বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ ধরে উশখুশ করছিল। নীল হাফহাতা শার্ট, কালো ফুলপ্যান্ট। ফোন এসেছিল দু’বার – যতদূর সম্ভব একই জায়গা থেকে। কথোপকথন অতি সংক্ষিপ্ত। এক প্রান্তের কথা শুনে অমিত আন্দাজ করেছিল যেন বাড়িতে কেউ খুব উদ্বিগ্নভাবে অপেক্ষা করে রয়েছে, আর এত দেরি হওয়ার হেতু জানতে চাইছে বারবার। নীলজামা দু’বারই যথেষ্ট ধৈর্যের সঙ্গে ও নরম গলায় বিলম্বের কারণ জানাল। আশ্বাস দিল আর বেশি দেরি হবে না, যদিও অপরপ্রান্ত তাতে বিশেষ নিশ্চিন্ত হয়েছে বলে মনে হল না। অন্তত অমিতের সেরকমই ধারণা। লোকটি এখন বারবার পকেট থেকে ফোন বের করে দেখছে। তৃতীয় ফোন হয়তো শীঘ্রই আসবে।
অমিত পকেট থেকে রুমাল বের করল। রোদের জোর বেশি নেই আজ তবে আর্দ্রতা ভয়ানক। অস্বস্তিসূচক অনেক উপরে উঠে গেছে। ঘর্মসিক্ত কপাল, গলা, ঘাড় মুছে পকেটে রুমালটা রাখতে গিয়ে তার খেয়াল হয় এটা দিয়েই কাল রাত্রে বাবাইয়ের কপালে জলপটি দেওয়া হয়েছিল। সারারাত ছিল জলপটি। অনিমা ঘুমোয়নি একটুও, ফলে চোখে কালির দাগ। ভোরের দিকে যখন জ্বর নামে অনিমা তখন কপাল থেকে পটিটা নামিয়ে বালিশের পাশে রাখে। অভ্যাসবশে অমিত সেটাই তুলে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে।
বাড়িতে কি আর রুমাল আছে - অমিত একটু ভাবে, এবং অচিরেই মন থেকে উত্তর আসে, না নেই। যদি ছেলেটার আবার জ্বর বাড়ে। ঘরে অন্য নানা কাপড় আছে নিশ্চয় – জলপটির অভাব হবে না। কী জানি কেন, তার মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে।
ধর্মঘট চলছে নাকি দাদা ?
অপেক্ষারত এক মাঝবয়সি ভদ্রলোক হাতের মধ্যভাগ দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলেন এবং কোন উত্তর না পেয়ে পাশের জনের দিকে তাকিয়ে বাক্যটা শেষ করলেন বিড়বিড়িয়ে।… কই পেপারে তো দেখলাম না।
প্রায় আধঘণ্টার মতো কেটে গেছে, বাস আসেনি একটাও। স্ট্যান্ডে ছোটোখাটো ভিড়।
আর পেপার ! এদের মশাই ইনস্ট্যান্ট ধর্মঘট। কিছু একটা ছুতো পেলেই হয়। পাঁচ মিনিটের মধ্যে সব বন্ধ। বিকেলের মধ্যেই মিছিল-ফিছিল। দেখুন কোথাও হয়তো ড্রাইভারকে পিটিয়ে দিয়েছে...
হাতে ব্যাগ দেখে মনে হল অফিসযাত্রী। মুখ গনগন করছে রাগে এবং উত্তপ্ত মুখমণ্ডলে একটুও ঘামের দেখা নেই। অমিত একটু আশ্চর্য হয়, কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয় তার ঘাম জমবে কী করে ! রাগের যা তাপ। সব বাষ্প হয়ে উড়ে যাচ্ছে। দারুণ কিছু একটা ব্যাখ্যা পেয়ে গেছে এই ভেবে নিয়ে মনে মনে খুশি হয় সে।
নীলজামার ফোন বেজে উঠল। অর্থাৎ তৃতীয়বারের জন্য।
হ্যাঁ, হ্যাঁ। নিয়ে আসবো। অত চিন্তার কী আছে বুঝি না।
......
না রে বাবা, ভুলিনি। রাখো তো !
বেশ বিরক্ত হয়ে ফোন কেটে দিল তারপর অমিতের দিকে তাকিয়ে অপ্রতিভের মতো হাসল। অমিত পাল্টা হাসি ফিরিয়ে দিতেই বিনীত কণ্ঠে প্রশ্ন এল ভেসে, কাছাকাছি কোথায় বেবিফুডের দোকান আছে বলতে পারেন? অতিষ্ঠ করে দিল একেবারে ! সেই থেকে খালি...
অমিতের মুখের হাসি চওড়া হয়। বাবাই তখন খুব ছোটো, মনে পড়ল তার, অফিস থেকে ফিরতে একটু দেরি হলেই অনিমা ফোন করে করে নাজেহাল করে তুলত। কখনও বেবি-সোপ ফুরিয়ে গেছে, কখনও জনসন পাউডার এক শিশি, বা ল্যাক্টোজেন। অভাবের সংসারে অনিমার নিজের কতটুকুই বা চাহিদা, যেটুকু ছিল তাও ছেলের জন্যই। বাবার কাছে শুনেছিল, মা’ও নাকি করত এরকম। এমনটাই হয়ে আসছে। হাসি ঝুলিয়ে সে বলে, ক’বছরের ?
সামনের মাসে অন্নপ্রাশন। এক হপ্তাও দেরি নেই – আর দেখুন না, তিনদিন ধরে জ্বরে কাহিল হয়ে পড়ে রয়েছে। কী আর বলি। ওষুধ কিনতে বেরিয়েছিলাম। সে দোকানও দেখি বন্ধ। সেরেলাকও শেষ। বাড়ি থেকে অস্থির করে দিচ্ছে।
বাবাইয়ের কথা মনে পড়ল। ওরও জ্বর দু’দিন ধরে। রাস্তার ওপারে একটা ভ্যারাইটি স্টোর আছে। ওখানে পেয়ে যাবেন। পাশ থেকে বললেন একজন। আকাশ একটু মেঘলা হল যেন।
সেরেলাক রাখে ?
