হারবার্টের পরে নবারুণ ভট্টাচার্যের আর কোনো লেখা সে ভাবে টানে নি আমাকে। আসলে একটা ভঙ্গুর গোলক নিয়ে সমস্তদিন লোফালুফি তো - ডান হাত থেকে বাঁ হাত, বাঁ থেকে ডান - খুব সাবধানে সারাদিন - পড়ে গেলেই ভেঙে চুরচুর হয়ে যাবে গোলক, অভ্যন্তর থেকে বেরিয়ে আসবে এ যাবৎ জমাট বাঁধা কুয়াশা, মেঘ, জলকণা - ঘিরে নেবে চারদিক - এই আকাশ, এই গাছপালা, এই সব রাস্তাঘাট। অনন্ত কুয়াশায় পাকদন্ডীতে দাঁড়িয়ে থাকব আমি। সামনে খাদ। নাম পরবাস।
এই সব কুয়াশায় ফ্যান্টাসি খুব জরুরী ছিল। অথচ ফ্যাতাড়ুরা আমাকে টানে নি সেভাবে। সমস্যা হয়েছে পড়তে গিয়ে। নবারুণ বলেছিলেন, তথাকথিত প্রান্তিক মানুষের বেঁচে থাকায়, যাপনে কার্নিভাল দেখেছেন, সেই উদযাপনই ধরতে চেয়েছেন লেখায়। আমি জানি ফ্যান্টাসি বিনা কার্নিভাল হয় না আর বাস্তবের কার্নিভালকে ধরতে গেলে বাস্তবের সীমা তো টপকাতেই হয়। অথচ ফ্যাতাড়ুদের গল্পে একটা প্যাটার্ন পাই আর কার্নিভালে প্যাটার্ন থাকাটা আমাকে সমস্যায় ফেলত।
কিন্তু এই খাদের ধারে এই কুয়াশায় হারবার্ট ছিল। হারবার্ট ছিল বরাবর।
আমার হারবার্ট পাঠে বিস্ফোরণ ও তৎ সংক্রান্ত দর্শনে চমক ছিল, কিন্তু আকর্ষণ ছিল না। বরং একাধিকবার ফিরে যাওয়া ছিল শেষ পরিচ্ছেদে। নবম পরিচ্ছেদ শেষ লাইন ছিল "কখন কীভাবে বিস্ফোরণ ঘটবে এবং কে তা ঘটাবে সে সম্বন্ধে জানতে রাষ্ট্রযন্ত্রের এখনও বাকি আছে।" পাতা ওল্টাতেই - "বৃথা আসি, বৃথা যাই / কিছুই উদ্দেশ্য নাই"। অন্ততঃ দুটি লাইনে আছে -'এরকম তো হয়েই থাকে / সেরকম হওয়ারই কথা'। লেখা শেষ হয় এইভাবে - 'ফ্লপ ছবিতে পিকচার নেই, কেবলই সাউন্ড। তাও কমতে কমতে অস্ফুট উচ্চারণ যা প্রায় শোনাই যায় না, ক্যাট ব্যাট ওয়াটার ফিশ....' ।
হারবার্টের দাহ শেষে শ্মশান ফেরতা পরদিনের ভোরের কুয়াশায় এরকমই তো ভাবার কথা আমার মত সাধারণ পাঠকের। অথচ হারবার্ট যতদিন বেঁচে ছিল,এই লাইনগুলি আসেই নি। চিলছাদে তুবড়ির খোল ফেটে ছিল, মেঘ ডেকেছিল, শিল পড়েছিল,আর বাজ-অথচ কেউ বলে নি 'ভোরের কুয়াশায় চিলছাদ বড়ই অস্প্ষ্ট ও অবুঝ।' কিন্তু শেষ পাতায় এরকমই লেখা ছিল।
