এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • মত প্রকাশ এবং তথ্য অধিকার আন্দোলন’ ২০১৩

    আসিফ মহিউদ্দীন লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১০ অক্টোবর ২০১৩ | ৯২৭ বার পঠিত
  • গত কয়েকবছর ধরেই ব্লগার, অনলাইন একটিভিস্ট নামগুলো আমাদের পত্রপত্রিকাতে বারবার শোনা যাচ্ছিল। ব্লগারদের নানাবিধ অন্যান্য পরিচয় রয়েছে, তারা কেউ সাংবাদিক, কেউ লেখক, কেউ কবি, কেউ রাজনৈতিক কর্মী। সাধারণত ব্লগার বা অনলাইন একটিভিস্ট পরিচয়টা তখন খুব বেশি মুখ্য হয়ে ওঠে নি, এই পরিচয়টিকে কেউ তখনও খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন নি। কিন্তু গণজাগরণ মঞ্চ হয়ে যাবার পরে, চারিদিকে প্রচুর মানুষজনই যে ব্লগার বা ব্লগের পাঠক বা ইন্টারনেটে লেখালেখির সাথে কমবেশি যুক্ত, অন্তত পাঠক, এই পরিচয়গুলো প্রকাশ করতে শুরু করে। তখন দেখা গেল ব্লগের পাঠক বা লেখক, ফেসবুকের পাঠক বা লেখক নেহাত কম নয়। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যে, আপনাকে ব্লগার বা অনলাইন একটিভিস্ট হতে হলেই যে খুব ভাল লিখতে হবে, বা খুব বোদ্ধা হতে হবে এমন কোন ব্যাপার নেই, এখানে আপনাকে যোগ্যতা প্রমাণ বা পরীক্ষা দিয়ে পাশ করতে হবে না। আপনি একজন সাধারণ পাঠক, বা মন্তব্যকারী, আপনিও একজন কর্মী। আপনার এবং অন্যদের মিথস্ক্রিয়াতেই অনলাইনে যেকোন আলোচনা, যেকোন তর্ক বিতর্ক জমজমাট হয়ে ওঠে। তাই এখানে প্রতিটি মানুষই সে ব্লগ লেখক হোক কিংবা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দাতা, অথবা সাধারণ মন্তব্যকারী, বা শুধুমাত্র পাঠক, সকলেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
    গণজাগরণ মঞ্চ হবার পরে সত্যিকার অর্থে রাজনৈতিক নেতারা ব্লগার এবং অনলাইন একটিভিস্টদের শক্তিসামর্থ্য, তাদের যেকোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার অবস্থানের কথা, তাদের প্রতিবাদ করার অভিনব পদ্ধতির স্বরূপ দেখতে শুরু করলো, এবং তখন থেকেই তারা ভীত হতে শুরু করলো। কারণ আমাদের প্রতিটি রাজনৈতিক দলই রাজনীতিকে দুর্বৃত্তায়নের অভয়ারণ্য বানিয়ে ফেলেছে, নিজেদের একচেটিয়া পারিবারিক ব্যবসা বানিয়ে ফেলেছে, তাই এখানে তারা অন্য কাউকেই স্থান দিতে ইচ্ছুক নয়। একসময়ে দেশ এবং রাজনীতি নিয়ে উদাসীন তরুণরা আড়মোড়া ভেঙ্গে জেগে উঠেছে, আজকের তরুণ সমাজ রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে, তারা রাজনীতিতে নাক ঢোকাবার চেষ্টা করছে, এটা আমাদের অসৎ রাজনীতিবিদদের জন্য এক বড় অশনি সংকেত। কারণ তারা জানে তারা নিজেরা কতটা নীতিহীন আদর্শের, তাই এই মনোপলি ব্যবসায় অন্যরা ঢুকে পরলে তাদের আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। পাঁচবছর এই দল আর পাঁচ বছর ঐ দলের এই অশুভ চক্র ভেঙ্গে পড়বে, তাদের সমস্ত কুকর্ম জনসম্মুখে চলে আসবে। তাই তারা ভীত, এবং ব্লগারদের দমন করা তাদের জন্য জরুরী হয়ে পড়েছে। তারা এমনভাবে ব্লগারদের গ্রহণ করেছে যে, তাদের সাজানো রঙ্গমঞ্চে এরা আবার কোন আপদ?