রাখার তো কথা।
লোকটা এবার যেন একটু চিন্তামুক্ত। পকেটে ফোনটা রেখে রাস্তা পার হওয়ার জন্য প্রস্তুত হল। রাস্তা প্রায় যানবাহন-শূন্য। যাও বা একটা আধটা মাঝেসাঝে আসছে তা হয় মোটরবাইক বা প্রাইভেট কার। নীলজামা হাঁটা শুরু করে। হাঁটার ধরণটা অনেকটা বাবার মতন না ! অমিত দেখে চমকে গেল। ওইভাবে নীচের দিকে ঝুঁকে গভীর অভিনিবেশ সহকারে তলার পিচের ফাটল, স্থানে স্থানে জমে থাকা বালির ছোটো ছোটো স্তুপ, বা কাছাকাছি কোথা থেকে উড়ে আসা শুকনো পাতা দেখতে দেখতে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। রাস্তাখানি প্রশস্ত। দুপুরের রোদ পড়ে চিকচিক করছে কালো পিচ। অমিত একটা সিগারেট বের করল। রাস্তার মাঝামাঝি চলে এসেছে নীলজামা।
হঠাৎ একটা ঝড়ের মতো আওয়াজ। ম্যাচবক্সের উপরে দেশলাইটা ঘষতে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে অমিত দেখতে পেল, উল্টোদিক থেকে বিকট শব্দ-সহ নক্ষত্রবেগে আসা একটা ট্রাক তার আগমনের আকস্মিকতায় নীলজামাকে স্থাণুবৎ দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
মুহূর্তের কয়েক-ভগ্নাংশ মাত্র। অমিতের মুখ থেকে সিগারেটের খসে পড়া আর নীলজামাকে নির্বিকারভাবে পিষে দিয়ে সেই কালান্তক ট্র্যাকের তীরবেগে অন্তর্ধান এক সঙ্গে ঘটল প্রায়। অমিত চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল। কিছু দেখতে পায়নি সে, খালি একটা শব্দ শুনেছিল যা ছিল ভোঁতা অথচ প্রবল - তাতেই তার গোটা শরীর অসাড় হয়ে যায়। কিছুক্ষণ কাটে তারপর। ছেঁড়া ছেঁড়া কথা ভেসে আসে।
ইসসস !...... আরে ! যাব্বাবা ! একটা হর্ন দেবে তো ! একেই রং সাইড থেকে... জলজ্যান্ত লোকটা... দিনদুপুরেই মাল টেনে চুর, বুঝতে পারছেন না ! ... এই ট্রাক ড্রাইভারগুলো কি কাউকে আর মানুষ বলে ধরে ! ... বেঁচে আছে কি ?
একেবারে উপরে গিয়ে পড়ল তো। চান্স খুব কম... চলুন তো...
আন্দাজ এক মিনিট পর অমিত চোখ খুলে প্রথমেই দেখতে পেল পিচরাস্তার উপর দোমড়ানো সিগারেটটাকে, তারপর চোখ তুলে সেটাকে যারা দুমড়ে গেছে তাদের। বাসস্ট্যান্ডে কেউ নেই আর। রাস্তার মাঝামাঝি জটলা।
আমার যাওয়া কি উচিত ! অমিত ভাবে। তার হঠাৎ মনে হয় সে শেষ তিন বছর ধরে এই একটি কথাই ভেবে চলেছে যদিও কোনোবারেই কিছু স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছানো তার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। মা একসময় বলেছিল, নিজের বাবা তোর … এতদূর বলেই প্রায় কেঁদে ফেলেছিল তারপর কোনো রকমে কান্নার ঝোঁকটা সামলে চেপে শেষ করেছিল কথাটা, অন্তত শেষ দেখাটা দেখতে যাবি না অন্তু ! আর কিছু বলা হয়ে ওঠেনি। খালি ফুঁপিয়ে ওঠার আওয়াজ পেয়েছিল অমিত বারকয়েক। দেখার কি সত্যিই কিছু ছিল আর।
মাথাটার আর কিছু নেই মশাই। একেবারে পিচের সঙ্গে প্লেন করে দিয়ে চলে গেছে। হরিবল ব্যাপার। অত বড় চাকা। জটলা থেকে বেরিয়ে এসে জানালেন এক ভদ্রলোক। ... আপনি গেলেন না ?
অমিত সেবার যেতে চায়নি কিন্তু মা হাত ধরে নিয়ে গিয়েছিল। এবার গেল। রাস্তার মাঝামাঝি চিত হয়ে পড়ে আছে একটি দেহ। এখন আর জমার রঙ নীল নেই রক্তের সৌজন্যে। শরীরের নিম্নাংশ প্রায় অক্ষত কিন্তু কোমর থেকে উপর দিকে ক্রমশ মাথা তুলতে তুলতে পরতে পরতে শিউরে উঠতে লাগল অমিত। পেট থেকে বুক যেন রক্তের নদীতে ভাসমান একটি মাংসপিণ্ড। গলা থেকে শুরু করে গোটা মাথাটা পিচের সাথে মিশে গেছে।
লোহার পাঁচ টন একটা স্ল্যাব ত্রিশ ফুট উঁচু থেকে খুলে পড়েছিল নির্মলবাবুর মাথায়। উপুড় অবস্থায় প্রায় শুয়ে শুয়ে ফ্লোরের সূক্ষ্ম ফাটলগুলো সিমেন্ট দিয়ে ভরাট করছিলেন উনি। ফলে দেখতেও পাননি স্ল্যাবটা নেমে আসছে। জমাট রক্তে ফ্লোরের আর কোনও ফাটল ভরাট হতে বাকি ছিল না। নির্মলবাবুর মাথাও ফ্লোরের অংশ হয়ে কাছাকাছির ফাটলগুলো পূরণ করে দিয়েছিল। সত্যিই অমিতের আর কিছু দেখার ছিল না। কিন্তু তাও বিমলাদেবী নিয়ে গেছিলেন।
কালো প্যান্ট থেকে মোবাইলটা ছিটকে পড়েছে একপাশে, আরেক পাশে মানিব্যাগ। অমিত মানিব্যাগটা তুলে নিল। কেউ দেখল কি ?
