আজি কি তোমার মধুর মূরতি হেরিনু শারদ প্রভাতে!/
হে মাত বঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ ঝলিছে অমল শোভাতে।
শরতের নান্দনিক সৌন্দর্য, স্বচ্ছ সকালের কোমল রোদ, পূর্ণিমা রাতের অসাধারণ সুন্দর জোছনা সবার মন-মন্দিরে এক স্বর্গীয় অনুভূতির দোলা দেয়। নীল আকাশে শুভ্র মেঘের আনাগোনা, নদী তীরের শাদা কাশফুল কাব্যিক এই উপমাই শরতের কবিতার সুর।সেই শরৎ ঋতু বয়ে আনে বাঙালীর জীবনে আনন্দ, মা আসছেন এক বছর পরে তার পিতৃ গৃহে - এ যে বাঙালীর কাছে কত বড় আনন্দের দিন তা ভাবা যায় না।
প্রতি বছরের ন্যায় এবারেও লক্ষ্মীপূজার দিনে সকাল থেকেই মানিনীর মন খারাপ | নির্জন বাড়িতে আটফুট বাই চারফুট ব্যালকনিতে ইজিচেয়ারে সেই বিকেল থেকে বসে। না এই পুজোর দিনেও কোন ঘরে তার আলো জ্বলছেনা । এই লক্ষ্মীপুজোর দিনেই তো তার জীবনের সব আলো মুছে গেছে।
বাড়ি থেকেই উঠে গেছে ঈশ্বর বিশ্বাসী নিত্য পুজো দেওয়ার ঠাকুরের আসন | চেতন বা অবচেতনে কখনোই তার আর আসেনা বলা " মা মঙ্গল করো।"
প্রচন্ড ধর্মভীরু মানিনী কখনই কেউ দিব্যি দিয়ে কথা বললে অবিশ্বাস করেনি। মধ্যবিত্ত পরিবারে বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান ছিল সে। দেখতে ছিল প্রচন্ড সুন্দরী।
স্কুল কলেজে পড়ার সময় কত ছেলে যে প্রেম নিবেদন করেছে তার হিসাব রাখলে একটা ছোটো খাটো খাতার প্রতিটা পাতা ভর্তি হয়ে যেত। কিন্তু বাবার আদরের দুলালী বাবাকেই এসে হাসতে হাসতে সেই গল্পগুলি করতো। তিনিও শুনে হাসতেন আর বলতেন," খুব সাবধান আগে পড়াশুনাটা শেষ হোক তারপর নাহয় পছন্দসই হলে সাড়া দিও।"
মা শুনে রাগে গজগজ করতে করতে বলতেন, "আদিখ্যেতা দেখো বাপ মেয়ের। গল্প করছে যেন সমবয়সী দুই বন্ধু।" মায়ের কথা শুনে মানিনী তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলতো," বাবা আমার বেষ্ট ফ্রেন্ড।" দিনগুলি এভাবেই হাসি আর আনন্দে কেটে যাচ্ছিলো।
বাবা মায়ের সাথে মানিনী তার বাবার অফিস কলিগের মেয়ের বিয়েতে গেছিলো বেশ সেজেগুজেই। এমনিতেই সুন্দর চেহারা তার উপর বিয়ে বাড়ির সাজ।
সবাই তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলো তার অপরূপ মন ভোলানো সৌন্দর্য। একসময় বাবার বন্ধু আনন্দ কাকু বাবাকে বললেন, "তোর সাথে একটা খুব দরকারি কথা আছে।"
-"হ্যাঁ বল কি কথা ।"
"মেয়ের বিয়ের পরেই আমি আমার ছেলে অভিমানের বিয়ে দিতে চাই। ও মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। এই বাড়িঘর বিষয় সম্পত্তি সবই ওই ছেলের। বেশ ভালো মাইনেও পায়।"
"সবই ঠিক আছে তা আমাকে এসব আজ বলছি স কেন?"
"তার কারণ তোর মেয়েটাকে আমি আমার ছেলের জন্য চাই।"
"তোর ছেলে আজ বিয়ে বাড়িতে আছে?"
