মেলার বাজারের চেহারাটা দেখলে এই পরিবর্তনের একটা হদিশ পাওয়া যাবে। প্রথমদিকে থাকতো স্থানীয় গুজরাটি ব্যবসায়ীদের কৃপায় দুয়েকটা ভীরু শাড়ীর দোকান, দুয়েকটা রাজস্থানী স্টাইলের কাঁড়া কাঁড়া গয়নার দোকানও বোধহয় ছিলো। আর ছিলো আমাদের গর্ব, বাংলা বইয়ের স্টল, সঙ্ঘের সুশান্তদা প্রমুখ দুচারজন সদস্য স্বয়ং ঘাড়ে করে জাহাজঘাটা থেকে বইয়ের বস্তা নামিয়ে এনে টেবিল সাজাতেন, বিক্রি হোতো ভালোই। আর থাকতো অন্তত দুটো ক্যাসেট টেপের স্টল, একটায় আসল টেপ, আরেকটায় কপি করা। ততোদিনে বোধহয় ডিস্ক রেকর্ড উঠে গেছে। তারপর স্থানীয় ব্যবসায়েরা উপলব্ধি করলেন মেলায় এসে শাড়ী-গয়নার ব্যাপারে বাঙালী গিন্নিরা মুক্তহস্ত, তাই সে সব দোকানের সংখ্যা আর সাজ দুইই বাড়তে থাকলো, শেষপর্যন্ত কোলকাতা থেকে রুই কাতলারাও দোকান খুলতে শুরু করে দিলেন এবং এখনও দিচ্ছেন। বইয়ের ব্যাপারেও তাই, মধ্যে কয়েকবার তো আনন্দ পাবলিশার্সও ঝকমকে দোকান দিলেন। মুভি আর গানের ব্যাপারে কিন্তু দেশের দোকানীরা উত্সাহ দেখাননি কখনো, বোধ্হয় নকল মালের সঙ্গে পাল্লায় পেরে উঠবেন না, এই ভয়ে। তবে বইয়ের বাণিজ্যটা আমরা স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে ফিরিয়ে এনেছি, আর এখন বই, সিডি, ডিভিডি-- সবই একাকার। বইয়ের বাজারে মন্দা লেগেছে কিছুদিন, এবারের হিসেবে তো সারা বাজার যোগ করলে বইয়ের দোকান পুরো একটাও হবে না, বারোআনা হতে পারে। তার মধ্যে নজরে পড়ার ব্যাপার হচ্ছে অনেক ইংরেজী বই-- অবশ্যই প্রায় সবই বাংলা বইয়ের অনুবাদ। রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ তো আছেই, "শ্রাদ্ধবার্ষিকীতে" দাড়ি মুচড়ে যতোটা উপায় করে নেওয়া যায়, কিন্তু সুনীল গাঙুলী বা শীর্ষেন্দু মুখুজ্জের উপন্যাস, এমন কী "পদিপিসির বর্মিবাক্স"? বাংলা সাহিত্যের এসব অমূল্য সম্পদ কি আমরা আমাদের বাংলাভাষা-অভাষী ছেলেপুলেদের হাতে পৌঁছে দিতে চাইছি? মধ্যে আমরা, আমাদের অভিবাসী সমাজের বেবী বুমাররা (সত্তরের বা তার আগের দশকে যাঁরা এসেছেন) যখন অবসর নেবার কাছাকাছি আসছি তখন কোলকাতার বহুতল বাড়ীর দালালেরা সদলে এসে অনেক ঝাঁপ খুলতেন আর চেঁচামেচি করে খদ্দের ডাকতেন। তা এখন অনেকেই কেনার থেকে বেচার কথা ভাবছেন, কাজেই সে বাজারটি মন্দা, দোকানীরাও অদৃশ্য। দুটি দোকান টিম্টিম্ করছে। তবে নজরে না পড়েই পারে না যেটি সেটি হোলো এক জ্যোতিষীর দোকান, সেখানে জ্যোতিষসম্রাট স্বয়ং দোকান আলো করে বসে আছেন। ইনি বেশ যশস্বী মনে হোলো, এঁর সচিত্র বিজ্ঞাপন প্রায়ই দেখা যায় কাগজপত্রে, যাঁরা পরশুরামের সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড মনে করতে পারেন, তাঁরা শ্যামানন্দ ব্রহ্মচারীর মূর্তিটি ভেবে নিন। গোড়ায় লোকজন হচ্ছিলো না, বোধ্হয় লোকে ভয়ে দূরে ছিলো, মেলা শেষের কালে দেখি বেশ ভীড়। এইটি যোগ হতেই মেলা একেবার খাঁটি মেলায় দাঁড়ালো। কেন, এদেশী কার্নিভালে স্ফটিক গোলক্ধারিণীদের দেখেননি? যাক, জ্যোতিষী আবার আসুন, বাতের ব্যথাটা চাগাড় দিচ্ছে, একটা পাথর-টাথর ধারণ করার দরকার হয়ে পড়ছে।