দেখুন না মশাই, ভেতর নাম-ঠিকানাপত্তর কিছু আছে কিনা। একটা খবর তো দেওয়া দরকার।
দেখেছে। সাবধান হল অমিত। জটলা বাড়তে থাকে। আকাশে মেঘ করেছিল কিন্তু কেটে গেছে। শকুনের ওড়াওড়ি আরম্ভ হয়নি এখনও...
সাইরেনের আওয়াজ। পুলিশের গাড়ি আসছে দেখে ভিড়টা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। ফিসফাস শব্দে যা আলোচনা চলছিল সব বন্ধ। গাড়িটা দাঁড়াল ভিড়ের একটু আগে।
কী হয়েছিল একজ্যাক্টলি ? শরীরী ভাষা দেখে মনে হচ্ছে খুব তাড়া। ব্যাপারটা কম সময়ের মধ্যে মিটিয়ে দিতে হবে যেহেতু অন্য একটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজ অপেক্ষা করছে। সেরকমই ভাবভঙ্গি। ভিড় থেকে একজন বলে উঠল, রাস্তা ক্রস করছিলেন ভদ্রলোক। রং সাইড থেকে একটা ট্রাক...
হুম ! আর শোনার দরকার নেই তা বোঝা গেল। কেউ চেনেন ভদ্রলোককে ? প্রশ্ন শুনে ভিড় থেকে উত্তর এল না। নাম-ঠিকানা জানেন ?
‘খবর’-দিতে ইচ্ছুক সেই লোকটি তাকায় অমিতের দিকে। অমিত তখনও মানিব্যাগটা খুলে দেখেনি কিন্তু সে বুঝতে পারল না কখন তার অজান্তেই তার ঘাড় দুবার ঘুরে গিয়ে ‘না’ নির্দেশ করে দিয়েছে। বাকি ভিড় চুপ থাকে পূর্ববৎ।
নাম-ঠিকানাও নেই ? ফাইন। একসঙ্গে অনেকগুলি স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল। হাবিলদারটির উদ্দেশে হুকুম জারি হয় অতঃপর। এক্ষুনি গাড়ি ডাকো – বডিটা মর্গে নিয়ে চলে যাক। কুইক। আর জমাদার দিয়ে রাস্তাটা পরিষ্কার করিয়ে ফেলো। পাঁচ মিনিটের মধ্যে। হাবিলদারটি ছুটে বেরিয়ে গেল।
আপনারা জটলা করছেন কেন এখানে ? আমরা দেখে নিচ্ছি। ক্লিয়ার করুন, ক্লিয়ার করুন রাস্তা – গলা চড়তে থাকে অফিসারের। ভিড় আস্তে আস্তে পাতলা হতে লাগল। এক মিনিটের মধ্যেই সব ফাঁকা। ওয়াকিটকি যেন মুখে গুঁজে ফেলেন অফিসার। ... হ্যাঁ। এদিকে সব আন্ডার কন্ট্রোল... ট্র্যাফিক থেকে খবর পেয়েছিলাম... ডোন্ট ওরি স্যার... আনক্লেমড বডি, কেউ চেনে না... হ্যাঁ হ্যাঁ... সোজা মর্গে। কোনও চিন্তা নেই স্যার। সবাইকে হটিয়ে দিয়েছি... অল ক্লিয়ার... পাঁচ মিনিটের মধ্যেই কনভয় নিয়ে চলে আসতে পারেন... হ্যাঁ স্যার, বুঝি বুঝি। সিএমের ব্যাপার। মেজাজ একটু এদিকওদিক হলে আমরাই কখন আনক্লেমড বডি হয়ে পড়ে থাকব! কী বললেন... হাঃ হাঃ হাঃ...
পাঁচ মিনিট নয়, আধ ঘণ্টার মতো লাগল। জমাদার যখন রাস্তা থেকে রক্তের শেষ বিন্দুটি মুছে ফেলেছে, তখন অমিত বাড়ি থেকে প্রায় দেড় কিমি মতো দূরে। অনেকটা হাঁটা হয়েছে। আজ বাস চলবে না কারণ কিছুক্ষণের মধ্যেই মুখ্যমন্ত্রীর কনভয় যাবে এই রাস্তা ধরে। আধ ঘণ্টা আগের থেকে প্রাইভেট গাড়ির যাতায়াতও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফুটপাথের খোঁদলে পা পড়ল অমিতের এবং মুখ থেকে চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে এল একটা। গোড়ালির কাছে একটা ব্যথা, খুব পুরনো ব্যথা - বছর তেরোর পুরনো চোট। পায়ে পা জড়িয়ে পড়ে যাওয়ার অভিনয় করতে গিয়ে বেকায়দায় গোড়ালি মচকে গিয়েছিল। দলের হয়ে একটা পেনাল্টি আদায় হয়েছিল বটে, গোলটাও হয়েছিল কিন্তু ব্যথাটা ভুগিয়েছিল অনেকদিন। আজ দীর্ঘদিন পর আবার সেটা জানান দিয়েছে। গাছের তলায় একটা বেদীর মতন, সেখানে বসে পড়ল অমিত। একটু জিরিয়ে নেওয়া প্রয়োজন।
