"সব লোকে কয় লালন কি জাত এই সংসারে
লালন বলে জাতের কি রূপ, দেখলেম না এই নজরে"...
সাহিল অ্যাগনেলো পেরিওয়াল, নামটা প্রথমে শুনে একটু চমকেই গেছিলাম । মুমতাজ ম্যামের কাছেই শুনি এই নামটা। পুরো বিষয়টা বুঝতে গেলে একটু পিছিয়ে যেতে হবে আপনাদের। ছাত্র পড়ানোর সূত্রেই পরিচয় মুমতাজ ম্যামের সঙ্গে। লা মার্টিনিয়ার, ডন বসকো, সেন্ট জেভিয়ার্সের মতো নামিদামি স্কুলের ছাত্র ছাত্রী পড়ানোর সুবাদে আমাদের দুজনের বহু স্টুডেন্টই কমন। আমি অংক আর ফিজিক্স পড়াই, মুমতাজ ম্যাম ইংরেজি। ম্যাম হঠাৎ করেই ফোন করে দেখা করতে বললেন। একটু অবাকই হয়ে গেছিলাম। সেশনের মাঝখানে জেনারেলি ব্যাচে নতুন স্টুডেন্ট নেওয়া হয়না। এটা ম্যামও ভালোই জানেন।
যাই হোক, ওনার সাথে দেখা করলাম পরের দিন। মুমতাজ ম্যাম কাতর ভাবে অনুরোধ করলেন ওনার ছোট বোনের ছেলেকে পড়ানোর জন্য। জেনারেলি এরকম ইন্ডিভিজুয়াল স্টুডেন্ট পড়ানোর অনুরোধ আসেনা, কারণ বেশি টাকা দিতে হয় বলে অনেক অভিভাবকই ব্যাচে পড়ানো প্রেফার করেন। মুমতাজ ম্যামকে খোলাখুলি টাকার কথা বলতেই উনি বললেন, "টাকার জন্য চিন্তা করবেন না। ইউ টেক হোয়াট এভার ইউ থিংক ফিট। উই নিড রেজাল্ট।"
চ্যালেঞ্জটা অ্যাক্সেপ্ট করলাম এবং আজ মনে হয় সেদিন চ্যালেঞ্জটা না নিলে এমন একটি পরিবারের সঙ্গে পরিচয় হতোনা। আর সেটায় ব্যক্তিগত ক্ষতিই হতো। যেদিন ওদের বাড়ি গেলাম, প্রথম বিস্ময়টা দরজার সামনেই অপেক্ষা করছিলো আমার জন্য। ঝকঝকে গেটের মাথায় একটা নাইট ল্যাম্প লাগানো। আর তার একদিকে "786" আর অন্য দিকে "Jesus Loves Us" লেখা। বেল বাজাতে ছোটখাটো চেহারার ফর্সা টুকটুকে একটা ছেলে দরজা খুলেই এমন হাসিমুখে অভ্যর্থনা করলো, যেন আমি তার বহুদিনের পরিচিত। ছোট্ট Three BHK ফ্ল্যাট। ফ্ল্যাটে পা দিলেই আপনার মনে হবে স্বর্গ বোধহয় এরকমই হবে।
ফ্ল্যাটে ঢুকলেই আপনার নজর কাড়বে গৃহসজ্জা। দ্বিতীয় বিস্ময় আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো ওদের ডায়নিং কাম ড্রয়িং রুমে। ড্রয়িং রুমের একপ্রান্তে বিরাট প্লাজমা টিভি আর সারাউণ্ড সাউন্ড সিস্টেম। আর টিভির দুদিকে দুটি বড় ছবি। একদিকে ক্রুশবিদ্ধ জেসাস, আর অন্য দিকে কাবার ছবি। দুটি ছবির মাঝে আর একটি বালব লাগানো রয়েছে। আর দুটি ছবিকে ঘিরে এলইডি লাইট সাজানো। লাইফে কখনও এমন হতভম্ব হতে হয়নি। এ ও কি সম্ভব!! এমন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান! তাহলে কি প্যালেস্টাইন, গাজা স্ট্রিপ, ক্রুসেড, নানা হানাহানি, এসব বানানো গল্প!! কোনও সংঘাত ছাড়া যীশুখৃষ্টের সাথে মহম্মদ এক দেওয়ালে থাকেন কীভাবে? একই পরিবারে? লাভ জিহাদ? সাহিলের শোয়ার ঘর পর্যন্ত পৌঁছানোর আগে একঝাঁক প্রশ্ন মাথায় ভিড় করে এলো।
সাহিলের ছোট্ট বেডরুমকে কি আদৌ বেডরুম বলা যায়? ঘরের এককোণে একেবারেই ছোট স্টাডি টেবিল। তার ওপরেই কম্পিউটার রাখা। একটা ওয়ার্ডরোব আর বাকি দেওয়াল জুড়ে বুক শেলফ ঠাসা বইয়ে। সিংগেল ডিভানে অজস্র বই। গোটা ঘর জুড়ে শুধু বই আর বই। দরজার পাশে বড় বোর্ড, আর তাতে পরিবারের সদস্যদের বিভিন্ন ছবি দিয়ে কোলাজ বানানো। পরিবারের দ্বিতীয় সদস্য যিনি এলেন, তাঁর নাম শেহনাজ মনসুর পেরিওয়াল, সাহিলের মা। এই দুনিয়ায় কেউ কেউ থাকেন, যাঁদের দেখলেই আপনার মনে হবে নিজের মায়ের মতো। তেমনই একজন মানুষ শেহনাজ। আলাপের পরেই প্রথম জিজ্ঞাসা করলেন আমি খেয়ে এসেছি কি না!