আমি লিখি না, টিখি। আপিস করি, টিখি, ঘরদোর পরিষ্কার করি, ফুলকপিতে ফোড়ন দি, ঋতু গুহ শুনতে শুনতে ইস্ত্রি করি - আমার মত যাদের 'জগতে আনন্দ যজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ' বিশ্বাস করে বেঁচে থাকার ট্রেনিং, তাদের একটা বড় সংকট সৃষ্টি হয় 'টিখতে' গিয়ে। এই ট্রেনিংএ আমরা চিলছাদে আসি নি কখনও। খোড়ো রবিকে এড়িয়ে চলেছি, 'মৃতের সহিত কথোপকথন' লেখা সাইনবোর্ড দেখলে শাড়ির কুঁচি আলগোছে তুলে জলকাদা বাঁচিয়ে উল্টো ফুটে গিয়ে ট্যাক্সি ডেকেছি। অথচ এই জগত আমাদের স্বপ্নে রাদার দুঃস্বপ্নে এসেছে - যে জগত যাকে আমরা 'টিখতে' চেয়েছিলাম।
আমি হারবার্ট পড়তে একদা নিজেকে আবিষ্কার করেছিলাম এইভাবে – ‘হয়তো বা এরও অনেকদিন পরে, ... কোনো একটি বাচ্চা ছেলে তার বাবা, মা-র হাত ছাড়িয়ে, দৌড়ে গিয়ে, কোনো অ্যান্টিকের দোকানের ধুলোমাখা কাচের ভেতরে হাতে আলো নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পরীকে দেখে তন্ময় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে চাইবে। তাকে তার বাবা ও মা জোর করে নিয়ে আসার পর তার ঠোঁট হয়তো, থরথর করে কাঁপবে অভিমানে। এরকম অবশ্য নাও হতে পরে। যদি হয়, তাহলে হয়তো, এরও পরে, সেই বাচ্চা ছেলেটা যদি ঘুমের মধ্যে কেঁপে কেঁপে ওঠে, তাহলেও কারও চোখে পড়বে না।’
২০০৫ এ বাংলালাইভে যখন প্রবাসীর পত্র টিখতাম, একটি পর্বে, যার নাম দিয়েছিলাম 'স্মারক অথবা-' , হারবার্ট এসে দাঁড়িয়েছিল। তাকে আমি ডাকি নি, সে একদিন নিজেই এসে দাঁড়াল -
টেখাটা ছিল এই রকম-
***********************************************************
ইদানীং পোস্টারে ছয়লাপ পাড়া। ল্যাম্পপোস্টে সাঁটা, উঁচু দেওয়ালে টাঙানো অথবা ফুটপাথে ইষৎ হেলিয়ে দাঁড় করানো চড়া হলুদের ওপর কালো মোটা হরফে লেখা পোস্টার -সেভ আওয়ার অ্যানজ্যাক হেরিটেজ বা সেভ গ্রেথওয়েট অথবা রাইট মরিস ইমিডিয়েটলি কিংবা স্টপ মরিস সেলিং আওয়ার অ্যানজ্যাক হেরিটেজ ।এইসব।
মরিস নিউ সাউথ ওয়েলসের প্রিমিয়ার।
লেখার সঙ্গে কোথাও একটি ম্যাপ বা পুরোনো বিশাল বাড়ির ছবি, কোথাও বা একটি অতি প্রাচীন সিপিয়া রঙের গ্রুপ ছবি-সৈনিকের বেশে, নার্সের পোশাকে নারী, পুরুষ-পরিচ্ছদ, কেশবিন্যাস সবই বেশ প্রাচীনকালের অন্তত একশো বছরের পুরোনো তো বটেই।
