উত্তর ২৪ পরগণা জেলার এক ছোট্ট গ্রাম সুটিয়া। কলকাতার থেকে আড়াই ঘন্টার দূরত্বে, বাংলাদেশ সীমান্তের শেষ গ্রাম জাদুডাঙা থেকে এক ঘন্টার দূরত্বে। চাষবাসই এখানকার প্রধান জীবিকা, জনসংখ্যার একটা অংশ জমির মালিক, অন্য অংশ ভাগচাষী অথবা রোজ খাটা জনমজুরের দল। এদের বড় অংশেরই কোনও অস্তিত্ব নেই রাজ্যের জনসংখ্যার হিসেবে, বেশির ভাগই সীমান্তপারের অনুপ্রবেশকারী শ্রমিক। এ ছাড়া স্থানীয় কিছু ব্যবসায়ী আছেন যাঁরা মূলত সারের ব্যবসা, কেরোসিনের ডিলারশিপ, এবং বাংলাদেশ সীমান্তের চোরাচালানের সাথে যুক্ত। স্বাভাবিকভাবেই এইসব ব্যবসায় সহায়তা করে স্থানীয় গুন্ডা, স্থানীয় পুলিশ এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা, যারা প্রত্যেকে লাভের বখরা পেয়ে থাকে নিয়মিত।
উত্তর ২৪ পরগণার বারাসাত জেলার গাইঘাটা থানার অন্তর্গত এই সুটিয়া গ্রাম। একে ঘিরে আছে কুটিপাড়া, গজনা, বিষ্ণুপুর, পাঁচপোতা, গোবরডাঙা, ফৌদকাঁটি, ঠাকুরনগর, শিমূলকুর, ঝাউতলা, বাদেখাটুয়া, তেপুলাবরাপাড়া, গাইঘাটা, মালচাঁদপুর এবং বলদেঘাটা গ্রাম। গোবরডাঙা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন, শিয়ালদা থেকে দু ঘন্টার রাস্তা।
গ্রামের বাসিন্দারা বেশির ভাগই ১৯৭১এর যুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশ থেকে আসা উদবাস্তুদের দল। বেশির ভাগই তথাকথিত নিচু জাত, দুই ধর্মের মানুষই আছেন এখানে। ১৯৯১ সাল থেকে এখানে সন্ত্রাসের রাজত্ব শুরু করে সুশান্ত চৌধুরি আর বীরেশ্বর ঢাল নামে দুই বহিরাগত গুণ্ডা, যারা এসেছিল নাগপুর আর বলদেঘাটা গ্রাম থেকে। সেই থেকেই এরা এখানে তোলাবাজি, মুক্তিপণ আদায়, বাংলাদেশে চোরাচালানের মাল থেকে মুনাফা ইত্যাদি নানাবিধ দুষ্কর্মের সঙ্গে যুক্ত। ১৯৯৮ সাল থেকে সুশান্ত চৌধুরির ক্ষমতা বাড়ে, তার দলে আরও কিছু দুষ্কৃতীদের দল যুক্ত হয়। দুই গুণ্ডা মিলেই তাদের তোলাবাজির কারবার জমিয়ে তোলে, স্থানীয় ব্যবসায়ী, দোকানদার এবং বাসিন্দা এদের কাছ থেকে এরা নিয়মিত তোলা আদায় করত এদের স্থানীয়ভাবে ব্যবসা করতে দেবার বিনিময়ে। দুজনেই বাইরের লোক হলেও অবিলম্বে এরা সুটিয়ায় জমিয়ে বসে, এবং নিজেদের দলে স্থানীয় হতাশ, কাজ-না-পাওয়া ছেলেপুলেদের ভেড়াতে শুরু করে। এই স্থানীয় ছেলেদের বেশির ভাগই এই সব দলের "ইনফর্মার" হিসেবে কাজ করত। দেখতে দেখতে ছোটখাটো তোলাবাজির ঘটনা বাড়তে বাড়তে ২০০০ সাল নাগাদ এই সব বড় আকার ধারণ করে, এবং এর সাথে যুক্ত হয় গণধর্ষণের মত ঘটনাবলী। এর মূলে ছিল এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া চালুন্দি নদীর বন্যায় সুটিয়া এবং আশপাশের গ্রামের বহু মানুষ সহায়সম্বলহীন হয়ে পড়েন। বেশ কয়েকটি গ্রাম হতশ্রী হয়ে পড়ে। এই সময়ে সরকারি এবং বেসরকারি ত্রাণসাহায্য এসে পৌঁছয় এবং সেইসব বিলিব্যবস্থার কাজে লাগে স্থানীয় ছেলেরা। এর পরে যা হয়, ধীরে ধীরে তারা নিজেরাই সেই সব রিলিফের মাল সরাতে থাকে, এবং সুশান্ত আর বীরেশ্বরের সহায়তায় তাদের গুণ্ডাবাহিনি এই সব গ্রামে তাদের দৌরাত্ম্য শুরু করে। গুন্ডাবাহিনি রিলিফের দখল নেয় এবং তারাই স্থানীয় স্কুল পালানো, কর্মহীন, হতাশ কমবয়েসী ছেলেদের নিজেদের দলে নিয়োগ করতে শুরু করে, ক্রমে সুটিয়া এবং আশপাশের সমস্ত গ্রামের রিলিফ সেন্টারের দখল তারা নিয়ে নেয়, এবং তাদের সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয় পুরো এলাকায়। নির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনে তারা তোলাবাজি আর অত্যাচার চালাত, লোকাল ইনফর্মারদের সাহায্যে তারা স্থানীয় পরিবারগুলো সম্বন্ধে খবর জোগাড় করত, তারপরে বাইকবাহিনী নিয়ে চড়াও হত সেই পরিবারের ওপর, মহিলাদের অত্যাচার এবং ধর্ষণ করত, তারপরে টাকা দাবি করত। কখনও দাবির কম টাকা নিয়েই তারা খুশি হয়ে যেত, কখনও কখনও তারা বাধ্য করত পরিবারটিকে নিজেদের আংশিক জমিজিরেত বেচে টাকা তুলে দেবার জন্য। পুলিশে খবর দিলে মেরে ফেলার হুমকি দিত তারা। কখনও তারা লাগাতার কয়েক দিন ধরে কোনও একটি বাড়িকে ঘিরে থাকত, কাউকে বেরোতে দিত না যতক্ষণ না তাদের দাবি মানা হত। সবাই জানত, স্থানীয় পুলিশের সাথে তাদের যথেষ্ট বোঝাপড়া ছিল এবং দুই গুণ্ডাবাহিনির নেতাই বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার ছত্রছায়ায় পুষ্ট ছিল, তাদের ধরা সোজা ছিল না। মেয়েদের তারা ধরে নিয়ে যেত নাগবাড়ি এলাকায় একটা ছোট পরিত্যক্ত ঘরে, তারপরে সেখানে তার ওপর অত্যাচার চালাত। একটিমাত্র কেসে আমি জনৈক সারভাইভারের নিজের মুখ থেকে শুনেছি সেই অত্যাচারের কাহিনি, বাকি কেসগুলো আমি শুনেছি অন্যদের মুখ থেকে এবং লোকাল থানার এফআইআর থেকে। আমি আবার সুটিয়া যাব আরও বিস্তারিত জানতে।
মাত্র ৩৫টা কেস ডকুমেন্টেড হয়েছে, স্থানীয়দের মতে প্রকৃত কেসের সংখ্যা আরও অনেক, অনেক বেশি, সবই চাপা দেওয়া হয়েছে, কারণ অত্যাচারিতারা নিজেরাই মুখ খুলতে রাজি হন না অনেক সময়ে। আমি কয়েকটি কেসের ক্ষেত্রে কেস নম্বর দিয়েছি, সব দেওয়া গেল না কারণ সেটা একটা বিশাল সময়সাপেক্ষ কাজ হত। আমার প্রকাশিতব্য বইতে আমি সমস্ত কেস সম্পূর্ণরূপে লিখব যা আমি তথ্য সংগ্রহ এবং সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে এক এক করে জোগাড় করেছি। সুটিয়াবাসীদের কাছে এ আমার শপথ।