    রাজনৈতিকদলগুলো বুঝে গেছে ব্লগাররা একটা শক্তির কেন্দ্র হয়ে উঠছে, এদের আর ছোট করে দেখার উপায় নেই। পরবর্তীতে এই ব্লগাররাই যখন ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে নানা ইস্যুতে সোচ্চার হবে, আন্দোলনে নামবে বা সরকার বিরোধী গণজাগরণের নেতৃত্ব দেবে, সেটা এখন বা পরবর্তী, সব সরকারেরই মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তাই শাহবাগের আন্দোলনে তারুণ্যের এই নতুন শক্তির কেন্দ্রটির, বাঁধভাঙা টগবগে যুবকদের স্ফুরণটিকে শুরুতেই কোমর ভেঙ্গে দিতে না পারলে, দমন করতে না পারলে সামনে দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতির ক্ষমতা কমতে থাকবে, তাদের আধিপত্য সংকুচিত হতে থাকবে। ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠী থেকে শুরু করে রাজনৈতিক বেনিয়া চক্র কখনই মুক্তচিন্তার এই ক্ষেত্রটিকে পছন্দ করবে না, কারণ তাদের ভোটের রাজনীতির মূল উৎসই অশিক্ষা, কুশিক্ষা, ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ, মাদ্রাসা, হিজাব, গ্রেনেড, ব্লেড, চাপাতি। ব্লগার-অনলাইন একটিভিস্টরা রাজনীতির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে, জাতীয় রাজনীতিতে তারা ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে। তারা জাতীয় ইস্যু গুলোতে মতামত দিতে শুরু করেছে, তারা দেশের ভালমন্দ নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে। এখন আর ফেসবুক ব্লগের তরুণরা হিন্দি সিনেমা আর সিরিয়াল নিয়ে কথা বলছে না। তারা কথা বলছে সমস্ত বিষয়ে যেসব জায়গায় শুধুমাত্র রাজনৈতিক নেতাদের একাধিপত্য ছিল এবং ছিল কিছু ভাড়াটে সাংবাদিকের। তেল গ্যাস আন্দোলন থেকে শুরু করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বিরোধী আন্দোলন, নারী নির্যাতন বা সাম্প্রদায়িক আক্রমণের বিরুদ্ধে ব্লগার অনলাইন একটিভিস্টদের দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পরে শাহবাগ আন্দোলন, এই কর্মকাণ্ডগুলো সবগুলো রাজনৈতিক দলই ভাল চোখে দেখবে না। প্রথাগত দুর্নীতিবাজ এবং ভ্রষ্ট রাজনীতিবিদদের চাইতে ব্লগার-অনলাইন একটিভিস্টরা অনেক ক্ষেত্রেই অনেক বেশি চৌকষ, অনেক বেশি আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের। আর প্রতিটি সরকারই চাইবে ব্লগার এবং অনলাইন একটিভিস্টরা তাদের পক্ষে কথা বলুক, তাদের সুরে সুর মেলাক। তারা চাইবে রাজনৈতিক লাঠিয়ালদের এই ক্ষেত্রটিতে নিয়ে এসে এই ক্ষেত্রটিকে ক্রমশ চর দখল-হল দখলের মত কুৎসিত ক্ষেত্রে পরিণত করতে।

    বাক-স্বাধীনতা মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার, চিন্তাশীল মানুষের জীবন ধারণের অবলম্বন। আমাদের সংবিধানও আমাদের বাক-স্বাধীনতার অধিকার দেয়। মানুষের স্বাধীনতা, কথা বলার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা কোন দয়া দাক্ষিণ্য নয়, ক্ষমতাসীন বা বিরোধী রাজনৈতিক দলের অনুগ্রহ নয়, বরঞ্চ আমাদের অধিকার ও দায়িত্ব। স্বাধীনতা, বাক-স্বাধীনতা বিষয়গুলোর কোন সীমা নির্ধারণ যখন হয়ে যায়, তখন তা আর স্বাধীনতা থাকে না, বাক-স্বাধীনতা থাকে না; তখন তা স্রেফ রসিকতা হয়ে যায়। ধরুন আপনাকে যখন বলা হবে, আপনি পোশাক পড়ার ব্যাপারে স্বাধীন, কিন্তু আপনি শার্ট পড়তে পারবেন না, লুঙ্গি পড়তে পারবেন না, গেঞ্জি পড়তে পারবেন না, তখন আর তা আপনার পোশাক পরার স্বাধীনতা থাকে না। ব্যক্তি কী পোশাক পড়বে তা তার নিজস্ব ব্যাপার, তার ব্যক্তিগত অভিরুচির বিষয়। সে যদি নগ্নও থাকতে চায়, সেই অধিকার তার থাকতে হবে। তার পরিপক্বতার, প্রাপ্তবয়স্কতার, ম্যাচিউরিটির, মননশীলতার উপরেই নির্ভর করবে সে কী পোশাক পড়বে। সে হয়ত স্বাধীনতার উল্লাসে কয়েকদিন নগ্ন হয়ে ঘুরবে, তারপরে সে নিজেই বুঝতে পারবে নগ্ন