হুমায়ূন আজাদের ওপর যখন হামলার খবর পেয়েছিলাম, বিশ্বাস করতে পারিনি। বইমেলায় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এমন ঘটনা ঘটবে, এটা কল্পনার বাইরে ছিল।
অভিজিৎ রায় এর ওপর হামলার (২৬ ফেব্রুয়ারি) খবর শোনা মাত্র অবিশ্বাসের প্রশ্নই আসেনি, আশঙ্কাটাই বরং নিমিষে তীব্রভাবে গ্রাস করেছে। তখন এটা অবিশ্বাস্য ছিল, এখন এটাকে বাস্তব, সম্ভব বলে মেনে নিয়েছি, এই তো অগ্রগতি।
মাত্র দুই দিন আগে তার সাথে পরিচিত হলাম বইমেলায়, বিজ্ঞানের বইপত্র নিয়ে অনেক আড্ডা হলো। স্মৃতিটুকু এখনও উষ্ণ রয়ে গেছে। মর্মান্তিক এই অনুভূতি ছাপিয়ে কিছু লেখা বা বলা কঠিন। একটা ছবি দেখলাম, রক্তাক্ত বন্যা সাহায্যর জন্য ডাকছেন, আর পেছনে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা অভিজিৎ এর লাশ। এই দৃশ্য কোনদিন যেন ভুলতে না পারি, এই দৃশ্য কাউকে ভুলতে না দেয়া হোক। এই দৃশ্যের প্রায়শ্চিত্ত না করে আমরা কেউ মুক্ত হতে পারবো না, আমাদের জাতি মুক্ত হতে পারবে না।
অসহিষ্ণুতা এই রাষ্ট্র আর সমাজের স্তরে স্তরে টিকিয়ে রাখা হয়েছে, তাকে লালন করা হয়েছে, প্রয়োজন মত প্রকাশ্য লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে তাকে ব্যবহার করা হচ্ছে, কখনো কখনো গোপন আততায়ী হিসেবে তারা শ্বাপদের মত ঝাঁপিয়ে পড়ছে।
রোদেলা প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করার বিষয়টা খেয়াল করুন, অধিকাংশ জাতীয় পত্রিকায় এটা কোন সংবাদ হয়নি। এর প্রতিবাদে আয়োজিত সমাবেশটাও না। কতবড় একটা মাফিয়া চক্র মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে তার ক্ষমতা বাড়িয়ে নিচ্ছে, কিন্তু বাকিরা দেখেও না দেখার ভান করলো, যেন কিছু ঘটেনি। প্রকাশকদের এরা বুঝিয়ে দিলো, কোন বই প্রকাশ করা যাবে না, লেখকদের জানিয়ে দিলো কোন লেখায় সে আর নিরপদ থাকবে না। মাদ্রাসার শিশুদের কথা ভাবুন, দুনিয়ার মাঝে সবচে কম টাকা শিক্ষাখাতে খরচ করা বাংলাদেশের সরকারগুলো এই শিশুদের এমন শিক্ষায় শিক্ষিত করছে, যেখানে নিজেদের ছেলেমেয়েদের কোন ক্ষমতাধর প্রভাবশালী পড়াবেন না। সৌদি আরব থেকে তেল আমদানি করতে ব্যারেলপ্রতি দ্বিগুন দাম দেয়ার চুক্তি করে যে টাকা চুরি করা হবে, শুধু সেই টাকাতেই হয়তো প্রতিটি শিশুর জন্য একই মানের শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব। এই শিশুগুলোকে ব্যবহার করা হবে হেফাজতের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ময়দানে পেশিশক্তির প্রদর্শনে-- আওয়ামী লিগ বিএনপি কেউই তাদের ব্যবহারে পেছপা থাকবে না।
হিজবুত এর মত প্রধানত উচ্চমধ্যবিত্ত সমাজ থেকে আসা কিংবা শিবিরের মতো প্রধানত নিন্মমধ্যবিত্ত সমাজ থেকে আসা তরুণদের কথা ধরুন, এরা কি এই গোটা অসহিষ্ণু শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার ফলাফল নয়?
