আমি আর অপূর্বকুমার। রুপোলি বিকেল বেলায়। ঢাকুরিয়া ঝিলের ধারে, ইউনিভারসিটি রোয়িং ক্লাবের উল্টোদিকে সবুজ কাঠের বেঞ্চিতে। পাশে মস্তো কেয়া ঝোপ, তাই সাপের ভয়ে কেউ বসে না এখানে। চার পুরিয়া উড়ে গেছে...একটাকা।
খুব একটা কুলীন কিছু না। ভুররা, বীজ আর ডাঁটিতে ভরা। সেসব বেছে ফেলে দিয়ে খৈনি ডলার মতো হাতের চেটোয় ডলে মিহি গুঁড়ো করা। তারপর সবচেয়ে সস্তার ফিল্টার সিগারেটের তামাক তর্জনী আর বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ফেলে দেওয়া। এরপর হাতের তেলোয় থাকা মিহি গুঁড়োর মত ভুররা সেই ফাঁকা সিগারেটের খোলে ঢোকানো। আর থেকে থেকে তর্জনী আর বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে টাইট করা। শেষে মুখটি পাকিয়ে বন্ধ করে দেওয়া। ব্যস, রিফার তৈরী। এক পুরিয়ায় একটা রিফার। গাঁজা, গ্রাস, হ্যাশ, হাশিস, তামুক, যে নামেই ডাকো, সাড়া দেন প্রথম পুরিয়ান্তে।
ঝিম। এসময় বড়ো মায়াবী লাগে চারপাশ। গোধূলির জাদু আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে গাছেদের পাতায় পাতায়। সামনে শ্যাওলা-ঝাঁঝিতে ভরা ছলাৎছল ঝিলের জল। একপাশে ভিড় করে আছে কুচো কচুরিপানা। ত্রস্ত পায়ে জলপিপি ছুটে যায় জল বেয়ে বেয়ে। রূপসী জলসাপ সোনা ও কাজলে মুড়ে ডুবে থাকে নিঝুম আলস্যে। পানাকৌড়ি যুগল ডুবে যায় ভেসে ওঠে এমনিই। ওপারে এক দারুণ বালক চার খুঁটিতে বাঁধা নৌকায় এক মনে দাঁড় বায়। সে নৌকা কোথাও যায় না। স্থির সেই নৌকাটিতে দাঁড় বেয়ে চলে বালক অবিরাম, অক্লান্ত। সে বুঝি অনুশীলনরত। নৌকা যাবে না কোথাও, কোত্থাও। তেমনই কথা দেওয়া আছে ঘাটের সাথে। অথচ বালকটিকে যেতে হবে দূরে বহুদূরে....। আর আমরা, তাম্বুরিন বাজানো ডিলানের মানুষটির মত, কোথাও যাবার নেই যার, গাইতে থাকি।
হেই আমার বাউল মন / একখান গান গাও না / আমার চক্ষেতে ঘুম নাই / আমার যাবার কোথাও নাই গো গোঁসাই / হেই আমার বাউল মন / একখান গান গাও না / বিহান বেলায় / তোমার পিছু পিছু চলেই যাবো...
গানের পিছু পিছু ঝুপ করে নেমে আসে সন্ধ্যা। বাতি জ্বলে ব্রিজের ওপর। ম্লান-লাল হ্যালোজেন। চামড়ার রং পাল্টে দেয়। মৃত মানুষের মতো ফ্যাকাশে লাগে।
বুঁদ। অপূর্বকুমার দেখতে পায় প্রথম।
- রেডস্টার ওভার কোলকাতা
- কই
- সোজা উত্তরে তাকা
ততক্ষনে ল্যান্সডাউন আর সাদার্ন অ্যাভেনিউয়ের মোড়ে দুজোড়া আটত্রিশ ইঞ্চি বেলবটস জিনস হাওয়াই চটি স্খলিত অয়নে। ল্যান্সডাউনের দূরতম উত্তরে লাল তারা। চলমান লাল তারা। কে কাকে টানে? তারাটি ও আমাদের মধ্যে এক আশ্চর্য টান তৈরি হয়। আধেক চেতন মেখে সেই তারা, কাঁহা কাঁহা মুল্লুকে নিয়ে যায়, হ্যামলিনের বাঁশিতে পান্নালালের তান। পাগল তান সমে পড়ে না কোনদিনও। বার বার সম এড়িয়ে ছুট দেয় আকাশের এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্ত। মোহগ্রস্তের মতো পিছু পিছু। দেশপ্রিয় পার্ক ছাড়িয়ে, হাজরা রোডের ক্রসিং ছাড়িয়ে ল্যান্সডাউন বাজারের ভিড়ে সে হারিয়ে যায়, নাকি আমরা? কে জানে! অনেক অনেক খুঁজে ক্লান্ত লাগে। শরীর আশ্রয় চায়। বাঁদিক ঘুরে টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ডানে রেখে বাঁয়ে বকুলবাগান রোড। গোলমাঠ পেরিয়ে শ্যামেদের বাসার রকে। বন্ধুসকল কুশলকলরবে আকূল,
- বিন্দাস? নাকি মজে মে ?
