আমার শোয়ার ঘরের জানালাটা পূর্ব দিকে হওয়ায় শীতের সময় সূর্যের প্রথম আলোর ছটা পর্দার ফাঁক গলে আমার মুখে এসে পড়ে ঘুম ভাঙায়। আর্লি রাইজার আমি নই, তাই অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ি। আজ ঘুম ভাঙলো অসংখ্য পাখির কিচিরমিচির শব্দে। কলকাতার বাড়িতে কাকের ডাক শোনা যায় বটে কিন্তু নানা পাখির শিস শুনতে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। গায়ের থেকে কম্বল সরিয়ে মাটিতে পা দিয়েই বুঝলাম খুব ভুল হয়ে গেছে আর আমি আমার কলকাতার বাড়িতে নেই। ঝটপট মোজা আর হুডি গলিয়ে ফেলে বিছানা থেকে নেমে চটি পরে দরজা খুলে বাইরে বেরোলাম। ছবির মত ছোট্ট গ্রাম টা তখন সবে ঘুম ভেঙে আড়মোড়া ভাঙছে। ইতিউতি ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে, কাঠের চুলোয় আঁচ পড়েছে। আবছা একটা কুয়াশার আস্তরন গোটা গ্রাম টা জুড়ে, দূরে নেওরাভ্যালির নীলচে সবুজ পাহাড়।
আমার বড় সাধ, বুড়ো বয়েসে এরকম কোনো একটা গ্রামে এসে কাঠের বাড়ি করে থাকবো। যতদিন তা না হয় ততদিন জীবন দার মত অন্যের বাড়িই ভরসা। মজার ব্যাপার হলো এখানে এলে একবারের জন্যও মনে হয়না আমি আমার নিজের বাড়িতে নেই। গতকাল ঠিক সন্ধ্যে নামার মুখে এসে পৌঁছেচি সিকিম-পশ্চিমবঙ্গ বর্ডারের তাগাথাং' এ। প্রায় ৫০০০ ফিট উঁচুতে এই পাহাড়ে ঘেরা গ্রামটি। সব মিলিয়ে গোটা পঞ্চাশেক বাড়ি আছে। ছবির মত গ্রাম, মিষ্টি সব মানুষজন। গাড়ি থেকে নেমে ঘরে ঢুকবো, সামনে জীবন গিন্নি - আমাদের বৈনি দাঁড়িয়ে। চোখ পাকিয়ে বললো এত দেরী করে এলে, তোমাদের লাঞ্চ ঠাণ্ডা হয়ে গেলো যে। এনজেপি থেকে রংপো হয়ে আসার পথে রেনক এ অনেকটা সময় নষ্ট হয়েছে গাড়ি না পাওয়ার জন্য। তাতে আমরা দুপুরের বদলে সন্ধ্যা করে ফেলেছি হোমস্টে পৌঁছতে। অবশ্য সেটাই একমাত্র কারণ নয়। বহু দিন বাদে, হ্যাঁ বহু দিনই বলবো কারণ শেষ কবে এরকম নির্জন সৌন্দর্য্য পাহাড়ে ঢোকার মুখে পেয়েছি মনে করতে পারছিলাম না। আমাদের সারথি দীপকদা'কে রাস্তায় বার তিনেক বাধ্য করেছি গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমাদের ছবি তোলার সুযোগ করে দিতে। দীপক দাজু এক্স আর্মি, দারুন মজার ও মিশুকে মানুষ। আমাদের সব বায়নাক্কা হাসি মুখে সামলেছেন এটা বুঝে যে দুই পাহাড়পাগলের পাল্লায় উনি পড়েছেন এবার। যেখান থেকে পিতামচিন আর তাগাথাঙের রাস্তা ভাগ হয়েছে সেখানে দাঁড়িয়ে সামনের মেঘ নেমে আসা পাহাড় থেকে আমার ক্যামেরা ফেরার দিন সকাল অবধি জেগে ছিলো। সেই অনির্বচনীয় রূপ দু চোখে দেখার সাথে ক্যামেরা বন্দী না করলে যে বেড়ানো অসম্পূর্ণ থেকে যায়।