পাঠালে অনেক সহজে পাঠকের মননে অক্ষয় হয়। অস্তিমান গল্প ছাড়া এই অংশে থাকবে নতুন গল্প লেখার দু-একটা ব্যক্তিগত পরামর্শ। তার দায়ভার নিতে হবে লেখকদের। ধাপে ধাপে পাঠকদের পরিণত করুন। মূলত বাংলাকেন্দ্রিক আলোচনা করে আসছি এবং করব। সমাকলনের নিয়ম অনুযায়ী আমাদের অভীষ্ট লক্ষকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে নিকটতম ভাগটাই নিলাম। প্রবন্ধ শেষ হলে দেখবেন, একে আসমুদ্র-হিমাচল সমস্ত ভাষার ‘লিমিট’এর মধ্যে রেখে ‘সামেশন’ করে দেওয়াই যায়।


    কিন্তু এক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্যের ভূমিকা নগন্য । অন্যান্য ভারতীয় আঞ্চলিক সাহিত্যের তুলনায় অনেক বেশি ঠিকই, কিন্তু যুগের তুলনায় খুব কম। সামাজিক অবদমনে বহু মানুষ যেমন পরিচয় গোপন করে রয়েছেন, তেমন তার ফলশ্রুতি গল্পেও প্রতিফলিত হচ্ছে। ২০১৩ সালে দাঁড়িয়ে ক্যালিফোর্ণিয়া ভাবতে পেরেছে সমকামী সাহিত্যকে বিদ্যালয় পাঠ্যসূচীতে আনার। আর এখানে কতজনকে আজও বাড়ির লোকের চোখ এড়িয়ে এই বিষয়ক বই কিনতে হয়।


    আমাদের মাইথলজিক্যাল গল্প জুড়ে স্থানে স্থানে যে সমকামিতা রয়েছে, সেকথা আগেই বলেছি। তারপর থেকে টপিকে খরা। আঠারো শতকের শেষভাগে সামান্য কয়েকটা লেখায় বিক্ষিপ্ত প্রয়োগ দেখা গেছে। তবে সেটাকে ‘হোমোসেক্সুয়ালিটি’ না বলে ‘হোমো-ইরোটিসিজম’ বলা যায়, যেটা সমকামিতার একটা ‘সাময়িক’ সংস্করণ। দুই পুরুষ বা দুই নারীর মধ্যে ক্ষণস্থায়ী আকর্ষণমাত্র। ‘ইন্দিরা’তে বঙ্কিমচন্দ্র ইন্দিরা ও সুভাষিনীর মধ্যে এরকমই একটা সম্পর্ক দেখিয়েছিলেন। পরবর্তী যুগে কবিতা সিংহের   একটা গল্পে একইভাবে দুই নারীর মধ্যে ‘হোমো-ইরোটিসিজম’ এসেছে। সমরেশ মজুমদার একটি উপন্যাসে হালকভাবে প্রসঙ্গটা ছুঁয়ে গেছেন। ষাটের দশকে হাংরি মুভমেণ্টের সময় অরুণেশ ঘোষের ছোটগল্প ‘শিকার’ ছাড়া আর কোনো নথি চোখে পড়ে নি। একটা ব্যাপার বেশ বোঝাই যাচ্ছে, যৌনতা বস্তুটাই যখন মারাত্মক ট্যাবু ছিল তখন ‘অপর যৌনতা’ নিয়ে কাহিনী নির্মাণ কল্পনারও দূর অস্ত। তাছাড়া সাহিত্যিকরা উপাদান পাবেনই বা কোত্থেকে? ঐ সামাজিক অবস্থায় কেউ ‘ব্যতিক্রমী’ যৌন ইচ্ছা যে পুরোপুরি ধামাচাপা দিয়ে রাখবেন এ তো সহজেই অনুমেয়। এত অন্তরায়ের ফাঁকফোকর দিয়েও যখন একটু-আধটু প্রসঙ্গোত্থান হয়েছে, বঙ্কিমচন্দ্রের মত রক্ষণশীল লেখকও যখন এড়িয়ে যেতে পারেন নি, তখন ব্যাপারটা আড়ালে আড়ালে এ যুগের মতই বহাল ছিল বলে ধারণা করে নেওয়া যায়। যৌন আচরণ অবধি না গেলেও ‘কামনা’টা তো মিথ্যে হয়ে যাচ্ছে না। ফলে একটা বিশাল সময় জুড়ে সাহিত্য থেকে সমপ্রেম ‘প্রায়- লুপ্ত’ হয়ে গিয়েছিল মানে সমাজ থেকেও উধাও হয়ে গিয়েছিল – এমনটা ভাবা খুব অযৌক্তিক।


    এসব ছিটেফোঁটা আভাসের মধ্যে হঠাৎ সাহসী পদক্ষেপ নিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়  ।  আলোড়ন সৃষ্টিকারী উপন্যাস ‘সেই সময়’তে মাইকেল মধুসূদন দত্তকে সমকামী দেখিয়ে দিলেন  ।  আঠারো শতকের মধ্যভাগে বাংলার ঐতিহাসিক চরিত্রদের এক একটা বিস্ময়কর ঘটনা পাঠকদের ধাঁধিয়ে দিয়েছিল। তার মধ্যে মাইকেল-প্রসঙ্গও চোখ এড়িয়ে যায় নি। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন এটা আদৌ সত্যি কিনা। বলাই বাহুল্য, প্রভূত গবেষণা না করে সুনীল কখনো ইতিহাস লেখেন নি। আর মাইকেল ও গৌরদাস বসাকের সম্পর্কের বিক্ষিপ্ত প্রমাণ অনেকেই পেয়েছেন। এছাড়া আগের প্রজন্মে কমলকুমার মজুমদারের ছোট গল্প ‘মল্লিকা বাহার’ দুই নারীর প্রণয়ের একটা চাঁচাছোলা দলিল। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, উক্ত প্রজন্মের সাহিত্যিকদের মধ্যে সবচেয়ে সাহসী কাজ করেছেন নবনীতা দেবসেন ‘অভিজ্ঞান’ ও ‘বামাবোধিনী’ উপন্যাসে (নব্বই দশকের মাঝামাঝি)। প্রথমটা দেজ পাবলিশিং কর্তৃক প্রকাশিত, দ্বিতীয়টা আনন্দ পাবলিশার্সের ‘নবনীতা দেবসেনের দশটি উপন্যাস’-এ পাওয়া যাবে। এখানে যথাক্রমে উভকামী পুরুষ ও মহিলা বিয়ের পরেও, এমন কী সন্তান হয়ে যাওয়ার পরেও সমপ্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন, বাড়ি ছেড়ে চলেও গেছেন নতুন সঙ্গীর সাথে। লোকলজ্জার ভয়ে বিয়ে করে ফেলার চূড়ান্ত কুফল লেখিকা দেখিয়েছেন । আমাদের রক্ষণশীল সমাজ এখনো এমন ঘটনা শুনলে শুধু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিন্দাতেই থামে না, সামগ্রিকভাবে সমকামীদেরও তুলোধনা করে ছাড়ে। অথচ যারা নিজেদের প্রেফারেন্সের উপর পাথর চাপিয়ে সমাজের কাছে মুখ রাখতে মরিয়া, তাদের কথা অপ্রকাশিত থেকে যায়। লেখিকা এই দিকটাই তুলে ধরেছেন। সদর্থক করে দেখিয়েছেন এই চরিত্রদের। ‘বামাবোধিনী’র ইংরেজী অনুবাদ করেছেন অর্থনীতিবিদ সাহানা ঘোষ এবং ইংরেজী সংস্করণটার প্রচুর কাটতিও হয়েছে।


    একটা কথা বলে রাখা ভালো, আমি কোনো থিসিস লিখতে বসি নি। এই যে এত মাস্টারপিসের নাম বলে যাচ্ছি এবং এরপরে আরো বলব, মুখ্যত দুটো উদ্দেশ্যে। সমকামী মানুষরা লেখাগুলো পড়ুন, ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্সের ক্লেদ ঝেড়ে ফেলুন। আর হোমোফোবিকরা সত্যর সাথে পরিচিত হোন  । এত গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ পড়তে না পারলেও এটুকু জানুন, কত সাহিত্যিক কত কাজ করেছেন সত্যোদ্ঘাটনের দিগদর্শন খাড়া করতে। ইতিহাস বলছে, প্রত্যেকটা সমাজ সংস্কারই সাধিত হয়েছে অনেক কাঠ পোড়ানোর পর। আমি এই প্রবন্ধটা আগামী সমাজ পরিবর্তনের নিশানা হওয়ার মধ্যেই আবর্তিত করতে চাইছি। ফলে এখানে যা যা উদাহরণ দিচ্ছি, সব ছাঁকনিতে ছেঁকে। এমন লেখা অনেক আছে, যা এই বিষয় সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ব্যক্তিদের খুব ভালো লাগবে। কিন্তু যারা সমকামিতাকে অপ্রাকৃতিক মনে করে তাদের রসাস্বাদন ছাড়া কিছুই দেবে না, বরং এদের হাতে আমার মোটিভ মাঠে মারা যাবে। যেমন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’। নিঃসন্দেহে অসাধারণ উপন্যাস। বাংলাদেশ থেকে ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত, কলকাতা থেকে প্রতিভাস পুনর্মুদ্রণ করে ঠিক পরের বছর। মুখ্য চরিত্র ওসমান বিভিন্ন কারণে মানসিকভাবে বিকৃত। যদিও তার সমকামনা বিকৃত ভাবনার পরাকাষ্ঠা হিসেবে লেখক দেখান নি, তবু যে পরিস্থিতিতে যেভাবে সে সমলিঙ্গের সাথে রতিক্রিয়া শুরু করেছিল, তার বর্ণনা পড়লে কেউ কেউ তেমনটাই ভেবে ফেলতে পারে। ....তাহলে গড় মেধার পাঠকদের মাথায় রেখে এই বই বলি কী করে? একই বক্তব্য খাটে রবিশংকর বলের গভীর চিন্তাধারার গল্প ‘দারু নিরঞ্জন’ সম্পর্কে। ভাবগম্ভীর এই আখ্যানটা পড়লে অনেকেই সমকামিতাকে ‘রোগ’ বলে ভুল করবেন। তাও সত্যিকারের সমঝদারদের জন্য বলে রাখি, দেজ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত ওনার পঞ্চাশটি ছোটগল্পের সংকলনে পেয়ে যাবেন।


