কথাটা কীভাবে নেবেন সেটা আপনার ব্যাপার তবে না বলে আর পারা যাচ্ছে না । মানে বলছিলাম যে আপনার চারিদিকে জগত জুড়ে উদার সুরে এইসব যা যা ঘটে চলেছে, যার জন্য রোজ গড়ে কয়েক কুড়ি ছিছিক্কার খরচ করেন, ভেবে দেখবেন, তার পেছনে আপনারও ভূমিকা কিছু কম নয়। আপাততঃ একটা-দুটো সোজা-সাপ্টা ব্যাপার দিয়েই শুরু করি, তারপর নাহয় গূঢ় বিষয়ে যাওয়া যাবে। যা বলব তা সবই আপনি জানেন, মানেন কিনা সেটা দেখা যাক।
যেমন ধরুন ‘আমরা-ওরা’। এই এক্কেবারে সাধারণ, স্বাভাবিক, আটপৌরে সর্বনাম জোড়া এই ক’বছরে এহেন শোরগোল তুলেছে আর এমন বদনাম কুড়িয়েছে যে পারলে এই দুটি শব্দকে গালাগালির অভিধানে জায়গা দিতে হয় ! কিন্ত সত্যি বলতে কি এই সেদিন সেই প্রাক-কলিযুগে সেই সাদা চুল-ধুতি-শোভিত ভদ্রলোক দু-একবার মুখ ফস্কে ‘আমরা ছক্কা ওরা ফক্কা’ জাতীয় কথা বলে ফেললেন আর সেই থেকে পৃথিবীতে হল ‘আমরা-ওরা’র চাষ, এমন গপ্পো তো নিজের দেওয়ালেও (ফেসবুকের) লিখতে লজ্জা করবে ! কারণ এই ‘আমরা-ওরা’র ভাগাভাগি কখনো ছেলে-মেয়ে, কখনো ঘটি-বাঙাল, কখনো আবার হিন্দু-মুসলমান, গেঁয়ো-শহুরে এই রকম হাজার হাজার রূপ ধরে চিরদিন আমাদের সামনে আস্ফালন করেছে আর আমরা চিরদিন তাদের নানাভাবে প্রশ্রয় দিয়ে এসেছি। সেই লক্ষ লক্ষ ছিদ্র পথে ঢুকে পড়া প্রায় অদৃশ্য ভাগাভাগির জীবাণুকে আমরা দেখেও দেখি নি যতক্ষণ না তারা আমাদের পায়ের নীচের মাটিকে আলগা করে দিয়েছে। অন্তঃসারশূন্য করে দিয়েছে আমাদের অস্তিত্বকে।
কীভাবে জানেন? এই যে আমরা-ওরা’র ধারণা তা যে আমাদের অস্তিত্বকে শুধু দুটি ভাগেই ভাগ করে ফেলছে, এমন নয়। বরং এই ধারণা একটা চলমান ব্যবস্থার মতো, যা প্রতিমুহূর্তে ভাঙছে, ‘আমরা’র পরিধির মধ্যেই ক্ষণে ক্ষণে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন ‘ওরা’র দল, যতটা ভাঙছে তার চেয়ে অনেক কম গড়ছে, তাই এই নিরন্তর ভাঙাভাঙির খেলার ‘আমরা’র পরিধি ছোট হতে হতে শেষ অব্ধি হাতে থাকছে স্রেফ আমি। আমিই। এমনকি আমার নিজের বিচারবুদ্ধিও আমার হাতে থাকছে না। একটা উদাহরণ দিই। ২০০২ সালে গোধরায় ট্রেনে হামলা হল, নিউটনের তিন নম্বর সূত্রকে নয়ছয় করে প্রতিক্রিয়া হল চূড়ান্তভাবে অসমান ও বিপরীত। দিনের পর দিন আমরা কাগজে পড়লাম সংখ্যালঘু নিধনের-ধর্ষণের গা-ঘুলিয়ে ওঠা কাহিনি, বিশ্বাস করতে কষ্ট হল ‘আমরা’ই এই কাজ করেছি। পূর্বপ্রান্তের এই নিরাপদ দুরত্বে বসে যেখানে গোধরা বা গুজরাট দুইই কেবল কাগজের খবর, সেখানে আমাদের বাঙালীদের কাছে গোটাটাই হতে পারত ‘ওদের’ ব্যপার, স্বাভাবিক হত দুটি বিষয়েই তীব্রভাবে দুঃখ পাওয়া, নিন্দা করা। কিন্ত এই কলকাতার শিক্ষিত, মননশীল, স্নেহময় মানুষদের মুখে শুনেছি ‘ঠিক হয়েছে, ‘আমরা’ কি চিরদিন ‘ওদের’ হাতে শুধু মারই খাব নাকি!’ যিনি বলছেন তাঁর জীবনে এই ‘আমরা’ মানে যে কোন হিন্দু, যিনি কোন না কোন সময়ে মুসলমানের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন! সেই হিন্দুরা যাঁরা তাঁর কোন আত্মীয় নয়, তাদের তিনি চেনেন না, এমনকি ঠিক জানেনও না, বরং অনেক বেশি চেনেন পাশের টেবিলে কাজ করা মুসলমান সহকর্মীকে, কিন্ত সেই মুহূর্তে তাঁর ‘আমিত্ব’ মানে স্রেফ হিন্দুত্ব। বা আরো ভাল করে বললে ‘অ-মুসলমানত্ব’। সেই সময়ে তিনি মনে মনে কোন নির্যাতিত হিন্দুর হয়ে প্রতিশোধ নিচ্ছেন গোধরার হিন্দুদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে। সেই হিন্দুত্বের ‘আমি’-ও এরপর ছোট ছোট টুকরোয় ভেঙে যাবে, ‘হিন্দু এবং বাঙালি’, ‘হিন্দু-বাঙালি-ঘটি’ এইরকম ভাবে। আর এই প্রতিটা পর্যায়ে তৈরি হবে কিছু ‘ওরা’ যাদের সঙ্গে তিনি(মানে ‘আমি’!)‘রিলেট’ করেন না। তাই কোন ঘটনায় আপনার প্রতিক্রিয়া কী হবে তা নির্ভর করবে শুধুমাত্র ঘটনার ওপর নয়, সেই ঘটনার সঙ্গে আপনি কিভাবে রিলেট করেন তার ওপর। যদি আপনি রিলেট করেন তা হলে যে ঘটনা তীব্রভাবে নিন্দা করবেন, না করলে সেই ঘটনাই আপনার কাছে ‘সাজানো’ মনে হবে, তাই হয়! কিন্ত ওই রিলেট করার ব্যাপারটাই বড্ড জটিল হয়ে পড়ছে দিনকে দিন।
তা না হলে জমি অধিগ্রহণের বিরোধিতা করতে গিয়ে পুলিশের গুলি খেয়ে কিছু লোক মারা গেল আর নিয়ম মাফিক আইন অমান্য করতে গিয়ে পুলিশি হেফাজতে একটি ছেলে মারা গেল, আপনার কাছে দুটো ব্যাপারই সমান কষ্টের, রাগের, প্রতিবাদের হওয়া উচিত ছিল। কিছু লোক রাজ্যের অর্থমন্ত্রীর ওপর হামলা করল, তাঁকে ধুতি-পাঞ্জাবি ছিঁড়ে হেনস্থা করল, আর কিছু লোক রাজ্যের একজন বর্ষীয়ান প্রাক্তন মন্ত্রীর ওপর হামলা করে তাঁকে দস্তুরমতো আহত করলঃ আপনি একজন শিক্ষিত, স্বাধীন নাগরিক, আপনার কাছে এই দুই ঘটনাই সমান নিন্দনীয় হওয়া উচিত ছিল। কিন্ত হল না। দিল্লির ঘটনার নিন্দা করতে গিয়ে আপনি সেই ঘটনার কতটুকু সাজানো, কতটা নিপুণ নাটক, তাই নিয়ে বেশি কথা খরচ করলেন, প্রেসিডেন্সিতে হামলার নিন্দা করতে গিয়ে কী কী হয়েছে তার থেকে কী কী হয়নি তাই নিয়ে বেশি কথা বললেন, এই রকম হল। কোন না কোন রাজনৈতিক দলকে আপনি সমর্থন বা বিরোধিতা করবেন এটা যেমন স্বাভাবিক, আপনার মৌলিক অধিকার, তেমনি কোন দলের রাজনৈতিক নীতিকে সমর্থন করলেও তার অন্যায়ের বিরোধিতা করাও যে আপনার মৌলিক কর্তব্য, এই কথাটা আপনার মনে থাকল না। উপরন্ত সেই কাজটা যদি কেউ করে ফেলেন (সে মৃণাল সেন থেকে কৌশিক সেন যে-ই হোক না কেন!)