আমাদের দেশে সাহিত্যের ইতিহাস ঘাঁটলে পাওয়া যাবে না এমন কোনো বিষয় নেই। আর্য সভ্যতার সময় থেকেই সাহিত্যিকরা বয়সে সমাজের চেয়ে এগিয়ে থেকেছেন। আর যেটুকু এগিয়েছেন তার উপর আলো ফেলেছেন আগামীদিনের পাথেয় দেখিয়ে দিতে। যেমনভাবে এখন অনেকে আলো ফেলছেন যৌনতার তুলনামূলক একটা উপেক্ষিত অংশের উপর । বিষয়টা হল সমকামিতা।
প্রাচীন ভারতে সমকামিতা গর্হিত ছিল না। কিন্তু মানুষ ধীরে ধীরে যৌনতার প্রতি অসহিষ্ণু হয়ে উঠল। এই পরিবর্তনের প্রমাণসাপেক্ষ বিবরণ পাওয়া যায় বৈষ্ণব সন্ন্যাসী অমর দাস উইলহেলমের ‘ইণ্ডিয়াস স্লো ডিসেণ্ট ইনটু হোমোফোবিয়া’ বইতে। লেখক ‘গে অ্যাণ্ড লেসবিয়ান বৈষ্ণব অ্যাসোসিয়েশন’ (GALVA) এর প্রতিষ্ঠাতা। ভারতীয় বংশোদ্ভুত লেখিকা-গবেষিকা রুথ বানিতা একাধিক বইতে বিশদভাবে একই বক্তব্য রেখেছেন। উইকিপিডিয়াতে বইয়ের তালিকা দেখে নিতে পারেন। ভানিতার সাথে যুগ্মভাবে ‘সেম সেক্স লাভ ইন ইণ্ডিয়াঃ রিডিংস ফ্রম লিটারেচার অ্যাণ্ড হিস্ট্রি’ বইয়ের সম্পাদনা করেছেন ইতিহাসের অধ্যাপক সেলিম কিড়ওয়াই। তিনি প্রথম ভারতীয় শিক্ষাবিদ যিনি স্বঘোষিত সমকামী । রামদেবের ‘হোমো-বাদ’এর উপর ‘আস্থা’শীল লোকজন বোধ হয় এঁদের নামই শোনে নি। কিন্তু এঁদের দৌলতে এখন অনেকের কাছেই প্রতীত যে, সমকামিতা ভারতীয় সংস্কৃতির অন্যতম ‘হেয়ারলুম’ । এছাড়া ছোটখাটো অগুনতি লেখায় প্রাচীন ভারতে ও প্রাচীন সাহিত্যে সমকামিতার কাঁড়ি কাঁড়ি উদাহরণ পড়েছি।
এ তো গেল শুধু ইতিহাসে নমুনা। সমকামিতা সম্পর্কে কত বিজ্ঞানী যে কত গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন, বলে শেষ করা যাবে না। পাঁচের দশকে আলফ্রেড কিনসের গবেষণার পরেও স্থানভেদে, কালভেদে প্রচুর গবেষণা হয়েছে। রোগ নাকি রোগ নয়, রোগ না হলে প্রাকৃতিক না অপ্রাকৃতিক, প্রাকৃতিক হলে সমাজের পক্ষে কি ক্ষতিকারক – প্রত্যেকটা পয়েণ্টের উপর অজস্র বিবৃতি বিভিন্ন বিজ্ঞানী ও চিকিৎসক দিয়েছেন। ফলস্বরূপ উক্ত তিনটে প্রশ্নের পরীক্ষিত ও সর্বজন বিদিত তিনটে উত্তর এসেছে যথাক্রমে ‘রোগ নয়’, ‘প্রাকৃতিক’ আর ‘ক্ষতিকারক নয়’। পাশাপাশি প্রমাণিত হয়েছে ‘গে জিন’ বা ‘গে মস্তিষ্ক’ বলে কিছু হয় না। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যৌন আকর্ষণের মতই এটাও মানুষের ব্যক্তিত্বের একটা অংশ। যৌনতা পরিবর্তনের সমস্ত প্রস্তাবিত পদ্ধতিও নস্যাৎ হয়েছে। আমি নতুন করে স্বতঃসিদ্ধের কথা বলব না। তাতে শুধু বক্তব্য কপি-পেস্ট করা হবে। সমকামিতাকে স্বাভাবিক প্রমাণ করা আর ‘সূর্য পূর্বদিকে ওঠে’ প্রমাণ করা এখন সমার্থক।