সাহিত্য সম্মেলনে গিন্নিকে পাঠিয়েছিলাম, বেশ কিছুক্ষণ পরে দেখি ভগ্নদূত হয়ে ফেরত্ আসছেন। এসে বললেন, ওগো, ওখানে মঞ্চ আলো করে কিছু লোক থাকলেও দর্শক কেবল পাঁচজন, আমার একটু ভয় ভয় করছিলো বাপু, আমি চলে এলাম, "রইলো বাকী চার"। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মশায় জীবদ্দশায় এসব সম্মেলনের খুঁটি হয়ে থাকতেন। একবার সাহিত্য সম্মেলনে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া শুরু করেছিলেন তারপর থেকে আমরা একটু ভয়ে ভয়ে থাকি, এর পরে কী ঘটবে সেই আশঙ্কায়। মনে পড়ে গেলো একবার আমাদের শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ, এল্ম্হার্স্ট ও রাণু অধিকারীর গল্প শোনাবেন বলেছিলেন। সে আর শোনা হবে না। সম্মেলনের তারকাদের নামের তালিকা কোথাও পেলাম না, কেবল একেশ্বরী এক মহিলা কবির সচিত্র পরিচিতি ছাড়া। আমার মনে হয় এসব জায়গায়, যেখানে একান্তই জনরঞ্জক অনেক আকর্ষণ রয়েছে, সেখানে লোক টানতে কিছু জাঁদরেল "সাহিত্যিক গুণ্ডা" (পরশুরাম, "দক্ষিণ রায়") আমদানি করা দরকার। আমরা একবার তেমন চারজনকে এনেছিলাম রবীন্দ্রমেধ যজ্ঞ করার জন্য, তাঁরা মঞ্চে উঠে রবীন্দ্ররসের ঘোরে মত্ত হয়ে একেবারে হল্লা তুলে দিয়েছিলেন। ভবিষ্যত্ সাহিত্যসম্মেলকরা এ কথাটা ভেবে দেখতে পারেন।
সাহিত্যের কথাই যখন উঠলো তখন সম্মেলন উপলক্ষ্যে প্রকাশিত ম্যাগাজিনটির কথা বলতে হয়। একসময়ে হুজুগ উঠেছিল, দেখ বাপু, সম্মেলনের অনেক কিছুই লোকে ভুলে যাবে, কিন্তু এই বইটি সম্মেলনের স্মৃতি ধরে রাখবে অনেকদিন, তাই এটিকে কিন্তু ভালো করে তৈরী করতে হবে। তাই সে বইগুলোতে এখানকার লেখকদের লেখা থাকতো কিছু, আবার দেশ থেকে নামী লেখকদের লেখা, অপ্রকাশিত লেখা-- সম্মেলনের থীম বা অভিবাসীদের চিন্তাভিত্তিক-- চাওয়া এবং ছাপা হোতো। এ করতে খরচ হোতো একটু বটে, বিজ্ঞাপন নেওয়া হোতো না, তাতে ব্যাপারটা খেলো হয়ে যায়, দেশের লেখকদের দক্ষিণা দেওয়ার ব্যাপার ছিল একটা আর দেশ থেকে ছাপিয়ে আনতে হোতো বলে গাড়ীভাড়া পড়তো অনেক। কিছুদিন এভাবে চলার পর ঝানু সম্মেলকরা দেখলেন যে এ ব্যাপারটির গোড়াতেই গলদ। অভিবাসী বাঙালী বই পড়েনা, টিভি দেখে (এখন ফেসবুক), অব্যবহারে অনেকে বাংলা বর্ণমালাই ভুলে যাচ্ছে, এদিকে দেশের লেখকরা দক্ষিণা নিচ্ছেন বটে কিন্তু সাপ্লাই যা দিচ্ছেন তা হয় পচা নয় বাসি, আর বিজ্ঞাপন