সেই প্রথম দিনের জেল প্রবেশের কথা মনে পড়ছে।
গাড়ি থেকে যখন নামানো হল, তখন আমরা সংখ্যায় পরিণত হয়েছিলাম। গরু বাছুরের মত আমাদের বারবার গোনা হচ্ছিল, এরপরে একটা অন্ধকার করিডোরে নিয়ে যাওয়া হল। আমরা চারজন একজনার পিছনে আরেকজন ঢুকছি, আমাদের সামনে পিছনে চারজন কারা প্রহরী। সবার আগে রাসেল ভাই, তারপরে শুভ, তারপরে আমি, সবশেষে বিপ্লব ভাই। আমাদের ১৪ সেলে নিয়ে গেল। ১৪ সেলের দরজা দিয়ে ঢোকার সাথে সাথেই চারদিক থেকে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল, তাদের টিনের বাসন দিয়ে শব্দ করে কান ঝালাপালা আবস্থা। তারা সবাই একসাথে স্লোগান দিতে লাগলো; বলতে লাগলো, "নাস্তিকমুক্ত জেলখানা চাই", "নাস্তিকদের আজই ফাঁসি চাই", "জেলখানায় নাস্তিক, মানি না মানবো না"।
একটা সিনেমাতে এমনটা দেখেছিলাম। খুব বিখ্যাত একজন খুনী জেলে ঢোকার পরে সিনেমাটায় এমন হয়েছিল। জেলখানায় খুনী ধর্ষক মাদকব্যবসায়ী সকলেই আছেন, এমন কোন অপরাধ নেই যা এক একজন করে নি। কেউ নিজের মা কে হত্যা করেছে তো কেউ ছোট একটা বাচ্চা মেয়েকে ধর্ষন করেছে, আবার কেউ ২০-২৫ টা খুন করেছে, কেউ বা দেশ ফেনসিডিলের বন্যায় ভাসিয়ে দিয়েছে। সবাই আছে থাকবে ছিল, কিন্তু পুরো জেলখানায় চারজন ধর্মে অবিশ্বাসী নাস্তিকের জায়গা নেই! যেন পৃথিবীর সবচাইতে বড় অপরাধ হচ্ছে ঈশ্বরে অবিশ্বাস করা, মনে হচ্ছিল চিন্তা করতে পারার মত, নিজের বিশ্বাস অবিশ্বাসের সিদ্ধান্ত নিজে পছন্দ করার মত খারাপ কাজ এই শতাব্দীতে আর একটিও নেই।
সত্যিকথা বলতে কী, এই কথাটি বলে তারা ধার্মিকদের জয়গান গাইলো নাকি প্রকারান্তরে নাস্তিকদেরই জয়ধ্বনি দিল, সেটা বোঝা গেল না। কারণ জেলখানা তারা ধার্মিক দিয়ে পূর্ণ করে ফেললে ধর্মের সম্মান হয় নাকি অসম্মান, সেটা একটা সুন্দর বিতর্কের বিষয় হতে পারে, তবে সেই বিতর্কে তখন যাবার মত অবস্থা ছিল না। আমি সম্ভবত তাদের বেশ পছন্দের ছিলাম, তারা বলতে লাগলো, "ঐ যে তিন নম্বরটা আসিফ মহিউদ্দীন" এবং সেই সাথে আমার পরিবার পরিজন পূর্বপুরুষের সবাইকে খুব সভ্য ভদ্র মার্জিত ভাষার বুলি সমূহ। স্বঘোষিত ধর্মরক্ষকগণের এহেন বুলি শুনে কারো মনে তাদের পবিত্র ধর্ম সম্পর্কে কী ধারণা হওয়া উচিত, তা পাঠক মাত্রই বুঝে নেবেন। এর চাইতে বেশি কিছু বলা শোভন হবে না, এই মুহূর্তে আরেকটি মামলা খেয়ে যাবার কোন ইচ্ছা নেই। তবে খাঁটি ধর্মপ্রাণ সমাজ আসলেই এরকমই হবে, এরকমই হবার কথা।