বসতে গিয়ে বাঁ’পকেটে ফুলে ওঠা মানিব্যাগটা অনুভব করল। কী আছে এর ভেতর? এটা খুব সম্বব যে ঠিকানা রয়েছে লোকটার। তাহলে কী করবে। ফেরত দিয়ে আসবে ? অন্য কেউ হলে কি ফেরত দিত ? ...তারাও ফেরত পায়নি। না, অনেক কিছু ভাবার রয়েছে। - লোকটার বাড়িতে অপেক্ষমান স্ত্রী। হয়তো বৃদ্ধ বাবা-মাও রয়েছেন। আছে একটি পুত্রসন্তান, এক সপ্তাহ পর যার অন্নপ্রাশন এবং তার জন্য সেরেলাক কিনে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। সবার মাঝে গিয়ে বলতে হবে খবরটা। নিজের অতীত থেকে সে জানে এইরকম খবরের অভিঘাতটা ঠিক কেমন হবে। এ তার পক্ষে সম্ভব না। তাহলে ? – পুলিশ ? নিজেই ফাঁসবে। দুর্ঘটনার পরে যখন পুলিশ গিয়েছিল ওখানে, তখনই কেন মানিব্যাগটা জমা করেনি, এটার সন্তোষজনক ব্যাখ্যা আছে কি তার কাছে ? বলতেও পারবে না যে, উপস্থিত অফিসরটি এসবে পাত্তাই দেয়নি, তিনি তখন বডি মর্গে পাচার করার তোড়জোড়েই ব্যস্ত ছিলেন। বললেও পুলিশে মেনে নেবে না। ঝঞ্ঝাট বাড়বে।
ভীত হাতে মানিব্যাগটা খুলে অমিত দেখল এবং আশ্বস্ত হল - ঠিকানা বলে কিছু নেই। নেই কোনও আইডি কার্ড, এমনকি ছবিও। বাবা-মা-স্ত্রী-পুত্র কারোরই না। থাকার মধ্যে খালি একখানি রশিদ আর একটা অস্পষ্ট পে-স্লিপ। রশিদটি মানিব্যাগ কেনার। তারিখ দেখে বুঝল অমিত, মানিব্যাগটা আজকেই কেনা। স্যালারি-স্লিপের অত্যন্ত অস্পষ্ট কার্বন কপি থেকে তারিখটি খালি পড়া যায় আর বিশেষ কিছু আবিষ্কৃত হয় না। স্লিপে নাম নেই কোনও। খালি রয়েছে কর্মচারীর সিরিয়াল নম্বর। কারা সেই বেতন দিয়েছে, সেটা কারখানা বা আপিস যাই হোক তাদের নাম বা ঠিকানা কিছুই পড়া যাচ্ছে না কার্বন কপিতে। খালি খুঁটিয়ে দেখে টাকার অঙ্কটা হালকা বোঝা গেল – সাতের পর তিনটে শূন্য। ওটা যে ‘স্যালারি’, সেটাও কষ্ট করে বুঝতে হল একেবারে নিচের লাইনের লেখাটা পড়ে। সবার নিচে হিজিবিজি একটা সই। নীলজামা আজকেই বেতন পেয়েছে - যার জন্য মানিব্যাগটি ফুলে ছিল। পাঁচশো, দু’হাজারের নোট, আরও কিছু খুচরো মিলিয়ে মোট নগদ ছ’হাজার আটশো ত্রিশ টাকা। সে মাইনে এখন তার কাছে।
এমন কিছুই সূত্র নেই অমিতের কাছে, যেটা ধরে সে এই টাকা-সহ ব্যাগটি ফিরিয়ে দিতে পারে নীলজামার বাড়িতে। এটা ভেবে সে একটু স্বস্তি পেল। কার্বনকপিতে কারখানা বা আপিসের ঠিকানা দুষ্পাঠ্য, মানিব্যাগের রশিদটা পড়া গেলেও সেটা কোনও কাজের না। দোকান থেকে রোজ হাজার হাজার লোক মানিব্যাগ কিনে নিয়ে যায়। তারা একটি বিশেষ খদ্দেরের নাম-ধাম জানবে এটা আশা করা বৃথা। নীলজামার আসল নামটাও জানে না সে। অর্থাৎ, এক সম্পূর্ণ অচেনা লোকের মাইনের প্রায় গোটা টাকাটাই এখন তার। ঠিক কী ভেবে তখন মানিব্যাগটা তুলে নিয়েছিল, সেটা এখন আর কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না অমিত। সে খালি দেখতে পেয়েছিল অনুরূপ আরেকটা মৃতদেহের ছবি। তার পাশে পড়ে ছিল একটা খাম এবং সেটা কেউ তুলে নিয়েছিল ফাঁকতালে এসে।গরম হাওয়ার স্রোত বইছিল চারপাশ থেকে।
এই দেখুন। আকাউন্টের নিখিলবাবু খাতা খুলে দেখিয়েছিলেন। উনি মাইনের টাকাটা রিসিভ করেছিলেন। এই যে সই।
বাবার সই ছিল তাতে। মাইনে নিয়েছিল বাবা। তারপর ডিপারচারে সই করে বেরিয়ে পড়েছিল।
নির্মলবাবু বেরিয়ে গেছিলেন সেদিন – দারোয়ান বলেছিল। কিন্তু গেটের বাইরে কিছু দূর যাওয়ার পরেই ভেতর থেকে কয়েকজন বন্ধু ডাকলেন যে ওনাকে। কী বলব আর। নিয়তির ডাক।
মধুবাবু, সেই ‘বন্ধু’দের মধ্যে একজন, জানিয়েছিলেন পরে যে, গ্রাউন্ড ফ্লোরের টাইলসগুলোতে খুব ছোটো ছোটো কিছু ফাটল দেখা যাচ্ছিল। বলেছিলেন -
...সামান্য সময়ের ব্যাপার। সিমেন্ট বানানোই ছিল। তাই নির্মলকে ডেকে নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম কতক্ষণই বা লাগবে। একদিন ফেলে রাখলে অনেকটা ড্যামেজ হবে – তাই ফ্যাক্টরি ছুটি হওয়ার পর...
ড্যামেজ অনেকটাই হয়েছিল। একদিন ফেলে রাখলে অতখানি হত না।
মানিব্যাগটা পকেটে পুরে আবার হাঁটা শুরু করে অমিত। বাড়ি তাড়াতাড়ি পৌঁছতে হবে। ছেলের জ্বর। এই একই কথা বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে নীলজামাও নিশ্চয় ভাবছিল। তারও বাড়িতে অপেক্ষা করছে অনিমা, নীলজামার বাড়িতেও অপেক্ষায় ছিল তার স্ত্রী।
উফফ !