    বৈদিক সাহিত্য ও ওয়াই-টু-কে পরবর্তী আধুনিক সাহিত্যের মাঝামাঝি লম্বা সময়ে নামকরা উপন্যাসগুলো বাদ দিয়েও যে এত বিক্ষিপ্ত লেখা রয়েছে, তাদের কথা আগে জানতাম না। শুধু আমি কেন, প্রচারের অভাবে অনেক অ্যাক্টিভিস্টও জানেন না। এর অধিকাংশ তথ্যের জন্য আমি আলিপুরদুয়ারের স্কুলশিক্ষক ও লেখক শৌভিক দে সরকারের কাছে ঋণী। ২০০৬-২০০৭ নাগাদ উনি সামগ্রিক ভারতীয় সাহিত্যে এবং সিনেমায় সমকামী থিমের উপর প্রচুর গবেষণা করে অনেক কিছু লিখেছিলেন। ওনার কাছেই জানতে পেরেছি, হিন্দী, উর্দু, মালয়ালম এবং অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষায়ও  লেখা হয়েছে। সেইসব লেখার সংখ্যা বাংলার তুলনায় খুব কম হলেও তাদের হাতিয়ার করেই সমানাধিকারের দাবীতে মানুষ রাস্তায় নেমেছেন। অথচ বাংলা সাহিত্যে সব যুগে কম-বেশি উপাদান থাকা সত্ত্বেও প্রচারের অভাবে সেগুলো আন্দোলনকারীদের নজরে আসে নি। আপাতত শৌভিক দে সরকারের পাণ্ডুলিপি প্রকাশকের বাক্সবন্দী। আশা করব, খুব তাড়াতাড়ি যেন প্রকাশ পেয়ে যায়। উনি বলেছেন, খুঁজলে হয়তো আরো উদাহরণ পাওয়া যাবে। কিন্তু সেসব লেখা দুষ্প্রাপ্য। তাই, সমাজ পরিবর্তনের প্ররোচক খুঁজতে হলে হাল আমলের দিকেই তাকাতে হবে।


    চলে আসছি সেইসব লেখায় । সাম্প্রতিক লেখক লেখিকাদের মধ্যে ডা.ইন্দ্রনীল সান্যাল বিভিন্ন ধরনের চরিত্র নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন । তাঁর লেখা পাঁচটি গল্প ‘ব্লাইণ্ড ডেট’, ‘কৃষ্ণকলি’, ‘তাজপুর’, ‘ব্যাচেলার্স পার্টি’ এবং ‘বাই’।   সমকামীদের মুখোশের আড়ালে থাকার যন্ত্রণা তাঁর লেখার পরতে পরতে। তিলোত্তমা মজুমদারের ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ’ (আনন্দ পাবলিশার্স) অনবদ্য যুগোপযোগী সৃষ্টি   । তাঁর হাতে গড়া দেবরূপা আর শ্রেয়সী দেহজ কামনা উত্তরণ করে অবিনশ্বর মনের মিলনে আবদ্ধ, যেমনটা আমরা বিষমকামী সম্পর্কে দেখতে পাই। এদের সান্নিধ্যেই রুমমেট শ্রুতি হোমোফোবিক থেকে ধীরে ধীরে সমকামীদের প্রতি সংবেদনশীল হয়ে উঠল। পাশাপাশি মেয়েলি স্বভাবের ছেলে দেবাংশু সমাজের চাপে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হল তার বহিঃপ্রকৃতি পাল্টে ফেলতে। যদিও ভেতর থেকে তার নারীসত্তা মুছে গেছে কিনা, কিংবা আচরণে মেয়েলি হলেও সে সমকামী কিনা, সেসব অজ্ঞাতই রয়ে গেল। এভাবে সমাজে যৌনতার বিভিন্ন ধূসর অধ্যায় নিয়ে লেখিকা কাটাছেঁড়া করেছেন। স্পর্ধিত উপন্যাস ‘শামুকখোল’এও (আনন্দ পাবলিশার্স) তিনি একই চেষ্টা করেছেন। অন্যান্য বিতর্কিত বিষয়ের সাথে সেখানেও রয়েছে এক সমকামী পুরুষের মনস্তত্ত্ব ব্যাখ্যা। ব্রাত্য বসুর বিখ্যাত নাটক ‘কৃষ্ণগহ্বর’ মঞ্চস্থ হয়েছে অনেক জায়গায়    ।  আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত ব্রাত্য বসুর নাটকসমগ্রতে পাওয়া যাবে। রূপান্তরকামী রঞ্জনের যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে কঠোর বাস্তবতা দেখিয়েছেন কাবেরী রায়চৌধুরী ‘শ্রীমান রঞ্জাবতী’  উপন্যাসে (দে’জ পাবলিশিং )। দেখিয়েছেন, ‘মেয়েলি ছেলে’দের কত নোংরামির শিকার হতে হয়, আবার অনেকে তাদের মেয়েলিপনার সুযোগও নিয়ে নিজেদের কামুকতা নিবৃত্ত করে। আমার মনে হয়, আনকোরাদের থেকেও এঁদের মত সুপ্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয় লেখক-লেখিকাদের বেশি এগিয়ে আসা দরকার সমকামী চরিত্রদের দেখানোর জন্য। কারণ, কোনো ভক্ত তার পছন্দের লেখককে যদি সমকামিতার পক্ষে প্রচার করতে দেখে, তাহলে তার দুর্লঙ্ঘ্য গোঁড়ামির প্রাচীরেও আঘাত লাগতে বাধ্য। নামকরা লেখকরা এইটুকু সমাজ সংস্কারক হলেই উত্তরণের পথ দ্রুত হবে।


    এছাড়া পরীক্ষামূলক কাজ করেছেন রবিশংকর বল। গল্পটার কথা আগেই বলেছি। এ বিষয়ের উপর ওনার উপন্যাসের সংখ্যা দুই  । ‘মধ্যরাত্রির জীবনী’ ও ‘এখানে তুষার ঝরে’  । যথাক্রমে কোরক ও করুণা প্রকাশনীর। প্রথমটাতে একজন উভকামী পুরুষের সাথে সমকামী পুরুষের সম্পর্ক, দ্বিতীয়টাতে দুই নারীর। ‘মধ্যরাত্রির জীবনী’ নামে ওনার একটা ছোটগল্পও আছে, কিন্তু আমি বলছি উপন্যাসের কথা।  রূপান্তরিত নারী অধ্যাপিকা মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অন্তহীন অন্তরীন প্রোষিত ভর্তৃকা’ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা অবলম্বনে রচিত উপন্যাস। রূপান্তরকামিতা নিয়ে আধুনিক বাংলা উপন্যাস এটাই প্রথম। ২০১৫র জানুয়ারীতে প্রকাশিত স্বপ্নময় চক্রবর্তীর ‘হলদে গোলাপ’ (দেজ পাবলিশিং) অশ্রুতপূর্ব নতুনত্বের মশাল জ্বেলেছে। শুধু সমকামী নয়, অসংখ্য কিশোর-যুবকের যৌনজিজ্ঞাসার নিরসন হবে এই উপন্যাসটা পড়ে। কদর্য লোকাচার থেকে সমকামীদের উপর অত্যাচারের খণ্ডচিত্র – কিছুই বাদ পড়ে নি এখানে। সম্প্রতি হলদে গোলাপ ১৪২১ বঙ্গাব্দের আনন্দ পুরস্কারে সম্মানিত হয়ে নতুন করে শোরগোল ফেলে দিয়েছে। এ ছাড়া স্বপ্নময় লিখেছেন একটি ছোট গল্পঃ ‘সিলি সিলি সিলিফাস’। আফসার আমেদের ‘অশ্রুমঙ্গল’ (দে’জ পাবলিশিং) গ্রামের পটভূমিতে লেখা সুন্দর একটা উপন্যাস। দীর্ঘদিন স্বামীদের অনুপস্থিতিতে থাকা দুই জা লালমন ও মনোয়ারার মধ্যে গড়ে ওঠা প্রণয় নিয়ে। মুশকিল হল, কেউ কেউ এটা পড়ে সমকামিতাকে যৌনবুভুক্ষার পরিণাম বলে দাবী করে বসবে, ঠিক যেমনটা অনেকে ভেবেছিল দীপা মেহতার ‘ফায়ার’ দেখার পর। এদের জন্য একটা অ্যাণ্টিডোট দিচ্ছি। জেনে রাখুন, বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে পুরুষ-নারী নির্বিশেষে সবার প্রতিই যৌন আকর্ষণ আসতে পারে, কারণ আমরা প্রত্যেকেই কমবেশি উভকামী । অনুকূল পরিবেশে সময়মত সমকাম বা বিষমকাম বিকশিত হয়। আমাদের সমাজ উভয় সম্ভাবনার জন্য ‘অনুকূল পরিবেশ’ দেয় নি। এই মর্মার্থ মাথায় রেখে লালমন-মনোয়ারার পরিস্থিতি বিচার করুন, তাহলে এটাকে ‘পরিবর্তিত কাম’ বলে মনে হবে না।


    এই মোটামুটি বাংলা গল্পে সমকামিতার মানচিত্র। এবার আমাদের নজর দিতে হবে নতুন কাহিনী নির্মাণের দিকে। যতদিন না এই কাহিনীগুলো ‘সমকামী গল্প’ শিরোপা ছেড়ে ‘প্রেমের গল্পের’ পরিচিতি পাচ্ছে, ততদিন সামাজিক বাধা থেকেই যাবে। এর জন্যই চাই অজস্র নতুন   গল্প। সিনেমার ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে  । ‘হোমোসেক্সুয়্যালিটির উপর ফিল্ম ’ বা ‘স্টোরি’ কথাটা শোনা যায়। কই, ‘হেটারোসেক্সুয়্যালিটির উপর ফিল্ম’ তো কাউকে বলতে শুনি নি? এখানেই কি একটা অর্গল দিয়ে দেওয়া হল না যে, একটা স্ট্যাণ্ডার্ড, আরেকটা ডেভিয়েশন? ....কিন্তু এই অবস্থা বদলাবেও বা কী করে?


