তখন রাত দেড়টা। ডিবি অফিসে হাজতখানার পাশের লম্বা টুলে শুয়ে শুয়ে আমি যতীন সরকারের একটি বই পড়ছি(অনেক কষ্টে বই পড়ার অনুমতি পেয়েছিলাম); গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার কয়েকজন পুলিশ সহ আসলেন দুইজন হেফাজত ইসলামের সদস্যকে নিয়ে। সদস্যদ্বয় বয়সে তরুণ, একজনার দাড়ি বড় হয়েছে, আরেকজনার দাড়ি এখনও বেশি গজায় নি।
আমাকে দেখিয়ে পুলিশ উপ-কমিশনার জিজ্ঞেস করলেন, এই লোককে চেনোস?
তারা দুইজন আমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলো, তারপরে বড় জন চোখ বড় বড় করে বললো, হ স্যার চিনি। এর নাম আসিফ মহিউদ্দীন। পেপারে এর ফটো দেখছি।
কমিশনারঃ এই লোক কে?
হেফাজতঃ এই লোক বলকার, শাহবাগ পার্টি। বিরাট নাস্তিক, নাস্তিকগো সর্দার।
কমিশনারঃ এই লোকেরে বাইরে পাইলে কী করবি?
হেফাজতঃ ইনশাল্লাহ জবাই দিমু।
কমিশনারঃ হালা কত্ত বড় সাহস, আমার সামনে এই কথা কইলি? কেন জবাই দিবি?
হেফাজতঃ এই লোক ইসলাম আর নবী নিয়া ব্লগে খারাপ কথা কইছে।
কমিশনারঃ তুই কি ব্লগ পড়স?
হেফাজতঃ না স্যার, আমার বড় হুজুরে কইছে।
কমিশনারঃ তোর বড় হুজুর কি ইন্টারনেট চালায়? সে ব্লগে গিয়া পড়ছে?
হেফাজতঃ না স্যার সে কম্পিউটার চালাইতে পারে না। সে পেপারে পড়ছে।
কমিশনারঃ কোন পেপারে?
হেফাজতঃ আমারদেশ পেপারে।
কমিশনারঃ তুই কি ব্লগে ঢুইকা দেখছস তার লেখা? না দেইখাই জবাই দিবি?
হেফাজতঃ স্যার, কথা যখন উঠছে কিছু না কিছু তো হইছেই, নাইলে পেপারে আইবো ক্যান? তার উপরে সে নিজে স্বীকার করে সে নাস্তিক। হাদিসে আছে ইসলাম ত্যাগের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তাই জবাই দেয়াই লাগলো। আমাগো কিছু করার নাই স্যার, যেইটা নিয়ম সেইটাই।
সেই রাত্রে এই দুই হেফাজতির জন্য কোন খাবার ছিল না, ক্যান্টিন ৯ টার সময়ই বন্ধ হয়ে যায়। আমি তাদের একটু কেক খেতে দিলাম, কিন্তু তারা নাস্তিকের খাবার খাবে না, যদিও তাদের চেহারা দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছিল তারা ক্ষুধার্ত। এরপরে কমিশনার আমার দিকে তাকালেন। বললেন আপনি এদের সাথে একটু আলাপ করেন, আমরা একটু শুনি। আমি আলাপ শুরু করলাম।
এই ধরণের মাদ্রাসার ছাত্রদের কিভাবে নাস্তানাবুদ বানাতে হয়, সেটা আমার জন্য খুব কঠিন না। ৩০ মিনিটের মধ্যে পুলিশের চরম ধার্মিক ব্যক্তিটিও দেখি আমার সুরে কথা বলতে শুরু করেছে। কমিশনার থেকে শুরু করে সবাই তখন মোটামুটি আমার পক্ষ হয়ে তাদের সাথে তর্ক করছে। যদিও তারা ব্যাপক ধর্মপ্রাণ, কিন্তু আমি এমন কয়েকটা প্রশ্ন করেছি যে, বেচারাদের চেহারা লাল হয়ে গেছিল। আমতা আমতা করে বলছে, এই প্রশ্নের উত্তর তাদের কাছে নাই, বড় হুজুরের কাছে