হয়ে ঘোরাটা কেন অন্যের অধিকার ক্ষুণ্ণ করছে, এই বুঝতে পারাটাই তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাকে যখন সীমা নির্ধারণ করে দিয়ে আইন মেনে চলতে বলা হবে, সে আইন মেনে চলবে ঠিকই, কিন্তু কেন এই আইন, নগ্ন থাকার খারাপ দিক কী, ভাল পোশাক পড়ার ভাল দিক কি তা সে কখনই বুঝে উঠতে পারবে না। অর্থাৎ সে ম্যাচিউরড হয়ে উঠবে না, নিয়মনিষ্ঠ আইন মেনে চলা নাগরিক হবে হয়তো, তবে অন্তরের অন্তঃস্থলে সে নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি আগ্রহী হবে, এবং মানসিক অবদমনের শিকার হতে থাকবে। একটি চিন্তাশীল, মননশীল জাতির জন্য তাই প্রয়োজন মানুষের চিন্তাগত মুক্তি, মানুষের পূর্ণ স্বাধীনতা। তাছাড়া ব্যক্তির বিকাশ অসম্ভব।
    বস্তুতপক্ষে ফেসবুক-ব্লগ কোন গণমাধ্যম নয়। এই মাধ্যমগুলোতে মানুষ নিজের ব্যক্তিগত সুখ দুঃখ, অভিজ্ঞতা, নিজের ক্ষোভ, নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। একটি রাস্তা দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি বহর যাচ্ছে, কারো অসুস্থ মাকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়া দরকার। কিন্তু রাস্তা পুলিশ বন্ধ করে রেখেছে। তার কিছু করার নেই। তার রাগ তিনি কীভাবে প্রশমন করবেন? তিনি রাতে বাসায় ফিরে রাগে দুঃখে ক্রোধে তার ডায়রিতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি তার রাগের কথা লিখলেন, অথবা ফেসবুকে ঢুকে একটি স্ট্যাটাস লিখে ফেললেন। নতুন তথ্যপ্রযুক্তি আইনে তার চোদ্দ বছরের জেল এবং জরিমানা হয়ে যাবে।
    ব্লগ, ফেসবুকের স্ট্যাটাস হচ্ছে মানুষের ডায়রির মত। এখানে ব্যক্তি তার নিজের কথা বলবে। কারো সেই কথা ভাল না লাগলে খুব সহজেই সে তাকে ব্লক করে দিতে পারে, সেই স্বাধীনতাও সংরক্ষিত। কিন্তু কারো লেখা আপনার ভাল লাগলো না, অথচ খুঁজে খুঁজে তার লেখাই আপনার পড়তে হবে যার লেখা আপনাকে আহত করে, এবং তারপরে তাকে হত্যা করতে হবে, তার নামে মামলা দিতে হবে, এসব অসভ্য সমাজের চিহ্ন। মানুষ যত অসভ্য হবে এই প্রতিযোগিতা তত বাড়বে। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের লেখা পড়ে উত্তেজিত হতে থাকবে, এবং মামলা হামলা করতে থাকবে। এসবই মানসিক বিকার এবং সহনশীলতা-পরমত সহিষ্ণুতার অভাব।
    অস্বীকার করছি না যে, বাক-স্বাধীনতা চর্চার কিছু খারাপ দিকও রয়েছে। কিন্তু মানুষ নির্দ্বিধায় গালাগালি এবং মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে যাচ্ছে অনলাইনে। কিন্তু এই অশুভ শক্তিকে রুখতে হলে ব্লগের, ফেসবুকের শুভ শক্তিগুলোকেই শক্তিশালী করতে হবে। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তগুলো পর্দার আড়ালে বসেই তাদের অপকর্ম চালিয়ে যায়, তাদের সাথে যুদ্ধটা তাদের ভাষাতে করতে গেলে তাতে বিপদের সম্ভাবনাই বেশি থাকে; কারণ “দ্বার রুদ্ধ করে দিয়ে ভ্রমটাকে রুখি সত্য বলে, আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি?” দ্বার বন্ধ করায় মিথ্যার কোন ক্ষতিবৃদ্ধিই হবে না, মিথ্যা আবারো খোলস পালটে ফিরে আসবে। ক্ষতি যা হবার হবে প্রগতিশীল আন্দোলনের, ক্ষতি হবে স্বাধীন মত প্রকাশের। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের সংশোধনের মাধ্যমে নতুন যেই আইন হয়েছে তাতে শুধু প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ মৌলবাদী এবং প্রোপাগান্ডা চালানো লোকজন, অসৎ রাজনীতিবিদরাই ক্ষমতাশালী হবে, আর ক্ষমতাশালী হবে পুলিশ। আমাদের বাক-স্বাধীনতা এখন থেকে নিয়ন্ত্রণ করবে পুলিশ, এবং তারা নির্ধারণ করে দেবে আমাদের স্বাধীনতার সীমারেখা। কারণ এই আইনটি যথেষ্ট অস্পষ্ট, এবং ইতিহাসে সকল অস্পষ্ট আইনই জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছে। এই আইনে বলা