বাদ দেওয়াটাও এমন কিছু কাজের কথা নয়। আস্তে আস্তে ম্যাগাজিন ফিকে হতে শুরু করলো, দেশের লেখা বাদ হতে হতে সবই স্থানীয় লোকেদের লেখায় এসে দাঁড়ালো, বিজ্ঞাপনও থাকে। এখন আবার এদেশেই ছাপা যায়, খরচের কথা বলতে পারবো না। স্থানীয় লেখকদের বেশ কিছু ভালো লেখা থাকা সত্ত্বেও এমন ব্যবস্থায় পত্রিকার মান যতোটা নামানো যায় টোরাণ্টোর ম্যাগাজিনটি প্রায় সেখানে পৌঁছে গেছে। নাম "বঙ্গ নবজাগরণ", তার যাথার্থ্য জানতে চাওয়া আর কাণা ছেলেকে কেন পদ্মলোচন ডাকা হয় তার হদিশ খোঁজা একই কথা। ম্যাগাজিনটির সংরক্ষণ হওয়া উচিত, বিশেষ করে "সম্পাদকীয়" শীর্ষক যে পাতাটি আছে। যুগ্মসম্পাদনা বোধহয়, তাঁরা ভারী লাজুক, স্ম্পাদক হিসাবে তাঁদের নাম খুঁজে পেলাম না (ব্যক্তিগত ইমেলে অবশ্য একজন স্বীকার গেছেন), একটি বাংলা আর একটি ইংরেজী কলামে বক্তব্য রেখেছেন। আমার সাধ ছিলো স্ক্যান করে সেই পাতাটি "বিশ্বময় দিয়েছো তারে ছড়ায়ে" করে দিই, কিন্তু কপিরাইট আইনে পড়ে যেতে পারি, তাই তা করা গেলো না। এ ছাড়া বইটা উল্টে পাল্টে মনে হোলো টোরাণ্টোর বাংলাদেশীরাও এই সম্মেলনে কিছু একটা ভূমিকা নিয়েছিলেন। সেটা অবশ্য সম্মেলনের প্রচার বার্তা বা কুমীরদের বলা ও না-বলা বাণীতে কোথাও দেখতে পাইনি, সেটা আমার হাঁ-করা চরিত্রের দোষও হতে পারে।
শ্রেয়া ঘোষাল আজ বিনোদনের জগতে এক উজ্জ্বল তারকা, উজ্জ্বলতম কিনা তা নিয়ে তর্ক উঠতে পারে অবশ্য। কিন্তু সম্মেলনে তাঁর মার ছিলো শেষ রাতে। সম্মিলিতদের মধ্যে আমার পরিচিত কয়েকজন যে শুধু শ্রেয়ার আকর্ষণেই এখানে এসেছেন একথা আমি হলফ করে বলতে পারি। তাঁর শোয়ের আগে ঘণ্টা দুই হল ফাঁকা করে দেওয়া হয়, শব্দব্রহ্মের ঘটশোধন কার্য চলে তখন। সে কারণে হল থেকে বিতাড়িত হয়ে দেখি বাইরে এক বিশাল অসহিষ্ণু লাইন, প্রাকৃতিক প্রয়োজনে লাইন পেরোবার চেষ্টা করে বিপদে পড়ে গেলাম। [একটা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক কথা মনে এলো, বলার লোভ সামলাতে পারছিনা। পিনাট্স্ কার্টুনের চার্লি ব্রাউন বলছে: Happiness is peeing your black pants-- feels warm and nobody notices. কালো প্যাণ্ট পরিনি তাই এ সুযোগটা মাঠে মারা গেলো।] কনভেনশন সেণ্টারের সিঁড়ি যেন মহাপ্রস্থানের পথ, তাই বেয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ওপরে উঠে দেখি কালো উর্দীর পুলিশে ছয়লাপ, জানলাম যে সম্মেলনের কর্তারা এই শ্রেয়ার প্রোগ্রামের জন্য আবার আলাদা করে বাইরে টিকিট বেচেছেন, অন্য লাইনটাই তাদের লাইন। তাদের উষ্মার কারণটা বোঝা গেলো। তবে মানতেই হবে কর্তারা খুব বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন (এঁরাই সম্মেলনের টিকিট বিক্রির সময় ক্যাশ টাকা, আজ্ঞে