"দেখবি তাকে? দাঁড়া ডাকছি।"
"নিজের ছেলে বলে বলছিনা রে আজকের দিনে এ রকম ছেলে দেখা যায়না।"
"শোন তুই ছেলেকে ডেকে নিয়ে আয়। আমিও আমার মেয়ে আর তার মাকে ডেকে আনি। কিন্তু ওদের সামনে শুধু পরিচয়টাই করাস | ওরা দেখে যাক বাকি কথা নাহয় আমরা আলোচনা করেই তোকে জানাবো। মেয়ে তো আর আমার একার না ওর মা কি বলে দেখি। আমার যদি তোর ছেলেকে পছন্দ হয় তবে ধরে নিবি আমার মেয়েরও পছন্দ হবে।"
এই ঘটনার ছমাসের মধ্যেই মানিনীর সাথে অভিমানের বিয়ে হয়ে যায় | শ্বশুর, শ্বাশুড়িকে নিয়ে বেশ মানিয়ে গুছিয়ে মানিনী তার সুখী দাম্পত্য জীবন কাটাতে লাগলো। অভিমান ছুটির দিন হলেই মানিনীকে নিয়ে বাইক চেপে এদিকওদিক ঘুরতে যায়। তবে বাপের বাড়িতে গিয়ে থাকা আর হয়না কারণ শ্বশুর শ্বাশুড়ি তাকে যেন চোখে হারান। আর অভিমান তো অফিস থেকে ফিরে তাকে সঙ্গে সঙ্গে দেখতে না পেলে অভিমানেই তার মুখ হাঁড়ি হয়ে যায়। মাঝে মাঝে মানিনী ভাবে এতো সুখ জীবনে পাবো তা কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি। দুবছরের মাথায় তার আর অভিমানের ভালোবাসার সন্তান শ্রেয়া আসে তাদের জীবনে | বাড়িতে যেন খুশির বন্যা বয়ে যায়।
বিয়ের পর থেকেই মানিনী দেখে আসছে লক্ষ্মীপূজার দিন তার শ্বশুরবাড়িতে বিশাল বড় করে পুজো হয়। চারকাঠা জমির উপর এই মস্তবড় বাড়ি টাকে টুনি লাইট দিয়ে সাজানো হয়। আর সেই লাইট খোলা হয় কালীপূজার পর | বাড়িটা অভিমানের পিতৃপুরুষের। যখন যে এর মালিকানা স্বত্ব পায় সেই তার নিজের মত করে একটু সাজিয়ে গুছিয়ে নেয় | এই করতে করতে বাড়িটা বর্তমানে দাঁড়িয়েছে চারকাঠা জমির উপর | অভিমানদের বসত ভিটেই হচ্ছে বাইশ কাঠা জমি। বাড়িতে সমস্ত রকম সব্জী চাষ হয় এই কলকাতা শহরের উপর থেকেও | তারজন্য লোক রাখা আছে |
বিশাল গেট পেরিয়ে বাড়িতে ঢোকার মুখে দুপাশে ফুলগাছের সমারোহ। কোন পুজোতেই বাইরের থেকে ফুল কেনার প্রয়োজন হয়না | বাড়ির বাগানের অজস্র ফুঁটে থাকা ফুল দিয়েই পুজো হয়ে যায়।
বিয়ের চারবছর পরে ---
মেয়ের বয়স তখন দুবছর। সেদিন ছিল লক্ষ্মীপুজো। বাড়ির সকলেই কাজে ব্যস্ত। আয়োজন যেহেতু বিশাল তাই পুজোর কা জে সহায়তা করার জন্য পাড়ার কিছু বৌ, মেয়ে এসে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় | তখনও পূর্ণিমা লেগে পারেনি। সে বছর সন্ধ্যা সাতটার পরে পূর্ণিমা লেগেছিলো | কৃষ্ণ কাকু যিনি বারোমাস অভিমানদের জমিতে সব্জি চাষ করেন তিনি এসে অভিমানকে জানালেন,
ছোটবাবু তালের যে আঠিগুলি এনেছেন সেগুলি সবই পচা | আপনি আমাকে কিছু টাকা দিন আমি নিজে গিয়ে দেখে নিয়ে আসছি।
-আরে তোমাকে যেতে হবেনা। তুমি বরং এদিকটা সামলাও আমি বাইকে গিয়ে এক্ষুণি নিয়ে আসছি।
এই অসময়ে বেরোনোটা মানিনীর একদম ভালো লাগেনি। সে ছদ্ম রাগ দেখিয়ে বলেছিলো,
যে কটা আছে তাই দিয়েই পুজো হয়ে যাবে। তোমাকে এখন যেতে হবেনা |
দূর পাগলী কত লোক আসবে। কেউ যদি খেতে চায় তাকে বলবে 'নেই?' তাই হয় নাকি? আমি যাবো আর আসবো। দশ থেকে পনের মিনিট লাগবে |
মনে থাকে যেন | পনের মিনিটের মধ্যেই কিন্তু আসা চাই।
অভিমান মানিনীর কাঁধে হাত রেখে বলেছিলো," পাক্কা প্রমিস ।"