আপনি তাকে বললেন ধান্দাবাজ! নন্দীগ্রামে গুলি চালানোর প্রতিবাদের পর থেকে ‘সুশীল সমাজ’, ‘বুদ্ধিজীবি’ ‘মোমবাতি মিছিল’ এইসব কথাগুলোকে আপনি প্রায় গালাগালির পর্যায়ে নামিয়ে এনেছেন কিন্ত আজ আবার সেই কথাগুলোর কাছেই আশ্রয় চাইছেন। মানে সেদিন প্রতিবাদ করার জন্য যাদের গালি দিয়েছেন, আজ চুপ করে থাকার জন্য তাদেরই গালি দিচ্ছেন (বা উল্টোটা)! আর একটা ঘটনার বিচার করতে হলেই যে আগের ঘটনার সূত্র ধরে টানছেন, তাও ভারি গোলমেলে ব্যাপার! সেকালে বড়লোকের মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে পুলিশি অবিচারের শিকার হয়ে এক যুবক আত্মহত্যা (?)করতে দেখেছেন বলেই এ-যুগেও একটি মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে পুলিশি চাপে এক যুবকের গায়ে আগুন লাগিয়ে পড়ে যাওয়াকে ‘স্বাভাবিক’ বলে মেনে নেবেন, এ কেমন কথা!
কিন্ত এইটুকু পর্যন্ত যে সিপিএমত্ব বনাম তৃণমূলত্বের সরল গল্পটা শুনলেন, সেটাই সবটা নয়। কারণ এই অবধি আমরা-ওরার গল্পে অন্ধবিশ্বাস আছে, রিলেট করা ততটা নেই। কিন্ত মফস্বলের এক শিক্ষিকাকে কটুক্তি করা বা আঘাত করার সময়ে যে আপনি চুপ করে ছিলেন বা বলেছিলেন ‘কী হয়েছে সঠিক না জেনে ...’ ইত্যাদি, সেই আপনিই কিন্ত প্রেসিডেন্সির হামলায় তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানাতে পিছপা হলেন না, যে আপনি শর্মিলা চানু বা সোনি সোরির কথা শুনেই ভুলে যান সেই আপনিই কিন্ত দিল্লির গণধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে ‘নির্ভয়া’ বলে ডাকেন, তসলিমা নাসরিনের রাতারাতি কলকাতা ছাড়ার জন্য বা মকবুল ফিদা হোসেনের দেশ ছাড়ার যে সময় আপনি বলেছিলেন ‘ওরা গোলমাল বাধিয়েছে, তাই ওদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে’ সেই আপনিই অম্বিকেশ মহাপাত্রের গ্রেফতারের সময় ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ বিষয়ে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। একজন আজমল কাসভকে কেন এক্ষুণি ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে না তাই নিয়ে অনেক কথা খরচ করেন কিন্ত একজন আফজল গুরুর প্রতি রাষ্ট্রের আচরণ কতটা যথাযথ (মানবিক কিনা সে কথা তো দুর-অস্ত)তাই নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবেন না, কারণ কাসভ যাদের খুন করেছে আপনি তাদের সঙ্গে রিলেট করেন, আফজল গুরু-র মতো ‘ওরা’ যারা উপদ্রুত এলকার বাসিন্দা তাদের সঙ্গে রিলেট করেন না! আর সর্বোপরি দেশের সেনাবাহিনি আপনার কাছে সবসময় নায়ক আর অন্য দেশের সেনা হল জঙ্গি ইত্যাদি। এই হল রিলেট করা। এরই অপর নাম হল পক্ষপাত। অর্থাৎ আপনার বিচার-বুদ্ধি-বিবেক নিরপেক্ষ হচ্ছে না, এক-একটা গণ্ডীর মধ্যে এক এক ভাবে কাজ করছে। এইটা হয় তো কোন নতুন কথা নয় বরং মানুষের মৌলিক আচরণের মধ্যেই পড়ে কিন্ত শুধু সেই কারণেই তো আর চুপ করে মেনে নেওয়া যায় না!