আর সেই কারণেই সমকামিতা নিয়ে লিখতে গিয়ে অন্য রাস্তা ধরলাম। আমার আলোচনার বিষয়, সাহিত্যিকদের ভূমিকা। এ রাস্তায়ও অনেকে অনেক অবদান রেখেছেন। কিন্তু আমার লক্ষ একটু আলাদা। ঠিক কীভাবে জনমত গঠনের এই মাধ্যমটাকে কাজে লাগালে আমরা সমাজ বদলাতে পারব, সেইটা খোঁজা। বিশ্ব জুড়ে এত গবেষণা তো হল, কিন্তু সমাজের মানসিকতা বদল হল কই? অনেক অভিজাত পল্লীতেও তো সমকামিতা বিশাল বড় ট্যাবু। ...চলুন না, তাহলে মানসিকতা বদলের দিগদর্শন খোঁজা যাক। ২০১৩-র ১১ই ডিসেম্বর সুপ্রীম কোর্ট নিদান দিয়েছিল, সমকামিতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তারপর থেকে প্রতিবাদের দাপটে এই বিষয়ের প্রাসঙ্গিকতা উত্তরোত্তর বেড়েছে। সৌভাগ্যক্রমে দেশের মিডিয়া অত্যন্ত সক্রিয়। তাই এখনো কোনো গ্রেফতারের খবর পাওয়া যায় নি। বরং ক্ষোভের বশে অনেক মানুষ প্রকাশ্যে নিজেদের পরিচয় দিয়েছেন। ৩৭৭ এর সাংবিধানিকতাকে সক্রিয়তাবাদীরাও বুড়ো আঙুল (নাকি মধ্য আঙুল?) দেখিয়েছেন। অর্থাৎ আইন আসল শত্রু নয়। আসল শত্রু সমাজের মানসিকতা। ২০০৯ থেকে ২০১৩ – খুব কি পরিবর্তন হয়েছিল সমকামীদের অবস্থার? অনেকের কাছে ‘গা-ঘিনঘিনে বস্তু’ না হলেও ‘হাস্যাস্পদ’ অথবা ‘করুণার পাত্র’ ছিলেন তাঁরা। এই অসুস্থ মানসিকতার মূল উপড়াতে এখন দায়িত্ব নিচ্ছেন সাহিত্যিকরা। মূলত যাঁরা ‘নিপীড়িত’ বিষয় ও ব্যক্তি নিয়ে বরাবর সংবেদনশীল। তাঁরাই পারবেন মনস্তত্ত্ববিদ, যৌন গবেষক, সমাজতত্ত্ববিদ, ধর্ম প্রচারক, ঐতিহাসিকদের উদার মতবাদের নির্যাসটুকু ছেঁকে নিয়ে সাধারণের কাছে পৌঁছে দিতে। তাঁরাই পারবেন ‘মাইণ্ডসেট’ নামক জগদ্দল পাথরটাকে নাড়িয়ে সময়কে এগিয়ে নিয়ে যেতে।
সম্প্রতি জাতিসঙ্ঘে সমকামী কাপলদের সমান সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রস্তাব জানায় রাশিয়া (স্বনামধন্য হোমোফোবিক দেশ)। ভারত, পাকিস্তান, চীন, ইরান, ইরাক, কুয়েত, কাতার, ওমান, সিরিয়া, ইজিপ্ট, সংযুক্ত আরব, সৌদি আরবসমেত ৪৩টা দেশ রাশিয়ার সঙ্কল্পের পক্ষে সায় দিয়েছে। মূলত এশিয়ান উৎপাতেও জাতিসঙ্ঘের সাধারণ সমাবেশে এই সঙ্কল্প পর্যুদস্ত হয়, কারণ ৮০টা দেশ ভোট দিয়েছে রাশিয়ার বিপক্ষে। জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব বান কি-মুন কড়া পদক্ষেপ নিচ্ছেন সমকামীদের সমানাধিকারের জন্য। ভারতে ভ্রমণকালে তিনি ৩৭৭ ধারার উৎপাটনের আর্জি জানান। এই ভারতই আবার ২০১৪-র সেপ্টেম্বরে LGBT