আমার তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষ। দাদার হঠাত মৃত্যু। পড়া ছেড়ে ঘরে ফেরা। সংসার আর চলে না। আমার মাথার উপর এসে পড়ল সব। মাত্র দুই বিঘা জমি তখন সম্বল। প্রাইভেট পড়িয়ে পয়সা এনে চলে না সংসার। পাশাপাশি চাষীদের দেখে চাষ শুরু করলাম। কোদাল হাতে প্রথম দিন চোখের জলে ভিজে গেল জমি। পয়সা নেই, রোদে থাকতে পারি না ঘণ্টার পর ঘণ্টা, চাষের পদ্ধতি জানি না, সবটাই প্রতিকূল। শুরু করলাম চাষের বই পড়া। শুনতে শুরু করলাম আকাশবাণীর চাষের আলোচনা রেডিওতে। সেখানে জানলাম জমির মাটি পরীক্ষা প্রথম কাজ। মাটি নিয়ে গেলাম। ল্যাবরেটরিতে। সেখানে লোকজন আমাকে দেখে খুব অবাক। আমি নিজেই চাষী পরিচয় দেওয়ায় তারা খুব অবাক। মাটি জমা দিতে গিয়ে একজন মহিলা অফিসারের দেখা মিলেছিল। সেদিন তাঁরই উদ্যোগে আমি দুই সপ্তাহের ট্রেনিং নিই এবং প্রশিক্ষণ শেষে লিখিত পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান পাই। তারপর আমি এস আর আই পদ্ধতিতে প্রথম ধান চাষ শুরু করলাম। এই পদ্ধতিতে দশ ইঞ্চি গ্যাপে একেকটা চারা দশ দিনের নিতে হয়। একটি থেকে ৪০-৪৫ টা ঝাড় হবে। বিঘা প্রতি ১ কেজি বীজধান লাগবে। এই পদ্ধতিতে চাষ করে আমি বিঘা প্রতি ২২ মণ মানে ৯ কুইন্ট্যাল উতপাদন করি। তিনগুণ বেশি ফসল আমি তুলি সাধারণ চাষীর তুলনায়। কলা চাষের ক্ষেত্রেও আমি কাঁদিতে সাধারণের (কাঁদি প্রতি ১২০-১৩০টি) থেকে অনেক বেশি (২৫০-৩০০টি) কলা চাষ করি। এই কলা যে পুরনো পদ্ধতির চেয়ে শুধু বেশি কলা দেয় তা নয়, এগুলি অনেক ফ্রেশ আর কীটনাশকের ব্যবহারও কম। বাজারে কলা দেখে সকলেই বলত মৌসুমীর কলা। আমার উতপাদিত কলা মৌসুমীর কলা নামে পরিচিত হয়। তারপর আমি সর্ষে ও তৈলবীজ চাষ শুরু করি। চারার সংখ্যা কমিয়ে নতুন পদ্ধতিতে চাষ শুরু করে ৬ মণ সর্ষে তুলি। সাধারণ চাষীরা ১ মণ থেকে ৩ মণ ফসল তোলে। আমার চাষের পদ্ধতিতে সর্ষের তেলের গুণমান ভালো হয়। জগিং না করে গাছ কেটে রোদে শুকিয়ে মারলে তেলের গুণমান ভালো হয়। জৈব কীটনাশক ব্যবহারের ফলে প্রকৃতিও বাঁচে। আম, বেগুন, কপি,ঢ্যাঁড়শ সব সব্জি-ফসলকে জৈব পদ্ধতিতে চাষের আওতায় আনার চেষ্টা করেছি।নিমপাতার নির্যাস, কলমি, ভ্যাট, নিসিন্দাপাতার নির্যাস নিয়ে জৈব কীটনাশক করেছি। জমিতে ফসলের অণুখাদ্য সরবরাহ ও ধ্বসজাতীয় রোগ থেকে রেহাইয়ের জন্য আমি গোমূত্র ও মলের নির্যাস দিয়ে মিশ্রণ তৈরি করেছি। এর জন্য প্রয়োজন ২ লিটার গোমূত্র এবং দুই কেজি টাটকা গোবর, চুন ৫০ গ্রাম, গুড় ৫০ গ্রাম। পদ্ধতিটা এমন - দুই কেজি গোবর ও মূত্র মিশিয়ে সুতি বা মশারি জাতীয় কাপড়ে জড়িয়ে গোমূত্রে ডুবিয়ে রাখতে হবে। তারপর ১০ লিটার জলে হাফ লিটার মিশ্রণ দিয়ে জমিতে স্প্রে করতে হবে। পেঁয়াজ, রসুন, কালোজিরে,আদা,হলুদ আমি নিজের পদ্ধতিতে চাষ শুরু করি। আমার কাছে ৪০০ চাষী কাজ শিখেছে যারা ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক। আমি হাতে কলমে তাদের ট্রেনিং দিই। তাদের চাষ সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান করি। তাদের মুখে হাসি ফুটলে আমার কাজ সফল হয়। কারও ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যাই। মাঠের দুরবস্থা দেখে কান্না পায়। রাসায়নিক সার অতিরিক্ত প্রয়োগের ফলে মাটির করুণ অবস্থা আমায় খুব ভাবায়। আমি বুঝতে পারি আমরা আগামীর