'শ পুরতে আর সামান্যই বাকি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরু। অস্ট্রেলিয়া একটি ফেডের্যাল কমনওয়েলথ সেই সময় -- বয়স বছর পনেরো। নিউজিল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার সেনা মিলে তৈরি হল অস্ট্রেলিয়া অ্যান্ড নিউজিল্যান্ড আর্মি কর্পোরেশন বা অ্যানজ্যাক - মিত্রশক্তির নৌবাহিনীর অবাধ প্রবেশের জন্য অ্যানজ্যাক আক্রমণ করল গ্যালিপলি পেনিনসুলা। উনিশশো পনেরোয়। প্রায় আট হাজার অস্ট্রেলিয়ান সেনা নিহত আর আহতের সংখ্যা অগণন।সেই সময় নর্থ সিডনি অঞ্চলের জনৈক স্যার থমাস ডিবস নিউ সাউথ ওয়েলসকে দান করলেন তাঁর বিশাল ভিক্টোরিয়ান ম্যানসন "গ্রেথোয়েট', আহত অ্যানজ্যাক সেনাদের শুশ্রুষার জন্য। উনিশশো ষোলো থেকে উনিশশো আশি রেডক্রস ব্যবহার করে গ্রেথওয়েটকে। আশি থেকে স্বাস্থ্য দফতর দায়িত্ব নেয় এই বাড়ির একটি নার্সিং হোম চালু করে।
এখন এই বিশাল বাড়ি, সংলগ্ন বাগান ব্যবহারের অযোগ্য সর্বতোভাবে স্বাস্থ্যদফতর চাইছে গ্রেথওয়েট বিক্রি করে দিতে, চাইছে ম্যানসনটি ভেঙে গড়ে উঠুক একটি কারপার্ক, কিছু টাউনহাউস। এর আগেও, চুরানব্বই নাগাদ, সরকার একই প্রস্তাব এনেছিল কিন্তু জনমত ছিল এবারের মতোই অর্থাৎ প্রস্তাবের বিপক্ষে। সেই সময় ইলেকশনের মুখে তাই বিক্রির প্রস্তাবে ধামাচাপা পড়ে। এখন আবার উদ্যোগী হয়েছে গভর্নমেন্ট। তবে, এই সময়, শুধু প্রতিবাদ নয়, নর্থ সিডনি কাউন্সিল এবারে সরকারের থেকে বাড়িটি কিনতে চেয়েছে - রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কাউন্সিলের। একটি হেরিটেজ পার্ক গড়ে তুলবে কাউন্সিল, ম্যানসনটি অটুট রেখে। হলদে কালো পোস্টারগুলির পশ্চাৎপট এইটুকুই।
এক বিকেলে স্যান্ডস্টোনের এই ভিক্টোরিয়ান ম্যানসনটির সামনে এসে দাঁড়াই। পোস্টারের ম্যাপ দেখে পৌঁছে গেছি। প্যাসিফিক হাইওয়ের মতো অতি ব্যস্ত রাস্তা থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ অথচ নাগরিক কোলাহল ফেলে আসছি রাস্তার মুখের পাবটিতে। প্রাচীন বাড়ি, প্রাচীন দুয়ার, অজস্র পাখি ডাকছে- কুলায় ফেরা পাখি সব, সূর্য অস্তগামী। হাল্কা হিমভাব।
প্রবল অযত্নের চিহ্ন সর্বত্র। আগাছা, বিষাক্ত ঝোপ-ঝাড়, কুকুরের বর্জ্য, বিয়ারের ক্যান, প্লাস্টিক ইতস্তত -ভারী ট্রাকের টায়ারের দাগ ঘাসে। দুটি অতি প্রাচীন ডুমুর গাছ। তিনতলা প্রাসাদোপম বাড়িটির জীর্ণ অতি জীর্ণ দশা। প্রাচীন উদ্যানটিতে দাঁড়িয়ে মনে পড়ল একটি ঘটনা।