এবং আরেকটা ফাটল। পায়ের সেই জায়গাটাই। ব্যথায় ককিয়ে উঠল অমিত আর তখনই মাথার মধ্যে ভেসে উঠল বিলুর মুখটা। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে বিলু। তার খালি পায়ের গোড়ালি মচকেছিল, বিলুর গিয়েছিল পাঁজরের একটা হাড়। অত গাঁট্টাগোঁট্টা ছেলেটা, একটা ম্যাচের পরেই ছ’মাস শয্যাগত। মারকুটে সব খেলোয়াড় নামিয়েছিল বাণী সঙ্ঘ। মিডফিল্ডে একজন কলকাতা থেকে ভাড়া করে আনা খেলোয়াড় – ফার্স্ট ডিভিসন ক্লাবে খেলত, খালি সে-ই এলোপাথাড়ি পা চালায়নি। বাকিদের কথা আর বলার না। খেলার শুরুর আধঘণ্টার নিয়মকানুন ছিল বড় সহজ সরল। বিপক্ষের যার পায়ে বল, তার পা লক্ষ করে লাথি চালাও। ভারতীর কেউ ভয়ে ওদের হাফে যেতেই পারছিল না, যারা যাচ্ছিল তারা কিছুক্ষণের মধ্যেই কেঁদে-ককিয়ে ফিরে আসছিল – দু’হাতে পা ধরে। রেফারি যে কী করছিল জানা নেই। বাস্তবিক, ওই ম্যাচগুলোতে রেফারি সারা ম্যাচ জুড়ে বাঁশি মুখে সঙের মতো দৌড়নো ছাড়া বিশেষ কিছুই করত না।
সবকিছু অমিতের চোখের সামনে ভাসছে। লিকলিকে সেন্ট্রাল ব্যাক বল নিয়ে তরতর করে উঠে এসেছে ভারতীর হাফে। সামনে অনেকখানি অরক্ষিত অঞ্চল। প্রচুর ছুটে পেনাল্টি বক্সের ঠিক আগে বিলু ধরে ফেলল তাকে। ছেলেটাকে গতিতে পরাস্ত করে ফেলেছে বিলু, সামনে থেকে ট্যাকল যেই করতে যাবে – ছেলেটা বিলুর বুকে কনুই দিয়ে প্রকান্ড এক গুঁতো মেরে বিলুর উপরেই পড়ে ওকে জড়িয়ে এক পাক ঘুরে নিল। রেফারি দূরে, কাছে যখন এল তখন দুজনই মাটিতে শুয়ে। কে কাকে ফাউল করেছে অত দূর থেকে কেউ দেখতে পায়নি। অতঃপর এই টুর্নামেন্টগুলিতে যেভাবে রেফারি এসব ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন এখানেও তাই প্রযোজ্য হল। বিলু এবং সেন্ট্রাল ব্যাকের মধ্যে যে বেশি ষণ্ডা, সিদ্ধান্ত হয়, সেই ফাউল করেছে। ফলত বাণীসঙ্ঘ পেনাল্টি পায় এবং গোল করে লিড নিয়ে ফেলে। বিলুর আর খেলার মতো অবস্থা ছিল না, সাবস্টিটিউট নামাতে হয়েছিল।
নীলু দেখেছিল গোটা ঘটনাটা। নীলু, ভারতীর গোলকিপার- বিলুর ভাই। গোল হওয়ার পরেই অমিতকে ডেকে বলে আসলে কী হয়েছিল। অমিত ফুঁসে উঠেছিল।
দেখে নেব।
এই ‘দেখে নেব’ কথাটি অমিত অজস্রবার শুনেছে। সবচেয়ে বেশিবার মায়ের কাছ থেকে। মা যাদের প্রথম এই দুটি কথা বলেছিলেন, তারা অবশ্য কেউ কথাগুলিতে পাত্তা দেয়নি বরং কাঁধ ঝাঁকিয়ে দরজা দেখিয়ে দিয়েছিল। অথচ মিনিট পনের আগে তাদের আচরণ ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। নিজেরা গাড়ি পাঠিয়ে বিমলাদেবীকে নিয়ে এসেছিল। ডেকেছিল অফিসঘরে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলার ছিল। বাবার মৃত্যুর পর বছরখানেক কেটে গেছে। সংসারের ছোটো ভেলাখানি মাঝনদীতে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছিল। বিমলাদেবীরও বলার ছিল অনেক কিছুই। যেমন -
আমার স্বামী আপনাদের ফ্যাক্টরিতে কর্মরত অবস্থায় দুর্ঘটনায় মারা গেছেন...
হ্যাঁ, বিমলাদেবী। আমরা খুবই দুঃখিত...
আপনাদের কন্ট্রাক্টে লেখা ছিল এসব ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্ক সন্তান পিতার চাকরি পাবে। অথচ এক বছর পেরোতে চলল – আপনারা এখনও কিছু...
আপনি ভুল করছেন। উনি ফ্যাক্টরির মধ্যেই মারা যান সেটা সত্যি। কিন্তু ওনার ডিউটি আওয়ার পেরিয়ে গেছিল। উনি তখন অন ডিউটি ছিলেন না। আমাদের কন্ট্রাক্টে স্পষ্ট করে ‘অন ডিউটি’ -এই দুটি কথা লেখা ছিল...
মানে !
আমরা দেখেছি, ডিপারচারে ওনার সই ছিল। অর্থাৎ উনি আর সেদিন ফ্যাক্টরির কাজে ছিলেন না। ওই সইয়ের পর, ওই দিনে ওনার সাথে যা যা ঘটবে – আমাদের কোম্পানি তার জন্য কোনওভাবেই দায়ী থাকবে না।
কিন্তু উনি তো ফ্যাক্টরির কাজেই ফিরে এসেছিলেন। কয়েকজন সহকর্মীর কথায় গেট থেকে বেরিয়েও চলে আসেন, ফ্লোরের সিমেন্টিং করতে – দারোয়ান জানে। ডাকুন ওনাকে... আমি ডাকবো ?
উত্তেজিত হবেন না। ওসব আনঅফিসিয়াল স্টেটমেন্ট। ধরা হয় না। কে কী বলল তার চেয়েও বড় প্রমাণ হচ্ছে ওনার সই। উনি ডিপারচারে সই করেছিলেন – ব্যাস। ওই সইয়ের পর উনি সেদিন ফারদার ফ্যাক্টরিতে এসে কী করছিলেন, ওনার সাথে কী কী হয়েছে – সেসব, আমি খুব দুঃখের সাথেই বলছি – সেসবে আমাদের কোনও দায় নেই...
