গুগল নিউজে ‘দলিত’ টাইপ করে দেখুন। তথাকথিত ‘নিচুজাতি’-র মেয়েদের ধর্ষিতা, লাঞ্ছিতা হওয়ার, ছেলেদের কুপিয়ে খুন হওয়ার অসংখ্য রিপোর্ট পাওয়া যাবে। শুধুমাত্র হরিয়ানাতেই প্রায় পঁচিশটি ধর্ষণের ঘটনা রিপোর্টেড হয়েছে এক মাসে। গণধর্ষিতা একটি বছর ষোলর কিশোরী গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছে। এক মহিলাকে তাঁর তিন সন্তানের সামনে গণধর্ষণ করা হয়েছে; আরেকটি ষোল বছরেরই মেয়েকে আট জন ধর্ষণ করেছে, আরও চারজন সেই অত্যাচারের ভিডিও রেকর্ড করেছে, প্রচার করেছে।
প্রতিদিন তিনজন দলিত মহিলা ধর্ষিত হন, দুজন খুন হন, এগারো জন প্রহৃত হন, দুটি ঘর জ্বালানো হয়। জানাচ্ছে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো। এই সমানে ঘটে যাওয়া বর্বরতা সত্বেও দলিতদের মানবিক চেতনা বারবার নজরে আসে। প্রতিবাদসভা হয়, আদালতে কেস ঠোকা হয়। কিন্তু এইসব প্রচেষ্টায় জনমানসে দলিতদের অবস্থানের কোনও উন্নতি হয় কি? প্রশ্নটা থেকেই যায়। আর সে জন্যই বিহার-এর দলিতরা চেষ্টা করলেন নতুন কিছু করবার।
ফেব্রুয়ারী, ২০১১। প্রায় হাজার দলিত মহিলা, ডোম সম্প্রদায়ভুক্ত, ঘড়ায় জল নিয়ে হেঁটে যান পরবত্তা শহরের মধ্যে দিয়ে। বছরের পর বছর অত্যাচার চালিয়ে যাওয়া উঁচু জাতের মানুষদের থেকে প্রতীকী দখলমুক্ত করেন গঙ্গার পবিত্র জল।
বিহারের খাগারিয়া জেলার তৃতীয় গঙ্গা কলস যাত্রা ছিল এটি। প্রসঙ্গত, খাগারিয়া বিহারের সবচেয়ে অনুন্নত জেলা। মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ দলিত। অসম জমি বিভাজন এবং জাতপাতের সামাজিক সমস্যার কারণে চাকরির সুযোগও বেশ কম। অনেকেই ক্ষেতমজুরের কাজ করেন – কঠিন শ্রমের পরিবর্তে সামান্য রোজগার – কেউ কেউ চলে যান বিভিন্ন শহরে, ছুটকো ছাটকা কাজ করে রুটি-রুজির জোগাড়ে। বিপাকে পড়েন মহিলারা; হয়ে ওঠেন সামন্তপ্রভুদের ভোগ্যসামগ্রী।
ডোমদের কখনই কোনও জমি ছিল না, এবং তাই নিজস্ব আয়ের ব্যাবস্থাও ছিল না। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে তাদের বাধ্য করা হত, যা ‘উঁচুজাত’ এর কেউ কখনোই করতে চাইত না – শবদাহ, পায়খানা পরিস্কার বা জীবজন্তু-র মৃতদেহ সরানো। বাকি সমস্ত ‘নিচুজাতি’ দের মতই তাদেরও গঙ্গার ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিল। যা কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠান, গঙ্গার এক শাখানদীতেই সারতে হত। জুলুমবাজির এই সমস্ত চিহ্নগুলিকে মুছবার দরকার ছিল। গঙ্গা কলস যাত্রা সেই দিকেই একটা পদক্ষেপ, জানাচ্ছেন সঞ্জীব। সঞ্জীব - ডোমদের বহুদিনের সঙ্গী – এই আন্দোলনের অন্যতম হোতা।