এই যুদ্ধস্মারক সংরক্ষণ নিয়ে ভারী গন্ডগোলে পড়ি একবার। সেদিন বাড়িতেই ছিলাম। একাই। দুপুরের দিকে জানলা দিয়ে হঠাৎ দেখি অ্যাম্বুলেন্স, দমকল, পুলিশের গাড়ি - কার কি হল ভাবতে ভাবতেই দরজায় করাঘাত। সিনেমায় যেমন দেখি তেমনই সপ্রতিভ ভঙ্গিতে আইডেন্টিটি কার্ড দেখান তরুণ পুলিশ অফিসারটি - "যে অবস্থায় আছেন, সেই অবস্থায় বাইরে বেরিয়ে আসুন, নীচের স্টোরেজে গুটিকয়েক গ্রেনেড পাওয়া গেছে।' অগত্যা পাসপোর্ট আর ল্যাপটপটি হাতে, চটি পরেই সটান বাইরে। জানা গেল, আমারই ওপরতলার বাসিন্দার কিছু জিনিসপত্র রাখা ছিল স্টোরেজে - বৃদ্ধ মারা গেছেন বহু বছর, বৃদ্ধাও অসুস্থ নার্সিংহোমে। তাঁদের পুত্রটি এসে স্টোরেজ পরিষ্কার করতে গিয়ে গ্রেনেডগুলি দেখে ও তৎক্ষণাৎ পুলিশে খবর দেয়। অফিসার নাম-ধাম খাতায় লিখে কাছের থানায় কফি খাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, থানায় কফি খেলে কত -- এরকম কোনও কাল্পনিক মানসাঙ্ক কষে অকুস্থলেই দাঁড়িয়ে থাকি আমি। অতঃপর বম্ব স্কোয়াড আসে। জানা যায়, এই গ্রেনেড বিশ্বযুদ্ধের সময়ের - বৃদ্ধ ছিলেন সৈনিক, তিনি নাকি গ্রেনেডগুলি স্মারক হিসাবে তুলে রেখেছিলেন সযত্নে। পুলিশের মত সেরকমই। সত্যি কথা সঙ্গে নিয়ে বৃদ্ধ স্বর্গে গেছেন বহুদিন, বৃদ্ধাও অসুস্থ। অতএব ...
এই জীর্ণ ম্যানসন, প্রাচীন বৃক্ষদ্বয়, সিপিয়া রং-এর গ্রুপ ছবিটি, গ্রেনেডসমূহ যুদ্ধস্মারক সংরক্ষণের একটি কোলাজ হতে পারত। আদ্যন্ত। অথচ, সেদিন, শেষ বিকেলে, সেই ডুমুর গাছের তলায় কোলাজের এই ফ্রেমটিতে ঢুকে পড়ে আরও একজন। পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি। ফর্সা। চোখা, সাহেবি গড়ন ...হারবার্ট। হারবার্ট সরকার।
মুহূর্তে, প্রাচীন গাছটি শমীবৃক্ষে রূপান্তরিত হয়ে যায়। আয়ুধসকল অপেক্ষায় থাকে।
***************************************************************************
আমি সেই অর্থে কেউই নই এখানে লেখার। অতি নগণ্য পাঠক। বড়জোর শ্মশানবন্ধু, হারবার্টের দাহ শেষে নিমপাতা দাঁতে কেটে লোহা ছুঁয়ে ঘরে ঢুকেছি।
সেই জায়্গা থেকে বিস্ফোরণ ও তৎসংক্রান্ত দর্শনকে তুচ্ছ লাগা হয়তো একদম ধৃষ্টতাই - হারবার্ট পড়ার এত বছর পরে আজ আর বিস্ফোরণকে তেমন তীব্রও মনে হয় না অথচ এত দিন পরেও একটা দৃশ্যকল্প কেমন জ্বালায় - ঐ শেষ পরিচ্ছেদের একটা দৃশ্যকল্প - হারবার্টের সেই সাইনবোর্ড বেলুন বন্দুকওলা কিনে নেয় এবং এর ওপরে কাঁটা পেরেক ঝুলিয়ে বেলুন ঝোলাবার ব্যবস্থা করে - সব বেলুন ফেটে গেলে পেরেকের মধ্যে হয়তো বা চোখে পড়বে, উল্টো হরফ - 'মৃতের সঙ্গে কথোপকথন' প্রোঃ হারবার্ট সরকার -