জিজ্ঞেস ক’রে তারা পরে আমাকে এই উত্তর জানাবে। এই নিয়ে হাজত খানায় ব্যাপক হট্টগোল, দুই পক্ষ হয়ে চরম তর্ক বিতর্ক। একদল আমার পক্ষ, আরেকদল ঐ পক্ষ। ঐ পক্ষ বলছে ধর্ম নিয়ে যুক্তি দেয়া ঠিক না, আরেকপক্ষ বলছে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারোস না তোরা কিয়ের হেফাজত করোস? কিয়ের নামাজ রোজা করোস? এরপরে নানাভাবে ব্যর্থ হয়ে দুই হেফাজতি আমাকে তাদের সাথে নামাজ পড়তে অনুরোধ জানালো, বললো নামাজে দাঁড়ালেই নাকি আমি সব উত্তর পেয়ে যাবো! আমি বললাম আমি যেহেতু কোন ধর্মেই বিশ্বাসী না, সেহেতু প্রার্থনা আমার জন্য কোন অর্থ বহন করে না। নামাজের পরে আরো ২ ঘণ্টা কথা বললাম। দুই ঘণ্টা পরে তারা আর আমার সাথে কথা বলবে না বলে প্রতিজ্ঞা করলো, কারণ আমার সাথে কথা বললে নাকি তাদের ইমান দুর্বল হয়ে যাবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে!
এর দুইদিন পরে। আমি বসে আছি উপ-কমিশনারের রুমে। বড় হেফাজতিটাকে নিয়ে আসা হলো। আমাকে দেখিয়ে বলা হলো, এই লোকটা কেমন? মানে মানুষ কেমন?
হেফাজতিটা বললো, সে মানুষ হিসেবে ভাল। মনটা ভাল আছে, লোক খারাপ না, কিন্তু সমস্যা হইলো নাস্তিক। নাস্তিক না হইলে তারে খুব ভাল মানুষই বলা যাইতো।
কমিশনারঃ এখন বল, এরপরে এরে রাস্তায় পাইলে কি করবি?
হেফাজতিঃ স্যার ইনশাল্লাহ জবাই দিমু?
কমিশনারঃ কি কস? তুই না কইলি মানুষ ভাল, তাইলে জবাই দিবি ক্যান?
হেফাজতিঃ স্যার এইটা হাদিসে আছে, আমাগো ধর্মের নিয়ম। ধর্মের বাইরে তো যাইতে পারুম না। সে যত ভাল মানুষই হোক, নাস্তিক হইছে মানে এরে আল্লাহর নামে শাস্তি দেয়া ছাড়া উপায় নাই। এ যদি তওবা কইরা আবার মুসলমান হয়, তাইলে একটা কথা আছে।
কমিশনার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, এরে বাইরে পাইলে আপনি কী করবেন? আমি ঠোঁট উলটে বললাম, এক কাপ চা খাওয়া যাইতে পারে, আর কাঁধে হাত রেখে একটু আলাপসালাপ করতে পারি। আর কী করবো?
নাহ, তারা তাদের লাইনে ঠিকই আছে। অন্তরে যা বিশ্বাস করে সেটাই বলে, অন্তত হিপোক্রিট না। সমস্যা এদের শিক্ষায়, বিষবৃক্ষের গোঁড়ায়, এদের ধর্মান্ধ মৌলবাদী "হয়ে ওঠায়"; কেউ মৌলবাদী হয়ে জন্মায় না, ক্রমশ পরিণত হয়। আর এই হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটার বিরুদ্ধেই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে, মাদ্রাসার এই অল্পশিক্ষিত ছেলেগুলোর বিরুদ্ধে নয়। একই কথা প্রযোজ্য জামাত শিবির হিজবুতিদের ক্ষেত্রেও। যুদ্ধটা প্রথা, প্রতিষ্ঠান এবং ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হলেও আরেকজন ব্যক্তি এসে শূন্যস্থান পূরণ করবে। তাই আঘাত করতে হবে শেকড়ে।