এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • হেরে যাওয়া মানুষ

    Yashodhara Raychaudhuri লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২৭ মে ২০১৮ | ৩১৭২ বার পঠিত
  • হেরে যাওয়া মানুষ
    যশোধরা রায়চৌধুরী

    যখন সবাই সুখের কথা বলছে
    তখন কাউকে না কাউকে তো মনখারাপের কথাও বলতে হবে।
    মানুষ বিশেষ ভাল নেই, এই কথাটাও ত কারুকে চেঁচিয়ে বলতে হবে।
    কারুকে তো বলতে হবে সত্যি সত্যি কী ঘটছে, আমরা কেউ বলব না যখন।

    যে বলছে, সে ্বিশাল কিছু নয়।
    কোন আন্দোলন করছে না, স্লোগান দিচ্ছে না, শুধু একনাগাড়ে
    সত্যিটা বলে যাচ্ছে।
    আমাদের চোখে এই লোকটাই পাগল। এই লোকটাই সেই লোক, যাকে ভয় পেতে শিখেছি ।

    যখন কেউ মিথ্যে লিখছে, এই লোকটা তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
    বগল চুলকোয়, মাথা থেকে উকুন বের করে নেয়।
    মিথ্যে লেখকের কলম দ্বিধাগ্রস্ত হয়, আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে যায়
    মিথ্যে লেখক একটু ঘাবড়ে গিয়ে কলম বন্ধ করে,
    আবার ভাবতে বসে।

    যখন কেউ এই লোকটাকে নিয়ে লিখছে
    “এই লোকটা সত্যিটা বলে। আমাদের চোখে এই লোকটাই পাগল”...

    তখন লোকটা তার সামনেও গিয়ে দাঁড়ায়
    দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাথা চুলকোয়, পা ঘষে।
    যে লোকটা লিখছিল, তার লেখা থেমে যায়।

    এই লোকটাকে নিয়ে লেখা যায় না তাই। এর কাছে,
    আমাদের প্রতিটা ছেনালির ফুটো
    ছেঁড়া খবরের কাগজ দিয়ে বন্ধ করা আছে।
    (এই লোকটা, বিপজ্জনক, মদীয়)

    প্রতিদিন এই গল্পগুলো ঘটে চলেছে। আমরা যখন এসব কবিতা লিখি, তখনো আমরা একটা “জিতে যাওয়া” সমাজেই বাঁচি। জিতে যাওয়া আর হেরে যাওয়ার দুটো ধারণার মধ্যে দড়ি টানাটানি করতে করতে বাঁচে আমার সমাজ। রোজ দেখি অটোতে, বা বাসে যে মাকে, যে নাকি বুভুক্ষু অবস্থায় নিজের ছেলের মুখে দুধ পাউঁরুটি তুলে দিয়ে সক্কাল সক্কাল বেরিয়েছে তাকে শিক্ষিত করে সফল করতে, সে কিন্তু বাসে উঠেও ছেলেকে জিতিয়ে দেবার পরিকল্পনা করছে, শেখাচ্ছে অন্যের পা মাড়িয়ে ছেলেকে ফাঁকা সিটটার দিকে দৌড়ে যেতে, ঠেলে দিচ্ছে বন্ধুদের টিফিনের ভাগ না দিয়ে নিজে বেশি খাবার খেতে শেখার দিকে, ভাবছে কবে তার এই “ইনভেস্টমেন্ট” ছেলে তুলে আনবে চাকরির ফর্মে, মাইনের ফর্মে...হয়ত বিবাহের পণের ফর্মেও , ভবিষ্যতে। ফেরত আনবে তার এই আত্মত্যাগের মহিমার চতুর্গুণ জিতে যাওয়া!
    আমাদের জিতে যাওয়া সমাজ প্রতিবার, প্রতি অবস্থায় জানে, যে, এই জিতে যাওয়ার রাশিতত্ত্বগত সম্ভাবনা কত কম। আমরা জানি, ৯৯ জন হারলে তবে একজন জেতে। তবু এই জেতার প্রতি আস্থাবান আমরা , আমরা বিশ্বাস করি যে জেতেনি সে কিছুই করেনি। তাই আমাদের ছায়াছবিরা জিতে যাবার স্বপ্ন দেখায়। বলে, দ্যাখো , যতই শুরুর দিকে হার দেখাই আমরা, শেষ দৃশ্যে জয় না থাকলে পাবলিক খাবেনা, জনতা জনার্দন মজবে না। কারুর পরিতৃপ্তি লাভ হবে না।
    তাই “তারেঁ জমীন পর” এর মত রাজনৈতিকভাবে সঠিক ছবিতেও দেখাতে হয়, বার বার নানা কাজে হেরে যাওয়া, ডিসলেক্সিয়ার শিকার, ছোট ছেলেটি, অন্তত আর কিছুতে না হোক, আঁকার কম্পিটিশনে ফার্স্ট প্রাইজ পায়। প্রতি ছায়াছবি প্রথমে একজন হেরে যাওয়া মানুষের গল্প দেখাতে শুরু করেও, শেষ মেশ তাকে জিতিয়ে না দিলে দর্শকের মন শান্তি পায় না।
    হেরে যাওয়া মানুষ? কী তার মানে?
    আমরা প্রতিজন, প্রতি মুহূর্তেই কোন না কোনভাবে হেরে যাওয়া। তবু , নিজেকে সেভাবে দেখার অভ্যাস আমাদের নেই। সেভাবে নিজের দিকে তাকালে যে প্রতিটি দিন আরো দুর্ভার, দুর্বহ হয়ে উঠবে। অথচ সত্যবাদী, সত্যদ্রষ্টারা আজকের দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি ভুলবোঝা লোক, সবচেয়ে বেশি তাঁদের এড়িয়ে চলি আমরা। তাঁদের মনোভাবকে, নৈরাশ্যবাদী, ডিপ্রেসিভ বলে দাগিয়ে দিই।

