অত:পর... "ইশকিয়াঁ'। শিরোনামটি প্রকৃতপক্ষে বিশেষ্য (প্রেম) না বিশেষণ (প্রেমিক), সেই বিতর্কের থেকেও বেশী গুরুত্বপূর্ণ এ ছবির ভাষা -- যা কিনা সমঝদার দর্শকের প্রতি পরিচালকের প্রেমপত্র হবার দাবী রাখে। যেখানে বলিউডের নতুন প্রজন্মের পরিচালকদের সিংহভাগই টারান্টিনো ঘরানার তুখোড়, শহুরে এবং আদ্যোপান্ত স্মার্ট ভঙ্গিটি অনুসরণ করে থাকেন, সেখানে এই ফিল্ম যেন কিছুটা কোয়েন ভাইদের ঘরানার অনুসারী। অর্থাৎ গতিশীল ক্যামেরা এবং নিওন-ঔজ্জ্বল্যের জায়গায় আমরা পাই ধীর লয়, কাহিনীর ঠাসবুনোট এবং প্রকৃতির অসম্ভব সুন্দর চিত্রগ্রহণ। টানটান অপরাধের noir ধারাকে মেরুদণ্ড হিসাবে ব্যবহার করলেও এ ছবিতে সূর্যের আলোর অভাব নেই - যার প্রভাবে রাত্রের শটগুলিও হয়ে ওঠে কবোষ্ণ, উজ্জ্বল অথচ মেদুর। এ ছবির গল্প একই সঙ্গে আত্মসচেতন এবং সূক্ষ্ম। যেখানে বিশালের নিজের ছবি "কামিনে' নিশ্চিত ভাবেই টারান্টিনো ঘরানার শহুরে পরাবাস্তবতার অনুসারী ছিল, "ইশকিয়াঁ'-র গল্পের ভাষা সেখানে সচেতন ভাবেই চাপা, এবং বাস্তবতার প্রান্তসীমার মধ্যেই আবদ্ধ থাকে। তাই বৃষ্টি ও রক্তে ভেজা মুম্বই আন্ডারওয়ার্ল্ডের চকচকে পিচরাস্তার জায়গায় আমরা দেখি গোরখ্পুরের আধা-গ্রামীণ ধূলিধূসরিত পথ, যেখানে জাতিবিদ্বেষ তীব্র এবং প্রতিহিংসার ভাষা প্রায়শই নরহত্যার আশ্রয় নেয়। আমার এরপরের মন্তব্য অবশ্য অনেকেরই মন:পূত হবে না। বিতর্কের অবকাশ রেখেই বলি,আমি "ইশকিয়াঁ'-র গল্পে "শোলে'-র ছায়া দেখতে পাই এবং বারেবারে। নাসিরুদ্দিন শাহের স্বল্পভাষী ইফতিকারের চরিত্রে যেন জয়ের আদল; আরশাদ ওয়ারসির উচ্চকিত আচরণ মনে করায় বিরুকে এবং বিদ্যা বালানের কৃষ্ণা যেন রাধা এবং বাসন্তী, একাধারে। "শোলে'-র কাঠামোকে হয়ত এভাবেই তুখোড় রসবোধের মোড়কে সাজিয়ে পেশ করেন অভিষেক চৌবে। তবে আবার ও বলি, এ আমার নিতান্ত ব্যক্তিগত অভিমত।
"ইশকিয়াঁ' প্রথমেই দৃষ্টি কেড়ে নেয় আলোর পরিমিত ব্যবহারের মাধ্যমে। সত্যজিৎ রায়ের সহকর্মী এবং প্রথিতযশা আলোকচিত্রী সৌম্যেন্দু রায় একবার নব্বইয়ের দশকের হিন্দি ছবি সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন যে হিন্দি ছবি সবসময়ই অতিরিক্ত আলোর ব্যবহারের মাধ্যমে দৃশ্যের ব্যঞ্জনা নষ্ট করছে। এই কথার সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ থাকেনা যখন আমরা দেখি বেশি আলো ব্যবহারের ফলে একটি চরিত্রর একাধিক ছায়া, অথবা ছায়ার সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি। "ইশকিয়াঁ' প্রথম থেকেই এই