    আমার মনে হয়, এর জন্য সবার আগে অনুবাদের কথা ভাবতে হবে। যেসব দেশ অনেকদিন আগে থেকেই সমকাম, উভকামকে আর পাঁচটা সাধারণ বৈশিষ্ট্যের মত এক করে দেখছে, তাদের মানসিকতার সাথে   যোগসূত্র রচনার সবচেয়ে সহজ মাধ্যম অনুবাদ । ঠিকমত প্রচার করলে কাটতি খুব ভালোই হবে। ইংরেজী ভাষার অভ্যস্ত পাঠকদের মধ্যেও অনুবাদের বিস্তার কম নয়। কবি উৎপলকুমার বসু লেসবিয়ান গ্রীক কবি স্যাফোর অনেক কবিতা বাংলায় অনুবাদ করেছেন। আমাজন ডট কম কিংবা উইকিপিডিয়াতে ‘গে নভেল’, ‘লেসবিয়ান ফিকশন’, ‘লিস্ট অফ নন-ফিকশন বুকস অ্যাবাউট হোমোসেক্সুয়্যালিটি’ খুললে অনেক উপন্যাসের নাম পাওয়া যায়  । উইকিপিডিয়ার ‘লিস্ট অফ LGBT থিমড স্পেকুলেটিভ ফিকশন’ পেজে আরো নির্দিষ্টভাবে বইয়ের নাম ও আধেয় আলাদা তালিকা করে লেখা আছে। আমি বঙ্গানুবাদের জন্য এত উদাহরণের মধ্যে থেকে এমন কয়েকটা বইয়ের কথা বলছি, যেগুলো আমাদের আবেগের মোক্ষম জায়গায় নাড়া দিয়ে সত্যিটা সহজভাবে নিতে শেখাবে।


    নামী প্রকাশনা সংস্থারা দক্ষ অনুবাদকদের হাতে তুলে দিতে পারেন অস্কার ওয়াইল্ডের ‘দ্য পিকচার অফ দ্য ডোরিয়ান গ্রে’ (যে বইয়ের জন্য লেখককে শাস্তি পেতে হয়েছিল), চার্লস জ্যাকসনের ‘দ্য লস্ট উইকএণ্ড’, মার্সেল প্রুস্টের সাত খণ্ডে বিভক্ত ফরাসি উপন্যাস ‘আ লা রিশের্শ দি তোম্প পের্দু’ (ইংরেজী অনুবাদঃ ‘ইন সার্চ অফ লস্ট টাইম’)। তারপর, সাম্প্রতিক সাহিত্যের মধ্যে অ্যালান ডাউন্সের ‘দ্য ভেলভেট রেজঃ ওভারকামিং দ্য পেইন অফ গ্রোয়িং আপ গে ইন আ স্ট্রেট ম্যানস ওয়ার্ল্ড’। যদিও উদ্ধতভাবে ‘গে কালচার’ বা ‘গে কমিউনিটি’কে জাহির করার পক্ষপাতী আমি নই, তবু এই বইটার নাম বললাম। কারণ, লেখক যে প্রভূত গবেষণা করেছেন তার দু-এক টুকরো জানলেও সমকাম-বিরোধী অশিক্ষিতদের মস্তিষ্কশুদ্ধি হবে। ফারজানা ডক্টর ‘সিক্স মিটারস অফ পেভমেণ্ট’ উপন্যাসে দুই লেসবিয়ান মহিলাকে পার্শ্ব চরিত্রে রেখেও জোরালো আবেদন তৈরী করেছেন। আইডেণ্টিটি ক্রাইসিসে ভুগতে থাকা ছেলেমেয়েদের কাউন্সেলিং হবে এদের অনুবাদ হাতে পেলে । জেমস বল্ডউইনের ‘গিয়োভানিস রুম’এ আবেগের পারদ অতিরিক্তরকম চড়ানো, তাও এর অনুবাদ এই মুহূর্তে খুব জরুরি । উপন্যাসের মর্মান্তিক পরিসমাপ্তি পাঠকদের ধারণাই শুধু পাল্টাবে না, চলতি আইনের বিরুদ্ধেও রক্ত গরম করে তুলবে।


    কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকস্তরের ইংরেজী পাঠক্রমে মহেশ দত্তানির নাটক ‘ব্রেভলি ফট দ্য কুইন’, অ্যালিস ওয়াকারের উপন্যাস ‘দ্য কালার পারপল’ রয়েছে। আবার কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজীর উচ্চস্নাতক স্তরে রয়েছে টমাস মনের নভেলা ‘ডেথ ইন ভেনিস’, ক্রিস্টোফার মারলোর নাটক ‘এডওয়ার্ড দ্য সেকেণ্ড’, ক্রিস্টোফার ঈশারউডের গুটিকয়েক কবিতা। সবগুলোতেই সরাসরি সমপ্রেমের কথা এসেছে। এবার ছাত্রছাত্রীরা উত্তরজীবনে হাত দিক এসব অসাধারণ লেখার সারবত্তা ছড়িয়ে দিতে। ভারতে LGBT সাহিত্যকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে নিয়ে যাওয়ার জন্য অধ্যাপক রামচন্দ্রপুরাপু রাজ রাও-এর ভূমিকা স্মরণীয়। তিনি স্বস্বীকৃত সমকামী। ২০০৩ সালে ‘দ্য বয়ফ্রেণ্ড’ নামের একটা উপন্যাসও লেখেন, একাধিক সমকামী ও উভকামী চরিত্রকে নিয়ে। উপন্যাসটা জনপ্রিয় হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু আমি এটার অনুবাদ চাইছি না।


    মেলিসা স্কট ও অধ্যাপক স্যামুয়েল ডেলনির আলাদা করে কোনো উপন্যাসের কথা বলছি না। কারণ, এঁরা প্রায় প্রত্যেকটা উপন্যাসেই বিভিন্ন আঙ্গিকে সমকামীদের দেখিয়েছেন।  অনুবাদের আনুকূল্যে এসব চরিত্রের প্রাচুর্য প্রচার   পাওয়া দরকার। ইণ্টারনেটে খুঁজে দেখুন, পছন্দের স্টোরিলাইন অনেক পেয়ে যাবেন। সেইমতো ফ্লিপকার্টে অর্ডার করে দিন।


    অনুবাদের আলোয় আসুক কিছু জীবনীও। পাঁচ-ছয়ের দশক অবধি আমেরিকা-ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সমকামিতা বে-আইনি এবং সামাজিকভাবে নিষিদ্ধ ছিল। আমাদের জানা দরকার তার মাঝেও কত সাহিত্যিক দুর্দৈবের সাথে লড়াই চালিয়ে আজ স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। পশ্চিমী দুনিয়ায় ‘আইন প্রণয়ন’এর আগে থেকেই সামাজিক বাধা সরে গিয়েছে । সমকামী কাপলরা অনেকদিন ধরেই প্রকাশ্যে ডেটিং করেন।  এই সমাজ একদিনে তৈরী হয় নি। ক্রমশ আত্মপ্রকাশ ও ‘প্রান্তিক’ বর্গ থেকে নিজেদের বিচ্যুত করার সাবলীলতা সামাজিক অবমাননা থেকে তাঁদের মুক্ত করেছে। এই পরিবর্তনের শরিক হতে, অন্তত প্রথম ধাপ হিসেবে, বিখ্যাত মানুষদের জীবনীর সাথে পরিচিত হওয়া দরকার।


    মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের জীবনী বাংলায় লিখতে এগিয়ে আসুন জীবনীগ্রন্থকাররা। বৌদ্ধধর্ম, বৈষ্ণবধর্মসহ ভারতীয় সংস্কৃতির একাধিক বিষয়ে তাঁর পাণ্ডিত্য ও গবেষণা, লালন ফকিরের গানের ইংরেজী অনুবাদ, একদিকে ইস্কনের প্রতিষ্ঠাতা প্রভুপাদ অন্যদিকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, মলয় রায়চৌধুরীর সাথে বন্ধুত্ব, জড়বাদ, ধনতন্ত্র, যৌন অবদমন সম্পর্কে তাঁর বিরূপ মনোভাব প্রভৃতি বিভিন্ন কারণে গিন্সবার্গের জীবনী বাঙালী রসিয়ে রসিয়ে খাবে। আর সেই ফাঁকেই আমরা জেনে যাব, তিনি খোলাখুলিভাবে স্বীকৃত সমকামী ছিলেন। পুরুষসঙ্গী বিখ্যাত কবি পিটার অর্লোভস্কির সাথে তিনি কলকাতা ও বারাণসীতে অনেকদিন কাটিয়েও গেছেন। তাঁর কবিতার মধ্যেও বারবার ফিরে এসেছে সমপ্রেম (বিশেষ করে ‘হাউল’ কবিতায়)। ঠিক একই কারণে ক্রিস্টোফার ইশারউডের জীবনীও বাংলায় লেখা হোক। বেদান্ত ও ভাগবত গীতার উপর তাঁর অসামান্য কাজ রয়েছে। শ্রীরামকৃষ্ণদেব ও স্বামী বিবেকানন্দের উপর তিনি অমূল্য এক-একটা প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁর জীবনী পড়লে কোনোভাবেই কারোর ‘ব্যতিক্রমী’ মনে হবে না। প্রথম প্রেমিকের সাথে সম্পর্কছেদ, তার ঠিক পরপরই নিজের শৈশব ও কৈশোরের ঘটনা নিয়ে উপন্যাস লেখা, বয়সে অনেক ছোট চিত্রশিল্পী ডন বাকার্ডির সাথে প্রণয়– প্রত্যেকটা ঘটনা যেমন আমরা হেটারোসেক্সুয়াল সম্পর্কে দেখতে অভ্যস্ত, তেমনভাবেই এগিয়েছে। এইসব জীবনী অনেক ভ্রান্ত ধারণা দূর করবে। সমপ্রেম যে বিষমপ্রেমের মতই এক মুদ্রার অপর পিঠ, সেই ধারণা স্পষ্ট হবে।