    আমার মনে হয়, হেরে যাওয়া মানুষদের আর কোথাও ঠাঁই হোক চাই নাই হোক, তাঁদের ঠাঁই ঠিকই আছে সাহিত্যে। কারণ সাহিত্যই সেই জায়গা, যেখানে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী হেজিমনি ( শব্দটা খুব চলছে আজকাল, সবাই মানে জানেন , তবু সহজপাচ্য করে হেজিমনি বোঝাতে গেলে এটাই বলব, মৌরশিপাট্টা কথাটা, বাংলার , খুব কাছাকাছি আসে হেজিমনির। আর “হেঁজিপেঁজি নয়” এমন লোকই হেজিমনির ধারক বাহক, হেজিমনি অনেক রকম , গোটা বিশ্বের রাজনীতিতে যদি আমেরিকার হেজিমনি চলে, তো, পাড়ায় দাদা-মামা-কাকাদের... ক্লাসে পড়াশুনোয় ভাল ছেলেদের অথবা খেলার মাঠে লম্বাচওড়াদের...) গুলোকেই লেখক ক্রমাগত টার্গেট করে চলবেন। লেখক ক্রমাগত তছনছ করতে চাইবেন ক্ষমতার কাঠামো। এই প্রক্রিয়ায় তিনি বেছে নেবেন কাহিনির কেন্দ্র হিসেবে নায়কোচিত মানুষকে নয়, বরং তথাকথিতভাবে সামাজিক “হেরে যাওয়া মানুষদের”ই।
    অবশ্য সেদিক থেকে দেখলে পৃথিবীর বিশাল ক্ল্যাসিক যেভাবে হেরে যাওয়ার গল্প বলেছে, অথবা নিরীহ, শিশু, অনাথদের... এবং জনপ্রিয় হয়েছে, সেভাবেই ছায়াছবির পর্দায় জনপ্রিয়তা পেয়েছে চোর বদমাশ বেশ্যা ভিখারি সাধুরা...
    মনে করব চার্লস ডিকেন্স –এর অনাথাশ্রমের শিশুদের, অথবা টলস্টয়ের সমাজপরিত্যক্ত চরিত্রদের। কাউন্ট অফ মন্টিক্রিস্টোর অবাস্তব উত্থানও তো হেরে যাওয়া মানুষেরই ঘুরে দাঁড়াবার গল্পই। হালের হিন্দি ছবির কথা আগেই বলেছি, শোলের মত ছবিও তো সমাজবহির্ভূতদের গল্প।
    সমাজ অন্যথা যাদের দিকে ফিরেও তাকায় না, তাদেরই গল্পবইতে বা রূপালি পর্দায় দেখে বিগলিত হয়, এই এক বৈপরিত্যও তাই চোখ এড়ায় না আমাদের। ভেতরে ভেতরে কি তবে মানুষ নিজেকেও আসলে হেরো ভাবে? হেরে যাওয়ার কষ্ট অনুভব করে প্রতিমুহূর্তে, আর বাইরে দেখায়, দ্যাখো আমি জিতে গেছি? দ্যাখো আমি বাড়ছি মাম্মি!
    দুহাজার পরবর্তী বাংলা কবিতাতেও , হেরোদের প্রতিভূ, হেরো মানুষ-বেশ্যা-বেঘর-বেসাহারা মানুষের ঢল নেমেছে।
    নব্বই আর দুহাজার পরবর্তী সময়টাই আসলে বেশ্যা আর হেরো মানুষর, ভবঘুরের আর ভিখিরির, ভিখিরির আর গৃহহীনের। এই সব মানুষের মুখ মিলেমিশে যায় থিকথিকে শেয়ালদা স্টেশন চত্বরে, শপিং মলে, মেটিয়াবুরুজের অন্ধকার বন্দর এলাকায় আর জনাকীর্ণ পার্ক স্ট্রিট অথবা লোক উপচে পড়া লোকাল ট্রেনের কামরায়।