বাংলা ভাইয়ের মত ব্যক্তি ও সংগঠন গড়ে উঠেছিল রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ইন্ধনে, সেটা প্রথম দিন থেকেই পরিস্কার ছিল। ঘটনার পরম্পরায় বাংলাভাই নিকেশ হয়েছে, কিন্তু এর সাথে রাষ্ট্রের ইন্ধন কিভাবে কাজ করেছে, তার তদন্ত কই, পর্যালোচনা কই?
আমাদের কি তাহলে একটা খাঁচায় আটকে রাখার বন্দোবস্ত করা হচ্ছে, যেখানে গরিব চাষা-পোষাক শিল্পের কর্মী আর প্রবাসী শ্রমিকরা বৈদেশিক মুদ্রা আয় করবেন, করের টাকায় কোষাগার পূর্ণ করবেন, আর সেই টাকা লূট করবে ঋণ খেলাপিরা, লট করবে উড়াল সেতুর ঠিকাদাররা, লুট করবে আর সব মাফিয়া রাজনীতিবিদরা। তাই নিয়ে হবে তাদের ক্ষমতার কামড়াকামড়ি। আর বাকি জনগণকে আতঙ্কে রাখতে, বশ রাখতে, অনুগত রাখতে টিকিয়ে রাখা হবে, সহ্য করা হবে, মদদ দেয়া হবে এই নারকীয় শক্তিগুলোকে? ট্রেড ইউনিয়ন থাকবে না, হেফাজত থাকবে। সরকারী বিদ্যালয় বাড়বে না, মাদ্রাসা আর ইংরেজি মাধ্যম বাড়বে।
কোন একটা সাম্প্রদায়িক হামলার এই দেশে বিচার হয়নি। দেশি বিদেশী শক্তিগুলোর সাথে মৌলবাদী রাজনীতির গাঁটছড়া নিয়ে কোন আইন হয়নি।
অভিজিৎ রায় এর হত্যাকারীদের অবিলম্বে বিচার চাই। একই সাথে চাই সমাজে-রাষ্ট্রে এই পাপের মূলোৎপাটন। সমাজে অসহিষ্ণুতা যখন খুনের মানসিকতার এত তীব্র বিস্তার ঘটিয়েছে, আপনার বর্তমান বা ভবিষ্যতের কোন স্বাভাবিকত্ব নিরাপদ? বিদেশে পালিয়ে যদি রেহাই না পেতে চান, দেশকে যদি রক্ষা করতে চান, উটপাখির মত বালুতে মুখ গুজে থাকবেন না। মৌলবাদ আজকের দুনিয়ায় কোন রকম ব্যতিক্রম ছাড়াই লুণ্ঠকদের রাজনীতির পরজীবী। বাংলাদেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি-মানবিকতার নতুন নির্মাণে অংশ নিন, সাধ্যমত ভূমিকা রাখুন। লুণ্ঠকদের, মৌলবাদী রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকদের প্রত্যাখ্যান করুন, প্রতিহত করুন।
চাপাতিধারীদের অতর্কিত হামলা আতঙ্কের যে সমাজে আমাদের বসবাস, তাতে নবতর সংযোজন এই ব্লগার খুন। যে গভীর পাপ আমাদের মানহীন শিক্ষাব্যবস্থায়, আমলাতন্ত্রের দাপটে, সংস্কৃতি চর্চায়, সামাজিক সংগঠনের ভূমিকাহীনতায়, দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষকতায়য় এত বছর ধরে চর্চা করে আসা হয়েছে, তার ফলাফল হাতেহাতে পাওয়া যাচ্ছে। বিজ্ঞান লেখকদের আড্ডা কি আর হবে এই দেশে? আইনস্টাইনের জন্মদিন পরের বছর কি পালন করা যাবে? শিশু-কিশোরদের মা বাবারা পাঠাবেন তো সাংস্কৃতিক আয়োজনে? সবশেষ ওয়াশিকুর রহমান বাবুর হত্যাকাণ্ড (৩০ মার্চ) এই ভীতির সংস্কৃতিকে আরও পাকাপোক্ত করার শয়তানি আযোজন।
আমরা জানি যারা আসছে, সেই নতুন প্রজন্মের জন্যই আমাদের লড়ে যেতে হবে। সহিষ্ণু-মানবিক একটা সমাজ নির্মাণের জন্য প্রাণপণ যুদ্ধ চলবে।