    এবার বলি কয়েকটা আত্মজীবনীর কথা। লেখক এডমুণ্ড হোয়াইটের ‘আ বয়েজ ও্যন স্টোরি’ একটা ট্রিলজির প্রথম উপন্যাস, যা অনেকাংশেই তাঁর আত্মজীবনী-কেন্দ্রিক । পরের অংশদুটো না হলেও এটা, আমার মতে অবশ্যপাঠ্য। একটি ছেলের কৈশোর থেকে ক্রমশ জেগে ওঠা সমপ্রেমের অনুভূতির পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা। যারা সবে নিজেদের ওরিয়েণ্টেশনের কথা বুঝতে পেরেছে, তারা এই লেখার মধ্যে শক্ত অবলম্বন পাবে। আঠারো শতকের ইংরেজ কবি জন এডিংটন সিমণ্ডসের আত্মজীবনীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়েছে অবদমিত থাকার যন্ত্রণা। এর অনুবাদ বেরোলে সবার আগে পড়তে বলব টিনএজারদের অভিভাবকদের। কারণ, এই লেখার মূল রস সহমর্মিতার উৎস্রোত। ‘কামিং আউট অফ দ্য ক্লোজেট’ বলতে যা বোঝায়, সিমণ্ডস সেটা প্রণোদিত করতে পারেন নি। তিনি চাইতেনও না কেউ তাঁর ব্যক্তিগত কথা জানুক। তাই, এর অনুবাদ রক্ষণশীল থেকে অনুভূতিশীল রূপান্তরকরণের কাজে লাগানো হোক। লোকলজ্জার চাপে বিয়ে করে বসলে সমকামীদের জীবন কীভাবে দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে তার ধারণাও পাওয়া যাবে। অভিজিৎ রায়ের বইতে সিমণ্ডসের আত্মজীবনী প্রকাশের দীর্ঘ ইতিহাস লেখা আছে। সেটুকুও আমাদের হোমোফোবিয়ার মূলে আঘাত করার জন্য যথেষ্ট। অভিজিৎ রায় অনেক প্রথিতযশা ব্যক্তির জীবনের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন ‘সমকামিতাঃ একটি বৈজ্ঞানিক ও সমাজ মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান’এ। পূর্ণ অনুবাদ না হোক, সেগুলো জানলেও চলবে।


    রিটা মে ব্রাউনের ‘রুবিফ্রুট জাঙ্গল’ তাঁর আত্মজীবনী আশ্রিত সদ্য-বয়োসন্ধির লেসবিয়ান উপন্যাস। এখানে মুখ্য চরিত্র (মলি) পারিবারিক রূঢ়তার শিকার। অল্প বয়স থেকেই সে সমপ্রেমে আকৃষ্ট হয়, ছেলেদের সাথেও আখছার শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। ব্রিটিশ লেখিকা জিনেট উইণ্টারসনের ‘অরেঞ্জস আর নট দ্য ওনলি ফ্রুট’এও পারিবারিক প্রেক্ষাপট অনেকটা একই। বাড়তি রয়েছে ভিন্ন যৌনতার মানুষদের উপর ক্যাথলিক ধর্মযাজকদের নোংরামির বর্ণনা । দুই লেখিকাই তাঁদের ছায়াবলম্বী সমকামী চরিত্রদের বানিয়েছেন দত্তক কন্যা হিসেবে। ফলে পারিবারিক কারণে তৈরী হওয়া অন্যান্য অবসাদের মত সমকামিতাকেও কেউ কেউ ‘বিকৃতি’ ভেবে ভুল করতে পারেন (আজকাল গ্রন্থ-বিশ্লেষকরা যে হারে ঘরে ঘরে গজিয়ে উঠছেন, তাতে এমন ব্যাখ্যা বানানো আশ্চর্যের কিছু নয়) । এদের স্মরণে রেখেও বইদুটোর উল্লেখ  করলাম । কারণ, দুটো বইতেই মর্মস্পর্শী ভাষায় সামাজিক প্রতিবন্ধকতার বিবরণ দেওয়া আছে। জিনেট উইণ্টারসন নিজের যৌনতা আবিষ্কার করার পর ষোলো বছর বয়স থেকে ঘরছাড়া। তারপর বিস্ময়কর সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে পড়াশুনা শেষ করে আজ তিনি বিখ্যাত লেখিকা এবং সক্রিয়তাবাদী। এইসব বর্ণনা টিনএজারদের সামনে আসুক। সরাসরি জীবনী না হয়ে জীবনী আশ্রিত গল্প হিসেবেও আসতে পারে। তাতে সমকামী, বিষমকামী, উভকামী নির্বিশেষে সবাই সমাজের অঙ্গুলিলেহনকে উপেক্ষা করে নিজের একান্ত চাহিদাকে গুরুত্ব দিতে শিখবেন । বই পড়ে নিজেরা না পারলে মনোবিদদের কাছে গিয়ে সাহস সঞ্চার করবেন। ইগো-ডিস্টোনিকদের (অর্থাৎ যাঁরা নিজেদের ওরিয়েণ্টেশন নিয়ে খুশি নন) উদ্দেশ্যে বলছি, যৌনতা পরিবর্তনের জন্য নয়, যৌনতাকে গ্রহণ করার অভ্যাস গড়ে তুলতে আপনারা কাউন্সেলিং করান।


    বঙ্গানুবাদ ছাড়াও প্রায় অনুরূপ একটা পদ্ধতিতে বাংলার ঘরে ঘরে বিদেশী গল্প পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে। তা হল, কাঠামো অপরিবর্তিত রেখে আমাদের ছাঁচে বিদেশী কাহিনীর প্রতিলিপিকরণ । অর্থাৎ শুধু প্রেক্ষাপট ও চরিত্রের নাম, জাতিত্ব পাল্টে দেওয়া। এভাবে ভিত্তিপ্রস্তর বদলে গেলেও উপস্থাপনা জীবন্ত হলে ওটুকু পার্থক্য ‘লেখকের কল্পনা’ বলে মেনে নিতে পাঠকের অসুবিধা হবে না  ।  বরং অনুবাদের থেকেও এর কার্যকারিতা অনেক বেশি। আমি অনুকরণে লেখার জন্য এমন কয়েকটা বইয়ের নাম বলছি, যাদের অল্প পরিশ্রমেই বাংলার মঞ্চে নিয়ে আসা যাবে। সেই সাথে ফলপ্রদ হবে। এই কারণে জঁ জিনেটের ফরাসি উপন্যাস ‘নোৎর দ্যাম দি ফ্লুয়রস’ (ইংরেজী অনুবাদঃ ‘আওয়ার লেডি অফ দ্য ফ্লাওয়ারস’) সাড়া জাগানো সৃষ্টি হলেও অনুবাদ, অনুকরণ কোনোটার জন্যই উল্লেখ করছি না।


    অধ্যাপিকা সারা শুলমানের ‘এমপ্যাথি’কে এই দলে রাখা যেতে পারে, কিন্তু বিষয়ের গভীরতার কারণে এই উপন্যাস সব শ্রেণীর পাঠক নিতে পারবেন না। তবে লেখিকার দুর্দান্ত একটা পদক্ষেপ, এখানে তিনি সমকামিতাকে ‘ভাবপ্রবণ বিষয়’ কিংবা ‘সংখ্যালঘু যৌনতা’র অংশ হিসেবে জাহির করেন নি। বরং গুরুত্ব পেয়েছে একজন লেসবিয়ান মহিলার মনস্তত্ত্ব। ‘সামগ্রিক মনস্তত্ত্ব’ বলা ভালো, কারণ ‘লেসবিয়ানিজম’ আলাদা করে প্রাধান্য পায় নি। একই কথা বলতে হয় ক্রিস্টোফার ইশারউডের ‘আ সিঙ্গল ম্যান’ সম্পর্কেও। লস এঞ্জেলস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জর্জ তাঁর প্রেমিক জিমের মৃত্যুর পর সম্পূর্ণ একা হয়ে যান। এই একাকীত্বের ছোট ছোট চড়াই উৎরাই আবেগপ্রবণ বাঙালী খুব পছন্দ করবেন। একজন সমালোচক দুর্দান্ত মন্তব্য করেছেন বইটা সম্বন্ধেঃ ‘This is not a great piece of gay literature, this is a great piece of literature full stop’  । ২০০৯ সালে পরিচালক টম ফোর্ড এই উপন্যাস অবলম্বনে সিনেমাও তৈরী করেছেন, একই নামে।