করকরে ডলার দাবী করছিলেন, দেখলে মনে হতেই হবে যে এঁরা আপনাকে বঙ্গ নবজাগরণের খাস কালে উপস্থিত করতে চেয়েছেন, তখন তো চেক বা ক্রেডিট কার্ড জন্মায় নি), আমাকে শ্বেতহস্তী নাচাতে দিলে আমিও তাই করতাম। তারপর একটু গুঁতোগুঁতি হলেও কুলিশপাণি পুলিশের কোঁত্কায় সবাই সামলেসুমলে প্রেক্ষাগৃহে ঢুকেছেন, শ্রেয়া অনেক গেয়েছেন, অনেকক্ষণ গেয়েছেন এবং পেশাদারী তাঁর উপস্থাপনা। যাঁরা এখনও চটে আছেন তাঁদের বলি যে মাইকেল জ্যাকসনের জলসা শুনতে গেলে এর দশগুণ বেশী ল্যাজেগোবরে হতে হোতো, সে কথা খেয়াল রাখবেন। অবশ্য সেখানে যথেষ্ট দুঃখহারিণী গঞ্জিকার সাপ্লাই থাকতো, তাহলেও। আমাদের সম্মেলনেও যে একদিন তা চালু হবে না তা কে বলতে পারে।
শ্রেয়া প্রথমে আলাপ দিয়ে শুরু করেছিলেন, অর্থাত্ জানাশোনা ভব্য্সভ্য সব গান, ভালোই হচ্ছিলো কিন্তু সেরকম উত্তাপ নেই। এর মধ্যে কয়েকজন অজমূর্খ দর্শক অনুরোধ করলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে, এবং নানা অজুহাত দিয়েও দর্শকপ্রাণা শ্রেয়া ঢেঁকিটি গিলে ফেললেন। দুটি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলেন, এবং দুটিতেই ছড়ালেন। শ্রেয়া পেশাদারী শিল্পী, তাঁর দক্ষিণার বহর দেখলে সে নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়, তাঁর কিন্তু এমন ঘটিতব্যের কথা চিন্তা করে গোটা দুই গান মুখস্থ রাখা উচিত ছিলো। তাতে অবশ্য কিছু এসে গেলো না, বিরতির পর তিনি রণসাজে ফেরত্ এলেন, যে সব পৃথুল পৃথুলারা রুদ্ধশ্বাসে বসে ছিলেন তাঁরা মঞ্চের কাছে গিয়ে উদ্বাহু হয়ে নাচতে লাগলেন, মহাপ্রভু যখন খোল গলায় নদীয়ায় নগরসংকীর্তনে বেরোতেন তখন নগরবাসীরা যেমনটি করতো। এখানে কীর্তনের ভাষা হিন্দী বলে মনে হোলো-- নবজাগরণের চূড়ান্ত! সম্মেলনের উদ্যোক্তারাও আমাদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতাভাজন হলেন।
এতসব কথার পরে দিবাশেষে কিন্তু বলতেই হয়, "ভালো আমার লেগেছিলো, রইলো সেই কথাই"। কতো লোকে খেটেখুটে ব্যাপারটা দাঁড় করালেন, মনে রাখতে হবে তাঁদের কারুরই এই কর্মটি জীবিকা নয়। দিনগত পাপক্ষয় করার পর সময় করে এই সম্মেলন নামাবার কাজ ধরতে হয়, সে চারটিখানি কথা নয়। তাঁদের এই নিঃস্বার্থ কৃতির ফলে দেখলাম অনেক মানুষ, অনেক মজা আর অনেক মজার মানুষ। অব্যবস্থার ব্যাপারটা এখন তো মোটামুটি একটা সমতলে পৌঁছে গেছে,-- খাবার কম পড়বে, রেজিস্ট্রশন খুঁজে পাওয়া যাবে না, সময় মাফিক প্রোগ্রাম হওয়াটা মরীচিকা মাত্র, এইসব আর কী। এসব কিছুর জন্য আগে থেকে মোটামুটি তৈরী হয়ে আসা যায়, আর বাকী দুয়েকটা ধাক্কা হঠাত্ আলোর ঝলকানির মতো এসে আমাদের সহনশীলতার মাত্রা বাড়ায় বই নয়। অতএব রঙ্গ বোঙ্গো "সন্মেলন" যুগ যুগ জিও !