সময়-সারণীঃ
২০০১-২০০২ - কিছু মহিলা মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভকে ধর্ষণ করা হয় (সংখ্যা পাওয়া যায় নি)। তাঁরা যখন সুটিয়া এসেছিলেন, তাঁদের টেনে নিয়ে যাওয়া হয় পাশের মাঠে, সেখানে ধর্ষণ করা হয় তাঁদের। কোনও এফআইআর হয় নি এ ব্যাপারে, শ্রী ননীগোপাল পোদ্দারের জুলাই ২৭, ২০১৩-র বক্তব্য অনুযায়ী লেখা।
২০০১ - তেরো-চোদ্দ বছরের একটি মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়। সে থাকত তার মা আর ভাইয়ের সাথে, পুঁতির গয়নার কাজ করে দৈনিক মজুরিতে তাদের দিন চলত, দারিদ্র্যসীমার নিচের বাসিন্দা। গুন্ডাদের দল জোর করে মেয়েটিকে ধরে নিয়ে যায় এক নির্জন জায়গায় কোনও এক ধানক্ষেতের মাঝে, জোর করে তাকে মদ খাওয়ানো হয় যতক্ষণ না সে বেহুঁশ হয়ে পড়ে, তারপরে চারজন মিলে তাকে উপর্যুপরি ধর্ষণ করে। পরদিন তাকে বাড়ি ফিরিয়ে দেওয়া হয় এবং হুমকি দেওয়া হয় পুলিশ বা অন্য কাউকে খবর দিলে প্রাণে মেরে ফেলা হবে। এর পর আবার দ্বিতীয়বার অন্য এক দিন তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় "সুখসাগরের ভিটে" নামে পরিচিত সুটিয়ার একটা নির্জন জায়গায়, এবং আবার তার ওপর গণধর্ষণ চালানো হয়। নগ্ন অবস্থায় তার ছবি তোলা হয়। মেয়েটির মামাকেও হুমকি দেওয়া হয়, এ ব্যাপারে কেউ কিছু জানতে পারলে তাদের প্রাণে মেরে দেওয়া হবে। চারদিন ধরে মেয়েটির ওপর অত্যাচার চালানো হয়, তারপরে আবার সে ছাড়া পেলে তাদের পরিবার রাতারাতি সুটিয়া ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়।
২০০১ - হিতলাল বায়েন নামে এক ব্যক্তি যিনি এখন প্রতিবাদ মঞ্চের সদস্য, তাঁর নিজের পরিবারের ওপর হওয়া অত্যাচারের কথা বলেন। তাঁর বাচ্চাকে ছুঁড়ে ফেলা হয়, স্ত্রীকে নির্মমভাবে পেটানো হয়। নন্দ হালদার নামে একজন বলদেঘাটা গ্রামের ঘরে ঘরে ঢুকে মহিলাদের নগ্ন করে ছবি তুলতে থাকে। গীতা বিশ্বাস নামের এক বয়স্কা মহিলা এবং শ্যামল বৈদ্য নামে এক ফটোগ্রাফার তাকে এই কাজে সাহায্য করত। গীতা বিশ্বাস মহিলাদের, বিশেষত সুন্দরী মহিলাদের ভুলিয়ে ভালিয়ে এই নন্দ হালদারের কাছে নিয়ে আসত, তারপরে শ্যামল বৈদ্য তাদের জামাকাপড় খুলে ফটো তুলে তাদের ছেড়ে দিত। এর পর গুন্ডাদের দল সেই সব ছবি লাখ টাকার অঙ্কে বাইরে বিক্রি করত।