ভাতিন্ডা হতে চলেছি। আমাদের মাটিও বন্ধ্যা হওয়ার মুখে। মাছ চাষের ক্ষেত্রেও আমি আধুনিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে সফল হয়েছি। জল পরীক্ষা, পুকুরের মাটি পরীক্ষা, জলের পি এইচ মাপা- সব আগে করে নিই। তারপর পুকুর তৈরি করি। সাধারণত পূর্ব ও পশ্চিমে যাতে কোনো গাছপালা না থাকে তা দেখে নিই। তারপর মজুত পুকুরে হাফ থেকে দুই লিটার জল রাখি। রোদ যাতে সরাসরি পুকুরে পড়ে সেটা লক্ষ্য রাখি। পুকুরের মাপ অনুসারে বাচ্চার টিকাকরণ করিয়ে চারা ছাড়ি। মাছের পরিমাণ ও ওজন অনুমান করে দিনে দুবার খাবার দিই। মাসে দুবার জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য দেখি তারপর বাজারের দাম দেখে মাছ তুলি। পি. এইচ মাপার জন্য আমার নিজের ট্রেসিং পেপার ব্যবহার করি ও মাছকে নিরোগ ও স্বাস্থ্যসম্মত রাখি। খাবার প্রস্তুত করি আমার নিজের পদ্ধতিতেই। ধানের খুদ, সর্ষের খোল, ডালের গুঁড়ো, ভূট্টার ময়দা, সোয়াবিনের গুঁড়ো দিয়ে মিশ্রণ তৈরি করি। আগামীতে সাগর থেকে মীন নিয়ে এসে চিংড়ি চাষের কথা ভাবছি। চাষীদের পরিবারের জন্য নিয়ন্ত্রিত বাজার চাই। কিষাণমান্ডি সঠিক সময়ে চাষীদের মাল তুলে নিলে তারা উপকৃত হয়। কিন্তু চাষীদের ফলানো ফসল বিক্রির পথে তারা এখন অন্তরায়। সে অবস্থার সমাধান জরুরি। চাষীদের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব ভঙ্গুর তাই তাদের সাহায্য প্রয়োজন। নিজের অধিকার তারা জানে না। আধুনিক পদ্ধতিতে চাষ ও প্রশিক্ষণ এবং সরকারি অনেক ঘোষণা সম্পর্কে তারা ওয়াকিবহাল নয়। মহিলাদের আমি চাষের কাজে সবসময় আহবান জানিয়ে এসেছি অনেক আগে থেকেই। ঘরে বসে না থেকে তারা নিজেরা উতপাদনমূলক কাজে হাত বাড়াতে পারে। লেখাপড়া শিখে চাকরি না পেলে হতাশ হবার কারণ নেই। সেল্ফহেল্প গ্রুপের মেয়েদের চাষের প্রশিক্ষণের আওতায় আনলে বহু মেয়ে নিজেদের সারা বছর কৃষক করে তোলার সুযোগ পেতে পারে। লেখাপড়া জানা মানুষের আজ চাষের মাঠে খুব প্রয়োজন যারা কৃষকের ঘরে চাষের প্রশিক্ষণ পৌঁছে দেবে। বাড়ির শিক্ষিত মেয়ে যারা চাকরি বা বিয়ের অপেক্ষায় সেইসব মেয়েরা তবে চাষে হাত লাগাতে পারবে। আমি নিজে একজন শিক্ষিত চাষী ও মহিলা। আমি গর্বিত, আমি নিজের হাতে কোদাল ধরি, বীজ পুঁতি, ঝাড়াই বাছাই করি, এমনকি মাথায় করে ফসলও বাজার পর্যন্ত নিয়ে গেছি। আমার শ্রম কোথাও অসম্মানিত হয় না। আমার শিক্ষা আমার হাতিয়ার। আমি বই পড়ে চাষের বিষয় জেনেছি সব থেকে বেশি। আমি বিয়ে করিনি। পরিবারের আর্থিক চাপে নিজেকে নিয়ে ভাববার ফুরসৎ পাইনি। মাঠই আমার পরিবার। চাষী যারা আমার উপর নির্ভর করে তারা সকলেই আমার সন্তান। সকলের ইচ্ছা আমার ইচ্ছা। পরিবার চালানো চাষের মধ্য দিয়ে আজকের দিনে খুব কঠিন কিন্তু আমি পেরেছি কেননা আমার শিক্ষা আমাকে সংগ দিয়েছে। আমি অনেক পুরস্কার পেয়েছি কিন্তু সেরা পুরস্কার আমার চাষীর মুখের হাসি। তারা লাভের মুখ দেখলে আমি খুশিতে ভরে উঠি। আমার নির্দেশে এক জমিতে ৪টি ফসল হয়। দুটি ধান, একটি পাট ও সর্ষে। সেবার ৫ বিঘায় ৫ রকমের ফসলও আমি ফলিয়েছি এবং সেদিন আমার সত্যি করে এক চরম বেদনা থেকে মুক্তি মেলে। আমার এম. এ. পাশ না করার যন্ত্রণা সেদিন থেকে ভুলে যাই। মাঠ ভরা শস্য আমার রিপোর্ট কার্ড।
ফেমিনিজম ডট কম সম্পাদিত গুরুচণ্ডা৯ র 'তাহাদের কথা' বই্তে প্রকাশিত।