    জেমস ওনীলের ‘অ্যাট সুইম, টু বয়েস’-এ ডাবলিন-বে কে বঙ্গোপসাগর বানিয়ে দেওয়া এমন কিছু কঠিন নয় । ১৯১৬ সালের আয়ারল্যাণ্ডের রাজনীতি ও ইস্টার রাইজিং-এর মত ঐতিহাসিক ঘটনা সহজে সাধারণ পাঠকের মন ছোঁবে না। তাই আমি চাইব, একই জায়গায় এখানকার কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তর দেখানো হোক। নারী নির্যাতনের পাশাপাশি সমকামিতাকে দাবার ঘুঁটি বানিয়ে রাজনীতি– এসব তো আমাদের দেশে হয়েছে, হয়ে চলেছেও। তেমন কিছু দিয়ে পরিলেখ তৈরী করে আমরা এর বাংলা প্রতিলিপি বানাতেই পারি। এ গল্পের মূল সার্থকতা চরিত্র রূপায়নে। এমন তিনটি চরিত্র লেখক দেখিয়েছেন যাঁরা নিজেদের ওরিয়েণ্টেশন অচ্ছদ রেখেছেন, কিন্তু তাই নিয়ে লোকনজর-অভিলাষী নন। অধিকাংশ LGBT ফিকশনের থেকে আলাদা পথে হেঁটে ওনীল গৌণ চরিত্রদের মধ্যেও সমকামী মানুষদের বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে দিয়েছেন। প্রত্যেককে পৃথক পৃথক আঙ্গিকে বানিয়েছেন নিপুন দক্ষতার সাথে (বিশেষ করে ‘ম্যাকমে’)। বাংলার থ্রিলার রাইটারদের হাতে পড়লে চমৎকার চেহারা পাবে মাইকেল শেবনের ‘দ্য মিস্ট্রিস অফ পিৎসবার্গ’। এই উপন্যাসে লেখক একাধিক সমকামী ও উভকামী সম্পর্ককে সমান্তরালে রেখেছেন। অপরাধ জগতের পাশাপাশি মুখ্য চরিত্র আর্ট ও ক্লেভেল্যাণ্ডের যৌন পরিচয় নিয়ে অস্পষ্টতাও গল্পের ‘রহস্যের’ অন্যতম অংশ। আর্টের মুখে লেখক সংলাপ বসিয়েছেন, যখন থেকে নিজের ওরিয়েণ্টেশন সম্পর্কে তার প্রশ্ন জেগেছে, তখন থেকেই নারীসঙ্গহীনতা তাকে কুরে কুরে খেত। নিজেই নিজের উপর মানসিক নির্যাতন চালাত। গল্প নির্মাতাদের বলছি, এগুলো রূঢ় বাস্তব এবং আমাদের বর্তমান সমাজে এর উদাহরণ বিস্তর। আপনারা এই বিরাট সংখ্যাক মানুষের যন্ত্রণা নিরসনের দায়িত্ব নিন। ‘দ্য মিস্ট্রিস অফ পিৎসবার্গ’এর লাইনে লাইনে আত্মজিজ্ঞাসা আর আত্মবিরোধের অনুধ্যায় দেখতে পাবেন, সেখান থেকেই রসদ খুঁজে নিন। দেখবেন, বইয়ের মাঝে এক জায়গায় ফুটনোটে শেবন স্বীকার করেছেন, বর্তমানে তিনি বিবাহিত। কিন্তু অতীতে তাঁর একাধিক সমকামী সম্পর্কের অভিজ্ঞতা রয়েছে, যা কাহিনী-নির্মাণের কাজে লেগেছে । এই উপন্যাসেরও চলচ্চিত্রায়ন হয়েছে, কিন্তু সেটা রেফার করছি না।


    সীমিত কয়েকটা উপন্যাসের ক্ষেত্রে আমার মনে হয়, বেদনাতুর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখানো যেতে পারে । তবে সেণ্টিমেণ্টাল খোঁচা মারাটা প্র্যাক্টিসের পর্যায়ে না নিয়ে যাওয়াই ভালো। এর মধ্যে প্রথমেই বলব জুডিথ ফ্র্যাঙ্কের ‘অল আই লাভ অ্যাণ্ড নো’ । সমাজের চোখ খুলে দেওয়ার মত হৃদয়স্পর্শী ঘটনাপ্রবাহ পাঠকদের বাধ্য করবে ড্যানিয়েল ও ম্যাথিউকে নিজেদের বন্ধু বলে ভাবতে । বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীর মত দুজন পুরুষ কীভাবে সন্তান প্রতিপালন করছে, তার বর্ণনা আমাদের সবার মন ছুঁয়ে যাবে। কানাডিয়ান সাহিত্যিক শ্যাম সেলভাদুরাই-এর ‘ফানি বয়’এর গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ নিয়ন্ত্রণ করেছে সিনহালা ও তামিলের মধ্যে জাতিগত কারণে সংঘটিত শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধ। এই যুদ্ধকে যে কোনো ধর্মীয় হানাহানি দিয়ে ঢাকা যেতে পারে। আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক বৈষম্য উত্তরোত্তর বাড়ছে, অথচ সমকামিতার বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে গিয়ে মৌলবাদী টিকি-দাড়ি-টুপি-তিলককে মাঝে মাঝে সমস্বরে ডাক ছাড়তে শোনা গেছে। এই ‘অপ্রিয় সত্য’গুলো দিয়ে গল্পের নকশার দেশিকরণ করলে জনপ্রিয়তা পেতে বাধ্য। প্যাত্রিশিয়া হাইস্মিথের ‘দ্য প্রাইস অফ দ্য সল্ট’ অনুবাদ আকারে বেরোলে সাড়া জাগাবে কিনা জানি না, কিন্তু মুখ্য চরিত্রদ্বয়কে মানহাটানের পরিবর্তে আমরা যদি কলকাতার দুই বাঙালী যুবতী হিসেবে দেখি, তাহলে তাদের ভালোবাসার আখ্যান অনেক বেশি প্রভাব ফেলবে আমাদের মনে। থেরেস, ক্যারল দুজনেরই সমকামী বনাম বিষমকামী জীবনযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়ে টানাপোড়েন, ভালোবাসায় সাময়িক বিমোহ এবং বনাম নিগূঢ় প্রণয় - প্রত্যেকটা মনস্তাত্ত্বিক অলিগলিতে লেখিকা নিখুঁতভাবে আঁচড় কেটেছেন। পাশাপাশি আমাদের প্রেক্ষাপটে লিখলে আইনি জটিলতার   জায়গাগুলো বিবর্ধিতভাবে দেখানো যাবে, ৩৭৭ এর অর্বাচীনতাকে দারুণভাবে আক্রমণ করা যাবে। এদের ধাঁচে বাংলা গল্প তৈরী হলে অনেক সমকামী মানুষ সাহসী আত্মপ্রকাশের প্ররোচনা পাবেন  ।


    বিদেশী গল্পগুলোর ভাবধারা আমাদের দেশে অবাধে আনতে পারলে এই বোধ খুব তাড়াতাড়ি গড়ে উঠবে যে, আমরা সবাই কমবেশি উভকামী। যারা সেটা বুঝতে পারে, তারাও একটা সাইডকে ব্লক করে রাখতে বাধ্য হয়। এইসব গল্পের স্বাদ পেলে উভকামীরা সমাজকে অগ্রাহ্য করে নিজেদের চেতনার চাহিদা অনুযায়ী এগোতে পারবেন । কারোর যদি সমলিঙ্গ ও বিপরীত লিঙ্গের প্রতি প্রায় সমান আকর্ষণ থাকে, তাহলে কোনদিকে যাবে সেটা তার ব্যক্তিগত এক্তিয়ার। অথচ উভকামীরা তো বটেই, অনেক ক্ষেত্রে সমাজের চাপে সমকামী পুরুষ বা মহিলাও নিজের যৌনতা গোপন রেখে বিয়ে করে ফেলেন। ফলে ভেতরে ভেতরে তাঁদের দাম্পত্য বিষিয়ে ওঠে । স্ত্রী লেসবিয়ান হলে গর্ভধারণে অসুবিধে নেই। কিন্তু স্বামী গে হলে সঙ্গমে অনীহা অনিবার্য। তাও বিস্তর কসরতে হয়তো সেক্ষেত্রেও বাচ্চা হল । কিন্তু পুরুষটির সমকামের তুলনায় বিষমকাম ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ হলে এটা সম্ভব হবে না। এইসব ঘটনা মারাত্মক স্পর্শকাতর বলে প্রকাশ্যে আসে না, ফলে আমরা জানতেও পারি না এই জীবন স্বামী-স্ত্রী উভয়ের পক্ষেই কত দুর্বিষহ। সাইকিয়াট্রিস্ট আর সাইকোলজিস্টদের কাছে এমন সমস্যা কিন্তু উত্তরোত্তর বাড়ছে। তাঁরা সমকামী মানুষকে সমলিঙ্গের সঙ্গী খুঁজে নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। অনেক সময় এসব সাহিত্যও হয়ে উঠছে তাঁদের থেরাপির অংশ। সুতরাং, আমরা চাইব এত এত মানুষের খুঁটি তৈরী করার জন্য আরো বেশি করে এই জাতীয় গল্প-উপন্যাস লেখা হোক।


    ইসমত চুঘতাই-এর উর্দু ছোটগল্প ‘লিহাফ’ বাংলায় অনুদিত হয়েছে। ভি.টি.নন্দকুমারের মালয়ালম উপন্যাস ‘রান্দু পেনকুট্টিকাল’ (দুটি মেয়ে), কন্নড় ঔপন্যাসিক এস.বাসুদেন্দ্রর ‘মোহানাস্বামী’, সতীশ আলেকর ও বিজয় তেণ্ডুলকারের মারাঠি নাটক যথাক্রমে ‘বেগম বার্ভে’ ও ‘মিত্রাচি ঘোস্তা’ কিংবা বিজয়দান দেতার একটা রাজস্থানী গল্প আঞ্চলিকভাবে মোটামুটি জনপ্রিয় হলেও সেভাবে প্রচার পায় নি। এইসব তথ্য থেকে বোঝা যায়, বিভিন্ন প্রান্তের চিন্তাশীল মানুষ ধীরে ধীরে সক্রিয় হচ্ছেন। তবে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ভূমিকা এদের সবার সমষ্টির থেকেও অনেক অনেক বেশি। কত ভাষায় তো একটাও কিছু লেখা হয় নি। সেই কারণে উক্ত বিদেশী বইগুলো বাংলা ছাড়াও যে কোনো আঞ্চলিক ভাষায় অনুবাদ বা প্রতিলিপি করা দরকার। আর বাংলা সাহিত্য তুলনামূলক এত এগিয়ে থাকায় আমাদের দায়িত্ব আরো বেড়ে গেল না কি? আমাদের আলোকস্তম্ভ যখন এতই উজ্জ্বল, তখন অন্য স্তম্ভদেরও আমরাই আলোকিত করতে পারি। আমাদের দেখাদেখিই এতগুলো আঞ্চলিক ভাষা এই বিষয়ে চর্চা শুরু করবে। ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দল আর ভাঁওতাবাজ যোগগুরুদের অপপ্রচার তখন জলাঞ্জলি যাবে।