তারপরে কোথা দিয়ে কেটে গেছে দুটি বছর, টেরও পাইনি। সাক্ষাৎ পরিচয় হয়েছে এক অনবদ্য পরিবারের সাথে। আমার জানা নেই, এমন পরিবার কোলকাতা শহরে আর দ্বিতীয় আছে কি না। সাহিলের বাবা মারিয়ো পিটার পেরিওয়াল ধার্মিক খ্রিস্টান। ভালোবেসে জীবনসঙ্গী হিসাবে বেছে নিয়েছেন শেহনাজকে। শেহনাজ ধর্মে মুসলিম। পিটারের মা বাবাও পরস্পরকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলেন। এবং পিটারের মা কিন্তু খ্রিস্টান নন, মাড়োয়াড়ি হিন্দু। পিটারের শ্যালক, মানে সাহিলের মামা আবার যাঁকে বিয়ে করেছেন, তিনি ধর্মে হিন্দু এবং বাঙালি। দু'বছরে ঈদ, ক্রিসমাস, বিজয়া দশমী, তিনটি উৎসবের নেমন্তন্ন পেয়েছি ওদের বাড়িতে। এমন নয় যে পরিবারে কেউ ধর্মের ধার ধারেনা। একই ছাদের তলায় নামাজ পড়া এবং রবিবারে চার্চে যাওয়া নিত্যকারের কাজ হিসাবেই দেখতাম আর অবাক বিস্ময়ে ভাবতাম, এও সম্ভব!!
সপ্তাহে দুদিন পড়াতে যাওয়া, বই পড়া, নিত্যনতুন খাওয়া এবং গল্পের নেশায় কখন যে হিসাবের গণ্ডি ছাড়িয়ে গেছে, নিজেও বুঝতে পারিনি। শেহনাজ নিজে অসাধারণ রাঁধুনি। রান্নাটা ওনার প্যাশন থেকে পেশায় পরিবর্তিত হয়েছে। নিউমার্কেট অঞ্চলে একটি রেস্তোরাঁ চালান একার হাতে। ওনার এই প্যাশনের সাক্ষী আমার রসনা। চিকেন প্যাটি হোক বা কুকিজ, লাচ্ছা পরোটা বা মাটন বিরিয়ানী, অথবা ফিরনির মধ্য দিয়ে শেহনাজ আমার হৃদয় ছুঁয়ে যেতেন বারেবারে।
অন্যদিকে পিটারের পেশা ফ্যাশন ডিজাইনিং হলেও নেশা গান গাওয়া। অনবদ্য গলা ভদ্রলোকের। রুজি রোজগারের জন্য একটি বুটিক চালিয়ে যেটুকু সময় পান, পরিবার এবং সঙ্গীত চর্চা ছাড়া আর কিছুতেই নজর নেই। বহুদিন এমন হয়েছে সাহিলকে অংক করতে দিয়ে আমরা দুজনে ডাইনিং রুমে বসে গল্প করে কাটিয়েছি। পিটার বিভিন্ন বিষয়ের ওপরে বলতেন, আর আমি এক মনে শুনতাম ওনার কথা। দেওয়ালে ঝোলানো জেশাস ক্রাইস্ট আর কাবার ছবির মাঝে আলোটা জ্বলে থাকতো। মনে হতো এই দুনিয়াদারির আনা পাইয়ের হিসাবের বাইরের এক জগতে সফর করতে বেরিয়েছি। পিটারের হাত ধরে সেই সফরে শুধুই আনন্দের মেলা। ভদ্রলোকের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারে যেন নেগেটিভ কিছু নেই। আপনার নেশা হয়ে যাবে এমন আসরে বসলে।
ঝরঝরে ইংরাজিতে পিটার বলে যেত ধর্ম কী? অলওয়েজ থিংক গুড, থিংক পজিটিভ অ্যাবাউট লাইফ। ডোন্ট স্পেন্ড ইওর টাইম থিংকিং নেগেটিভ। ইট উইল মিসগাইড ইউ। পজিটিভ থিংকিং উইল শো ইউ দ্য রাইট ওয়ে অফ লাইভলিহুড। বিলিভ মি, এটাই ধর্ম, আর কিচ্ছু না। স্বর্গ বা নরক কোথাও নেই। সব কিছুই এখানে, এই পৃথিবীর বুকেই। যখনই তুমি অন্যের জন্য ভালো কিছু করবে, তখনই তুমি স্বর্গে থাকবে। কথার ফাঁকে ফাঁকে গিটার বাজিয়ে হয়ত দুচার কলি গান। আমার মধ্যেও কোথাও যেন এই বিশ্বাস ছড়িয়ে যেত, ডু গুড টু আদারস এন্ড ইউ উইল বি ইন হেভেন। বাড়ি ফেরার পথ জুড়ে মাথায় ভাসতো আমির খসরুর লেখা...