প্রাসাদ থেকে পর্ণকুটির
সঞ্জীবের নিজের গল্পও যথেষ্ট চমকপ্রদ। কেরিয়ারের শুরুতে র্যা ম্প মডেল ও পরে মার্কেটিং এগজিকিউটিভ সঞ্জীব ২০০৪ অবধি কাটিয়েছেন দিল্লিতে। ২০০৪ এ এক আত্মীয়ের মৃত্যুতে তাকে খাগারিয়া আসতে হয়। খাগারিয়া তাঁর বাবা-মার আদি নিবাস। শ্রাদ্ধানুষ্ঠান শেষে আস্তাকুড়ে ফেলে দেওয়া ভুক্তাবশেষ নিয়ে কুকুর-মানুষে টানাটানি দেখে তিনি মানুষটিকে ঘরে এনে বসাতে চান এবং আত্মীয়দের অনুরোধ করেন এঁকে কিছু খাবার দিতে। ডোমকে ঘরে এনে বসিয়ে খাবার দেবার এ হেন প্রস্তাবে জোটে কেবল উপহাস, স্বাভাবিক ভাবেই।
সঞ্জীব আরও দেখেন উচ্চবর্ণ এলাকায় বসানো হ্যান্ডপাম্প ব্যবহার করার অধিকারও এই ডোম মানুষগুলির নেই। রন্ধ্রে রন্ধ্রে জড়িয়ে থাকা এই অসাম্য কী ভাবে দূর করা যায়? ভাবতে ভাবতে তিনি ফিরে গেলেন দিল্লি। কয়েকমাস পরে আবার এলেন খাগারিয়া। কোনও পরিকল্পনা ছাড়াই, রিটার্ন টিকিট না কেটেই।
কোথা থেকে শুরু হবে, কী করা উচিত? সঞ্জীব নিজেই জানেন না। হ্যান্ডপাম্প দিয়ে অপরিষ্কার ডোম বাচ্চাদের স্নান করানো শুরু করলেন। অনেকেই তাকে অবিশ্বাস ও সন্দেহের চোখে দেখতে লাগল। তিনি এই নিম্নবর্গের মানুষদের সাথে আলোচনা শুরু করলেন। মহিলাদের কাছে জানতে চাইলেন, তাঁরা পড়াশুনা করতে চান কিনা। কিছুদিনের মধ্যেই একটি জীর্ণ কুটিরে শুরু হল ক্লাস। মহিলারা আসতে আরম্ভ করলেন, ঘোমটায় মুখ ঢেকে। পুরুষদের সন্দেহ হল। ক্লাসরুমটি পুড়িয়ে দেওয়া হল। কিন্তু কয়েকবছরের মধ্যেই দেখা গেলো নারীপুরুষ নির্বিশেষে সকলেই পড়াশুনো করছেন।
কিছুদিন পর, ২০০৬ সালে তাঁরা নিজেরাই তৈরি করলেন বহিষ্কৃত হিতকারী সংগঠন – বিএইচএস। উচ্চবর্গ একে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিল। ‘নিচুজাত’-এর ওপর কর্তৃত্ব করবার ‘অধিকার’ এর ওপর হস্তক্ষেপ যেন। শুরু হল তান্ডব। হত্যালীলা। সঞ্জীবকে রুখবার জন্য, ভয় দেখাবার জন্য খুন করা হল ওঁর ভাইকে। সঞ্জীব এলাকা ছাড়তে বাধ্য হলেন। এলাকাটিতে মাওবাদী প্রভাব ছিল। মাওবাদীরাও ভাবল সঞ্জীবের কাজের জন্য এলাকায় তাঁদের গুরুত্ব কমে আসবে, সংগঠনে যোগ দিতে আসা দলিত ছেলেমেয়েদের সংখ্যা কমবে। চাপ এল সেদিক দিয়েও।
কিন্তু বিএইচএস টিকে রইল। সদস্যসংখ্যা দশহাজার এবং ঊর্ধ্বগামী। ডোম-রা যাতে আস্তাকুড় ঘেঁটে খাবার না খান, তার জন্য প্রচার শুরু হল। লেখাপড়াও চলতে থাকল পাশাপাশি। বেশ কিছু ডোম ছেলেমেয়ে স্কুলে ভর্তি হল – অনেকেই তাদের পরিবারে প্রথমবার। কিন্তু চলার পথ সহজ নয়। উচ্চবর্গ ছেলেমেয়েদের পরিবার নিম্নবর্গের একই স্কুলে যাওয়া, মেলামেশা মেনে নিতে পারছিল না। শিক্ষক-শিক্ষিকারাও অনেকে ডোম পড়ুয়াদের উপেক্ষা করতেন।