হচ্ছে, ‘কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে মিথ্যা ও অশ্লীল কিছু প্রকাশ করলে, যা দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট হতে উদ্বুদ্ধ করে, অন্যের মানহানি ঘটায়, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটায়, ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে বা কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি দেয়—তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। কোনো ব্যক্তি এ ধরনের অপরাধ করলে তিনি সর্বোচ্চ ১৪ বছরের ও সর্বনিম্ন সাত বছরের কারাদণ্ডে এবং সর্বোচ্চ এক কোটি টাকার অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’-যেখানে মানহানি ঘটা, ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হওয়া, উস্কানি দেয়া অথবা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত বিষয়গুলো কোনভাবেই স্পষ্ট নয়। যেকোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা নির্দ্বিধায় মানহানি, ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ বা উস্কানি দেয়া বলে বিবেচিত হতে পারে। যেকোন দার্শনিক সমাজতাত্ত্বিক বৈজ্ঞানিক আলোচনা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত বলে বিবেচিত হতে পারে।
    একজন বিজ্ঞানমনষ্ক ব্যক্তি মনে করেন বিবর্তনবাদ সত্য, এবং সৃষ্টিতত্ববাদ বৈজ্ঞানিকভাবে সঠিক নয়। এই বিষয়ে তিনি একটি স্ট্যাটাস বা ব্লগ পোস্ট করলেন। এই লেখাটি পরিষ্কারভাবে কোন ধার্মিকের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করতে পারে। এবং সে মামলা করে দিলে তার চোদ্দ বছরের শাস্তি হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, মামলা চলাকালীন পুরোটা সময় তাকে জেলে কাটাতে হবে, কারণ এই মামলায় জামিন নেই। অর্থাৎ যে কেউ মিথ্যা মামলা করে দিলেই বা পুলিশ কোন কারণে আপনার উপরে রুষ্ট হলেই মামলা দিয়ে দেবে, এবং বাঙলাদেশের মামলা সাধারণত দুই চার বছরে শেষ হয় না। এই দুই চার বছর আপনি জেলে থেকে পরে নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে বের হলেও আপনাকে মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলো খুঁজে বের করে হত্যা করবে। কারণ আপনি তখন চিহ্নিত হয়ে গেছেন, রাষ্ট্র নিজ দায়িত্ব আপনার হত্যার পরোয়ানা জাড়ি করে ফেলেছে।
    এই আইন পুলিশকে সীমাহীন ক্ষমতা দিয়ে দেবে, এবং নিরঙ্কুশ ক্ষমতা সবসময়ই সেই ক্ষমতা অপব্যবহারের রাস্তা তৈরি করে। এবং আমাদের দেশে পুলিশ ক্ষমতা পেলে কী করে তা সকলেই ভালভাবেই জানেন। ক্রস ফায়ারের নামে, সন্ত্রাসীকে আটকের পরে অস্ত্র উদ্ধার করতে যাবার পথে বন্দুক যুদ্ধের একই গল্প শুনিয়ে শুনিয়ে আমাদের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কত হাজার মানুষ হত্যা করেছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। লিমন আজও সুবিচারের আশায় দ্বারে দ্বারে ধুরে বেড়াচ্ছে। সেই একই পুলিশকে এবার প্রায় ঈশ্বরের মত ক্ষমতা দিয়ে লেলিয়ে দেয়া হলো ব্লগারদের দমন করতে। যাকে তাদের পছন্দ হবে না, তাদের স্বার্থ যেই ব্লগারের দ্বারা ক্ষুণ্ণ হবে, তাকেই তারা নির্যাতন করবে। এবং এই নির্যাতনে আমাদের রাষ্ট্র হবে তার রক্ষাকারী, আইন হবে তার অস্ত্র।
    ঈশ্বর অবমাননা, ধর্ম অবমাননা, নবী রসুল অবমাননা! এগুলো আধুনিক সমাজে খুবই রাজনৈতিক এবং ক্ষমতা দখলের, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধাবার অস্ত্র। সর্বশক্তিমান ঈশ্বর, যার হুকুম ছাড়া একটা গাছের পাতাও নড়ে না, তার সম্মান রক্ষার জন্য আমাদের আইন করতে হবে, পুলিশ পেটোয়া বাহিনী দিয়ে ঈশ্বরকে রক্ষা করতে হবে, তার সম্মান বাঁচাতে হবে দুষ্টু লোকদের হাত থেকে, নতুবা ঈশ্বরের সম্মান কেউ ফেসবুকে বা ব্লগে কিছু লিখে তার মান ভূলুণ্ঠিত করে ফেলবে, এমন ভাবনা সত্যিকার অর্থেই একটি বড় ঈশ্বর অবমাননা। সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের সম্মান রক্ষা পুলিশ পেটোয়া বাহিনীর কাজ নয়, তা তিনি নিজেই রক্ষা করতে পারেন। আর যদি ধারণা করা হয় তিনি তা রক্ষা করতে পারেন না, তা সর্বশক্তিমানের সর্বশক্তিমত্তার প্রতি বড় ধরণের অবজ্ঞা।