যাইহোক, আমাদের ঢোকানো হল একটি ১০/৬ ফুট সেলে, রুম নম্বর ১০; চারজন সেই রুমে ঢোকার পরে তালা লাগিয়ে দেয়া হলো, এবং তখনও চারিদিকে প্রচণ্ড হৈচৈ, হট্টগোল। আমাদের সবাইকে তারা সকাল বেলা কীভাবে জবাই করবে, আমাদের কোন পথে কী প্রবেশ করাবে, তার পুংখানুপুংখ বর্ণনা তারা দিয়ে গেলো। একজন লুঙ্গি খুলে নাচতে শুরু করলো, এবং আমাদের ডাকতে লাগলো, ডেকে ডেকে তার বিশেষ বিশেষ অঙ্গ প্রত্যঙ্গ প্রদর্শন করতে লাগলো। সকালে তারা লাইন ধরে কীভাবে ঐ প্রত্যঙ্গ দিয়ে অনেক কিছুই করবে বলে হুমকি দিল, আর আমরা অবাক হয়ে ভাবতে লাগলা, এদের নামই তবে ধার্মিক? ভয়াবহ বীভৎস পরিস্থিতি। আমরা চুপচাপ সব শুনে যাচ্ছি, কারণ আমাদের কিছুই করার নেই। রুমের ভেতরে একটা ফ্যান ঘুরছে, তারপরেও প্রচণ্ড গরমে আমরা দর দর করে ঘামছি।
একটু পরে কেউ একজন বাইরে থেকে আমাদের ফ্যানটি বন্ধ করে ষোলকলা পূর্ণ করলো। রুমের ভেতরে তখন মোটামুটি সাহারা মরুভুমির মত অবস্থা। নিচের ময়লা কম্বল আমাদের ঘামে ভিজে যাচ্ছে। কারো কাছে সিগারেট ছিল না, আমি বুদ্ধি করে ঢোকার সময় ২৪০ টাকা দিয়ে এক প্যাকেট বেনসনের ব্যাবস্থা করেছিলাম। প্যাকেটটা বের করতেই দেখা গেল, সবার কাছ থেকেই লাইটার এবং ম্যাচ রেখে দেয়া হয়েছে। আমরা কারারক্ষীদের ডাকতে লাগলাম। কারারক্ষীদের দূর থেকে দেখা যাচ্ছে, কিন্তু তারা সামনে আসছে না। দূরে বসে মজা দেখছে। প্রায় ঘন্টাদুয়েক ডাকাডাকির পরে একজন আসলো, এবং বললো কী হইছে। আমরা ফ্যানটা ছেড়ে দিতে বললাম, সে ফ্যানটা ছেড়ে বললো কেউ মনে হয় ভুলে বন্ধ করে দিয়েছে! বুঝতে পারলাম তারাই এই কাজটি করেছে। এরপরে অনেক অনুনয় বিনয়ের পরেও সে একটা লাইটার বা ম্যাচ আমাদের দিলো না। সারারাত সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে বসে থাকলাম আর তাদের চেঁচামেচি শুনলাম, আমি একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে নিয়ে টানার চেষ্টা করছিলাম। তখন মনে হচ্ছিল এই রকম পরিস্থিতিতে কী করা উচিত আসলে!
সকালের জন্য অপেক্ষ করছিলাম, সকালে কিছু না কিছু একটা ব্যবস্থা হবেই। প্রচণ্ড ভীত তখন, সকালে কী হবে জানি না। হয় কোন ব্যবস্থা হবে, নতুবা একপাল ভয়ঙ্কর অপরাধী আমাদের চারজনকে কচুকাটা করবে। গরমে ঘুম বারবার ভেঙ্গে যাচ্ছে, ঘেমে নেয়ে উঠছি আর শুনছি আমাদের বিরুদ্ধে তখনও স্লোগান চলছে। তাদের গালি গুলো অসম্ভব সৃজনশীল, কীভাবে তারা এই গালিগুলো চিন্তা করে বের করে সেটা এক অশ্চর্য বিষয়! তখনও আমরা জানি না আমাদের ছেড়ে দেবে নাকি আটকে রাখবে। আমরা ভাবছি আজকের রাতটাই তো, সকালেই ছেড়ে দেবে। আমাদের বিরুদ্ধে তো পুলিশ কোন প্রমাণ হাজির করতে পারে নি। তখনও জানতাম না, দুঃস্বপ্নের সবে শুরু।