যে অঞ্চলে আমি থাকি, সেখানে হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের জনসংখ্যার অনুপাত সমান সমানই হবে। হয়ত মুসলিম জনসংখ্যা কিছু বেশিই হবে মনে হয়। মৌজার নাম সৈয়দপুর, পরবর্তী সময়ে লোকের মুখেমুখে তা হয়ে দাঁড়ায় সোদপুর। ছোটবেলা থেকে যাদের সাথে খেলাধুলো করে বড় হয়েছি, জানাই ছিল না, যে তাদের অনেকেই ধর্মে মুসলিম। ভট্টাচার্য বামুনের ছেলে, কিন্তু বাড়ি থেকেও কখনোই কোন নিষেধাজ্ঞা ছিল না ভিন্ন ধর্মের মানুষের সাথে মেলামেশায়। সত্যি বলতে সঙ্গী সাথীদের অনেকেই যে ভিন্ন ধর্মের, সেটা বোঝার মতো বুদ্ধিও ছিল না মনে হয়। তাই যার সাথে খেলতাম, বা একটু বড় হবার পরে লুকিয়ে বিড়ি খেতাম শেয়ার করে, তার নাম কাল্টু বলেই জেনে এসেছি চিরকাল। তারও যে একটা পোষাকী নাম আছে, এবং সেই নাম মহম্মদ আব্বাসউদ্দিন, সেটা কোনদিন মনেও আসেনি।
কাল্টুর বাড়িতে মাঝেমাঝেই সিমুই বা পরোটা হতো। আর চিরকালীন পেটুক আমি, সেই খাওয়ার ভাগ কোনদিনই মিস করতাম না। কাল্টুর মা কে পিসি বলেই ডাকতাম। এবং নিজের পিসির কাছে চেয়ে খেতে যেমন লজ্জা লাগতো না, তেমনই কাল্টুর মায়ের কাছেও চেয়ে খেতে কখনোই লজ্জা পাইনি। কাল্টুর দাদারা রাজমিস্ত্রির কাজ করতো। আমাদের পুরোনো বাড়ির মেরামতি করতে হলেই কাল্টুর দাদার ডাক পড়ত।
এলাকায় মসজিদ ছিল দুটি। দুটিরই বেশ জরাজীর্ণ দশা। তার মধ্যে একটিকে লাল মসজিদ বলা হয়। মসজিদের পাশে অনেকটা খালি জায়গায় কোনও আদ্দিকালে কবর দেওয়া হতো। আমাদের ছোটবেলাতেই সেই কবরস্থান পরিত্যক্ত ঘোষিত হয়ে গেছিল। ফলে গোটা এলাকা জঙ্গলে ঢেকে এক অদ্ভুত ভুতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। ওই জঙ্গলে বড় বড় বিষধর সাপের আস্তানা থাকায় সন্ধ্যের পর থেকে ওই অঞ্চলে মানুষের আনাগোনা প্রায় হতোই না। বড়দের কাছে শুনেছি নকশাল আমলে মসজিদের পাশের ওই কবরস্থানে বোমা বাঁধা হত। সিআরপি বা পুলিশে তাড়া করলে ওই জঙ্গল তখন মায়ের মতো বুকে আগলে রাখতো তার দামাল ছেলেদের।
মসজিদে নামাজ পড়তে যেতেন হাতে গোনা কয়েকজন। নামাজ পড়া হয়ে গেলে ইমাম সাহেব কোন কোনদিন এসে আমাদের সাথে গল্প করতেন। কাল্টুদের সঙ্গে লতায় পাতায় ইমাম সাহেবের আত্মীয়তা ছিল। কাল্টু সম্পর্কে ওনার নাতি। তাই আমরাও সকলেই ছিলাম ওনার নাতি। ইমাম সাহেব আমাদের গল্প শোনাতেন। ফেরেস্তার গল্প, জ্বিন পরীর গল্প, ওনার ছোটবেলার গল্প। তখন চারদিকে কেমন জঙ্গল ছিল। হাতে গোনা কয়েকজনের বাস। গল্প করতে করতে মাঝে মাঝেই তাঁর লম্বা সাদা দাড়িতে হাত বুলাতেন ইমাম সাহেব। সন্ধ্যা হবার আগেই একবার উঠে যেতেন ইমাম সাহেব। নামাজ পড়ার জন্য। ঠিক যেমন আমার দাদু সন্ধ্যা হলেই আহ্নিক করতে বসতেন, তেমনই যেন মনে হতো আমার। আমরা তখন কেউ ষোলো, আর কেউ বা আঠেরো।