দায় নেই ?
উই আর এক্সট্রিমলি সরি, মিসেস সরকার, টু সে দ্যাট, নেই।
বিমলাদেবী এরপর পাগলের মতো হয়ে যান। উদভ্রান্ত, দিশেহারা। বিড়বিড় করে বলেন, সে মাসের মাইনের টাকাটাও...
হ্যাঁ। কিন্তু স্যালারি উনি রিসিভ করেছিলেন। ওটারও সই আছে। বডি উদ্ধারের পর মাইনের খামটা মিসিং ছিল সেটার রিপোর্টও আমরা পেয়েছি। কিন্তু, আবার, বুঝতেই পারছেন, ওতেও আমাদের কিছু করার নেই – কারণ...
বিমলাদেবী আর নিজের মধ্যে ছিলেন না। দ্রুত নিঃশ্বাস পড়ছিল, চোখ লাল হয়ে এসেছিল তাঁর। উঠে পড়েছিলেন চেয়ার ছেড়ে। ঠাণ্ডা গলায়, সাপের মতো স্বরে খালি বলেছিলেন,
দেখে নেব! আমি দেখে নেব আপনাদের।
মিসেস সরকার, আমাদের প্রস্তাবটা শুনুন...
দেখে নেব!
আর দেখে নেওয়া হয়নি, এবং সেই দিন থেকে বিমলাদেবীর মুখে এইদুটি বাদে আর অন্য কোনও কথা কেউ শোনেনি। অফিস থেকে গাড়ি করে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গেছিল। গাড়ি থেকে নামার সময় ড্রাইভারকেও তিনি ওই একই কথা বললেন ।
পায়ের ব্যথা কিছুটা কমেছে। অমিত দেখে পাড়ার লাইব্রেরি চলে এসেছে, অর্থাৎ মিনিট দশেক মোটে আর। নিলয়বাবু, যিনি লাইব্রেরিয়ান ছিলেন, মাসদুয়েক আগে রিটায়ার করেছেন। এখন অমিত কাজ চালায়। নিলয়বাবুর আন্তরিক চেষ্টায় ওখানে একটা কাজ জুটেছিল অমিতের। প্রথমে টেম্পোরারি, এক বছর পর হয় পার্মানেন্ট। সামান্য বেতন কিন্তু তাও একটা নিয়মিত উপার্জনের উৎস ডুবন্ত সংসারটায় খড়কুটো-স্বরূপ হয়ে উঠল। বিমলদেবী এখন পাবলভে। অমিত প্রতি সপ্তাহে দু’বার মায়ের সঙ্গে দেখা করে আসে। মা কিছু বলে না আর। চুপচাপ্ নীচের দিকে তাকিয়ে থাকে, কদাচিৎ মুখ তোলে। খালি বাবাইয়ের জন্মের খবরটা যখন জানিয়েছিল, মা চোখ তুলে চেয়েছিল একবার। আর বলেছিল...
অমিত অবশ্য ঠিকই দেখে নিয়েছিল খেলার মাঠে। টার্গেট করে রেখেছিল ওদের ষণ্ডা ডিফেন্ডারটাকে। অনিল। চোরাগোপ্তা মার অমিতের স্পেশাল পেপার। ঠিক জায়গায় সময়মতো একটি নিপুন লাথি চালাতে পারলে যত ষণ্ডা আর গাঁট্টাগোট্টা হোক না কেন – ভূমিশয্যা নেবে, এটা ও ভালোই জানত। আরও জানত, লাথি মারার পরেপরেই একসাথে জড়াজড়ি করে শুয়ে পড়তে পারলে চেহারার তুলনামূলক বিচার শেষে রেফারির বাঁশি তাদের পক্ষে বেজে উঠবে।
অমিত বল পায়ে পেয়েই বাঁ দিক ধরে ছুটতে থাকে। ফাঁকা জায়গা অনেকটা, আর ওদিকেই রয়েছে অনিল। কেউ বিশেষ আটকাতে আসেনি অমিতকে – একটা গোল পেয়ে বাণীসঙ্ঘ যেন বেশ কিছুটা আলগা ছেড়ে দিয়েছিল। পেনাল্টি বক্সের মধ্যে যখন ঢুকে পড়েছে সে, তখন অনিলের সম্বিৎ ফিরল। ষাঁড়ের মতো তেড়ে এল অমিতের দিকে। অমিত এটারই অপেক্ষায় ছিল। অনিল যেই হাফ ফুটের মতো ব্যবধানে এসেছে, পায়ের গোছা লক্ষ্য করে একটি মোক্ষম লাথি। কাটা কলাগাছের মতো যখন পড়ে যাচ্ছে অনিল, পায়ে পা জড়িয়ে একসঙ্গে মাটি নিল অমিত নিজেও। রেফারি ছুটে এল। একবার তাকাল অমিতের দিকে, একবার অনিলের দিকে। তারপর বাঁশি বেজে উঠল। ভারতী পেনাল্টি পেল। খেলায় সমতা ফিরেছিল।
চোটটা পেয়েছিল অমিত তখনই। সেই তার চোট পাওয়ার শুরু। তার দশ বছর পর মা যখন হাত ধরে ঠাণ্ডা ঘরে নিয়ে যায় সেখানে সে পায় দ্বিতীয় চোট।
প্রায় চলেই এসেছে। সামনের বাঁকটা ঘুরলেই প্রথম বাড়িটা। ব্যথাটা আবার বাড়ছে। একটু বসে নেবে ? নাহ ! একেবারে বাড়ি ঢুকে তারপরেই বিশ্রাম। ছেলেটা কেমন আছে কে জানে। জ্বর আসেনি তো আবার!