আগেই বলেছি, এইখানে আমি কোন নতুন কথা বলছি না, যা বলছি সবই আপনার জানা। কিন্ত আপনাকে মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে কারণ এই যে পনেরই অগস্ট, ছাব্বিশে জানুয়ারি, জনগণমন দিয়ে সাজানো আপনার জীবন, এই যে আপনার মত প্রকাশের স্বাধীনতা, প্রতিবাদ করার অধিকার, ভোট ভেবার অধিকার, এই সব কিছু জন্মসূত্রে পেয়েছেন বলেই এইগুলো আপনার অধিকার কিন্ত এই সব কিছুর প্রতি আপনার কিছুমাত্র দায়িত্ব নেই, এমন কিন্তু নয়। গণতন্ত্র নামক যে ইন্সটিটিউশন আপনাকে এই যাবতীয় সুযোগ-সুবিধার ভাগীদার করেছে, আপনার মতামতকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পর্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছে, তাকে টিকিয়ে রাখতে গেলে, তার কাছে সৎ থাকতে গেলে আপনারও কিছু খরচা আছে। বেশি কিছু নয়, চশমার কাঁচটা একটু মুছে নেওয়া যাতে দৃষ্টিটা কিঞ্চিৎ পরিষ্কার হয়, নিজের ‘আমি-আমরা’র গণ্ডী ছাড়িয়ে একটু দূর অবধি দেখতে পান! আর একটা ঘটনা আর তার প্রতিক্রিয়া দুটো যে আলাদা বিষয় সেটা যেন সবসময়ই গুলিয়ে না যায়। মানে গোধরায় ট্রেনে হামলাটা খুব খারাপ কাজ হয়েছিল মনে করেন বলেই বলেই গুজরাটের সুপরিকল্পিত দাঙ্গাকে আর নিন্দা করতে পারবেন না এমন যে নয়, চুরি করা অন্যায় বলেই পিটিয়ে মেরে ফেলাকে যে সমর্থন করতে হয় না আর কোন মেয়ের পোষাক-আশাক পছন্দ না হলেই তাকে হেনস্থা করাকে যুক্তিযুক্ত বলা যায় না, এই বোধটুকু যেন স্বচ্ছ থাকে।
আরো একটা কথা স্পষ্ট করে বলা দরকার, ‘আমরা-ওরা’-র ভাগাভাগিকে প্রশ্রয় না দেওয়ার করার অর্থ কিন্তু মানুষের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যকে অস্বীকার করা নয়। বরং প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব অবস্থানকে সম্মান করে তার জায়গা থেকে যে কোন পরিস্থিতি বিচার করা। মানে ‘ওরা’ রবীন্দ্রনাথ না পড়ুক, ইংরেজি না জানুক, মুসলমান হোক বা অন্য কিছু, বড়লোক হোক বা গরীব মেহনতি মানুষ’, মেধাবী হোক বা নির্বোধ, আমার নিজের ন্যায়-অন্যায় বিচারবোধ যেন সেসব দিকে না তাকায়, এইটাই মনে রাখার কথা। আমাদের সামাজিক ‘বিবেক’-এর ভূমিকায় রয়েছেন (তার জন্য গালাগালিও কম খাননি) যে আশি বছরের যুবক তিনি বক্তব্য রাখার বিষয়ে বলেছেন ‘কথাটা এ নয় যে ‘ওদের’ ‘আমরা’ করে তুলতে হবে, বরং এই হবার কথা ছিল যে ‘ওরা’ ‘আমরাই’। সেটা