রোগা ছিপছিপে দীর্ঘদেহী মানুষটির সাথে আমার ঠাকুরদার কোন তফাৎ করতে পারতাম না। ওনার জন্যেই হয়ত মসজিদের সাথে আমাদের একটা আত্মীয়তা হয়ে গিয়েছিল। এবং সেই আত্মীয়তায় কেবলই প্রাণের টান ছিল। মসজিদের পাশেই ছিল একটা এক কামরার ঘর। আর সেখানেই ছিল ইমাম সাহেবের গেরস্থালি। নিজেই রান্না করতেন। কোনদিন ডাল, ভাত, তরকারি। আবার কোনদিন কেউ কিছু রান্না করে দিয়ে যেতেন এই বৃদ্ধ মানুষটিকে। লালি পিসি (কাল্টুর মা) বাড়িতে যেদিন স্পেশাল কিছু বানাতেন, পাত্রে ঢাকা দিয়ে খানিক বেশি করেই নিয়ে আসতেন ইমাম সাহেবের জন্য। কারণ উনি ভালভাবেই জানতেন যে ইমাম সাহেবের ভাগ থেকে আমরাও ভাগ বসাবো। খাওয়ার দিয়ে যাওয়ার সময় আমাদের ডেকে বলে যেতেন যাতে আমরা সবটা না খেয়ে ফেলি। তবুও সেই নিষেধাজ্ঞা মাঝে মাঝেই ভুলে যেতাম আমরা। মাংসের শেষ টুকরোটাও আমাদের পাতে বেমালুম তুলে দিতেন ইমাম সাহেব। আর নিজে ঝোল দিয়ে মেখে ভাত খেতেন। লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে যেত। প্রতিজ্ঞা করতাম এর পরের বারে আর এমন না করার। কিন্তু সেই প্রতিজ্ঞা ভাঙ্গতে সময় লাগতোনা।
ইমাম সাহেব বলতেন, "আমি মরে গেলে তোরা আমার গোরে মাটি দিস বাপ"। আমরা হেসে বলতাম, "ধুর, আপনি আরো পঞ্চাশ বছর বাঁচবেন"। ঈদ আসছে টের পেতাম মসজিদ পরিস্কার হতে দেখলেই। রোজার এক মাস আমরা কেউ ইমাম সাহেবের ঘরে যেতাম না। বৃদ্ধ মানুষটাই কখনো সখনো আসতেন আমাদের কাছে। ঈদের আগে মসজিদের চারপাশ ঝকঝক করতো। ইমাম সাহেব দাড়িতে মেহেন্দি লাগাতেন। নতুন লুঙ্গি, নতুন পাঞ্জাবী পড়ে ওনাকেই যেন ফেরেস্তা বলে মনে হতো।
আমাদের এলাকাতেই থাকতেন মাধব চ্যাটার্জী। বিরাট বড় কীর্তনের দল ছিলো ওনার। মাঝেমাঝেই বাড়িতে বসতো অষ্টপ্রহর নাম সংকীর্তনের আসর। লাউডস্পিকারের বিকট আওয়াজে জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠত আমাদের। কাল্টু আর আমি ঠিক করলাম এই কীর্তন বন্ধ করতেই হবে। আর কিছু না পারি অন্তত মাইকের অত্যাচার বন্ধ করতেই হবে যেভাবেই হোক। প্ল্যান মোতাবেক ল্যাম্পপোস্টে উঠে কাল্টু লাউডস্পিকারের তার ছিঁড়ে দিল। মাইকের অত্যাচার থেকে রেহাই তো পেলাম , কিন্তু কিভাবে কে জানে, আমাদের এই কুকর্মের খবর ইমাম সাহেব জানতে পেরে গিয়েছিলেন। বিকালে মসজিদে যেতেই ডেকে পাঠালেন আমাদের দুজন কে। আর সেই প্রথম রাগতে দেখেছিলাম সদাহাস্যমুখ মানুষটিকে। আমাদের বারবার বললেন, "এটা তোমরা ভালো করলেনা রে বাবারা। ভগবানের নাম করছেন উনি। তাতে বাধা দেওয়া ঠিক কাজ নয়। তোমরা গিয়ে ওনাকে বুঝিয়ে বলো আওয়াজ কিছুটা কম করতে। কিন্তু কারোর ক্ষতি করা ঠিক কাজ নয়। তোমরা গিয়ে ওনার কাছে মাফ চেয়ে নেবে"।