“অনেকেই ভাবত এই ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখে যদি ভালো চাকরিবাকরি জুটিয়ে নেয়, তাহলে আর বর্গভেদ, অস্পৃশ্যতা থাকবে না। খর্ব হবে প্রতিপত্তি।“ – জানালেন সঞ্জীব।
বিএইচএস এসবে দমে যায় না। বরং তারা কিছু তহবিলের জোগাড় করতে পারে। ছ-জন মহিলা সমেত বারো জনের কোর টিম বানানো হয়। কিন্তু, দরকার আরও বড় কিছু। ডোম অধিকারকে মান্যতা দেবার প্রয়োজন। সামাজিক বৈষম্যের মূলে আঘাত করা দরকার। আলোচনা–পর্যালোচনা করতে করতে উপায় পাওয়া যায়। গঙ্গা কলস যাত্রা। ঠিক হয়, ফেব্রুয়ারি মাসে হবে এই অনুষ্ঠান। মহিলাদের এই সময় ক্ষেতে-খামারে কাজ কম থাকে। তা ছাড়া প্রবল গ্রীষ্মে হাঁটাও কষ্টদায়ক।
গঙ্গাদখল
প্রবল শীত উপেক্ষা করেও দূরদূরান্ত থেকে মহিলারা ২০১১-র গঙ্গা কলস যাত্রায় অংশগ্রহণ করতে পরবত্তা এসেছিলেন। কিছু কিছু টাকা দিয়ে অনেকে মিলে ট্র্যাক্টর ভাড়া করেছিলেন যাতায়াতের জন্য। প্রথম বছরে এসেছিলেন ১৭৫ জন। ২০১০ সালে প্রায় ৪০০। প্রতি বছরই মহিলারা তাঁদের ঘরকন্না সামলিয়ে, কিছুটা সময় বের করে নিজেদের অধিকার রক্ষার এই লড়াইয়ে সামিল হতে আসেন। আসেন ওবিসি মুসলিম মহিলারা, ধর্মের কারণে যাঁরা বৈষম্যের শিকার।
গঙ্গা কলস যাত্রার অন্তত একমাস আগে থেকে কুমোর মহিলারা জল বইবার ঘড়াগুলি বানাতে থাকেন। অন্যান্য বন্দোবস্তও চলতে থাকে, যেমন ফল কিনে প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরা, সমাবেশ স্থলে তাঁবু খাটানো, মাইক লাগানো। “এই বছর একজন ডোম অনুষ্ঠান পরিচালনা করবেন। যে রাজনীতিবিদকে আমন্ত্রণ করা হয়েছে, তাঁর সাথে একই মঞ্চে উনি থাকবেন। ডোমরা নিজেরাই নেতৃত্বে সক্ষম, কোনও রাজনৈতিক নেতার প্রয়োজন নেই তাঁদের পথ দেখানোর – এটা প্রচার হওয়া দরকার” – বললেন সঞ্জীব।
অনুষ্ঠানের আগের রাতে মহিলারা একটি ছোটো হলঘরে আশ্রয় নেন। ঘরের এককোণে সকলের জন্য ডাল-ভাত-সব্জি রান্না হয়। শীত বাড়তে থাকে, আলোও চলে যায়। কুপির আলোয় চলতে থাকে গানের আসর। কিন্তু সবাইকে ভোর চারটেতে উঠে নদীতে যেতে হবে। তাই ঘুমিয়ে পড়তে হয় তাড়াতাড়ি।
সূর্যোদয়ের অনেক আগেই পরিষ্কার জামা কাপড় নিয়ে মহিলারা ট্র্যাক্টরে এবং কয়েকটি জিপে চেপে নদীতীরে আসতে শুরু করেন। নদীতে স্নান সেরে সূর্য উঠলে ঘড়ায় জল ভরে নেওয়া হয়। কেউ কেউ সিঁথিতে সিঁদুর দেন, উচ্চবর্গীয় মহিলাদের মতো প্রসাধন করেন।