২০০১ - নাগবাড়ি এলাকায় এক মহিলা নিজের বাড়িতে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের শিকার হন। তাঁকে প্রথমে অপহরণ করা হয়, তারপরে এইখানেই আবার নিয়ে এসে তাঁকে নগ্ন করে ছবি তোলা হয়, সাথে যথারীতি হুমকি দেওয়া হয়, কাউকে খবর দিলে সুটিয়াতে তাঁকে টিকতে দেওয়া হবে না। পরদিন তারা আবার আসে, তাঁকে তুলে নিয়ে যায় বলদেঘাটায়, তিনদিন আটকে রেখে তাঁর ওপর অত্যাচার চালানো হয়। (এফআইআর এবং মহিলার মৌখিক জবানবন্দীর ভিত্তিতে লিখিতঃ কেস নং IPC 159/02)।
২০০২ - ১৪ বছরের একটি মেয়েকে গণধর্ষণ করা হয়। মেয়েটির মা বাড়ি বাড়ি কাজের লোক হিসেবে কাজ করতেন। সুশান্ত চৌধুরির দল পঞ্চাশ টাকার বিনিময়ে তাঁকে তাঁর শরীর বিক্রি করতে বলে। রাজি না হওয়ায় তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, জোর করে অ্যালকোহল খাওয়ানো হয়, ফলস্বরূপ তাঁর শরীর থেকে রক্তপাত শুরু হয়।
২০০১ - এক অল্পবয়েসী অবিবাহিতা মহিলাকে নাগবাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, নগ্ন করে ধর্ষণ করা হয়, এবং সেই অবস্থাতেই বন্দী রাখা হয়। ধর্ষণের ভিডিও রেকর্ডিংও করে রাখা হয়।
২০০১ - গণধর্ষণের পরে সবার সামনে এক মহিলাকে নগ্ন করে ঘোরানো হয়, নরপশুরা তাঁর যোনিতে আইসকিউব ঢুকিয়ে উল্লাস অনুভব করতে থাকে। আরেক মহিলা স্বামীর সঙ্গে রিক্সায় চেপে মছলন্দপুর থেকে তাঁর বাপের বাড়ি সুটিয়ায় আসছিলেন, পথে ভাড়া নিয়ে তাঁর স্বামীর সঙ্গে রিক্সাওলার কিছু বচসা হয়। সেই সময়ে গুন্ডা দলের এক ইনফর্মার ওখান দিয়ে যাচ্ছিল, সে গিয়ে দলটিকে খবর দেওয়া মাত্র গুন্ডারা এসে এই দম্পতিকে ঘিরে ধরে, এবং দাবি করতে থাকে এরা নাকি আসলে সত্যিকারের স্বামী-স্ত্রী নয়, অতএব এদের একসঙ্গে থাকা "অনৈতিক"। জোর করে তাদের রিক্সা থেকে নামিয়ে ছেলেটিকে বেদম পেটানো হয়, এবং প্রকাশ্য রাস্তায় ফেলে মেয়েটিকে নগ্ন করে এবং তারপরে ধর্ষণ করে এবং তারও পরে যোনিতে আইসকিউব ঢুকিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়ে। এর পরে তাদের কাছ থেকে গুণ্ডাবাহিনি পঞ্চাশ হাজার টাকা দাবি করে। দম্পতিটির পক্ষে ওই টাকা দেওয়া সম্ভব ছিল না। অনেক অনুনয় বিনয়ের পরে দশ হাজার টাকায় রফা হয়, এবং টাকা দেবার পরে তাদের ছাড়া হয় (কেস নং 160/02)।
