গত ১৪ই মে, ২০১৮ রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন 'কিছু বিচ্ছিন্ন হিংসাত্মক ঘটনা 'ছাড়া সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন হয়। সংবাদপত্রে পরদিন ১৫/০৫/১৮ তারিখ 'নিখোঁজ' প্রিসাইডিং অফিসার শ্রী রাজকুমার রায়ের কথা জানতে পারি, এবং তারও পরের দিন ১৬/০৫/১৮ তাঁর ভয়াবহ ত্রিখন্ডিত শরীর রেললাইনের পাশ থেকে উদ্ধার হয়। ভোটের দিন এবং পরদিনের ঘটনা বরং আমরা ১৯/০৫/১৮তে সোস্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত শাহীদুর রহমান, প্রধানশিক্ষক, রাহতপুর হাই মাদ্রাসা, রায়গঞ্জ , যেখানে প্রয়াত রাজকুমার রায় ইংরাজীর শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন, তার লেখাকেই উদ্ধৃত করে জেনে নিই -
"...গত ১৪/৫/১৮। তারিখে ইটাহার ব্লকের সোনারপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করছিল। সন্ধ্যা আটটা নাগাদ বাড়িতে ফোন করার জন্য বুথের বাইরে আসে। তার স্ত্রী কে বলে যে ভোট শেষ হতে ১০ টা - ১১টা হবে। তারপর আর কোনো যোগাযোগ নেই। আমার সহকর্মীরা খবর পেয়ে রাতে ইটাহার ব্লকের যান। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকদের সাথে যোগাযোগ করেন। কিন্তু তাঁদের কোনো তৎপরতা বা দায়বদ্ধতা দেখা যাইনি। অবশেষে পরের দিন সকালে মিসিং ডায়েরি করা হয়। তাকে অপহরণ করা হয়। অবশেষে তার ছিন্নভিন্ন দেহ রায়গঞ্জ স্টেশন থেকে দেড় কিমি পূর্বে রেল লাইনের উপর থেকে উদ্ধার করা হয়।"
খুব স্বাভাবিকভাবেইএকজন নির্বাচনী অফিসার যিনি ভোট কেন্দ্র থেকে অপহৃত হন ও পরবর্তীতে তার যে তিনখন্ড দেহাবশেষের ছবি সোস্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয় তা সমগ্র শিক্ষক সমাজের মধ্যে তীব্র আলোড়নের জন্ম দেয়। সাম্প্রতিক পঞ্চায়েত নির্বাচনে নিজেদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তাহীনতার বোধ তাদের সংগঠিত করে ও ক্রমপুঞ্জিত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হয় ১৬/০৫/১৮ রায়গঞ্জে জাতীয় সড়ক অবরোধ কর্মসূচীতে।
পঞ্চায়েত ভোটে ঘটে যাওয়া সন্ত্রাস, ভোটকর্মীদের নিরাপত্তার দাবী ও প্রিসাইডিং অফিসার রাজকুমার রায়ের মৃত্যুর প্রতিবাদে সেদিন ইসলামপুর, উঃ দিনাজপুরে গণহারে শিক্ষকদের কাউন্টিং ট্রেনিং বয়কট ও জাতীয় সড়ক - ৩১ অবরোধের সাড়ে দশঘন্টা পর জেলা প্রশাসন বিজ্ঞপ্তি জারী করে শিক্ষকদের গননাকার্য থেকে অব্যাহতি দেয়, কিন্তু তার আগেই ঘটে গিয়েছে এক চূড়ান্ত অনভিপ্রেত ঘটনা।
অবরোধস্হলে রায়গঞ্জ মহকুমাশাসক টি এন শেরপা, যিনি জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে অবরোধকারীদের সাথে আলোচনা করতে এসেছিলেন, রাজকুমার বাবুর আত্মহত্যার তত্ত্ব উপস্হাপন করেন। পরবর্তী ঘটনাক্রম প্রমাণ করে তিনি প্রশাসনিক মুখপত্র হিসেবেই পরিকল্পিতভাবে আত্মহত্যা তত্ত্বটি সামনে রাখেন ও ফলশ্রুতিতে শারীরিক নিগৃহীত হন বলে মিডিয়া জানায়। আগুনে ঘৃতাহূতি না হবার কোন যুক্তি সঙ্গত কারণ না থাকলেও সরকারী আধিকারিককে নিগ্রহ সমর্থনযোগ্য নয়, ঠিক যেমন উত্তেজিত জনতার সামনে আত্মহত্যা তত্ত্ব উপস্হাপন নিরপেক্ষ বিচারে নির্ভুলভাবেই উদ্দেশ্যপ্রনোদিত মনে হয়।
যদিও বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে, 'নিরপেক্ষ' এক ইউটোপিয়ান অবস্হান, যা শাসকের মতের পরিপন্হী তাই 'বিরোধীকন্ঠ', তাই তা দমন যুক্তিসঙ্গত তো বটেই! গত ১৯/০৫/১৮ , গননা ও ফলঘোষনা পরবর্তী সময়ে সংবাদপত্র প্রতিবেদনে ঠাঁই পায়ঃ
"...প্রিসাইডিং অফিসার মৃত্যুকাণ্ডে আন্দোলনকারী শিক্ষকদের হাতে শারীরিক নিগ্রহের শিকার হয়েছিলেন রায়গঞ্জ মহকুমাশাসক। মহকুমাশাসক টি এন শেরপা নিগ্রহের ঘটনায় শিক্ষকদের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা শুরু করল পুলিশ। পুলিশ ক্যামেরার ফুটেজ দেখে দোষী শিক্ষকদের চিহ্নিত করার কাজ শুরু করেছে। অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করতে জোর তল্লাশি শুরু করেছে রায়গঞ্জ থানার পুলিশ।
...