    অনুবাদ বা অনুকরণে ভারতের যে কোনো ভাষায় লেখার জন্য ভারতীয়দের ইংরেজী বইকেও গুরুত্ব দিচ্ছি । বিক্রম শেঠের বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য গোল্ডেন গেট’ আদ্যোপান্ত পদ্যে লেখা । সবার আগে এই বইটার কথা ভাবা যেতে পারে। তবে আমার মতে যেসব ভারতীয় গল্প ভারতের সামাজিক পটভূমিকে কম-বেশি আশ্রয় করেছে, অনুবাদের জন্য তাদের দিকেই সবার আগে হাত দেওয়া দরকার । মহেশ দত্তানি একাধিক নাটক লিখেছেন এই বিষয়ে। নব্বই দশকের গোড়ায় ফিরদৌস কাঙা একটি পার্শী ছেলের বকলমে নিজের জীবনের কথা লিখেছেন ‘ট্রাইং টু গো’ উপন্যাসে। লেখক বলেছেন, ছোটবেলা থেকে তিনি ‘তাঁর’ মত কাউকে দেখেন নি বা কারোর মুখে সমকামিতা নিয়ে একটা শব্দও শোনেন নি। শেষ পর্যন্ত বিশ্বসাহিত্যে সমকামিতার নিদর্শন পড়তে পড়তেই তিনি অবলম্বন খুঁজে পান। একই সময় বারো বছরের বালক কিরণের ‘সত্যি ঘটনা’ নিয়ে রাকেশ সত্যাল লিখেছিলেন ‘ব্লু বয়’। এর অনুবাদ ভীষণভাবে চাইছি, কারণ কাহিনীর অনেকাংশ হিন্দু ধর্মকে নেপথ্যে রেখে এগিয়েছে। কিরণ মানসিকতায় ছিল পূর্ণাঙ্গ নারী, আবার সে নিজেকে মনে করত কৃষ্ণের পরজন্মের অবতার। দর্শনের সাথে মনস্তত্ত্ব মিলেমিশে গেছে এই উপন্যাসে। এছাড়া সমকামী কবি হোসাং মার্চেণ্টের নাম না বললেই নয়। তাঁর কবিতা বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে। তাহলে বাংলাও বা বাদ থাকে কেন? কবির একটা প্রবন্ধ থেকে জেনেছি, ভারতীয় সাহিত্যে সমকামিতার ক্রমবর্ধমান নিদর্শন এশিয়ার অন্যান্য দেশের লেখকদের উৎসাহ যোগাচ্ছে। তাহলেই দেখুন, সাহিত্যিকদের প্রভাব কত আমোঘ। এশিয়ার যে দেশগুলো রাশিয়ার সঙ্কল্পে সই করে গেল, আমরা কি আশা রাখতে পারি না সেইসব দেশের মানুষ আমাদের দেখাদেখি দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে শিখবে?


    ব্রিটেন নিবাসী বাঙালী ঔপন্যাসিক নীল মুখার্জীর বই ‘পাস্ট কনটিনিউয়াস’ ২০০৮ সালে ক্রসওয়ার্ড বুক অ্যাওয়ার্ড জেতে । দক্ষিণ কলকাতায় বেড়ে ওঠা সমকামী যুবক ঋত্বিকের জীবন  কাহিনী। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার জন্য সে লণ্ডনে পাড়ি দেয়। সেখানকার বিবিধ অভিজ্ঞতায় পাল্টে যায় তার জীবনের মোড়। এই উপন্যাসে কলকাতা ও লণ্ডনের পৃথক দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়ে লেখক এদেশের রক্ষণশীলতার উপর এক হাত নিয়েছেন। এর    বঙ্গানুবাদ করা অপেক্ষাকৃত সহজ এবং অনেক   বেশি কার্যকরী। একইভাবে হায়দারাবাদ ও সানফ্রানসিসকোর সামাজিক চাহনির পার্থক্য ধরা পড়ে সানফ্রানসিসকো নিবাসী লেখক কুনাল মুখার্জীর ‘মাই ম্যাজিকাল প্যালেস’ উপন্যাসে  ।  যৌনতা এবং সমাজের চাহিদার দ্বৈরথ তুখোড়ভাবে লেখক তুলে ধরেছেন রাহুলের বড় হয়ে ওঠার মধ্যে দিয়ে। আশপাশের ঘটনার আমাদের মনে কীরকম প্রভাব ফেলে, এই উপন্যাস তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। এর অনুবাদ হাতে পেলে অনেক মানুষ গ্লানিমোচনের অমৃতকুম্ভের সন্ধান পাবে, হাতিয়ার পাবে সমাজের অর্গলকে উৎপাটিত করার।


    তবে সাহিত্যিকদের দায়িত্ব শুধু এটুকুতেই থেমে থাকলে চলবে না। সমপ্রেমকে স্বাভাবিক বলে জানেন এমন অনেক মানুষও বিষয়টি সম্বন্ধে অর্ধনিমীলিত জ্ঞানের অধিকারী। তারা জানেন, সমকামী মাত্রেই এমন মানুষ যারা নিজেদের অন্য লিঙ্গের বলে মনে করেন। ‘গে’ মানেই পুরুষ দেহে বসবাসকারী আদ্যন্ত একজন নারী, ‘লেসবিয়ান’ মানেই নারীর চেহারায় স্বয়ংসম্পূর্ণ পুরুষ   । কিন্তু এটা সমকামীদের একটা ক্যাটেগোরি মাত্র (যাদের রূপান্তরকামী বলে)  । স্বভাব, মানসিকতা যে লিঙ্গের মত হবে, যৌন আকর্ষণ থাকবে তার বিপরীত লিঙ্গের প্রতি (অর্থাৎ জৈবিকভাবে সে যে লিঙ্গে অবস্থান করছে, তার প্রতি)    – তেমনটা সবার ক্ষেত্রে সত্যি নয়  । এর উল্টো উদাহরণ ভুরি ভুরি দেওয়া যায়। কিন্তু লক্ষ করে দেখেছি, সাহিত্যে এই ‘উল্টো উদাহরণ’রা খুব একটা আসে না। ১১.১২.১৩ র রায় বেরোনোর পরদিন ‘এবেলা’র কভার জুড়ে যে পুরুষটির ছবি, তার চোখে কাজল, গালে ট্যাটু, চুল পিছনের দিকে আঁটিয়ে বাঁধা।   ‘সমকামী’ শব্দটার সঙ্গে এই চিত্র আমাদের দৃষ্টিতে সংশ্লিষ্ট হয়ে আছে। এর দায় মূলত সংবাদপত্র, বিভিন্ন ওয়েবসাইট এবং সিনেমার। মধুর ভাণ্ডারকর প্রত্যেকটা সিনেমায় সমকামীদের যেভাবে দেখান, আমরা সেভাবে দেখতে অভ্যস্ত। গোর ভিডালের ‘দ্য সিটি অ্যাণ্ড দ্য পিলার’এর অনুকরণ বেরোলে (অনুবাদ নয়) এধরনের অজ্ঞানতা কিছুটা হলেও কাটবে। মুখ্য চরিত্র জিম ও বব-কে লেখক ইচ্ছে করেই পুরুষালী পুরুষ হিসেবে বানিয়েছেন। পার্শ্ব চরিত্রদের মধ্যেও পুরুষ-নারী দ্বৈত সত্তাকে বিভিন্ন অনুপাতে দেখিয়েছেন। বাংলা সাহিত্যের মধ্যে এই প্রচলিত ধারার উপর সবচেয়ে সফলভাবে আঘাত হেনেছে সায়ন্তনী পুততূণ্ড-র ‘ছায়াগ্রহ’ (সপ্তর্ষি প্রকাশনী, ২০১৪-র বইমেলায় প্রকাশিত)    । ইচ্ছে করেই অন্যান্য গল্পের সাথে এর নাম বলি নি। কারণ, ছায়াগ্রহ যাবতীয় নিয়ম যেভাবে ছত্রখান করেছে, তাতে এই উপন্যাসকে নতুন রীতির চালকযন্ত্র বলা যায়  । আশা করব, এই উপন্যাস পড়লে ‘হোমো’ এবং ‘ট্রান্স’কে গুলিয়ে ফেলার বাতিক থেকে আমাদের সমাজ মুক্ত হবে  ।


    (চলবে)

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ০৬ জুলাই ২০১৫ | ৩৪৩২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • apps | ***:*** | ০৭ জুলাই ২০১৫ ০৩:৫৯87224
  • তুখোড় l
    কোন একটা কাগজের সাপলিমেনটারি-তে যেন 'গোরা' উপন্যাসকেও সমকামিতার পার্সপেক্টিভ থেকে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল, পড়েছিলাম l