লক্ষ্য না করে করে, আমরা-ওরার যে বিভাজনটা দূর করারই দায়িত্ব ছিল আমাদের, একটা শব্দব্যবহারের মধ্য দিয়ে সেটাকে হয়তো-বা বাড়িয়েই চলেছি আমরা’। শুধু শব্দব্যবহারের সীমা ছাড়িয়ে বিস্তৃত প্রেক্ষাপটেও এই কথা সত্যি। আমাদের যাবতীয় ভাবনা ও আচরণের ক্ষেত্রেই সত্যি। কারণ আমাদের অস্তিত্বের পরতে পরতে বাসা করে আছে যে পক্ষপাতদোষ তাকেও আমরা স্বাভাবিক তো বটেই, প্রায় নৈতিক বলেই যেন মেনে নিয়েছি। তাই যেকোন বিষয় তখনই আমাদের কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে, সত্যি হয়ে উঠছে যখন তা আমাদের নিজেদের সঙ্গে ঘটেছে বা ঠিক নিজেদের মতো কারুর সঙ্গে ঘটেছে। কিন্ত সেইভাবে চলে আমরা নিজেরাই যে আসলে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছি, সমাজের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে, সে কথা ভেবে দেখার সময় হয়েছে। আমাদের সামনে দিয়ে বুক ফুলিয়ে ঘুরছে খুনের আসামী, ক্ষমতায় উঠে আসছে দুর্নীতির নায়করা, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের হোতা হয়ে উঠছেন মহান জননেতা আর এই সব ঘটনার কোনকিছুই ‘আমাদের’ বৃত্তের মধ্যে ঢুকছে না! এই জন্যই শুরুতে বলেছিলাম, যা ঘটছে চারপাশে তাতে আমাদেরও কিছু অবদান আছে!
তাহলে কি আমি অপেক্ষা করে থাকব কবে সেনাবাহিনির জওয়ান আমার মেয়েকেই টেনে নিয়ে যাবে, কবে আমারই ছেলেকে পারিপার্শ্বিক প্রমাণের ভিত্তিতে (পড়ুন বিনাবিচারে) নাশকতার অভিযোগে খুন হয়ে যেতে হবে, আমারই টাকা লোপাট হয়ে যাবে, আমারই ভাইয়ের আঁকা ছবি কেউ কিছু না বুঝেই সাম্প্রদায়িক লেবেল সেঁটে দেবে বা আমার বোনের লেখাকে ‘উস্কানিমূলক’ বলে প্রচার করে তাকে দেশছাড়া করবে, আমার ভাষাকে, সাহিত্যকে, শিল্পকে প্রান্তিক বলে ঠেলে দেবে......। নাকি যে কোন বিষয় সামনে এলে মতামত দেওয়া এমন কি না দেওয়ার আগেও (মতামত না দেওয়াও একটা মতামত) একটু ভাববো কেন এমন হল! ওদের কথাও একটু মন দিয়ে শুনবো আর নিজেকে ওই ‘ওদের’ জায়গাটায় বসিয়ে দেখব এই ঘটনা আমার সঙ্গে হলে, আমার বাবা-মা-ভাই-বোন-ছেলে-মেয়ে-র সঙ্গে হলে কী করতাম, কী ভাবতাম! এই স্টেপটা সবচেয়ে কঠিন, কেবলই মনে হবে আমার সঙ্গে কক্ষনো এমন হত না, আমার এতসব ভাবার কী দরকার ইত্যাদি ইত্যাদি, কিন্তু এই স্টেপটা ‘জাম্প’ করে যাওয়া যাবে না।