অমিত ভেবেছিল কেউ দেখেনি। কিন্তু দেখেছিল একজন। নিতাইস্যার। গেমটিচার। হাফটাইমের সময় মুচকি হেসে বলেছিলেন, শোধবোধ হয়ে গেছে। এবার অনেস্টলি খেলো। অমিত লজ্জায় ঘাড় নেড়েছিল। নিতাইবাবু বলেছিলেন, প্রমিস ? অমিত প্রমিস করে।
কড়া হাতে পকেটের মানিব্যাগটা চেপে ধরে অমিত। বাবার মাইনের খাম পাওয়া যায়নি। শোধবোধ কি হয়ে এল ? এবার কি অনেস্টলি খেলা ?
কিন্তু কীসেরই বা শোধবোধ ? নিজের মনে প্রশ্ন জাগে অমিতের। আর অনেস্টলি খেলা ? সেদিনটার কথা মনে পড়ে। সেদিন তারপরেও কি অনেস্টলি খেলেছিল সে। চোরাগোপ্তা মার একটা নেশার মতো পেয়ে বসেছিল। একটা সফল হয়েছে, তাই ইচ্ছে হল আরেকবার। খেলা সেকেন্ড হাফের মাঝামাঝি। কলকাতার মিডফিল্ড হরিণের মতো ছুটে আসছিল বল নিয়ে, মাঝমাঠ পেরোনোর পরেই পাস দিল সেন্টার ফরোয়ার্ডকে। নিজে ভেতরে ঢুকে গেল। সেন্টার ফরোয়ার্ড থ্রু বাড়িয়েছে, অমিত মিডফিল্ডের গায়ের সাথে সেঁটে ছিল একেবারে। বল একটা ড্রপ খেয়ে মিডফিল্ডের হাঁটুর উচ্চতায় উঠেছে – অমিত দেখল এই সুযোগ। পা তুলে হাঁটুর জয়েন্ট টিপ করে তীরের মতো একটি লাথি চালাল।
বাবাইয়ের জ্বরটা আবার বেড়েছে। বাড়ি ঢোকা মাত্র অনিমা জানায়।
কখন থেকে ? ঘুমন্ত ছেলের কপালে হাত দিয়ে অমিত বলে। হাতে ছ্যাঁকা লাগে যেন।
দুপুর থেকেই। জলপটি দিয়েছিলাম, একটুও নামেনি। তোমার এত দেরি হল যে ?
থার্মোমিটারটা ঘুমন্ত ছেলের মুখে দিয়ে অমিত বলল, বাস ছিল না। মুখ্যমন্ত্রীর জমায়েত। অ্যাকসিডেন্টের কথাটা বলতে ইচ্ছা করল না তার।
ওষুধগুলো এনেছ ?
ইস ! একেবারেই ভুলে গেছে অমিত। অ্যাকসিডেন্টের চক্করে আর পুরনো সব দিনের চিন্তায় কথাটা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। থার্মোমিটার বের করে দেখল। একশো তিন।
ভুলে গেছি একদম ! ভেবেছিলাম বইগুলো জমা দিয়ে ফেরার পথে কিনে নেব। দাঁড়াও, এক্ষুনি নিয়ে আসি। জ্বরটা খুব উঠেছে। অমিত উঠে পড়ে।
দাঁড়াও- অনিমা ডাকে। কী ?
ইতস্তত করতে থাকে অনিমা। গলার স্বর নামিয়ে বলে, অনেক দাম কিন্তু। টাকা আছে ? নাকি আলমারি থেকে...
পকেটে হাত দিয়ে মানিব্যাগটা অনুভব করে অমিত। শোধবোধ পুরোপুরি হোক। তারপর অনেস্টলি খেলা।
না। আছে টাকা।
রোদ পড়ে এসেছে। কর্পোরেশন থেকে জলের গাড়ি রাস্তায় জল ছিটিয়ে গেছে, সেজন্যে রাস্তা থেকে একটা ঠাণ্ডা-গরম মেশানো ভাপ উঠে আসছে। পায়ের ব্যথাটা আর তেমন টের পাচ্ছে না অমিত। আস্তে আস্তে হেঁটে চলল মোড়ের দিকে। মোড়ের মাথাতেই একটা ফার্মেসির দোকান। ব্যথাটার জন্যেও একটা মলম দরকার। কখন যে আবার ফিরে আসবে কে জানে !
যদিও গোড়ালির ব্যথা, তবুও পা চালিয়েছিল সেদিন আর তারপরেই বুঝে গিয়েছিল গোলমাল হয়েছে একটা। পা হাওয়ায় এক পাক খেয়ে ঘুরে চলে এসেছিল – হাঁটু খুঁজে পায়নি। মিডফিল্ড কোনো এক অজানা কৌশলে নিজের হাঁটু বাঁচিয়ে বল নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল, এবং গোল দিয়েছিল।
মোড়ের মাথা থেকে সমস্বরে চিৎকারের আওয়াজ। চিৎকারটা ক্রমশ আর্তনাদে পরিণত হয়ে একসময় মিলিয়ে গেল। অমিত হাঁটার জোর বাড়াল। কী হল আবার ?
উল্লাস, চিৎকার সবকিছুর মধ্যে অমিতের দুটি চোখ খুঁজছিল একজনকেই। পা চালানোটা স্যার দেখতে পেয়েছেন কি ! না, অনেক দূরে। যাক ! অত্যন্ত শ্রদ্ধা করত অমিত লোকটিকে। অত দূর থেকে স্যার নিশ্চয় বুঝতে পারেননি অমিত কী করেছে। কিন্তু উদ্যত লাথিটা মিডফিল্ডের হাঁটুতে গিয়ে পড়লে মিডফিল্ড তৎক্ষণাৎ শয্যা নিত, আর ব্যাপারটা উনি ঠিকই ধরে ফেলতেন। তারপর স্যারের চোখে কী ঝরত সে অমিত জানে – হয়তো কোনও দিনই আর অমিতের সাথে কথা বলতেন না উনি। সারাজীবন একটি লোকের ঘৃণার পাত্র হয়ে থাকতে হত অমিতকে। সারা ম্যাচ আর বাড়াবাড়ি করেনি সে।
ম্যাচ হেরেছিল ভারতী। ম্যাচের শেষে নিতাইস্যার বলেছিলেন, থ্যাঙ্ক ইউ। আর অমিত ধন্যবাদ দিয়েছিল নিজের ভাগ্যকে। ভাগ্যিস লাথিটা হাঁটুতে গিয়ে লাগেনি !
