এই শীত শীত, শুরুর পৌষের দিনে আমরা যারা বহুদিন শান্তিনিকেতনের বাইরে, আমার বেলায় প্রায় ৩২ বছর, তাদের একটু কাঁপুনি, একটু ভোরের আঁধার আলোর মধ্যে দিয়ে কালীসায়রের দীঘি দুটোর মাঝ দিয়ে তেঁতুল গাছতলা পেরিয়ে শ্রীনিকেতন থেকে আসা, ঠান্ডায় জমে যাওয়া হাতে সাইকেল চালানো, তার ই মধ্যে, ব্রহ্ম সঙ্গীতের সুর অথবা তার অন্তর্নিহিত নলিনীদির চোখের মতো কড়া বারনের মধ্যেও কয়েকটি কাঁথা স্টিচের আলোয়ান বা ছেলেদের বেলায় কাঁধ খোলা শাল আর একটু বাহারি পাঞ্জাবী, বা টগরের কুঁড়ি দিয়ে দেওয়া চন্দনের ফোঁটা একজন বিশেষ কারো র হাত থেকেই নেওয়ার আকুলি বিকুলি অথবা বেশি ক্লিপ দিয়ে বাঁধা চুল আর ভীড়ের ফাঁকে ইতি উতি দেখবো না দেখবো না করেও চোখ পড়ে যাওয়া না আটকাতে পারার স্মৃতি উথলে ওঠা আশ্চর্য্য কিছু না। তবে সাজ জিনিসটা, নেহরুর সমাজবাদের সেই পড়ন্ত বেলাতেও, শুধুই পরিকাঠামো সহায়তায় সীমাবদ্ধ ছিল, সাজিয়েদের অতিক্রম করে উদ্ভ্রান্ত করে নি। ঝাঁকড়া চুল, বা চশমা , বা ব্লাউজের কাট দিয়ে নিরীক্ষার সরনীতে হুহু ময় মুগ্ধ জনতাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়া টা ঐচ্ছিক ছিল অবশ্য। মনমোহনের আগে থেকেই আমরা বরাবরি মিশ্র অর্থনীতি।
শান্তিনিকেতনের যে কোনো অনুষ্ঠানেই, দুজন মানুষ কে ভুলে থাকার কোন উপায় ছিল না। সুখময় মিত্র আর ননীগোপাল ঘোষ।
সুখময় বাবু সম্ভবত তিরিশের দশকের শেষ দিক থেকেই, ননী বাবু হয়তো পঞ্চাশের দশক থেকে কলাভবনের সঙ্গে যুক্ত, প্রথমে ছাত্র ও পরে অধ্যাপক হিসেবে। একটা আশ্চর্য্য সর্ব অর্থেই ভাঙা গড়ার সময়ের সাক্ষী তাঁরা। শিল্প বিষয়ে একেবারেই অধিকারহীন হলেও, পর্যবেক্ষন হিসেবে এটুকু বোধ হয় প্রস্তাব করাই যায়, রবীন্দ্রনাথের জীবৎ কালে বা তার পরে নন্দলালের কাছে সরাসরি শিক্ষা যাঁরা পাচ্ছেন, তাঁরা যে ভাবে ছবি আঁকতে শিখছেন, তার সঙ্গে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে, বিশেষতঃ বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠার পরে, পঞ্চাশের দশকের শেষ দিক থেকে কলা ভবনে যে চর্চাটা হচ্ছে তার একটা পার্থক্য থাকছে। সে সময়্টা সারা ভারত জুড়েই যে শিল্প চর্চা হচ্ছে সেটা বেংগল স্কুল কে পেছনে ফেলে এসেছে খানিকটা। দিনকর কৌশিকের তত্ত্বাবধানে কলাভবন ধীরে ধীরে স্বাধীন ভারতের শিল্প আন্দোলন গুলোর সব ধরণের ধারা র ই চর্চার জায়্গা হয়ে উঠছে, বিনোদবিহারী, সোমনাথ হোর, একটু পরে কে জি মনু সুব্রমন্যম, সনত কর, শর্বরী রায়চৌধুরী দের চর্চা কে কেন্দ্র করে। মুকুল দে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ছিলেন না বিশেষ, আর রামকিংকর, ছাত্র ছাত্রী দের মধ্যে অসম্ভব জনপ্রিয় হলেও, তাঁর মত করে কাজ করার চেষ্টা করার স্বাভাবিক ভাবেই লোক বিশেষ পাওয়া দুষ্কর ছিল।