    এই আইনে ধর্ম অবমাননা বিষয়টি খুবই ঘোলাটে। আধুনিক বিজ্ঞান এবং ইতিহাস অনেকাংশেই ধর্মের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। পৃথিবীর মানুষ বিবর্তনবাদ নিয়ে উন্নত গবেষণা করছে, সেখানে ধর্ম অবমাননা বলে একটি তত্বকে বাতিল করে দেয়া কোনভাবেই সভ্য আচরণ নয়। ইউরোপে একসময় পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে, এই তত্ব প্রচারের দায়ে চার্চ হাজার হাজার মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। জিওনার্দো ব্রুনোর কথা আমরা সকলেই কমবেশি জানি। আজ চার্চ এবং পোপ সেই সব হত্যাকাণ্ডের জন্য ক্ষমা চাচ্ছে, পোপ নাস্তিকদের স্বর্গে পাঠাতে চাচ্ছে! মানুষের বিজ্ঞান গবেষণা, জ্ঞান আহরণ ধর্ম দ্বারা, ধর্মান্ধদের দ্বারা, পুরোহিত বা মোল্লাতন্ত্রের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে থাকলে জ্ঞানের দ্বার রুদ্ধ হয়ে যেতে থাকে। মোল্লা শ্রেণি, পুরোহিত শ্রেণি আমাদের বুদ্ধিজীবী শ্রেণি, আমাদের বিজ্ঞানী-দার্শনিকদের নিয়ন্ত্রক হয়ে গেলে সেই সমাজ একটি মৌলবাদী সমাজে পরিণত হয়। এবং এই কারণেই সমস্ত বিশ্বে ধর্মান্ধ দেশগুলোতে জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রসার, শিক্ষার প্রসার খুবই অল্প। শুধুমাত্র নোবেল পুরষ্কারের কথা যদি বিবেচনায় আনি, দেখা যায় পুরো পৃথিবীর দেড় শ কোটি মুসলিমের ভেতর নোবেল পুরষ্কারের পরিমাণ এক কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ডিপার্টমেন্টের নোবেল পুরষ্কারের চাইতে কম। কারণ সেখানে মোল্লা শ্রেণি শিক্ষক, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, কবি সাহিত্যিকদের নিয়ন্ত্রক নয়। বিজ্ঞান অজ্ঞ, কোরআন হাদিস আর কিছু আরবী মুখস্থ করা স্বল্পশিক্ষিত মোল্লারা, যারা বিজ্ঞানের, গণিতের, দর্শনের, সমাজবিজ্ঞানের, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের, ইতিহাসের, জীববিজ্ঞানের, পদার্থ বা রসায়ন বিজ্ঞানের কিছুই জানে না তারা যখন বিজ্ঞানের হর্তাকর্তা বনে যাবে, আমাদের বলতে শুরু করবে এটা ঠিক আর ওটা ভুল, তখন মস্তবড় সমস্যা শুরু হবে।
    নবী রাসুলের সমালোচনা আরেকটি রাজনৈতিক অস্ত্র। নবী রাসুলগণ হচ্ছেন সেই সমাজের এক একজন রাজনৈতিক এবং আধ্যাত্মিক নেতা। মহানবী নিজেই বলে গেছেন, তিনি একজন সাধারণ মানুষ। তার নামাজ পড়তে যাবার পথে এক ইহুদী বুড়ি কাটা বিছিয়ে রাখতো, এমনকি তিনি সিজদায় গেলে তার পিঠে উটের নাড়িভুঁড়ি চাপিয়ে দিত। কিন্তু সে সময়ও মহানবী তাকে হত্যা করেন নি। বরঞ্চ একদিন যখন দেখলেন তার রাস্তায় কাটা নেই, তিনি বুড়িকে দেখতে গেলেন, গিয়ে দেখলেন বুড়ি অসুস্থ। তিনি তার সেবা করলেন, এবং বুড়ি তার এই মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন। মহানবী সেই বুড়িকে চোদ্দ বছরের জেল দেন নি, তাকে হত্যাও করেন নি। তিনি সে সময়ে বুড়িকে হত্যা করলে হয়তো ইসলাম আজকের যেই অবস্থানে আছে সেই অবস্থানে থাকতো না। এটাই মানবতাবাদী অসাম্প্রদায়িক মিশ্র ইসলামের শিক্ষা। আমাদের রাষ্ট্র আসলে ইসলামের পক্ষে নাকি ইসলামের বিপক্ষে কাজ করছে, সেটাই অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এরকম দমন পীড়ন সত্যিকার অর্থে ইসলামের মানবতাবাদী মিশ্র চেতনার বিরুদ্ধেই কাজ করবে, এবং ইসলাম সম্পর্কে অমুসলিমদের ভেতরে ভীতি সৃষ্টি করবে।