ভেদাভেদের বিরুদ্ধে পাশ হওয়া পূর্ববর্তী সঙ্কল্পে ভোটদানে বিরত ছিল। তাহলে বুঝে দেখুন আমরা কোন দেশে বাস করছি। অবশ্য শাসনযন্ত্রকে আর দোষ দিই কী করে, জনগণের মধ্যেই উন্নাসিক জঞ্জাল ভর্তি! এইসব জঞ্জালের উক্ত তিনটে প্রশ্নের পরেও একটা বাড়তি প্রশ্ন থেকে যায়, ‘রোগ না হলেও, প্রাকৃতিক না হলেও, সমাজের পক্ষে ক্ষতিকারক না হলেও, আমাদের কি ভালো লাগে?’ ...বলাই বাহুল্য, এর উত্তর নেতিবাচক। ভালো লাগে না এবং সেই কারণে সামাজিকভাবে বয়কট করব। এখন, এই ধারণা বেশিরভাগ মানুষেরই আসে অজ্ঞানতা থেকে। এই উপসংহারে যারা আসতে পারে, বিশ্বব্যাপী গবেষণার ছিটেফোঁটাও তাদের জানা নেই। প্রাথমিক তিনটে প্রশ্নের উত্তর তারা খুঁজে নেয় চায়ের টেবিল বা ট্রেনের সিট থেকে, একটু ‘অ্যাডভান্সড’রা ফেসবুকের দেওয়াল থেকে। তাদের ‘সিঁধেল যুক্তি’র জটাজালে এত এত গবেষণার সারকথা গরম চায়ে হাবুডুবু খায় কিংবা ট্রেনে কাটা পড়ে। ....তাহলে সাহিত্যিকদের মুখ্য উদ্দেশ্য ‘এইসব মূঢ় ম্লান মূক মুখে দিতে হবে ভাষা।’ সেক্ষেত্রে শুধু গবেষণার আদ্যন্ত জানালেই চলবে না, একটু একটু করে চিরন্তনের সাথে ধাতস্থ করতে হবে। কীভাবে করা যাবে, সে আলোচনায় আসব। তার আগে বলি, আর একদল আছে যারা সমকামিতা সম্পর্কে লব্ধ প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব জেনেও ব্যাপারটা মেনে নিতে পারে না। এরা স্বঘোষিত সমাজ-সচেতক। সমাজতত্ত্ববিদরা যদি ধরে ধরে বুঝিয়ে দেন, তাতেও এরা নড়বে না। এদের মানসিকতা পরিবর্তন ভগবানেরও দুঃসাধ্য। তবু আশার বাণী শোনাই, যুগের সাথে সাথে এসব গোঁড়ার ভূমিষ্ঠ হওয়ার হার কমে আসছে। আর সাহিত্যিকদের প্রয়াসে সমাজের মেজরিটিই যদি একসময় বদলে যেতে পারে, তাহলে তাদের পরবশে এরাও পাতিত-শোধিত হয়ে যাবে।
আধুনিক সাহিত্যে সমকামিতাকে কেন্দ্র করে লেখা সবথেকে তথ্যবহুল বাংলা বইটি প্রকাশ পেয়েছিল ২০১০ সালে ঢাকার ‘শুদ্ধস্বর’ প্রকাশনা থেকে। নামঃ ‘সমকামিতাঃ একটি বৈজ্ঞানিক ও সমাজ মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান’। লেখক ড.অভিজিৎ রায় বিজ্ঞানের আঙ্গিকে সমকামিতাকে ‘স্বাভাবিক’ প্রমাণ করার জন্য কোনো গবেষণার কথাই বাদ দেন নি। সত্যি কথা বলতে গেলে, এই বইয়ের পর সমকামিতা নিয়ে নতুন কিছু লেখা সম্ভব নয়। যে কোনো বিতর্কে বইটা সাক্ষ্য হিসেবে খাড়া করলেই আলোচনায় যবনিকা পড়ে যাবে। কিন্তু সমস্যা হল, কলকাতার বাজারে বইটা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। পড়তে চাইলে সফট কপি ছাড়া গতি