আমাদের এলাকায় কুরবানির সময়ে মস্ত একটা উট আনা হতো। কুরবানির পরে মাংসের ভাগ আসতো ইমাম সাহেবের জন্য। সেই কুরবানির গোস্তের স্বাদ যেন স্বর্গীয়। আমাদের তখন কতোই বা বয়স! কেউ সতেরো আবার কেউ উনিশ। ঈদের লাচ্ছা, সিমুই, মাংস বা বিরিয়ানি তখনও অমৃতই মনে হতো। তারপরে আমরা বড়ো হতে লাগলাম আর ইমাম সাহেব আরো বুড়ো। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ চাকরি পেয়ে গেলো। কাল্টু পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে পৈতৃক রাজমিস্ত্রির কাজে লেগে পড়ল। আমিও হুট করেই একদিন চাকরিতে যোগ দিলাম। মিষ্টি নিয়ে গেলাম ইমাম সাহেবের কাছে। খুব বুড়ো হয়ে গেছেন মানুষটা। খুব কাশছেন। বললাম, "ডাক্তার দেখাবেন না?" মাথায় হাত বুলিয়ে উপরের দিকে আঙ্গুল তুলে বললেন,"আল্লা মালিক, আমি তাঁর বান্দা। মালিক তার মর্জিমতো সব সব ঠিক করে দেবেন বেটা। তু চিন্তা মৎ কর"। টিমটিম করে জ্বলা মসজিদ চত্তরের হলদে আলোটাকে কি আরো বেশি ম্লান মনে হচ্ছিল? কে জানে, হয়ত চোখের ভুল।
কালের নিয়মে একদিন বিয়ে করলাম। নতুন বৌকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছি। রাস্তায় দেখা লালি পিসির সঙ্গে। হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন বাড়িতে। দেখলাম কাল্টুদের বেড়ার ঘর পাকা হয়েছে, ছাদ হয়েছে। আমাদের দুজনকে বসিয়ে প্লেটে করে দুটি সন্দেশ আর জল দিলেন। তাকের ওপরের কৌটো থেকে একটা দোমড়ানো ময়লা কুড়ি টাকার নোট বার করে দিলেন আমায় বৌয়ের হাতে। বললেন, "বৌমা, কিছু কিনে খেও"। বৌকে নিয়ে গেলাম একদিন ইমাম সাহেবের ডেরায়। আমার স্ত্রীর মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন। হাতে তুলে দিলেন একটি দশ টাকার নোট। চলে আসবার সময়ে বৃদ্ধ মানুষটার চোখের কোনাটা কি চিকচিক করছিল।কে জানে, হয়ত চোখের ভুল হবে।
সেদিন ছিল আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি কোন এক শুক্রবার। কাল্টু এসে খবর দিল ইমাম সাহেবের অবস্থা খুব খারাপ। একবার দেখতে চাইছেন আমাকে। অফিস থেকে জাস্ট ফিরেছি। জামা প্যান্ট না ছেড়েই ছুটে গেলাম। কে জানে আমার জন্যই কি বেঁচে ছিলেন মানুষটা? বড় বড় চোখ মেলে তাকালেন একবার। তারপর চোখের তারা স্থির হয়ে গেল। দুফোঁটা জল গড়িয়ে এল চোখের কোল থেকে। মসজিদের পাশের পরিত্যক্ত কবরখানায় খানিকটা জায়গা সাফ করে ওনাকে কবর দেওয়া হলো। সকলের সাথে ওনার শেষ যাত্রায় সঙ্গী হয়েছিলাম আমিও। নাহ্, কেউ আমাদের মানা করতে আসেনি, কেউ বলেনি আমরা ভিন্ন ধর্মের। আমাদের বড় কাছের সেই মানুষটি চলে যাওয়ার সময়ে চোখের জল ফেলতে কেউ বাধা দেয়নি। কেউ ডেকে বলেনি তোমরা কাফের। আমরা তখন কতই বা, কেউ পঁচিশ আর কেউ বা সাতাশ।