    পৃথিবীতে আসলে শিয়া সুন্নি ওয়াহাবী সালাফি ইত্যাদি ইসলামের ভাগ কোন মূল ভাগ নয়, আসল ভাগ হচ্ছে মানবতাবাদী ইসলাম যা যুগে যুগে গড়ে উঠেছে, এবং অন্যটি হচ্ছে মৌলবাদী কট্টর ইসলাম যা শুধু তলোয়ারের মাধ্যমে ভীতি ও ত্রাস সৃষ্টি করেছে। মানবতাবাদী ইসলাম এই দেশে প্রসার লাভ করেছে সুফি সাধকদের দ্বারা, খাজা মইনুদ্দিন চিশতীদের মত সুফি সাধকরা এই অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের মূল ভূমিকা পালন করেছেন। তার দরগায় এখনও গরুর মাংস রান্না হয় না, কারণ হিন্দু ভক্তদের যেন কোন সমস্যা না হয়। তার মাজারে এখনও লক্ষ লক্ষ হিন্দু মুসলিম শিখ নানা মতের নানা ধর্মের মানুষ আসেন। খাজা মইনুদ্দিন চিশতী কোন ধর্মের, তার চাইতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে তার অসাম্প্রদায়িক চেতনা। এই চেতনাই ইসলামকে এই অঞ্চলে গ্রহণযোগ্যতা দিয়েছে। কিন্তু কট্টর ইসলাম হচ্ছে বিন লাদেনের ইসলাম, কট্টর ইসলাম হচ্ছে বাঙলা ভাই এবং আল্লামা শফীর ইসলাম। ঐ ইসলামের কোন গ্রহণযোগ্যতা পুরো পৃথিবীতেই নেই। হযরত ওমর উটে চড়ে যাবার সময় কিছুক্ষণ নিজে উটে চড়তো, কিছুক্ষণ তার দাসকে উটে চড়াতো। আর আল্লামা শফী মাদ্রাসার লক্ষ লক্ষ শিশু কিশোরকে মতিঝিলে ডেকে এনে, তাদের সামান্য খাবার পানির ব্যবস্থাও না করে নিজে হেলিকপ্টারে চলাফেরা করেন। তিনি ইসলামের হেফাজতকারী হলে বলতে হয়, সেই ইসলাম টিকে থাকবে না, মানবতাবাদী অসাম্প্রদায়িক ইসলামেরই শুধু টিকে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। তারা খালি মাদ্রাসার কিছু কোমলমতি ছাত্রকে ব্যবহার করে টাকা কামাবেন, রাজনীতি করবেন, তবে ইতিহাসে তাদের নাম আস্তাকুড়েতেই পড়ে থাকবে।
    আল্লামা শফী তার ওয়াজে নানা কথা বলে থাকেন, খুবই যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ সে সব কথা শিক্ষিত মানুষের জন্য শুধু বমনউদ্রেককারী। তিনি বলেছেন, নারীরা হচ্ছে তেঁতুলের মত। তাদের দেখলেই সক্ষম পুরুষের লালা ঝরা উচিত! অর্থাৎ নারীকে প্রতিটি সক্ষম পুরুষের দেখতে হবে একটি ভোগের সামগ্রী হিসেবে। শুধু তাই নয়, মেয়েদের ক্লাস ফাইভের পরে শিক্ষার কোন দরকার নেই বলেও তিনি মতামত দিয়েছেন; এবং গার্মেন্টস শ্রমিকরা, যারা ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম করে নিজেদের সংসার চালায়, মা বাবা ভাই বোনের পেট চালায়, দেশের অর্থনীতি এগিয়ে নিয়ে যায়, তাদের তিনি অত্যন্ত অশালীন ইঙ্গিত করেছেন। অথচ নতুন তথ্য প্রযুক্তি আইনে আল্লামা শফীর বিরুদ্ধেও কিছু বলা যাবে না, বললেই মামলা হয়ে যাবে। তিনি তার ওয়াজে যা খুশি তাই বলতে পারবেন!
    সংশোধিত তথ্যপ্রযুক্তি আইনে বলা হয়েছে, নতুন আইন মোতাবেক ‘ যা দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট হতে উদ্বুদ্ধ করে, অন্যের মানহানি ঘটায়, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটায়, ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে বা কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি দেয়—তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।’
    অর্থাৎ এই আইন মোতাবেক আপনি কারোর সমালোচনাই করতে পারবেন না। আল্লামা শফী তার ওয়াজে বলেছেন, জন্মনিয়ন্ত্রণ খুব খারাপ কাজ, অথচ আপনি তার বিরুদ্ধে কিছু লিখতে পারবেন না, যুক্তি তুলে ধরতে পারবেন না। তাতে তার মানহানি ঘটতে পারে, তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হতে পারে, তার ভক্তদের বিশ্বাসে আঘাত লাগতে পারে, তারা মামলা করতে পারে। আপনি কোন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সমালোচনাও করতে পারবেন না, আপনি পুলিশ বা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে শুরু করে কারো বিরুদ্ধেই কিছু বলতে পারবেন না, পুলিশ কোন তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই-আদালতের নির্দেশ ছাড়াই আপনাকে গ্রেফতার করতে পারবেন, আপনার অজামিনযোগ্য মামলায় কয়েকবছর জেলে থাকার পরে আপনি নির্দোষ প্রমাণিত হলেও ততদিনে আপনি কয়েকবছর জেলে কাটিয়ে ফেলেছেন।