নেই। অভিজিৎ রায় প্রতিষ্ঠিত ‘মুক্ত-মনা’ ওয়েবসাইটে ওনার অন্যান্য বইয়ের সাথে এই বইটারও কিছু অংশ সংকলিত হয়েছে। http://www.mukto-mona/Articles/avijit/home/page2.html এই লিঙ্কে সমস্ত বই পাওয়া যাবে। অনলাইনে কিনতে চাইলেও অর্ডার করতে পারবেন। এছাড়া ‘মুক্ত-মনা’য় এই বিষয়ে আরো মূল্যবান প্রবন্ধ আছে। অর্ণব দত্ত, সজল খালেদ প্রমুখের লেখা। ব্লগের ‘পুরানো আর্কাইভ’-এর ‘হিউম্যান রাইটস’ কলামে ‘গে রাইটস’ অপশনে ক্লিক করলে প্রবন্ধগুলো পাওয়া যাবে। গত ২৬শে ফেব্রুয়ারী ২০১৫ ঢাকা বইমেলার সামনে জামাতি মৌলবাদীদের চাপাতির ঘায়ে অভিজিৎ রায়ের অকালমৃত্যুর পর ঐ সাইট সাময়িক বন্ধ ছিল। অবশ্য আমার মত ওনার অন্ধ ভক্ত অনেকেই আছেন যাঁরা ওনার সমস্ত লভ্য বই-ই ডাউনলোড করে রেখেছেন। উৎসাহী পাঠকরা আমাকে মেইল করে চাইতে পারেন (sayantanmaity1990@yahoo.com), pdf ফাইলগুলো পাঠিয়ে দেবো।
কলকাতা থেকে প্রকাশিত গবেষণাধর্মী বইয়ের মধ্যে রয়েছে অজয় মজুমদার ও নিলয় বসুর বই ‘সমপ্রেম’ (দীপ প্রকাশন) । বেশ কিছুদিন ধরে বইটা ‘বেস্টসেলার’ ছিল। অধ্যায়ভিত্তিক আলোচনায় অনেক না-জানা তথ্য পেয়ে যাবেন। ইংরেজীতে ভারতীয়দের লেখা বিভিন্ন তাত্ত্বিক বইয়ের মধ্যে ১৯৭৭ সালে শকুন্তলা দেবীর ‘দ্য ওয়ার্ল্ড অফ হোমোসেক্সুয়ালস’ প্রথম প্রকাশ । একবিংশ শতাব্দীতে LGBT Theme ইতিমধ্যেই একটা পরিশীলিত মাত্রা পেয়ে গেছে (বিশদ জানতে উইকিপিডিয়াতে ‘গে লিটারেচার’ দ্রষ্টব্য) ।
কলঙ্কিত ১১.১২.১৩-র পর থেকে পত্র-পত্রিকার ব্লগ ভরে উঠেছে শক্তিশালী কলমের যুক্তিনিষ্ঠ বয়ানে। খবরের কাগজের মাধ্যমে আছড়ে পড়েছে একের পর এক প্রবন্ধ - নিবন্ধের চাবুক। ফেসবুকেও দৃষ্টি আকর্ষকভাবে সোচ্চার হয়েছেন সাহিত্যিকরা। আইনসভা এবং সুপ্রীম কোর্ট – সবার কর্তব্যের গাফিলতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হয়েছে। এত লেখার হিসেব দেওয়া সম্ভব নয়। তবে ঠিক পরদিন আনন্দবাজারের সম্পাদকীয়তে উষশী চক্রবর্তীর প্রবন্ধটা বেশ মনে আছে। তার চেয়েও বেশি উল্লেখ্য ১৫.১২.১৩-র রবিবাসরীয়তে গৌতম চক্রবর্তীর ‘ভিনদেশি?’ শীর্ষক প্রবন্ধ। মনুসংহিতা, ঋগ্বেদ, মহাভারত, কৃত্তিবাসী রামায়ণ, বৌদ্ধধর্মে সমকামিতার একাধিক উল্লেখ লেখক দেখিয়েছেন। এসবের পাশে আমাদের ‘সংসদীয় গণতন্ত্রের’ কথা ভাবলে লজ্জাই করে। এছাড়া বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে সচেতনতামূলক অসংখ্য লেখা ছাপা হয়েছে।