মোড়ের কাছে ভিড়। জনাবিশেক লোক গোল করে দাঁড়িয়ে। কৌতূহলবশত এগিয়ে গেল অমিত। মনে হল দুপুর ফিরে এসেছে আবার। হালকা হালকা কিছু কথা যা ভেসে আসতে থাকে, তা অমিতের খুবই পরিচিত লাগে, কারণ আজ কিছুক্ষণ আগেই শুনেছে এরকম কিছু যেন...
রক্ত বেরোয়নি একটুও, দেখছ ? ... কেমন ফুলে গেছে মাথার পেছনটা।...আসল আঘাত তো ভেতরে। ওতেই শেষ। রক্ত নাই পড়ুক। ... পালস নেই। স্পট ডেড মনে হয়। রডটা সোজা এসে মাথার পেছনে হিট করেছে।… এসব ব্রেন-ট্রেনের ব্যাপার খুব সিরিয়াস।
অমিত নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। ঘোর লাগে তার মাথায়।
দ্রুত হাতে ভিড় ঠেলে এগিয়ে দেখে ফাঁকা জায়গায় এসে দেখে উপুড় হয়ে পড়ে আছেন এক ধুতি পরা ভদ্রলোক। মাথার পেছনটা ফুলে রয়েছে। শরীর থেকে একটু ইঞ্চিখানেক দূরে পড়ে আছে একটি হৃষ্টপুষ্ট লোহার রড। উপর দিকে তাকাল অমিত। সামনের নির্মীয়মাণ বাড়ির সবার উপরের তলাটা থেকে অব্যর্থ টিপ নিয়ে পড়েছে। ত্রিশ ফুট উঁচু হবে। বাবাও এভাবেই পড়ে ছিল। সে মানসচক্ষে দেখতে পায়। আরও দেখতে পায় মাইনের খামটা পড়ে আছে মেঝেতে। কেউ তুলে নেওয়ার আগেই কুড়িয়ে ফেলতে হবে।
কিন্তু চারপাশে কোথাও মানিব্যাগ পড়ে নেই।
বাবা খামটা রাখত পেছনের পকেটে। ফ্যাক্টরি থেকে ফিরেই মায়ের হাতে তুলে দিত।
ম-মরে গেছে ?
এটুকু জানার ছিল অমিতের, কিন্তু কেউ উত্তর দেয় না।
মরে গেছে ?
আর্তনাদ করে উঠল অমিত। কিন্তু তাও উত্তর নেই।
এরপর অমিতের পাগল হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। সে বুঝে গেছে মানিব্যাগটা বাবার পকেটে আছে এখনও, আর লোকগুলো ভিড় জমিয়েছে সেটা হাতিয়ে নেওয়ার মতলবেই। লোকটাকে ঘিরে বসেছিল যে দু-তিনজন লোক তাদের মধ্যে মিশে গেল অমিত। তাকালো একবার তাদের দিকে আর মুচকি হাসল। তোমাদের আর আমার মতলব একই, খালি আমার নেওয়ার অধিকার আছে, আর তোমরা যা করছ সেটাকে বলে চুরি। অদক্ষ হাতে নাড়ি পরীক্ষা করল। খুঁজে পেল না। শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে না। হার্টবিট দেখার ছলে লোকটির বুকপকেট হাতড়ে নিল একবার। কিছু নেই। না হার্টবিট, না মানিব্যাগ। এরপর তার সাবধানী হাত খুব সন্তর্পণে লোকটির সারা শরীরের তল্লাশি নিতে থাকল, চোরাগোপ্তা মার সত্যিই একটা নেশা, কিন্তু সুদীর্ঘ সন্ধানের পরেও কোনও মানিব্যাগের স্পর্শ পেল না। যেভাবে তার উদ্ধত গোড়ালি খুঁজে পায়নি মিডফিল্ডের হাঁটু। মিনিট পাঁচেক পর অমিতের মানুষিক অনুভূতি ফিরে এল এবং সে সিদ্ধান্তে এল তার আসার আগেই অন্য কেউ মানিব্যাগ নিয়ে নিয়েছে।
নিক গে। একটা তো আছেই।
চারধার দেখল অমিত। কেউ সন্দেহ করেনি এবং… নাহ ! বাবাও অনেক দূরে। অনেকটাই। দেখতে পেয়েছে কি ? না পাওয়ারই কথা। অমিত নিজেকে আশ্বস্ত করে। মানিব্যাগ পেয়ে গেলে নিশ্চয় দেখতে পেত। অমিত পায়নি, তাই খেলাটা অনেস্ট থাকল। কিন্তু সত্যিই কি?
ভিড়ের জিজ্ঞাসু চোখগুলোকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে বেরিয়ে এল সে। বিকেলের হাওয়া বইছে। বিকাশের কথা মনে এল তার। ওদের ক্যাপ্টেন। প্রথম গোলটা খাওয়ার পর মুখ যন্ত্রণায় নীল হয়ে গিয়েছিল।
শুরুতেই পিছিয়ে গেলাম রে ! আর জেতা হল না।
তারপর শোধবোধ হয়েছিল। বাকিটা সৎভাবে খেলার ইতিহাস।
মোড়ের মাথা থেকে একটু এগিয়ে গেলেই ছোটো দিঘি। পেটমোটা মানিব্যাগটা পকেট থেকে বের করল অমিত। তাকাল জলের দিকে।
কুব্।
দিঘির ওপার থেকে একটা ঢিল এসে পড়ল জলের ভেতর। তারপর মিলিয়ে গেল সলিলগর্ভে। একটা বাচ্চাছেলের ছায়া সরে গেল, যেটা দেখে অমিতের এক মুহূর্তের জন্যে মনে হল বাবাই। পরক্ষণেই ভুল ভাঙল, মনে পড়ল বাবাইয়ের খুব জ্বর, শয্যাগত। তার ওষুধ কিনতেই বেরিয়েছে সে।
হাতে একটা খাম। না তো ! খাম নয়। মানিব্যাগ। অমিত চোখ কচলে নিল। সামনেই দেখা যায় ওষুধের দোকান।