২০০২ - সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক মহিলা গোবরডাঙায় ট্রেন থেকে নামেন দুই সন্তান সমেত। বাচ্চাদুটির তেষ্টা পেয়েছিল, তিনি জলের খোঁজ করছিলেন। দুটি কোকের বোতল কেনেন তিনি, বাচ্চাদের হাতে দেন, এর পর তাঁরা বাসে ওঠেন। পুরো ব্যাপারটাই ইনফর্মাররা নজর করছিল, খবর পৌঁছে যায় যথাস্থানে, মাঝরাস্তায় বাস থামিয়ে ওই মহিলাকে বাচ্চাসমেত নামানো হয়, পাশের ধানক্ষেতে নিয়ে গিয়ে তাঁকে উপর্যুপরি ধর্ষণ করা হয়, তৃষ্ণার্ত বাচ্চাদের হাত থেকে কোল্ড ড্রিঙ্কের বোতল ছিনিয়ে নিয়ে তারা নিজেরা খেয়ে নেয়।
২০০২ - আরও এক মহিলার গণধর্ষণ হয়, স্বামীকে বেঁধে রেখে পেটানো হয়। সুটিয়ার কাছে বিষ্ণুপুরের ঘটনা। মহিলাটি প্রাথমিকভাবে বিধবা ছিলেন এবং সম্প্রতি এক বিপত্নীক ব্যক্তিকে বিয়ে করেছিলেন। গুণ্ডাদের দল একদিন তাদের বাড়িতে চড়াও হয় এবং অবৈধ সম্পর্কের অভিযোগ আনে, স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রী-র ওপর গণধর্ষণ চালায়। তার পরে তারা পঞ্চাশ হাজার টাকা দাবি করে দম্পতিটির কাছ থেকে। তাদের কাছে অত টাকা ছিল না। গুণ্ডারা তখন নজর দেয় তাদের সামান্য একটু জমির ওপর। সেই জমি বিক্রি করে তাঁরা পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে বাধ্য হন। এক বছর পর স্বামীটি মারা যান। এর মধ্যে অভিযোগের ভিত্তিতে দলটিকে পুলিশ গ্রেফতার করে, কিন্তু বয়ানের কিছু আইনি অসঙ্গতিতে তারা অনায়াসে বেল পেয়ে যায়।
২০০২ - সুটিয়ার কাছে গাজনা গ্রামে এক মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়, তারপরে নগ্ন করে তার ছবি তোলা হয়। দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় এদের বাড়ি এসেছিলেন, ইনফর্মার সেই খবর পৌঁছে দেয় যথাস্থানে, এর পর দলবল এসে চড়াও হয় মেয়েটির বাড়ি, অভিযোগ করে আগন্তুকের সঙ্গে মেয়েটির অবৈধ সম্পর্ক আছে। এর পরেই ঘটে গণধর্ষণ এবং তারপরে এক স্থানীয় ফটোগ্রাফারকে ডেকে এনে মেয়েটির নগ্ন ছবি তোলা হয়। ফটোগ্রাফারকে ছবি তুলতে রাজি না হলে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। এর পর পঞ্চাশ হাজার টাকা দাবি করা হয় এবং কুড়ি হাজার টাকায় রফা হয় (কেস নং IPC 161/02)।
২০০২ - সুটিয়ায় এক মায়ের সাথে রাগারাগি করে বড় ছেলে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। দুদিন পরে ছেলেটির মা, ছেলেটির মামাকে এই খবর দেন। মামা আসেন ছেলেটির বাড়িতে। ইনফর্মারের মাধ্যমে পুরো খবর পৌঁছে যায় গ্যাংএর কাছে, তারা আসে এবং একই পদ্ধতিতে প্রথমে দাবি করে ছেলেটির মামা এবং মায়ের মধ্যে "অবৈধ" সম্পর্ক আছে, তারপরে মহিলাকে টেনে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণ করে, এর পরে পঞ্চাশ হাজার টাকা দাবি করে। পরে কুড়ি হাজার টাকায় রফা হয়।