    আবার ধরুন ফেসবুক বা ব্লগে কেউ ভিন্ন নামে লিখলো, বা আপনার নামেই আইডি খুলে কোন অশ্লীল প্রচার চালালো। আপনি ফেঁসে গেলেন, পুলিশ স্রেফ সন্দেহের বশবর্তী হয়ে আপনাকে জেলে ঢুকিয়ে রাখলো। আপনি পরবর্তীতে নির্দোষ প্রমাণিত হলেও আপনাকে কমপক্ষে দুবছর জেলে কাটাতে হবে। অর্থাৎ তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে নুন্যতম ধারণা যেই পুলিশ বাহিনীর নেই, যারা একটি ইমেইল একাউন্টও খুলতে পারেন না, তারা তাদের তথ্যপ্রযুক্তি জ্ঞান দিয়ে বনে যাচ্ছেন এই মাধ্যমটির সবকিছুর কর্তাব্যক্তি এবং নিয়ন্ত্রক। আমাদের কয়জন আমলা, কয়জন পুলিশ কর্মকর্তা কোন সাহায্য ছাড়া একটি ইমেইল একাউন্ট খুলে দেখাতে পারবেন, তা খুব সহজেই অনুমেয়।

    ব্যক্তি ও রাষ্ট্র যখন পরস্পরবিরোধী অবস্থানে এসে দাঁড়ায়, একে অন্যের স্বার্থ এবং স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করে, তখন স্টুয়ার্ট মিলের প্রশ্নটি সামনে চলে আসে, রাষ্ট্রের অধীনে ব্যক্তি আসলে কতটুকু স্বাধীন? রাষ্ট্রের সকল আইনকানুন বিচার ব্যবস্থা বিধি নিষেধ অতিক্রম করে একজন ব্যক্তির স্বাধীনতা আসলে কতটুকু? ব্যক্তি যদি স্বাধীন হয় এবং স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে তবে রাষ্ট্র কতটুকু স্বাধীন? একই জনপদে একই সময়ে ব্যক্তি এবং রাষ্ট্র একযোগে স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে না। একটি এখানে বেশি স্বাধীনতা ভোগ করবে, অন্যটি কম। এবং দেখা যাচ্ছে, আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ব্যক্তিকে যত বেশি মূল্যায়ন করছে, ব্যক্তির স্বাধীনতা সংরক্ষণ করছে, সেখানেই গণতন্ত্রের সুফল দেখতে পাওয়া গেছে। সেই মূল্যায়ন তাত্ত্বিকভাবে শুধুমাত্র সংবিধানে মৌলিক অধিকারগুলোর কথা বলে, বাক-স্বাধীনতার কথা বলেই দায় শেষ করে ফেলা নয়, প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতা সংরক্ষণ। ব্যক্তির আর যেসব অঞ্চলে ব্যক্তি রাষ্ট্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে, ব্যক্তির স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে, সেসব রাষ্ট্রকাঠামো ভেঙ্গে পড়েছে।

    ব্যক্তির বিকাশ এই শৃঙ্খলা, এই নজরদারি, এই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে সম্ভব নয়। যেই দেশে যুদ্ধাপরাধের মত অপরাধ, ধর্ষণের মত অপরাধ, গণহত্যার মত অপরাধের সাজা হয় চোদ্দ বছর জেল, এবং ফেসবুকে কারো সমালোচনা করে স্ট্যাটাস দিলেও শাস্তি হবে চোদ্দ বছরের জেল, সেই দেশের আইনের শাসনের কোন পরিস্থিতিই নেই। রাষ্ট্রের মালিকানা ক্রমশ জনগণের হাত থেকে নিয়ে পুলিশের হাতে দিয়ে পুলিশকে ক্ষমতাশালী করা হচ্ছে, একটি পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করা হচ্ছে। এই সরকার আগামী নির্বাচনে হেরে গেলে আরেকটি দল এসে এই আইনটি দিয়েই বর্তমান সরকারের সমর্থক একটিভিস্টদের উপরে দমন-পীড়ন চালাবে। তাই বিরোধী দলও এই নিয়ে খুব একটা উচ্চবাচ্য করছে না, কারণ এই আইন তারাও ভালভাবেই ব্যবহার করবে। এ পর্যন্ত যেকোনো কালাকানুন আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর খুবই প্রিয় হয়ে ওঠে যখন তারা ক্ষমতায় থাকেন। বিরোধী দলে থাকলে তারা কালাকানুনগুলোর বিরুদ্ধে কথা বলেন, ক্ষমতায় গেলেই ভোল পালটে সেই আইনগুলোকেই আরো শক্তিশালী করেন, ব্যবহার করেন।