পুলিশসূত্রে জানা গিয়েছে, রায়গঞ্জ মহকুমাশাসক টি এন শেরপার অভিযোগের ভিত্তিতে সরকারি অফিসারকে শারীরিক হেনস্থা, কাজে বাঁধা, অবৈধ জমায়েত এবং অ্যাট্রোসিটি আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে।"
ঐ রাতেই শিক্ষক মনোজ ভৌমিক ও প্রদীপ সিনহাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ, জামিন অযোগ্য ধারায়। আগের দাবী ও দু'জন শিক্ষককে পুলিশ হেফাজতে নেবার প্রতিবাদে গত চব্বিশে মে কলকাতায় সম্পূর্ন অরাজনৈতিক ব্যানারে এক প্রতিবাদ মিছিলের আয়োজন হয়। অবিশ্বাস্য ভাবে এই মিছিলের রিপোর্ট করতে বঙ্গদেশীয় যেসব সংবাদমাধ্যম দাবী করেন যে তারা ‘এগিয়ে’ রাখেন, তাদের টিকিটিও দেখতে পাওয়া যায় না, হিরন্ময় নয়, তারা শিক্ষক অসন্তোষ, প্রতিবাদ, সব বিষয়েই হীরক নীরবতা বজায় রেখে চলে তাদের পক্ষপাতপূর্ণ অবস্হান স্পষ্ট করে দেন।
অভিনব পন্হা নেন শিক্ষকরা মিডিয়া শৈত্যের বিরোধিতায়। অন্য একটি তুলনামূলকভাবে কম প্রচারিত সংবাদ পত্রের উদ্ধৃতি বরং বিষয়টির নিপুণ ব্যাখ্যা দিতে পারে।
"...এমনও যে প্রতিবাদ আন্দোলন হতে পারে তা বড় বড় তথ্য প্রযুক্তি পন্ডিতেরও ধারনার অতীত। আর এবার প্রতিবাদের লক্ষ্যও অভিনব। মিডিয়া, মূলত সর্বাধিক প্রচারিত দুটি বাংলা নিউজ চ্যানেলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের ঝড় এবার আছড়ে পড়লো। রায়গঞ্জের শিক্ষক হত্যা, দুই শিক্ষকের গ্রেপ্তারী ও তার পরবর্তী শিক্ষক আন্দোলনের সংবাদ বাংলার প্রথম সারির নিউজ চ্যানেল ও খবরের কাগজগুলিতে সেভাবে পরিবেশিত হচ্ছে না বলেই মনে করছেন আন্দোলনকারী শিক্ষকরা। আর সেই ক্ষোভ থেকেই এই চ্যানেলগুলির ফেসবুক পেজ গুলিতে গণহারে ১টি তারা রেটিং হিসাবে দিতে শুরু করেন শিক্ষকরা। সর্বাধিক ৫টি তারা রেটিং হিসাবে দেওয়ার সুযোগ থাকলেও এর ফলে জনপ্রিয় নিউজ চ্যানেলগুলির গড় রেটিং কমতে থাকে। একটি চ্যানেলের রেটিং ৪ এর কাছাকাছি থেকে নেমে দাড়ায় ১.৭ অপর একটি চ্যানেলের গড় রেটিং নেমে দাড়ায় তিন এর কাছে। গতকাল দুপুরের পর থেকে টনক নড়ে এই মিডিয়া মালিকদের। তারাও তাদের সর্বশক্তি দিয়ে নেমে পড়েন ড্যামেজ কন্ট্রোলে। দিনের শেষে বহু চেষ্টা করেই প্রথম চ্যানেলটির রেটিং কোনরকমে ২ এর উপরে উঠেছে। কী এই রেটিং ? রেটিং কম বেশিতে কী লাভ বা ক্ষতি জানতে চাইলে কলকাতার এক তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ জানালেন আপাত দৃষ্টিতে কোম্পানিগুলো এই ব্যবস্থা রাখেন তাদের কাস্টোমার ফীডব্যাক নেওয়ার জন্য। একটি তারা রেটিং মানে তা খুবই অপছন্দের সংকেত। যেকোনো ব্যবসায় কাস্টোমার ফীডব্যাক সার্ভে করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এক্ষেত্রে শিক্ষকদের রাগ বা ক্ষোভ এর প্রতিফলন যে ফেসবুক পেজ এ রেটিং এ গিয়ে পড়বে তা কোম্পানির বড় বড় কর্তা বা তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদেরও মাথায় আসেনি। কী হতে পারে এর ফলে! তিনি জানালেন, বিভিন্ন বিজ্ঞাপন সংস্থা কিন্তু এই বিষয়গুলির উপর ধারাবাহিকভাবে নজর রাখে। ফলে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আয়ের ক্ষেত্রে একটা ক্ষতি হলেও হতে পারে বলেই মনে করছেন এই তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ। এদিকে ফেসবুকে আন্দোলনকারী শিক্ষকদের বিভিন্ন গ্রুপ গুলিতে নজর রাখলে দেখা যাচ্ছে আগামীতে নিউজ চ্যানেলগুলির টি আর পি কমানোর জন্য সংগঠিত উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে। সব মিলিয়ে প্রতিবাদের পদ্ধতি অভিনব। এর পথ আগামীতে কোন দিকে যায় সেদিকে কৌতুহল নিয়ে নজর রাখছেন তথ্যপ্রযুক্তি ও মিডিয়া বিশেষজ্ঞরা।"
ঘটনাক্রমে ফিরে আসি। আরও দেড়শো শিক্ষকের মধ্যে নাকি ভিডিও দেখে সত্তর জনকে সনাক্ত করা গেছে। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী জেলা প্রশাসন তাদের বেতন বন্ধ করেছে এবং তারা গ্রেফতারের অপেক্ষায়। রাজকুমারবাবুর পোলিং অফিসার বয়ান দেওয়ায় তিনি সহ আরও দুজন শিক্ষককেও অ্যারেস্ট করেছে পুলিশ, হেফাজতে নিয়েছে অপরাধীর মতো, অথচ প্রয়াত প্রিসাইডিং অফিসারের হত্যাকারীদের ধরবার কোনো তৎপরতা তো নেইই, বরং প্রশাসন আত্মহত্যার তত্ত্বে সীলমোহর লাগাতে ব্যস্ত!
এমতাবস্হায় সোশ্যাল মিডিয়ায় এক শিক্ষক গ্রুপে মতবিনিময়ের মাধ্যমে পুনরায় কলকাতায় এক প্রতিবাদমিছিল আয়োজন করা হয়েছে আবারও সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ব্যানারে, আগামী ২৮/০৫/১৮ তারিখ বেলা দেড়টায়। খবরটি ক্রমাগত চর্চা হতে থাকায় পাল্টা ‘খবর’ হচ্ছে সর্বোচ্চ প্রশাসনিক স্তর থেকে নাকি শিক্ষক গ্রেফতার বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সে খবরের যাথার্থ্য অবশ্য যাচাই করা যায়নি!
শিক্ষকসমাজের ত্রুটিবিচ্যুতি ফলাও করে প্রচার করে যে বাজারি সংবাদমাধ্যম, শিক্ষকসমাজের ন্যায়প্রতিষ্ঠা, নিরপেক্ষ তদন্ত, দোষীদের শাস্তি ও অনর্থক প্রতিহিংসামূলক হয়রানির বিরুদ্ধে লড়াই করতে তারা ঘণ্টাখানেক তো নয়ই, মিনিটখানেকের প্রচারের আলো ফেলতেও রাজি নয়!
আমরা আপোষ করেছি সমাজের নাগরিক তৈরির ক্ষেত্রে, তাই আজ এ লড়াই আমাদের ভবিতব্য। পিতৃহীন দুটি অবোধ শিশু তাদের পিতার হত্যাকারীদের উপযুক্ত শাস্তি পেতে দেখুক, বৃদ্ধ পিতামাতা, অসহায় স্ত্রী তাদের জন্যে সরকারী সর্বতো রকম সাহায্য পান প্রচ্ছন্ন শাসানি ছাড়াই, ভবিষ্যতে কোন ভোটকর্মী যেন নিরাপত্তাহীন হয়ে এমন অসময়ে চলে না যান সরকারি শাসনযন্ত্রকে সে ব্যবস্হা গ্রহণে উদ্যোগী করতে গেলে সমাজের সর্বস্তরীয় মানুষকে এ লড়াই নিয়ে জানানো প্রয়োজন।