২০০৩ - একটি চোদ্দ বছরের মেয়েকে (নাম ধরা যাক, ক) ধর্ষিতা হতে হয় তার বাবার চোখের সামনে। ১৯ বছরের একটি ছেলে, (ধরা যাক, তার নাম খ) ক-এর দিদির প্রেমে পড়ে। ক-এর দিদি প্রত্যাখ্যান করে, খ তবু হাল ছাড়ে না। ক-এর মা-বাবা ছেলেটিকে ডেকে তাঁর মেয়ের কাছে আর আসতে বারণ করে দেন। খ এতে অপমানিত বোধ করে এবং গুণ্ডাদের দলে যোগ দেয়। ইতিমধ্যে ক-এর বাবা নিজের বাড়ির কিছু সারাইয়ের কাজকর্ম শুরু করেন। এই পরিবারটি বাংলাদেশ থেকে ১৯৭১ সালে চলে আসা, সেই থেকেই এঁরা এই এলাকাতেই বসবাস করছেন। ২০০৩এ আর্থিক অবস্থার কিছু উন্নতি হয়, হাতে কিছু পয়সা আসে, ক-এর বাবা তাই বাড়ির সংস্কারে মন দেন, কিছু ঘর বাড়ান। একদিন রাতে খ বাইকে চেপে দলবল নিয়ে ক-এর বাড়িতে হামলা করে। দরজা জোর করে খুলে ঢুকে তারা পঞ্চাশ হাজার টাকা দাবি করে ক-এর বাবার কাছে, কারণ তারা লক্ষ্য করেছিল, ক-এর বাবার হাতে কিছু পয়সা এসেছে। তারা আরও হুমকি দেয় যে পয়সা না পেলে তাঁর দুই মেয়েকেই ধর্ষণ করা হবে। মেয়েদুটির মা পেছনের দরজা দিয়ে পালান, এবং তাদের ন'বছরের ভাইও পালিয়ে এক সম্পর্কিত ভাইয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। অসহায় বাবা যখন জানান যে তাঁর পঞ্চাশ হাজার টাকা দেবার সামর্থ্য নেই, গুণ্ডারা তখন বড় মেয়েকে মারতে শুরু করে, মেয়েটির তখন ১৮ বছর বয়েস। এর পর চারজনে মিলে ছোট মেয়েটিকে উপর্যুপরি ধর্ষণ করে, তাদের বাবার চোখের সামনেই। বড় মেয়েটি তখন অসুস্থ ছিল, তার অ্যাপেন্ডিসাইটিসের অপারেশন হবার ছিল, সে একটু জল চায়। গুণ্ডারা জল দিতে অস্বীকার করে এবং সমানে তাকে মারধোর করতে থাকে। মারধোর এবং গণধর্ষণের পর দলটি পুলিশকে না-জানানোর হুমকি দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। দলের কয়েকজন আড়াল থেকে পরিবারটির ওপর নজর রাখছিল, তারা দিনরাত বাড়ির চারপাশে পাহারা দিত, কাউকে বাড়ি থেকে বেরোতে দিত না। ফলে ক-এর দিদিকে তাঁরা হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারেন না, এমনকি নিজেদের দোকান বাজার যাওয়া পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। তিনদিন পরে গুণ্ডাদের নজরদারিতে ঢিলেমি পড়ে, এই সুযোগে পরিবারটি ঘর থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এখন ক-এর বিয়ে হয়ে গেছে এবং সে একটি দশ বছরের ফুটফুটে বাচ্চার মা। প্রতিরোধ মঞ্চের আজ সে একজন সামনের সারির সদস্য। নিহত বরুণ বিশ্বাসের নামে শপথ নিয়েছে সে, এই অন্যায়ের প্রতিশোধ সে নিয়ে ছাড়বে (কেস নং IPC 158)।
অনুবাদঃ শমীক মুখোপাধ্যায়