    বছর কয়েক আগে একটা খিল্লি মূলক টিভি শো-এ দেখেছিলাম একজন পুরুষ আরেকজনকে জিগ্গেস করছে- আর ইউ বাইসেক্সচুয়াল? উত্তরে দ্বিতীয়জন বলেছিল- আই থিঙ্ক আই অ্যাম ট্রাই সেক্সচুয়াল, বিকজ আই লাভ টু try এভরিথিং l :P
    আমার এই উভয়্কামী শব্দটার প্রয়োগের ক্ষেত্রে বাহুল্য ও সরলীকরণ নিয়ে সমস্যা আছে l ব্যক্তি মাত্রই কমবেশি উভয়কামী- এমনটা দাবি করলে কিরম মৈনাক ভৌমিক ও বাংলা কাগজের মিষ্টি মামনি টাইপ রিভিউয়ার দের মতো শোনায় l ব্যক্তি মাত্রই কাম ও প্রেমের কোন অথবা কোন-কোন বিভাজনকে গ্রহণ ও বর্জন করবে সেটা তার ব্যক্তি-গত ব্যাপার l হতেই পারে কেউ হোমো, কেউ বাই, কেউ প্যান, কেউ ক্যুয়ার l শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য কিন্তু আমরা সবাই সমকামী এমন বোধ গড়ে তোলা নয় l বরং পরধর্ম-সহিষ্ণুতার মতই, পর-যৌনতা-সহিষ্ণু হতে শেখানো l
    আমি একজন নারী, ত্রিশ বছর আগে তোমার বাবাকে বিয়ে করেছিলুম, চার বছর বাদে তুমি জন্মেছ, কন্যাসন্তান জন্মানোয় আমরা যারপরনাই আহ্লাদিত হয়েছি, এখন তুমি বলছ তুমি যাকে ভালোবাসো সে একটি মেয়ে, বেশ, আমাদের এতে কোনো আপত্তি নেই l অথবা, তুমি যাকে ভালোবাসো সে একজন ইউনাক, আমাদের এতেও কোনো আপত্তি নেই l কিংবা, তুমি সেক্স চেন্জ করে একজন পুরুষ হয়ে আরেকজন মহিলাকে বিয়ে করতে চাইছ, আমাদের এতেও কোনো আপত্তি নেই l মূল উদ্দেশ্য এটাই l বোঝা এবং বোঝানো l
    আমার জনৈক অধ্যাপিকা বান্ধবী স্বীকৃতভাবে লেসবিয়ান l বছর দশেক আগে সে একটি অতীব সুন্দরী মহিলার সঙ্গে সংসার করত l পাঁচ বছর থাকার পর সেই সঙ্গিনীর মনে হয় আদতে সে হোমোসেক্সচুয়াল নয়, সে একজন পুরুষকে ভালোবেসে, তাকে বিয়ে করে ও সন্তান উত্পাদন করে ভালো থাকতে চায় l বলা বাহুল্য আমার বান্ধবীটি সে সময় এক্কেবারে ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল l কিন্তু নিরপেক্ষভাবে দেখলে এতেও তো আপত্তির কিছু নেই l মানুষ তার সেক্সচুয়াল ওরিয়েনটেশন সঙ্গে নিয়ে জন্মায় না l সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রেক্ষিত তার ওরিয়েন্টেশন-কে ক্রমে ক্রমে তৈরি করে, যা কখনও সুস্থির, কখনও একটা নিরন্তর ভাঙা গড়ার মধ্যে দিয়ে চলতে থাকে l
  • Akash Roy | ***:*** | ০৭ জুলাই ২০১৫ ০৪:৫৬87225
  • Osamanyo laglo ei porber lekha...bangla vasay sunil gangulir 'sei somoy' e modhusudon dutta k somokami dekhano hoyeche eta to ami ei prothom sunlam r sune ritimoto obak hye gechi !!' Sei somoy' to oti jonopriyo uponyas!koutuhol hoy totkalin pathokra ki vabe react krechilen ei boita porar pir seta jante ! R bangla vaay je somoprem niye eto kaj hoyeche setao ojana chilo....'chander gaye chand' ba' holde golap' procharer aloy aste pereche (obossyoi abp group/songbad protidin er soujonye) ble hoyto amra ei uponyas guli porar tagid onuvob krechi...tai ei lekhar madhyome eto gulo bangla boier name jante parata nisondehe amar kache ekta "epiphany".! Asa korbo boiguli ekhono available ache.
    poriseshe kobir vasay bolbo bangla sahitye somopremider jonno je
    " eto kotha ache ,eto gaan ache, eto pran ache" sayontoner lekha chara jana hto na.
  • kk | ***:*** | ০৭ জুলাই ২০১৫ ০৫:৪০87226
  • রৌহিন, আপনার লেখা খুব ভালো লাগছে। আগের পর্বে বলা হয়ে ওঠেনি। লিখতে থাকুন। সাগ্রহে পড়ছি।
  • | ***:*** | ০৭ জুলাই ২০১৫ ০৭:১৮87227
  • কলি, এই লেখাটা সায়ন্তন মাইতির।
  • রৌহিন | ***:*** | ০৭ জুলাই ২০১৫ ১০:৩৩87223
  • ভালো লাগল - আগের পর্বের চেয়েও। যে সব বই নিয়ে আলোচনা হয়েছে তার কিছু পড়া, বেশিরভাগই নয়, তাই প্রকাশনা উল্লেখ করার জন্য বিশেষ ভাবে ধন্যবাদ জানিয়ে রাখলাম।
    " জেনে রাখুন, বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে পুরুষ-নারী নির্বিশেষে সবার প্রতিই যৌন আকর্ষণ আসতে পারে, কারণ আমরা প্রত্যেকেই কমবেশি উভকামী । অনুকূল পরিবেশে সময়মত সমকাম বা বিষমকাম বিকশিত হয়। আমাদের সমাজ উভয় সম্ভাবনার জন্য ‘অনুকূল পরিবেশ’ দেয় নি।" - এটা যে এখন প্রমাণিত সত্য তা জানা ছিল না - এ কথাটা আমার বহুদিনই মনে হয়েছে - দুয়েক জায়গায় এ কথা উল্লেখও করেছি। এখন আরো জোরের সঙ্গে উল্লেখ করতে পারব জেনে ভালো লাগছে - লেখকের কাছে বা অন্য কারো কাছে এই গবেষণার কোন রেফারেন্স পাওয়া যাবে কি?
  • apps | ***:*** | ০৮ জুলাই ২০১৫ ০১:৩৯87230
  • আআআর... ঠিক ভুলের বিচার কেই বা করে...
    তা এসআরকে-এর লিংক খানা পাওয়া যায় নাকি সায়ন্তন বাবু?
  • apps | ***:*** | ০৮ জুলাই ২০১৫ ০৩:০৫87231
  • হ্যা পেইচি l তেভিন ক্যাম্পবেল এট্টা ইন্টারভিউ তে বলেছিল l পরে সারুখ্খান সেইটে ক্লিন ঝেড়ে দেয় l যাই হোক, ওপেন ফোরামে এসব কুকতা আর বেশি না বলি
  • kk | ***:*** | ০৮ জুলাই ২০১৫ ০৪:৫৯87232
  • হ্যাঁ হ্যাঁ, সায়ন্তন লিখতে গিয়ে ভুল করে রৌহিন লিখেছি! আন্তরিক ভাবে দুঃখিত!
  • সায়ন্তন মাইতি | ***:*** | ০৮ জুলাই ২০১৫ ০৯:০৩87228
  • প্রথমে রৌহিনদার প্রশ্নটার জবাব দিই।
    সবাই যে কম-বেশি উভকামী এই কথাটা এখন প্রায় সব মনস্তত্ত্ববিদ ও যৌন গবেষকই বলেন। তাঁদের ব্লগ, জার্নাল বাদ দিলেও খবরের কাগজে অন্য প্রতিবেদনের অংশ হিসেবেও একই মতামত পেয়েছি। তাও বলছি, এটার অ্যাণ্টি-লজিক খাড়া করেও বেশ কিছু আর্টিকল প্রকাশ পেয়েছে। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, আপনি গ্রহণ করবেন কোনটা?

    সেক্ষেত্রে আপনাকে ধারালো যুক্তির পক্ষই নিতে হবে। আর কোনটা ধারালো যুক্তি, সেটা man to man vary করে। আমি, আপনি বা অন্যান্য যারা এটা নিয়ে লিখছি, তারা অনেক পড়াশুনা করে যেগুলোকে 'ঠিক যুক্তি' বলব, অনেকের কাছে সেগুলো গ্রহণযোগ্য না-ও হতে পারে। আমি কয়েকটা রেফারেন্স দিচ্ছি। সব জায়গায় যে স্পষ্ট করে বলা আছে, তাও নয়। কিছুটা sense করে নিতে হয়। আমার মনে হয়, আমার আপনার স্ট্যাণ্ডপয়েণ্ট যেহেতু এক, তাই আপনিও আমার মতই এগুলো পড়লে "সবাই কমবেশি উভকামী" কথাটাকে "ultimate conclusion" বলবেন। :-)

    ১) wikipedia তে 'Innate bisexuality' পেজটা পড়ে নিতে পারেন।

    ২) আমেরিকার সাইকোলজিস্ট ড.John A Sanford-এর বিখ্যাত বই "The Invisible Partners: How the Male and Female in Each of Us Affects Our Relationships" পরে দেখতে পারেন। এই আইডিয়াটা একদম পরিষ্কারভাবে দেওয়া আছে।

    ৩) http://www.cat-and-dragon.com/stef/Poly/Labriola/bisexual.html

    ৪) http://www.collective-evolution.com/2014/10/17/are-we-all-a-little-bisexual-exploring-gender-identities-cultural-programming/

    5) http://www.zenit.org/en/articles/the-psychology-behind-homosexual-tendencies-part-1

    এছাড়া ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় অনেক মনোবিদ ও মনোবিশ্লেষক একথা আমাকে বলেছেন।
  • সায়ন্তন মাইতি | ***:*** | ০৮ জুলাই ২০১৫ ১১:৩৩87229
  • এবার বলছি apps নামে যিনি লিখেছেন তাঁকে,

    ১) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গোরা উপন্যাসে গোরা আর বিনয়ের মধ্যে জোর করে একটা সম্পর্ক বানানোর চেষ্টা আমিও দেখেছি। কিন্তু এটা সর্বৈব ভুল। এই উপন্যাসে কোনোভাবেই গল্প সমপ্রেমের অ্যাঙ্গেলে যায় নি।