কাল্টুর দাদা বড় যত্ন করে ইমাম সাহেবের কবরস্থান বাঁধিয়ে দিয়েছিল। ইমাম সাহেবের মৃত্যুর দিনে আমরা সকলে যেতাম সেখানে। বড় বড় গাছের ছায়ায় কবরটা ঢেকে আছে। পাতা খসে পড়েছে অনেক। সেগুলি হাত দিয়ে সরিয়ে কিছু ফুল রেখে আসতাম আমরা। গাছের পাতা খসে পড়ার টুপটাপ শব্দ। ইমাম সাহেবকে যেন ছুঁতে পারতাম আমরা। কাউকেই ডাকতে হতোনা আসার জন্য। সকলেরই যেন মনের ক্যালেন্ডারে দাগ দেওয়া থাকতো ইমাম সাহেবের চলে যাওয়ার দিনটা। আমরা তখন কেউ ত্রিশ আবার কেউ বা বত্রিশ।
ইমাম সাহেব চলে যাওয়ার পরে মসজিদের সাথে আত্মীয়তার সুতোটা যেন ছিঁড়ে গেছিল। বয়সের ছাপ পড়ছিল আমাদের সবার শরীরেই কম বা বেশি। এর মধ্যেই ছেলে জন্মালো। হাসপাতাল থেকে বাড়ি নিয়ে আসার পথে দেখি লালি পিসি দাঁড়িয়ে। ট্যাক্সিটা দাঁড় করাতেই ছুটে এলেন। আমাকে বললেন, "বাবা, একটু দাঁড়া। ঘর থেকে ছুটে নিয়ে এলেন এক শিশি জল আর একশ টাকার একটা নোট। নাতির মুখ দেখে নোটটি তিনি দিলেন আমার স্ত্রীর হাতে। আর জল ভরা শিশিটা দিয়ে বললেন, "বৌমা, এতে জমজমের পানি আছে। নাতির জন্য দিলাম। ওর শরীর খারাপ হবে না দেখো। পরে আমি গিয়ে একটা তাবিজ দিয়ে আসবো ওর জন্য।" লালি পিসির চোখ আনন্দে চকচক করছিল বলেই। মনে হচ্ছিল ওনার ঘরেই যেন নাতি এসেছে। আমাদের তখন কতোই বা বয়স, কেউ পঁয়ত্রিশ আবার কেউ সাঁইত্রিশ।
আমাদের সেই মসজিদ এখন ঝকমক করছে। দোতলা মার্বেল বসানো বিশাল আকারের। তার মিনারের মাথায় বাঁধা লাউডস্পিকার। উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা চারদিক। কবরস্থানটা পাঁচিলের বাইরে। সেখানে জঙ্গল আরো ঘন হয়েছে। ইমাম সাহেবের কবরের বেদীটা ফেটে একটা বড় গাছ বেরিয়েছে। কাল্টু এখন আর রাজমিস্ত্রির কাজ করেনা। সে এখন মস্ত প্রোমোটার। তিনতলা বাড়ি হয়েছে তার। লালি পিসি মারা গেছেন অনেকদিন। কাল্টুদের বাড়ির সামনে ওর অফিস। ঝাঁ চকচক করছে। বিশাল হোর্ডিং লাগানো অফিসের দেওয়ালে ..."মহম্মদ আব্বাসউদ্দিন। ডেভেলপার এণ্ড প্রোমোটার"। তার সাথে গোটা চারেক মোবাইল নাম্বার। বাতাসে কানাঘুষো ভাসে আগামী পৌরসভা নির্বাচনে দাঁড়াতে চলেছেন মহম্মদ আব্বাসউদ্দিন। আমরা এখন কেউ পঞ্চাশ কেউ বাহান্ন।
অফিস থেকে ফেরার পথে অটো থেকে নেমে মসজিদের সামনে দিয়ে আসছিলাম। সোডিয়াম ভেপারের আলোয় চারদিক দিনের আলোর মতো লাগছে। পাঁচিলের পাশের কবরস্থানও সেই আলোয় আলোকিত। লাউডস্পিকার থেকে ভেসে আসছে ঈদের শুভেচ্ছাবার্তা। খুশি উপচে পড়ছে চারিদিকে। আজকের তৌসিফ , আনোয়ার, জামালরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। মসজিদের দেয়ালে ইতিউতি লাল ছোপ পড়েছে। ইমাম সাহেবের কবর ফুঁড়ে একটা বিশাল কৃষ্ণচূড়া গাছ চারদিকে ডালপালা মেলে দিয়েছে। কতো ফুল ফুটে আছে গাছটায়। এত আনন্দের মাঝে আমি খুঁজে পাই না ছোটবেলার খেলার সাথী কাল্টুকে। ইমাম সাহেব , লালী পিসিরা তো কবেই হারিয়ে গেছেন। চোখের কোনাটা বারেবারেই ভিজে যাচ্ছে আমার। জানি ফিরবে না তবু কেন যে খুঁজি? একি চোখের দোষ না বয়সের রোগ, কে জানে!!