ধারা মেনে চলতে অস্বীকার করে। ছবির ফ্রেমে অন্ধকারের অভাব নেই, যার ফলে বিছানায় শায়িতা এক নারীর শরীর হয়ে ওঠে শিথিল যৌন আবেদনের প্রতীক, অথচ যেন কিছুটা অবাস্তবও। এভাবেই দর্শকদের প্রথম পরিচয় ঘটে কৃষ্ণা বর্মার সাথে, যাকে আপাত দৃষ্টিতে স্বামীসোহাগে তৃপ্ত, ঘরকন্নায় পারদর্শী, সাধারণ উত্তর ভারতীয় গ্রাম্য গৃহবধূ ছাড়া আর কিছুই মনে হয়না। বলা বাহুল্য, এই ভ্রান্তি সাময়িক। কৃষ্ণার চরিত্রটি প্রকৃতপক্ষে noir ধারার femme fatale-এর দক্ষ রূপায়ণ। সিনেমার ইতিহাসে অনেক ক্ষেত্রেই এ ধরণের চরিত্র পিতৃতান্ত্রিকতার হাতের পুতুল, কিন্তু কৃষ্ণা বহির্জগতের কার্য্যকারণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত, এবং এ ছবির নায়কদের থেকে সে সবসময়ই এক ধাপ এগিয়ে। নায়কের প্রসঙ্গে চলে আসে মুখ্য জুটির কথা। ছিঁচকে অপরাধী এবং ইফতিকার ও বব্বনের সঙ্গে দর্শকের পরিচয়ের মুহূর্তটিও বিশেষ উল্লেখের দাবী রাখে - ছবির তথাকথিত নায়কদের আমরা আবিষ্কার করি মদ্যপ এবং প্রায় উন্মত্ত অবস্থায়, এবং পেছনে বেজে চলে কোনো এক তৃতীয় শ্রেণীর ব্যান্ডের গলায় গাওয়া "অজীব দাস্তাঁ হ্যায় ইয়ে' গানটি। এই ভবিষ্যদ্বাণীকে সত্য প্রমাণিত করতে নায়কদ্বয়ের দ্রুত ভাগ্য পরিবর্তন হয়। জীবন্ত সমাধিস্থ হওয়ার হাত থেকে এক চুলের জন্য বেঁচে যাওয়া নাসিরুদ্দিন-আরশাদ পালিয়ে যায় গোরখ্পুরে, আশ্রয় নেয় পূর্বপরিচিত বিদ্যাধর বর্মা'র (আদিল হুসেন) বাড়িতে। বলা বাহুল্য, এ ছবির সূচনায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ফলে বিদ্যাধর বর্মার "মৃত্যু' তাদের কাছে অজ্ঞাত ছিল। গল্প এর পরে এগিয়ে চলে তার নিজস্ব গতিতে। চিত্রনাট্যের চমকটুকু নষ্ট না করেই বলা যেতে পারে ইফতিকার-বব্বন-বিধবা কৃষ্ণা এই ত্রিধারার ইস্পাত-ব্যবসায়ী কমলকান্ত কক্কড়কে অপহরণের ছক কীভাবে আক্ষরিক অর্থেই এক বিস্ফোরক উপসংহারে আনীত হয় - এ ছবির মূল উপজীব্য সেটিই।
এ পর্যন্ত আমাদের আলোচনা থেকে এ কথা স্পষ্ট যে "ইশকিয়াঁ'-র ঘরানার ছবি সব সময়ই তার কাহিনীগত জটিলতার ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য শক্তিশালী অভিনয়ের দাবী রাখে। সুখের বিষয়, কর্কশ কামুক বব্বনের চরিত্রে আরশাদ ওয়ারসি, বরফশীতল কৃষ্ণার ভূমিকায় বিদ্যা বালান পাল্লা দিয়ে অভিনয় করে যান বর্ষীয়ান ইফতিকারবেশী নাসিরুদ্দিন শাহর সঙ্গে। নাসির স্বভাবসিদ্ধ স্বচ্ছন্দ অভিনয়ের মাধ্যমে এই ছবিতেও দাগ কেটে যান। "যানে ভি দো ইয়ারোঁ' অথবা "ইজাজৎ' এর নব্য যুবক এ ছবির বলিরেখায় আকীর্ণ এক প্রৌঢ়, কিন্তু সেই তীক্ষ্ম বাদামি চোখ, অন্যমনস্ক মৃদু হাসি আর অমসৃণ গলার ইন্দ্রজাল আজও সেই একই রকম তীব্র। কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলি বাদ দিয়ে বাকি অভিনেতাদের সম্পর্কে "যথাযথ' কথাটি ব্যবহার করাটাই সমীচীন হবে, যদিও গ্রাম্য কিশোর নন্দুর চরিত্রে অলক কুমারের অভিনয় বিশেষ উল্লেখের দাবী রাখে।
উপসংহার টানার আগে এ ছবির গান সম্পর্কে কিছু না বললেই নয়। সুর ও লিরিকের একঘেয়েমির হাত থেকে গুলজার-বিশাল জুটি শুধু সাময়িক মুক্তিই দেননা, বরং গুলজার-রাহুল দেববর্মণ জুটির কথাও মনে করিয়ে দেন। ছবির প্রথম গান "ইব্ন-এ-বতুতা' অনায়াসে চতুর্দশ শতকের স্বনামধন্য ভূপর্যটককে নামিয়ে আনে গতিময় ঝকঝকে সুরের আদলে (সুখবিন্দর সিং ও মিকার কন্ঠনৈপুণ্যের কথা উল্লেখ্য)। এর বিপরীতে রাহৎ ফতে আলি খানের মসৃণ কন্ঠে "দিল তো বচ্চা হ্যায় জী' আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় প্রৌঢ় খালুজানের কল্পনাবিলাস এবং অনিবার্য হৃদয়ভঙ্গের মুখোমুখি। হিন্দি ছবির ধ্রুপদী গানগুলিকে এ ছবি বর্জন করেনি: গুলজারের নিজস্ব ছবি "কিতাব' এর "ধন্নো কি আখোঁ মে' গানটির যথাযথ ব্যবহার ছাড়াও রসিক দর্শকের জন্য রয়েছে একটি দমবন্ধকরা মুহূর্তে আচমকা ভাবেই লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া "অনুপমা' ছবির "কুছ দিল নে কহা'-র সুরকারের নাম নিয়ে কৃষ্ণা ও ইফতিকারের হালকা তর্কাতর্কি।
তবে একেবারে অকুন্ঠ প্রশংসাও করা গেলনা। বেশ কিছু চিত্রনাট্যগত দুর্বলতাও চোখ পড়ে যায় । চরিত্রগুলির মূল অভিসন্ধি কখনই যেন পুরোপুরি স্পষ্ট নয়, এবং এই ভ্রান্তিবিলাসকে পূর্ণতা দেয় ছবির নেহাৎই সাদামাটা উপসংহার (যা হয়ত শেষ দৃশ্যে কিছুটা হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার করে উঠতে পারে)। বিদ্যা বালানের চরিত্রটিও যেন তার পারিপার্শ্বিকের তুলনায় একটু বেমানানভাবে সপ্রতিভ এবং ধারালো। তবে অসাধারণ অভিনয়ণৈপুণ্যে এসব ছোটোখাটো ত্রুটি বেশিরভাগ সময়ই ঢাকা পড়ে যায়, একথাও ঠিক। "ইশকিয়াঁ' নিজস্ব নৈপুন্যে হিন্দি ছবির জগতে একটি ছোট্ট কিন্তু গুরুত্বপুর্ণ জায়গা করে নিতে পেরেছে, একথা বেশ জোর দিয়েই বলতে পারি। হয়ত আজ থেকে কয়েক বছর পরে আবার "ইশকিয়াঁ' দেখে এতটা উচ্ছ্বসিত হব না, কিন্তু আপাতত... "অ্যায়সি উলঝি নজর উনসে হঠতি নেহিঁ।'
মূল রচনা :
http://klaustrophilic.blogspot.com/2010/04/ishq-yeah.html
অনুবাদ করেছেন দিব্যকুসুম রায় ।
23 Nov, 2010