    ২) খিল্লিমূলক টিভি-শো তে যে উত্তরটা শুনেছিলেন সেটা শাহরুখ খানের উক্তি। ওনাকে একজন সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেছিল, "আপনি কি বাইসেক্সুয়াল?" তখন স্বভাবসিদ্ধ witty শাহরুখ এই উত্তর দিয়েছিলেন।

    ৩) "ব্যক্তিমাত্রেই কমবেশি উভয়কামী" -কথাটা কিন্তু ঠিক। যার মতই শোনাক না কেন, কথাটা অনেক মনস্তত্ত্ববিদই বলেছেন। আপনি আমার আগের রিপ্লাই-এর লিঙ্কগুলো দেখতে পারেন।

    ৪) "পরধর্ম-সহিষ্ণুতার মতই, পর-যৌনতা-সহিষ্ণু হতে শেখানো"র যে উদাহরণটা দিলেন, খুব খুব ভালো লাগল। এটাই একদম 'পারফেক্ট থট' হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। আর "সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রেক্ষিত তার ওরিয়েন্টেশন-কে ক্রমে ক্রমে তৈরি করে, যা কখনও সুস্থির, কখনও একটা নিরন্তর ভাঙা গড়ার মধ্যে দিয়ে চলতে থাকে" আপনার এই কথাটাও খুব ভালো লাগল। সবাই যদি এভাবে ভাবতে পারতেন, তাহলে আজ এই বিষয়ে সমদর্শিতা তৈরী করতে আমাদের এত লিখতে হত না।
  • সায়ন্তন মাইতি | ***:*** | ২৭ জুলাই ২০১৫ ০৩:৩৫87233
  • এবার আমার 'আন্তরিকভাবে দুঃখিত' হওয়ার পালা। স্বপ্নময় চক্রবর্তীর একটা ছোটগল্পের নাম লিখেছি, 'সিলি সিলি সিলিফাস', ওটা হবে 'সিলি সিলি সিলিকন'।
  • voice for equality | ***:*** | ২৯ আগস্ট ২০১৫ ০৪:১২87234
  • এর আগে অনেক লেখাতেই সাহিত্যে সমকামিতার বিভিন্ন উদাহরণ দেখেছি। কিন্তু এত বিসদ বর্র্ণনা এর আগে পাই নি। শুধু তাই না, অনুবাদ সম্পর্র্কে এইভাবে এইরকম বিশ্লেষণ জাস্ট ভাবাই যায় না। সায়ন্তন মাইতিকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
  • Sandy | ***:*** | ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৬:৫২87235
  • স্যালুট বস। এরকম লেখা এর আগে কখনো পড়ি নি। লেখক একটা বই সম্পর্র্কে বলেছেন, 'সমাজের চোখ খুলে দেওয়ার মত বর্ণনা'... এই কথা কিন্তু ওনার নিজের লেখাটিকে নিয়েও বলা যায়। লেখককে আমার অনুরোধ রইল, আপনি এতগুলো গল্প এত ধৈর্য ধরে যখন পড়েছেন আর এত সুন্দরভাবে সমালোচনা করেছেন, তখন আপনিই একটা ফিচার লিখুন প্লিজ। এইরকম সুচিন্তিত মানসিকতার লেখকের হাত থেকেই নতুন নতুন গল্প-উপন্যাস চাই। সমকামিতাকে মেইনস্ত্রিম গল্পে নিয়ে আসার উদ্যোগ আপনার লেখা পড়লে যে কারোর মধ্যে তৈরী হবে, এটা নিশ্চিত হয়ে বলা যায়।
  • সায়ন্তন মাইতি | ***:*** | ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০১:১৮87237
  • ওপরের সবাইকে অনেক ধন্যবাদ। Sandy বলে যিনি লিখেছেন তাকে বলছি, আমার কয়েকটা গল্পের প্লট মাথায় আছে। তবে সেখান থেকে কতটা দাঁড় করাতে পারব না জানি না। আপাতত সেগুলো দূর ভবিষ্যতের জিম্মায়

    আর Lio-কে বলছি, ই.এম.ফর্স্টারের মরিস এই লিস্টে রাখার মত একেবারে উপযুক্ত একটা নাম। কিন্তু এই লেখাটা যখন লিখেছিলাম, তখন আমার বইটা পড়া হয়ে ওঠে নি। আপনি মরিসের নাম বলে খুব ভালো করেছেন। ১৯৮৭ সালে এই উপন্যাস অবলম্বনে যে সিনেমাটা হয়েছিল, সেটাও খুব সুন্দর।
  • Lio | ***:*** | ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৭:০৮87236
  • খুব ভালো লাগল। It's a groundbreaking creation । এতগুলো ইংরেজি গল্পের পটভূমিকে সার্থকভাবে ব্যবহার করেছেন সায়ন্তন। এই লেখাটা পড়ার পরেই বিদেশী গল্পগুলোর গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারলাম। সেই সাথে এটাও স্পষ্ট হল, আমাদের সাথে ওদের চিন্তাভাবনার পার্থক্যটাও কিভাবে সাহিত্যে ধরা পড়েছে। সত্যি তো , ওই উপন্যাসগুলোর ভাবধারা যদি আমাদের সমাজে ঢোকানো যায় তাহলে অনেকের দৃষ্টি খুলে যাবে। শুধু একটা প্রশ্ন করি, ই এম ফর্স্তারের মরিসের কথা লেখক অলেন ন দেখলাম। সেটা কি ইচ্ছা করে এড়িয়ে গেছেন ? এই উপন্যাসটা তো খুব বিখ্যাত বলেই জানি
  • সায়ন্তন মাইতি | ***:*** | ০৯ অক্টোবর ২০১৫ ০৫:২৫87239
  • ভাগ্যিস লেখাটা published হল। না হলে বাড়তি তথ্যগুলো জানতেই পারতাম না। এতজনের এত বই, গল্পর নাম জোগাড় করছি, আর এদিকে স্মরণজিৎদার মত এত কাছের মানুষটারই যে একটা গল্প আছে এই টপিকের ওপর, সেটাই জানতাম না।

    'চুমু কেবিন' সানন্দাতে বেরিয়েছিল। কিন্তু এখনো কোনো বইতে স্থান পায় নি। এ অবধি জানতাম। গল্পটা পড়া হয় নি। কী বিষয় নিয়ে লেখা সেটাও জানা ছিল না। প্রত্যয়কে অনেক ধন্যবাদ :-)
  • প্রত্যয় মৈত্র | ***:*** | ০৯ অক্টোবর ২০১৫ ০৭:২৯87238
  • অসম্ভব ভালো লাগলো । লেখকের আগের বেশ কিছু অসাধারণ লেখা পড়েছি;এটি আগের সমস্ত লেখাকে ছাপিয়ে গেছে । যে দেশে মানুষ কামসূত্র ও পর্ণোগ্রাফির তফাৎ বোঝে না তাদের এই স্পর্শকাতর বিষয়টি কতটা আন্দোলিত করবে তা নিয়ে প্রশ্ন থাকবে,তা সত্ত্বেও বলবো লেখাটি সমকামিতা সংক্রান্ত বিষয়ে একটি যুগান্তকারী সৃষ্টি । দুর্ভাগ্যবশত সমকামিতা নিয়ে খুব বেশি লেখা পড়ার অভিজ্ঞতা হয়নি,লেখকের সৌজন্যে বেশ কিছু তথ্য পেলাম । এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর " চুমু কেবিন " নাম এর একটি ছোট গল্প পড়েছিলাম। লেখা টি সম্বন্ধে বেশি কিছু বলে অযথা "spoiler" দেবো না, সবাইকে বলবো লেখাটা পারলে পরবেন ;গুরুগম্ভীর লেখা একেবারেই নয়,হাস্যকৌতুকের মোড়কে একটি অত্যন্ত সময়োপযোগী লেখা।
  • sosen | ***:*** | ১১ অক্টোবর ২০১৫ ০৫:২১87240
  • খুবই জোরালো লেখা, আর খাটাখাটুনি করে লেখা। সায়ন্তনকে অনেক ধন্যবাদ।
  • A.A. | ***:*** | ০৫ জুন ২০১৭ ০৩:৫২87241
  • Seriously???? বাংলা সাহিত্যে এত লেখা আছে সমপ্রেমের ওপর? এর তো কিছুই জানতাম না। লেখককে অনেক ধন্যবাদ।
    "এই যে এত মাস্টারপিসের নাম বলে যাচ্ছি এবং এরপরে আরো বলব, মুখ্যত দুটো উদ্দেশ্যে। সমকামী মানুষরা লেখাগুলো পড়ুন, ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্সের ক্লেদ ঝেড়ে ফেলুন। আর হোমোফোবিকরা সত্যর সাথে পরিচিত হোন । এত গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ পড়তে না পারলেও এটুকু জানুন, কত সাহিত্যিক কত কাজ করেছেন সত্যোদ্ঘাটনের দিগদর্শন খাড়া করতে। ইতিহাস বলছে, প্রত্যেকটা সমাজ সংস্কারই সাধিত হয়েছে অনেক কাঠ পোড়ানোর পর। আমি এই প্রবন্ধটা আগামী সমাজ পরিবর্তনের নিশানা হওয়ার মধ্যেই আবর্তিত করতে চাইছি" - এই কথাগুলো খুব ভালো লাগল। সত্যিই আপনি এরকমই একটা লেখা লিখেছেন, যেটা পড়লে সমকামী মানুষরা আত্নগ্লানি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে।
  • anick | ***:*** | ১৬ অক্টোবর ২০১৭ ০৫:৪৩87242
  • এপার বাংলা এবং ওপার বাংলার বিখ্যাত লেখকদের ৩০০০ এর উপর বাংলা বই , উপন্যাস বাংলা অনুবাদ , প্রাপ্ত বয়স্কদের বই, গল্পের বইয়ের বিপুল সমাহার।
    http://allbanglaboi.com/
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত প্রতিক্রিয়া দিন