বিশেষভাবে তারিফ করতে হয় ‘গুরুচণ্ডালি’ প্রকাশনাকে । এদের অবদান তিনটি বই । যুগ্ম সংখ্যা ‘অন্য যৌনতা’, ১৭টা আত্মকথা নিয়ে ‘আমার যৌনতা’ আর ঈপ্সিতা পালভৌমিকের ‘অসুখ সারান’। পাতিরাম, ধ্যানবিন্দুতে তিনটে বইই লভ্য। এর মধ্যে যুগ্ম সংখ্যাটা পড়লে সমকামিতা সম্পর্কে যে কারোর ধারণা পরিষ্কার হতে বাধ্য। স্বাভাবিকত্বের বয়ান প্রতিষ্ঠায় এত বিস্তৃত আলোচনা নিতান্তই দুর্লভ। সেইসাথে প্রায় প্রত্যেকটা লেখাতেই একসাথে এত বই ও ওয়েবপেজের রেফারেন্স। যৌনতাকে ঘিরে হয়ে চলা জঘন্য রাজনীতি নিয়েও লেখা আছে। প্রশ্নোত্তরে কথোপকথন রয়েছে একজন বাঙালী ও একজন আমেরিকানের। পাশাপাশি সাক্ষাৎকার দুটো পড়লে বুঝতে পারবেন, আমরা সামাজিকভাবে এখনো কত পিছিয়ে। ‘অসুখ সারান’-এর আদ্যোপান্ত ঈপ্সিতা পালভৌমিক লিখেছেন স্যাটায়ারের আঙ্গিকে । অনেক বিদেশী সংস্থা সমকামিতা ‘কিওর’ করার ভাঁওতা দেয়। কিছু বিদেশী মনস্তত্ত্ববিদ ‘বিকৃত’ বলে আখ্যা দেন। লেখিকা কোনো কিছুই এড়িয়ে যান নি। ওয়েব অ্যাড্রেসও দিয়ে দিয়েছেন দেখার জন্য, যাতে বইটা পড়ার পর এমন সংস্থার কথা শুনলে কারোর মনে প্রশ্ন না জাগে। পরোক্ষভাবে চরম বিদ্রুপ করেছেন এদের। যারা সমকামিতাকে রোগ মনে করে সমাজের চাপে ‘চিকিৎসা’ করাতে গেছেন, তাদের নারকীয় অভিজ্ঞতার কথাও লেখা আছে। সেসব পড়ার পর গুচ্ছের থেরাপি করে যৌনতা পাল্টানোর চেষ্টা বা অন্যকে পাল্টাতে পরামর্শ দেওয়ার বাসনা কারোর জাগবে না। কারণ, যা রোগ নয় তার সুশ্রূষা হয় না। বরং যারা উদার যুক্তির কাছে পরাস্ত হয়ে ‘প্রাকৃতিক’ বলে স্বীকার করে নিলেও সমকামীদের দেখলে নাক সিঁটকান, তাদের চিকিৎসার জন্য গুরুচণ্ডালির এই বইগুলো অব্যর্থ ওষুধ।
গুরুচণ্ডালির ব্লগের ‘অন্য যৌনতা’ কলামেও নিয়মিত লেখা আসে। মুদ্রিত সংখ্যা তিনটেরও অনেক অংশ সংকলিত হয়েছে ওয়েব-এ। লেখার উত্তরে যেসব মতামত আসে, সেখান থেকেও অনেক দামী কথা পাওয়া যায়। ওয়েব অ্যাড্রেস দিয়ে রাখলাম। উৎসাহী পাঠকরা প্রত্যেকটা লিঙ্ক সাবলিঙ্ক খুঁটিয়ে দেখবেন- http://www.guruchandali.com/default/categories/anyajounata/ । আপনাদের কোনো জিজ্ঞাস্য থাকলে ওখানেই কমেণ্ট করে জিজ্ঞেস করুন। কেউ না কেউ উত্তর দিয়ে দেবেন।