    স্বাধীন গণমাধ্যম যতদিন থাকবে, মানুষের বাক-স্বাধীনতা যতদিন থাকবে, মানুষ ধীরে ধীরে ক্ষমতাশালী হয়ে উঠবে। তারা সচেতন হয়ে উঠবে রাজনীতি সম্পর্কে, দেশ সম্পর্কে, বিজ্ঞান-দর্শন-ধর্ম সম্পর্কে। কিন্তু রাজনৈতিকদলগুলো ক্ষমতার চর্চা করে, এবং জনগণকে ক্রীতদাস বানিয়ে রাখার চেষ্টাতেই তারা নিত্যনতুন নোংরা আইন করে। ৫৪ ধারার মত নোংরা আইন এখনও একটা স্বাধীন দেশে থাকতে পারে, সেটা কল্পনাতীত। এই আইনে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের ১২ হাজার কয়েদী হাজতির মধ্যে ৬০% আটক রয়েছে। তাদের অনেকের কোন শাস্তিই হয় নি, অথচ দুই তিন বছর ধরে তাদের মামলা চলছে। তারা নির্দোষ প্রমাণিত হলে তাদের এই দুই তিনবছরের জেলে থাকার ভর্তুকি কে দেবে? যদি তাদের জীবনের দুই তিন বছর তাদের ফিরিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাষ্ট্রের না থাকে, সেটা কেড়ে নেয়ার ক্ষমতা তাদের নৈতিকভাবেই থাকতে পারে না।

    আমাদের দেশের এই তথ্যপ্রযুক্তি আইন যেন সেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতই। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে আমাদের দেশের ভূমি কেড়ে নিয়ে কয়েকজন জমিদারকে তা নিয়ন্ত্রণ করতে দেয়া হয়েছিল, এই নতুন তথ্যপ্রযুক্তি আইনের মাধ্যমে ব্লগার-অনলাইন একটিভিস্টদের তিলে তিলে করে গড়ে তোলা গণমাধ্যমটিকে কেড়ে নিয়ে পুলিশকে তা নিয়ন্ত্রণ করতে দিয়ে দেয়া হচ্ছে। এইসব আইন এবং কালাকানুনের বিরুদ্ধে তরুণ সমাজের সোচ্চার হতে হবে, প্রতিবাদী হতে হবে। কারণ এই দেশটা আমাদের, এই দেশে কী কী আইন হবে, এই দেশ কীভাবে চলবে তা আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সরকার জনগণের সেবক, তারা মালিক নয়। একদিন এই দেশের মানুষই ভাষা আন্দোলন করেছিল, পাকিস্তানী শাসক শোষকরা ভেবেছিল আমাদের ভাষাকে দুর্বল করে দিয়ে আমাদের আত্মপরিচয়হীন জাতিতে পরিণত করবে, আমাদের ক্রমশ অস্তিত্বহীন করে রাষ্ট্রের ভোগদখলে নিজেদের কর্তৃত্ব অনন্তকালের জন্য বলবত রাখবে। আর আজকে স্বাধীন বাঙলাদেশের সরকার চাচ্ছে জনগণের মত প্রকাশের, প্রতিবাদের, সমালোচনার, দ্বিমত পোষণের জায়গাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, কালাকানুন তৈরি করে, জেল রিমান্ড নির্যাতন চালিয়ে নিজেদের অশুভ রাজনীতির চাকা অনন্তকালের জন্য বলবত রাখতে। কিন্তু জনগণের সাথে প্রতারণা যারাই করবে, তারাই ইতিহাসের আস্তাকুড়েতে নিক্ষিপ্ত হবে। তারা যদি ব্রিটিশ সরকার বা পাকিস্তানী সরকারের মতই জনগণের নির্যাতকে পরিণত হয়, তখন জনগণ ক্ষেপে গেলে তাদের পালাবার কোন পথ থাকবে না। এটা সকল দলেরই মনে রাখা উচিত।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১০ অক্টোবর ২০১৩ | ৯২৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Pubদা | ***:*** | ১০ অক্টোবর ২০১৩ ০৭:১৩47611
  • আসিফ'দা - খুব ভালো লাগলো লেখাটা ।
    কিন্তু এ তো খুবই চিন্তার বিষয় ।
  • π | ***:*** | ১১ অক্টোবর ২০১৩ ০৩:৫২47612
  • লেখাটা ভালো লাগলো। কিন্তু সত্যিই চিন্তার বিষয়।
  • Biplob Rahman | ***:*** | ১২ অক্টোবর ২০১৩ ০২:১৪47613
  • আওয়ামী লীগের এই ইন্টারনেট সর্দারির সম্ভাব্য নীট ফল এই যে, শেষ পর্যন্ত কোনো চিন্তাই আইনে রোখা যাবে না। তবে তা ফ্যাসিবাদী ডিজিটাল রক্ষী বাহিনীর কদার্য মুখোশটিকে আরো কিছুটা উন্মোচিত করবে বৈকি।

    সন্দেহ নেই, "দ্রুত বিচার আইন" এর মতো এই গণ বিরোধী আইসিটি আইন অদূর ভবিষ্যতে সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে খোদ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধেই যথেচ্ছ ব্যবহৃত হবে।

    কালো আইনটির বিরুদ্ধে এরই মধ্যে অনলাইন ও অফলাইনে জোর প্রতিবাদ গড়ে উঠেছে। এখন চাই, আরো জোরালো প্রতিরোধ।

    ভাবনাটিকে উস্কে দেওয়ায় আসিফকে সাধুবাদ।

    জয় হোক- মুক্তচিন্তা, শুভ বুদ্ধির।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন