যে বইটি নিয়ে লিখতে চলেছি, তার কথা আমার দু'বছর আগেই বলা উচিত ছিল। আমি ভাগ্যবান, এই বইয়ের সব কটা গল্প প্রকাশিত হওয়ার আগেই পড়তে পেরেছি। অবাক হয়েছি। খুশি হয়েছি। তাই, সামনের বইমেলায় যে বই আপনি হাতে পাবেন, তার সম্বন্ধে স্পয়লার না দিয়েও কয়েকটা কথা বলে, আপনার সঙ্গে আমার আনন্দ ভাগ করে নিতে চাই।
দেখুন, আপনি আমি এমন একটা দেশের মানুষ, যেখানে ভাববাদী, ধর্মভীরুতার পাশাপাশি, কম বেশি হাজার আড়াই বছর ধরে আরেকটা দর্শনও নিজের অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। এই দর্শন কোনও রকম ধর্মাচরণ, অবিনশ্বর আত্মার অস্তিত্ব, পরলোক বা পুনর্জন্ম কিছুরই অস্তিত্ব স্বীকার করে না। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রত্যক্ষ প্রমাণ বা প্রত্যক্ষপূর্বক অনুমান, এই দর্শনের বিশ্বাসের ভিত্তি। যেহেতু, মৃত্যুর পর আর কিছুই নেই, তাই বাঁচাটাকে সম্পূর্ণভাবে - তার সব রঙ-রস-গন্ধ নিয়ে, কিন্তু, শীলিতভাবে, রুচিসম্মত উপায়ে- উপভোগ করতে বলে এই দর্শন।
যাবজ্ জীবং সুখং জীবেৎ।
নাস্তি মৃত্যোর্ অগোচরঃ।।
চেনা চেনা ঠেকছে? হ্যাঁ, সায়ণ-মাধব এই শ্লোকেরই দ্বিতীয় পংক্তি অম্লানবদনে পালটে দিয়ে, লিখেছিলেন : ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ।
মানে, স্রেফ মিথ্যে বলে প্রমাণ করে দেওয়া হলো ইহবাদী বা বস্তুবাদী দর্শন নাস্তিক, ধর্মদ্রোহী এবং বেলাগাম, উচ্ছৃঙ্খল, ইন্দ্রিয়সুখভোগের প্রচারক। আসলে, মেধা-যুক্তি-বিতর্কের সঙ্গে কায়েমি স্বার্থ কোনওদিনই পেরে ওঠে না। তখন, সব কালে, একটি পথই অনুসৃত হয়। চরিত্রহনন আর কুৎসা রটনা।
একেবারে এক জিনিস ঘটেছিল খ্রীস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের গ্রীক দার্শনিক এপিকিউরিয়াসের সঙ্গে। মূলতঃ লুক্রেশিয়াসের রচনা থেকে তাঁর দর্শন রেনেসাঁসের সময় ইওরোপ জানতে পারে। এবং পরম শক্তিশালী, জ্ঞানবিপণির চাবিকাঠির রক্ষক চার্চ, তাঁর দর্শন - যার সঙ্গে যাবজ্ জীবং সুখং জীবেৎ - এর আশ্চর্য মিল - কে অসংযত বেলেল্লাপনার সমার্থক বলে দেগে দেয়। ইংরিজিতে এপিকিউরিয়ান বলতে লাগামছাড়া ইহসুখবাদী (হেডনিস্ট) এক মানুষকে বোঝানো হয় আজও।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, দেশে দেশে, কালে কালে, চিন্তার মুক্তির দিশারী আর প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থবুদ্ধির একটা সংঘাত বেঁধেছে। ঠিক এখান থেকেই আলোচ্য বইটির দিকে চাইতে পারি আমরা।
সুজন ভট্টাচার্য তাঁর 'চতুর্দশ অশ্বারোহী' বইতে চোদ্দটা উত্তেজনায় টান টান ইতিহাস আশ্রিত গল্প লিখেছেন। গল্পগুলো, যাকে বলে, ক্র্যাকিং গুড রীড এবং আনপুটডাউনেবল্ - একবার ধরলে ছাড়া যায় না। কিন্তু, গল্পগুলো বস্তুবাদী দর্শনের সুতোয় বাঁধা। ভারতীয় বস্তুবাদের জনক অজিত কেশকম্বলী, গ্রীক দার্শনিক এপিকিউরিয়াস ও দিওগোরাস, কমেডির জনক আরিস্তোফেনিস, ইসলামিয় বৃত্তে নাস্তিক্যবাদের প্রবক্তা আবু আল-হাসান আহমদ ইবন ইয়াহিয়া ইবন ইশক আল রাওয়ান্দি (৮২৭-৯১১), রোমান কবি-দার্শনিক তিতাস লুক্রেতসিস ক্যারাস, ইরানি বিজ্ঞানসাধক, এবং ইওরোপীয় চিকিৎসা শাস্ত্রের ওপর বিপুল প্রভাব নিস্তারকারী আবু বকর মুহম্মদ ইবন জাকারিয়াহ আল রাজি (৮৫৪-৯২৫), আমাদের ভারতভূমির মখ্খল গোসাল, স্বয়ং ওমর খৈয়াম, যাঁকে হত্যা করায় পেপাল ক্রুসেড আরম্ভ হয়, সেই চার্চের সংস্কারকামী ইয়ান হুস, গুরু বান্দা সিং বাহাদুর - সবাই একটা কথাই বলে চলেন এই বইতে : মুক্ত জ্ঞান, স্বচ্ছ দৃষ্টি, স্পষ্ট কথা - এসব খুব কম লোকেরই আয়ত্তাধীন হয় এবং যাঁরা এই গুণগুলো পান, তাঁদের দেশ কালের সীমায় বাঁধা যায় না। তাঁদের বাসভূমির নাম মানুষের দুনিয়া। সব রকম মতলববাজি, ভণ্ডামি আর অবিচারের তাঁরা ঘোষিত শত্রু।
লেখক শেষ গল্পটি লিখেছেন তাঁকে নিয়ে, যাঁকে বাঙালি না করে, ভুলক্রমে মানুষ হিসেবে গড়ে ফেলেছিলেন বিধাতা। ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এতটাই জীবন্ত এই বইতে, যে তাকে হাত বাড়িয়ে ছোঁয়া যায় বলে মনে হয়।
বইঘরের স্বজনরা, যে কালবেলার মধ্যে আপনি আমি দিনাতিপাত করছি এই মুহূর্তে, সেখানে ভরসা করার মতো গল্প বলা ক্রমশঃ কঠিন হয়ে উঠছে। বাস্তব এতটাই নিষ্করুণ যে দিনযাপন-প্রাণধারণের গ্লানি আমাদের চেতনাকে অবসন্ন করছে। ফলে, আমরা গল্প শোনার সময়, এই বাস্তব থেকে ছুটি চাইছি এবং অতিলৌকিক বা রহস্য রোমাঞ্চকে আপন করছি। তবু, মনের একটা কোণায় এমন গল্প শোনার আকাঙ্ক্ষা থেকেই যায়, যা আনন্দ দেবে, আবার ভাবাবেও। তাৎক্ষণিক উত্তেজনা কাটার পরও যে গল্প আবার শুনতে ইচ্ছে করবে।
চতুর্দশ অশ্বারোহী আপনাদের সেরকম গল্পই শোনাবে।
যদি আমার কথা বিশ্বাস করেন, তবে পড়বেন বইটা।
হতাশ হবেন না। কথা দিচ্ছি।
চতুর্দশ অশ্বারোহী
সুজন ভট্টাচার্য
প্রকাশক: অভিযান