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। পূর্ণিমা তখন লেগে গেছে। বাড়ির তিনটে প্রাণীই অস্থির হয়ে পড়ছে। ঠাকুর মশাই নারায়ন নিয়ে পুজোর জন্য এসে পড়েছেন। হঠাৎ একটি পাড়ার ছেলে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে খবর দিলো, "অভিমানদা একসিডেন্ট করেছে ।" পাগলের মত মানিনী ছুটে বেরিয়ে গেলো মেয়েকে শ্বাশুড়ির কাছে রেখে। আনন্দ বাবু দ্রুত বেরোতে গিয়ে শোনেন এক প্রতিবেশিনী ঠাকুরমশাইকে বলছেন," আপনি কোনরকমে পুজোটা করে ফেলুন ।" আনন্দ বাবু থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন,"এবারে আর পুজোটা করতে হবেনা ঠাকুরমশাই। মা ঐভাবেই আমার ঘরে থাকবেন | আমার অভি সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরুক আগামীবার এই প্রতিমাকেই আমি পুজো করবো। আর যদি ----।" তিনি বিড়বিড় করতে করতে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন। ওনার মনের অবস্থা মোটেই ভালোনা।
দুরন্ত নাতনীকে নিয়ে এই পরিস্থিতিতে অভিমানের মা হিমশিম খাচ্ছেন। পরিস্থিতি মনেহয় মানুষকে শক্ত করে তোলে। স্বামী, বৌমা সেই বেরিয়েছে রাত এখন অনেক। কেউ এখনো ফেরেনি। দুধের শিশুকে মাঝে মধ্যেই দুধ করে খাওয়াচ্ছেন উজ্জ্বলা দেবী। স্বামীর ফোনের সুইচ অফ আর মানিনী তো তার ফোন নিয়েই যায়নি। সেই সন্ধ্যাতেই খবর পাওয়ার সাথে সাথেই বাড়ির সমস্ত আলোর সাজ নিভে গেছে। দু একজন প্রতিবেশী অনেক রাত অবধি উজ্জ্বলা দেবীর কাছে ছিলেন। খবর পেয়েই মানিনীর বাবা, মা রাত দশটা নাগাদ চলে এসেছেন | সারাটা রাত তিনটে প্রাণীই জেগে কাটিয়েছেন।
ভোর পাঁচটা নাগাদ ফিরে এলেন আলু থালু বেশে আনন্দ বাবু আর তার বৌমা। ফিরলো না শুধু অভিমান। সে এখন ঠান্ডাঘরে। আকাশ বাতাস মথিত করে বাড়ির সকলে চিৎকার চেঁচামেচি করে কান্নাকাটি করছে। কে কাকে সান্ত্বনা দেবে? কি বলে সান্ত্বনা দেবে?
শুধু কিছু পাড়াপ্রতিবেশী এই পাগল প্রায় মানুষ গুলিকে দুহাত দিয়ে শক্ত করে ধরে রেখেছে। তাদের চোখেও অবিরাম জলের ধারা।
অনেক চেষ্টা করেও মেয়ে নাতনীকে নিয়ে যেতে পারেননি মানিনীর বাবা, মা । তাদের দেখতে ইচ্ছা করলে তারাই এসেছেন তার শ্বশুরবাড়িতে | শ্বশুর আবার নুতন করে মানিনীকে তার জীবনটা নিয়ে ভাবতে বলেছিলেন বারবার। কিন্তু সে রাজি হয়নি।
অভিমানের একসিডেন্টের খবর শোনার পরেই মানিনীর বুকের উপর যে ভারী পাথর টা চেপে বসেছিল আজও তা বর্তমান। মেয়েকে উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে বিয়ে দিয়েছে ডাক্তার ছেলের সাথে। বিয়ে ঠিক করতে গিয়ে জেনে এসেছিলো ছেলে বাইক চালায় কিনা। সে ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েই তবে সে মেয়ের বিয়ের পাকা কথা দিয়েছিলো। আগে দু দুটো বিয়ে নাকচ করেছে ছেলে বাইক চালায় শুনে। মেয়ে শ্বশুরবাড়ি। মাঝে মধ্যে আসে মায়ের কাছে।
এখন সে সম্পূর্ণ একা।
বছর দুয়েক হল শ্বশুরমশাইও গত হয়েছেন। বেশ কয়েক বছর আগেই চলে গেছেন একেএকে বাবা, মা আর শাশুড়ি। সময় মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় ওষুধ | অন্য দিনগুলি যেমন তেমন ভাবে কাটে,কিন্তু এই লক্ষ্মীপুজো আসলেই পঁচিশ বছর আগের স্মৃতিগুলি বারবার অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যায় | তখন এই ব্যলকনিটাই বসে আপনমনে অভিমানের শেষ বলা কথাগুলো ভাবতে থাকে। সেদিন যে এই ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েই অভিমান তাকে কথা দিয়েছিলো পনের মিনিটের মধ্যেই সে ফিরে আসবে | তাই আজও মানিনী সেই অপেক্ষায় বসে যদি একবার সে এসে তার সামনে দাঁড়ায় ---। গতানুগগতিক জীবনের বাইরেও এমন কিছু ঘটে যার ব্যাখ্যা মেলেনা।
আর সেগুলিই তো অলৌকিক।
বাকি জীবনে সেই অলৌকিক কিছু ঘটার আশায় লক্ষ্মীপুজোর দিনে বিকেল থেকে সারারাত কাটে মানিনীর এই ব্যালকনিতে। মাঝে মাঝে মনেহয় শুনতে পান -
"জানি আমার পায়ের শব্দ রাত্রে দিনে শুনতে তুমি পাও, খুশি হয়ে পথের পানে চাও । খুশি তোমার ফুটে ওঠে শরৎ-আকাশে অরুণ-আভাসে।"
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।