এই পরিস্থিথিতে, সুখময় মিত্র মশাই আর ননীগোপাল ঘোষ মশাই দের ছবি আঁকার যেটা ধরণ সেটা ক্রমশ শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্য হিসেবে গড়ে ওঠা ডিজাইন এর সঙ্গে, বা এক ধরণের প্রতিনিধিত্ত্বমূলক মোটিফ এর সঙ্গে একাত্মীভূত হয়ে যাচ্ছিল, যাকে বলে নিরীক্ষামূলক 'হাই আর্ট' এর অংশ আর থাকছিল না। সমাবর্তন, পৌষ উৎসব, পয়লা বৈশাখ বা বসন্তোত্সবের মত অনুষ্ঠান গুলির রূপ পরিকল্পনা, আলপনা র সাজানো র কাজ সুখময় বাবু বা ননী বাবুর নির্দেশনা ছাড়া কল্পনা করাও সম্ভব ছিল না। এক অর্থে শিল্পী হিসেবে আর্টিস্ট থেকে আর্ট ডিরেকটর হয়ে ওঠা তাঁদের কাছে সুখকর ছিল না বেদনা দায়ক ছিল জানি না, সুখময় বাবু আর ননী বাবু দের কাজ তো বোঝার ক্ষমতা শিশু কিশোর বয়সে তো ছিল ই না , এখনো নেই, শুধু এটুকু বুঝি, প্রদীপের শিক্ষা রক্ষা করার যত্ন নিয়ে তাঁর স্ব স্ব ক্ষেত্রে কাজ করে যাচ্ছিলেন।
সুখময় বাবু র আদি বাড়ি ছিল কুমিল্লা অথবা মৈমনসিংহে। খুব গভীর পরিচয় হবার বয়স আমার ছিল না। মুজতবা, অনিল চন্দ র মত ই অনেক রবীন্দ্রমুগ্ধ পন্ডিত, জ্ঞানীগুণী, বুদ্ধিজীবি, শিল্পী , কর্মপ্রার্থী শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন, দেশ ভাগের অনেক আগে থেকে। সুখময় বাবুর ক্ষেত্রে যত টুকু বুঝি, তাঁর হৃদয়ের একটা টুকরো অন্তত ডাকঘরের দিকে ফেরা অমলের দৃষ্টির মত সিলেটের পাহাড়ের গায়ে লুটিয়ে ছিল।
সুখময় বাবু স্বপ্ন দেখতে ভালো বাসতেন। দৈনন্দিন কখনো-ই তাঁর কাছে সম্ভবত বিষম হয়ে ওঠে নি, এমনকি দেশ গঠনের নানা মতের , নানা পথের যে ধারা তার মধ্যে কড়া যুক্তি যতই থাকুক, ইতিহাসের ঘটনাবলী কে অতিক্রম করার সাহস সব সময়ে দেখা যেত না, সুখময় বাবুর স্বপ্ন ইতিহাস শুধু না ঐতিহাসিকতাকেও, শুধু ভালোবাসার জোরে অতিক্রম করার সাহস রাখত। তাঁর কল্প রাজ্য টির নাম ছিল, 'পাহিবা', তিনটি সার্বভৌম রাষ্ট্র, পাকিস্তান-হিন্দুস্তান-বাংলাদেশ, তাদের পূনর্মিলন পরিকল্পনা ই এই স্বপ্নের ভিত্তি। জেদী যুক্তি যেটা ছিল, সেটা হল, ভাঙতে যখন পেরেইছে, জুড়তে কতক্ষন। বহুদিন ধরে পুষে রাখা এই স্বপ্ন নব্বই এর দশকে এসে, দুই জার্মানির মিলনে সম্ভবত নতুন উৎসাহ পেয়েছিল। অত নাম করা শিল্পী, সকলের শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক, শান্তিনিকেতন তথা স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতের শিল্প বিষয়ক প্রতিষ্ঠানে নিজের জায়্গা পাকা হবা সত্ত্বেও, তাঁর ছেলে মানুষী আনন্দের শুধু না, আত্ম বিশ্লেষণ এবং ক্ষমার আকাশেও সম্ভবত সীমান্ত বলে কোন পদার্থ ছিল না।
আজ নাগরিকত্ত্ব প্রসঙ্গে, সীমান্ত প্রসঙ্গে, জাতির বিশুদ্ধতা প্রসঙ্গে নতুন করে উথলে ওঠা বিতর্ক , যে কোনো একলা মুহুর্তেই, আমাকে কয়েকটা প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়। বার বার ই মনে হয়, যে প্রজন্ম দেশ ভাগে সব চেয়ে বেশি ভুগলেন, যাঁদের স্মৃতি, সত্ত্বা, আত্মীয়তা, ঘর দুয়ার বিদীর্ন করে প্রশাসনের আর সামাজিক বিভাজনের কড়া বেড়া পড়ল, ভয়ানক রক্তপাতের বীভৎসতা যাঁদের