জেণ্ডার অ্যাক্টিভিস্ট পত্রিকাগুলো থেকেও কিছু মূল্যবান লেখা পাওয়া যায়, কিন্তু বেশিরভাগ পত্রিকার প্রকাশভঙ্গিই বড্ড অতিরঞ্জিত। সাম্যের মূল আদর্শটাকেই এরা ওভারহাইপিং-এর চাপে চৌপাট করে ছাড়বেন। তবে কলকাতার নামকরা লেসবিয়ান সংগঠন ‘স্যাফো ফর ইকুয়্যালিটি’ অনেক সচেতনতামূলক বই প্রকাশ করেছে। এদের দ্বিভাষিক মুখবন্ধ ‘স্বকণ্ঠে’ দেশের সীমা ছাড়িয়ে বিদেশেও বিক্রি হয়। খুব সম্প্রতি ‘স্বকণ্ঠে সংকলন’ তৈরী হয়েছে (ইংরেজীতে ‘সিলেক্টেড স্বকণ্ঠে’)। স্যাফো সম্পাদিত ইংরেজী বই ‘লেসবিয়ান স্ট্যাণ্ডপয়েণ্ট’ অবিসংবাদিত একটা গবেষণাপত্র। অধ্যাপিকা আশা অচুতান, মনোরোগ বিশেষজ্ঞা রঞ্জিতা বিশ্বাস এবং অধ্যাপক অনুপ কুমার ধর লিখিত। তাছাড়া উল্লেখযোগ্য ড.অমিত রঞ্জন বসুর গবেষণামূলক বই ‘লেসবিয়ানিজম ইন কলকাতা’। কিন্তু এক্ষেত্রেও সমস্যা, বইগুলো বাজারে পাওয়া যায় না। বইমেলার সময় ছাড়া হাতে পেতে হলে স্যাফোর অফিস ছাড়া গতি নেই। যদিও স্যাফো চেষ্টা করে অন্যান্য ইভেণ্টে বই রাখার। এই ওয়েবসাইট থেকে যোগাযোগের সমস্ত উপায় আর স্যাফোর যাবতীয় সার্ভিস সম্পর্কে জেনে নিতে পারেন। গুগলে ‘গে বাংলা স্টোরি’ কিংবা বাংলা ফণ্টে ‘সমকামী গল্প’ টাইপ করলে একগাদা চটিগল্পের লিঙ্ক চলে আসবে। অনুরোধ করছি, এগুলো পড়বেন না। কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ঠেসে দু-চারটে বটতলামার্কা বাক্য লিখলেই সাহিত্য হয় না। অপাঠ্য, কুপাঠ্য অক্ষরের সমাহার তৈরী হয়।
সত্যজিৎ রায়ের প্রফেসর শঙ্কু সিরিজের ‘কর্ভাস’ বলে একটা গল্প আছে। সেখানে শঙ্কু কাকদের শিক্ষিত করার জন্য অরনিথন বলে একটা যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন। তার দরজা খুলে কাককে ঢুকিয়ে দিলে বৈদ্যুতিক মাধ্যমে সে শিক্ষিত হয়ে বেরিয়ে আসত, তারপর মানুষের মত আচরণ করত। আমি এ যাবৎ যে যে বইয়ের নাম বলে এলাম, সব ঐ অরনিথনের মত । ঢুকতে পারলে অবহিত করেই ছাড়বে। গল্প অনুযায়ী যন্ত্রে প্রথম ঢুকেছিল কর্ভাস নামের একটা কাক। শঙ্কু শুধু দরজা খুলে রেখেছিলেন, তার জ্ঞানলাভের ইচ্ছে ছিল বলে নিজেই লাফাতে লাফাতে ঢুকে পড়েছিল। আমরা হলাম কর্ভাস। যারা বিষয়টা জানতে চাই, তারাই এই বইগুলোতে হাত দেব। কর্ভাসদের মধ্যে কেউ কেউ সমাজে সাম্য আনার জন্য ওকালতি করবেন। তাদের আমি অনুরোধ করব, হোমোফোবিকদের সাথে বিতর্কে নামার আগে এই বইগুলোকে হাতের বর্ম করে নিন। অরনিথন নিরুৎসাহী পাখিদের জ্ঞান-বুদ্ধি বাড়িয়ে দেওয়ারও ক্ষমতা রাখত। কিন্তু তেমন কেউ শঙ্কুর কাছে ধরা দেয় নি। তেমনি, যারা প্রেমের পরমার্থ বিচার করে বংশবিস্তারে, তারা তো সহজে যন্ত্রে ঢুকতে চাইবে না! তাদের শিক্ষিত না করতে পারলে সমাজের অসুখ সারবে কী করে? এই যে এত এত গবেষণা হয়েছে বলে বললাম, সেসব আমাদের চেয়ে তাদেরই বেশি জানা দরকার। সুতরাং বিকল্প পদ্ধতিতে তাদের অরনিথনে আনতে হবে।
(চলবে)