- দালির ঘড়ি। ঝুলে আছি সপসপে সময়ে।
টুপটুপ জল ঝরে কাঁটাদের থেকে। একদিন মুছে যাবে সময়। শুরু যদি হয়ে থাকে, একদিন মুছে যাবে ঠিক। আর সেই মুছে যাওয়া সময়ের গায়ে মৃত মাছের আঁশের মত লেগে থাকবে আমাদের সীমাহীন ভালোবাসা আর অসম্ভব বালখিল্যতা। সেই সব ছিন্ন জনপদ আর স্তব্ধ জলাশয় থেকে আমাদের রংধনু কুচকাওয়াজ। ঘাস-বিচালি-ঘাস, ঘাস-বিচালি-ঘাস, ঘাস-বিচালি-ঘাস। আমরা গাইতে থাকি।
তুমি ক্ষ্যাপার মতো ঘোরো / কেউ নয়কো তোমার পর / আকাশ মাথারই উপর / এই পথই তোমার ঘর / তাতে দেওয়াল নাই / তোমার নাচন দেখে / রাত আকাশের তারায় লাগে টান / ডাকে সমুদ্দুরে বান / হয় আঁধার খান খান / পাখীদের গানে...
ক্ষিদে পায়, তাই সব নদী ও জলাশয় ফিরে যায় মেঘালয়ে। অ্যালুমিনিয়ামের থালা ঢাকা দেওয়া রুটি আর কুমড়ো-ঝিঙ্গে-বেগুন-আলু, সামান্য আলুনি, কাঁচা লংকার ঝাল – ভালো লাগে ভালো লাগে ভারি।
ভোঁ। অ্যাসবেস্টাসের ছাদের তলায়, এক ফালি বিছানায় শুয়ে জানালা দিয়ে আকাশ। এই আমাদের ব্রহ্মাণ্ড, নীহারিকা, ছায়াপথ। পেতি প্রাঁস থাকে ওখানেই কোথাও। হেমন্তের অমবাস্যা এঁকে রাখে সব নক্ষত্রমালা। কালপুরুষ, সপ্তর্ষি, ধ্রুবতারা। নাম-না-জানা তারা খসে পড়ে লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে। ইচ্ছে করি, মনে মনে ইচ্ছে করি। ইচ্ছে করি কতো কিছু। প্রবালের দ্বীপে ঘুরে আসা। ঘুরে আসা উত্তুঙ্গ পর্বতরাজির ঝুরো তুষারের বুকে। মহাদ্রুমাকীর্ণ বনভূমি পায়ে পায়ে। এই সব ইচ্ছাসকল চুপি চুপি পাড়ি দেয় এক বিছানা থেকে অন্য বিছানায়, এক জানালা থেকে অন্য জানালায়। শান্তিপল্লী, নকুলেশ্বরতলা, স্কুল রোড, প্রতাপাদিত্য প্লেস আর গলফ ক্লাব ক্রিশ্চান সিমেটারি জুড়ে আমরা গাইতে থাকি।
হেই হেথায় রাতের তারা দ্যাখো / ধূলায় লুটায় // কোনখানে হারায় // আমায় কেবল ছুটায় সে পাগল পারা / দ্যাখো আমার দশা পাও দুখানি / আর যে চলে না / কেউ আমায় ডাকে না / আর স্বপন দেখি না এ বিজন পথে...
ক্রমশ দুলতে থাকে চরাচর দোলনায় দোলায়। উঁচুতে ওঠে, নিচে নামে, পিছে উঠে যায় আবার। সমস্ত মগ্নতা, সব নৈঃশব্দ গাঢ় হতে হতে হতে মধু। আমার অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলি ক্রমশ অচেনা হতে থাকে। চিন্তাসমূহ মস্তিষ্কের বাইরে এসে দাঁড়ায় মুখোমুখি।
না। আরশি নগরের পড়শি পাশে এসে বসেন। এলোমেলো চুলে হাত রাখেন তিনি। শরীর জুড়ে শান্তি নামে। নীহারিকা পুঞ্জ থেকে নেমে আসে গ্রহ তারা নক্ষত্রের দল। ফিসফিস কানাকানি। গল্প শোনায় ভিনগ্রহী পাখী। নিভে যাওয়া আগ্নেয় পর্বতের গল্প, সমুদ্রের ভিতর থেকে উঠে এসেছিল যারা মাত্র কয়েক আলোকবর্ষ আগে। সেই সব পর্বতের গায়ে নিজেদের মেলে দিয়ে আমরা গেয়ে উঠি।
আমায় একটুখানি দিও গো ঠাঁই / তোমার আজব নায় / আমার চেতন যায় যায় / আমার পথ চলে / হায় আমি যে আর চলতে পারি না / তবু রাজি আছি যেথায় খুশি / আমায় নিয়া যাও / আমার বাঁধন খুলে দাও / তোমার সুরের পরশ দাও / ভুলি যন্ত্রণা...
হেই আমার বাউল মন / একখান গান গাও না
অলংকরণঃ সুমেরু মুখোপাধ্যায়