যীবনে দুঃস্বপ্নের থেকেও কড়া বাস্তব হিসেবে ক্রমাগত অত্যাচার করে গেল, সেই প্রজন্মের লোকেরা এত সহজে এই সব স্বপ্ন দেখতেন কি করে। এমনকি যাঁরা সুখময় বাবুর মত চিন্তা ভাবনায় এগিয়ে ছিলেন না, তাঁরাও তো, ধরা যাক, উদ্বাস্তুরা, তাঁরাও তো এক ধরণের যূথবদ্ধতায় আস্থা রেখেছেন, পায়ের তলায় নতুন মাটির খোঁজে। কিন্তু আমাদের বিশ্বায়ন পরবর্তী প্রজন্ম আপেক্ষিক স্বচ্ছলতার সময়েও নতুন করে অস্মিতার নেশায় কেন মেতে উঠলো। জানি না, সমাজতাত্ত্বিক কোন বিশ্লেষণে এই পর্যবেক্ষন ধোঁপে টিঁকবে কিনা, কিন্তু ঘটনা হল, রাষ্ট্রের ভৌগলিক সীমানা যে গতিতে নতুন করে সামাজিক উন্মত্ত্বতার ইন্ধন যোগাচ্ছে, সেটা সীমানা তৈরীর অব্যবহিত পরে কিন্তু এত প্রখর ছিল না, অন্যেতর গঠনের একটা ধারা তৈরী হচ্ছিল।
আরেকটা কথা , সে অবশ্য একেবারেই ব্যক্তিগত, আমার নিজের কাছে সেটা খানিকটা অস্পষ্ট। বাঙাল বাড়ির পারিবারিক কথোপকথনে অথবা জরা ব্যাধিগ্রস্ত আত্মীয়দের বিলাপে প্রলাপে, 'দেশ' জিনিসটার কড়া উপস্থিতি থাকলেও, যৌথ পরিবারের ভাঙন এবং শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় শিক্ষার একেবারে অন্যরকম একটা অভিজ্ঞতা আমাকে হয়তো যৌথ স্মৃতির ভার থেকে খানিকটা আড়াল করেছিল। একেবারেই নগন্য, ক্ষুদ্র এবং ব্যর্থ লেখালিখি করার ভুত যখন থেকে মাথায় চাপলো, অবশ্য কবে চাপলো এখন আর ভালো করে মনে পড়ে না, তখন থেকেই, স্মৃতি হাতড়ে দেখছি, হয়তো দৈনন্দিনের চাপেই, তারাশংকরের বীরভূম আমাকে যতটা অধিকার করে বসেছিল, জসীমউদ্দিন বা জীবনানন্দের বাংলা ততটা করে নি। সাংস্কৃতিক , বৌদ্ধিক ঐতিহ্য সন্ধানের একটা দায়, লেখা ছেড়ে দিন, ন্যুনতম ভাবনা চিন্তার প্রারম্ভ থেকেই এড়ানো মুশকিল হয়ে ওঠে, আমরা বুঝতে পারতাম, আমরা মহানগরের আত্মপ্রকাশ পদ্ধতি সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হতে পারছিনা, আবার ভূমিপূত্র ও হতে পারছিনা, কোন ধরণের কোন রাষ্ট্র বিপ্লব বা অভিবাসনের অভিজ্ঞতা অন্তত আমার প্রজন্মে না থাকা সত্ত্বেও, এটুকু বুঝতে অসুবিধে হয় নি, আমরা বীরভূমে পিতৃদেবের কর্মসূত্রে সেটলার মাত্র।
প্রত্যয়যোগ্যতার একটা সংকট ই হয়তো এক ভাবে তাড়া করে, একটা নাগরিকতার মুখাবয়বহীন আড়ালকে শ্রেয় করে তুলেছে। এটা তো প্রচলিত অর্থনীতির ফলাফল মাত্র, কিন্তু অন্যদিকে ঘটনাচক্রে একটা স্মৃতির দায় থেকে পলায়ন্প্রবৃত্তির সাফল্যও বটে।
আজ ৬ই পৌষের নিদ্রাহীন রাতে, ৭ই পৌষ সকালের প্রার্থনায় অনুপস্থিতির জন্য তেমন মনখারাপ না হলেও, যে দেবতা অগ্নিতে, বনষ্পতিতে, চরাচরে ব্যপ্ত, তাঁর কাছে বা নিজেদের ই কাছে প্রশ্ন ঐ একটাই, যে প্রজন্ম আঘাত পেল, আঘাত পেয়েও স্বপ্ন দেখতে ভুললো না, আমরা ঠিক কতটা আত্মবিস্মৃত হলে , কতটা ক্ষমতালোভীর নৈকট্যের আকাংখায় নিমজ্জিত হলে, আজকে এই খানে এসে দাঁড়াতে পারি। উত্তরের খোঁজ টা সম্ভবত শুধু নিস্তব্ধ ভোরের একাকী স্তবে আটকে থাকবেনা, তাকে কলরব হতে হবে।