সকাল আটটা নাগাদ শুরু হয় পরবত্তার উদ্দেশ্যে হাঁটা। দুটো সোজা লাইন করে মাথায় কলস নিয়ে তাঁরা সমাবেশস্থল-এর উদ্দেশ্যে হাঁটতে থাকেন। আসে পাশে চলতে থাকে বিএইচএস এর ব্যানার দেওয়া একটি দুটি জিপ। লাউডস্পিকারে বাজতে থাকে স্লোগান। পরবত্তা শহর দেখতে থাকে। আগেও দেখেছে, কিন্তু এই বছর জমসমাগম অনেক বেশি। ছাদে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাঁরা দেখতে থাকেন প্রতীকী গঙ্গাজল ঘড়ায় নিয়ে একদা-দলিতদের সগর্ব মিছিল।
ঘড়াগুলিকে নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে সকলেই শামিয়ানা-র নীচে আশ্রয় নেন। প্রদীপ জ্বালানো হয়। প্রেসিডেন্ট এবং আমন্ত্রিত রাজনিতিবিদ বক্তৃতা দেন। মহিলারা ফল খেয়ে উপবাস ভঙ্গ করেন। এবং পরে রান্না খাবারও খাওয়া হয়। এই সুযোগে স্থানীয় প্রশাসনের প্রতিনিধিদের কাছে বিভিন্ন অভাব-অভিযোগও জানানো হয়। সমাবেশস্থলের পাশেই সরকারি বুথ থেকে স্বাস্থ্য শিক্ষা, আবাস, চাকরি সংক্রান্ত বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের খবর দেওয়া হয়।
বিকেল ৪টে নাগাদ অনুষ্ঠান শেষ হয়। মহিলারা বিশ্রাম নিচ্ছেন বা ইতিউতি ঘুরছেন। পুরোহিত দিয়ে চব্বিশ ঘণ্টা রামসীতা মন্ত্র পড়ানো হয়, টানা। ওইদিন বিকেল চারটে থেকে চলতে থাকে পরের দিন সন্ধ্যে অবধি।
মহিলারা ঘড়া নিয়ে আবার ফিরে যান নদীর ধারে। ঘড়াগুলি জলে ফেলে দেওয়া হয়। শপথ নেওয়া হয়, নির্যাতন প্রতিরোধের।
“আমি ডোমদের বোঝানোর চেষ্টা করছি যে গঙ্গা বা ধর্মীয় আচার, কোনটাতেই উচ্চবর্ণের অধিকার একচেটিয়া নয়” – সঞ্জীব আরও বলেন “ডোমদের মূলস্রোতে নিয়ে আসার জন্য গঙ্গা কলস যাত্রা একটা ছোটো অথচ গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। বহু বছর ধরে তাঁরা অবদমিত। সরকার নিম্নবর্গীয় মানুষদের জন্য প্রচুর প্রকল্প নিয়েছে। কিন্তু তাতে কি উচ্চবর্গের অত্যাচার কমেছে?”
বাকি রয়ে যাওয়া কাজ
২০১২ সালে তহবিল এর জোগান না থাকায় গঙ্গা কলস যাত্রা হয় নি, কিন্তু সবাই চান আবার শুরু করতে। কিছুদিন আগেই সঞ্জীব আমাকে ফোনে জানিয়েছেন, “ওঁরা এর মাধ্যমে একত্রে আসতে চান, একসাথে মজা করতে চান, নিজেদের শক্তি বুঝে নিতে চান।”
সঞ্জীব এই মুহূর্তে ভাবছেন কীভাবে ডোম ছেলেমেয়েদের দিয়ে সরকারের কাছে বাসস্থান আর আবাদী জমির দাবি করা যায়। আবাদি জমি থাকলে পরিবারের সারা বছর রোজগার থাকবে, ফলে ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতে পারবে।
“ওঁদেরকেই উঠে দাঁড়াতে হবে। আসল পরিবর্তন ওঁদের হাত দিয়েই আসবে” সঞ্জীব বলেন “আমি তো নিমিত্ত মাত্র।”
মূল লেখাঃ http://www.priyanka-borpujari.blogspot.in/2013/01/defiance-in-ganges.html অনুবাদক - কৃশানু মজুমদার