ওই দেখুন কথায় কথায় কখন আপনার কথা থেকে আমাদের কথা হয়ে একেবারে আমার কথায় চলে এসেছি! যাকগে ওই নিয়ে ভাববেন না, আপনি আর আমি তো আসলে একই ... এপিঠ আর ওপিঠ। তাই আলাদা কিছু হবে না।
পুনশ্চঃ এই লেখার সময় পর্যন্ত কামদুনি ঘটেনি, ২১শে জুনের মিছিলে কলকাতা হাঁটেনি। তাই এই লেখায় কোথাও কামদুনি নেই। কিন্ত সেই মিছিলের পর সুবোধ সরকার আনন্দবাজার পত্রিকায় (০২-০৭-১৩) যে স্বীকারোক্তি করেছেন, পড়ে মনে হয়েছে ঠিক এই কথাই আমিও বলতে চেয়েছি। চাইছি। তাই সেই লেখা থেকে একটু তুলে দিলাম।
“নন্দীগ্রামে গুলি চলার পর আমি সে দিন হাঁটিনি। অন্যায় করেছিলাম না হেঁটে। আমাকে কেউ বলেনি হেঁটো না, আমি নিজে থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম না-হাঁটার। দায় আমার। আমি কোনও দিন কোনও দলের ছিলাম না, হয়ে গেলাম একটা দলের। যাঁরা হাঁটছেন, তাঁদের সবার সঙ্গে হাঁটা যায় না। কমা নয়, দাঁড়ি নয়, একটা ভুল সেমিকোলন কাজ করেছিল আমার সংকটে। সেই সেমিকোলনটা আজ একটা টিউমার হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আমার আগুন লাগা অবচেতনায়। ‘সে দিন হাঁটেননি, আজ হাঁটতে এলেন কেন? আপনার হাঁটার অধিকার চলে গেছে, বাড়ি ফিরে যান।’ আত্মধমক নিয়ে হাঁটতে শুরু করি। আত্মধমক হয়ে ওঠে আত্মধিক্কার, আত্মধিক্কার হয়ে ওঠে চারটে লাইনঃ‘কী ভুল আমি করেছিলাম
কেন সে দিন হাঁটিনি মহামিছিলে?
চোখের জল মুছে সে দিন তুমি
হাঁটতে বলেছিলে।’কিন্তু সে দিন যাঁরা হেঁটেছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ কেন আজ বাড়িতে বসে আছেন? তাঁরা স্ব-স্ব ক্ষেত্রে কৃতী, তাঁরা আমার মতো ভুল করতে পারেন না। তা হলে কী দাঁড়াল? বিভাজন থাকবেই? আমরা-ওরা ঘুচবে না? সে দিন ওঁরা হেঁটেছিলেন, আমি হাঁটিনি; আজ আমি হাঁটছি, ওঁরা হাঁটতে আসেননি। এই কি তবে ঠিক হল যে, এমন করেই হাঁটতে হবে আর সবাইকে গাইতে হবে হুকুম মতো গান? হুকুমটা সব সময় বাইরে থেকে আসে না, ভিতর থেকেও উঠে আসে। এক বস্তাপচা আলুর মতো আমাদের পিঠে চাপানো রয়েছে ইডিয়োলজি। সেটা ফেলে উঠে দাঁড়ানোর সময় এসেছে। যে ইডিয়োলজি মানুষের কাজে আসে না, তার লজিক যত বড়ই হোক, সেটা লেজে-গোবরে হতে বাধ্য। যে কমিউনিজম নন্দীগ্রাম করেছে, নেতাই করেছে, ছোটআঙারিয়া করেছে, ২১ জুলাই করেছে, সেই কমিউনিজমকে আমি প্রত্যাখ্যান করি। এক জন প্রাইভেট মার্ক্সিস্ট হিসেবে মনে করি, কামদুনি হলে আমি ছুটে যাব, রাস্তায় যাব...”