    এই দুই দশকের কবিদের কবিতায় এখন পিছলে পড়া লুব্রিকেন্ট, অবধারিত যৌনতার প্রতীক যেমন, তেমনই পথ আর পথের ভেঙে যাওয়া, জীবনের সবচেয়ে বড় মাইল স্টোনহীনতার হু হু হাইওয়েতে রূপান্তরিত।

    চিরদিনের প্রান্তবাসী এই সমাজের ঐসব নামহীন মুখহীন চরিত্রের মত, কবিও। কবির সত্তা কোথায় থাকে? আসলে থাকে না, গড়ে ওঠে, আবার ভাঙ্গে, আবার গড়ে তুলি আমরা।

    আমাদের ভেতরের সত্তাটিকে আমরা ধ্বংস করতে চেয়েছি ক্রমাগতই , এইভাবে। এই দুই দশক, নব্বই আর দু হাজার দশকের কবি যারা, আমাদের কাছে বাইবেল যদি হয় জয় গোস্বামীর উন্মাদের পাঠক্রম, তাহলে মসিহা নবারুণ ভট্টাচার্যের ফ্যাতাড়ু, ..। এই সময়খন্ডের প্রতিটি কবিই তাই, নিজের সত্তাকে ছেতরে ফেলেছে তার কবিতার নানা লাইনে...

    এ বাড়ি আমার। তবু, এ ঠিক আমার বাড়ি নয়।
    কত সহজেই লেখা এসব সরলরেখা তোমার মাথায় ঢুকে পড়ে।
    যেমন সিঁদুর দূরে দিগন্ত নামায়, দূরে জল ও আকাশ
    আশ্চর্য সম্পর্ক। এক ছাড়া ছাড়া ভালবাসা, লোক দেখানোর
    সমগ্র বৃষ্টির ধারা আমার এই আজীবন পর হয়ে থাকা
    সে এক সরল বাক্য ক্রমশ জটিল জামাকাপড়...
    তোমার কাছেই আমি কল্পনাপ্রবণ হাতেখড়ি
    ( তাপস কুমার লায়েক, নাও)
    দুটি বাক্যাংশে জোর দিতে চেয়েছি ... যা মূলত বেঘর কবিকে চিহ্নিত করে। তাপস কুমার লায়েকও নব্বই দশকের কবি।
    কবিতার কাজ আড়ালে থাকা, লুকিয়ে থাকা কথাগুলোকে বার করে আনা। অথবা, আরো খটমট করে বললে, কবিতা গোপনকে উন্মুক্ত করে, ছেৎরে খুলে দেয় ভেতরের অন্ধকার, পাপ,অন্যায় ও নিজস্ব অন্ধতা।
    কবিতা বোমার মত বিস্ফোরক।
    এক ২০০০ পরবর্তী কবির ভাষায়ঃ
    “আমার কবিতা যেন বিস্ফোরকভর্তি স্যুটকেস/ দেখতে নিরীহ, আর ভেতরে অনন্ত আর ডি এক্স/ বারবার রেখে আসি ভিড় বাসে, মন্দিরে, হাওড়া স্টেশনে.../কিন্তু শালা কিছুতেই ফাটে না কেন যে.../ কে জানে” ( অভিষেক ভট্টাচার্য)
    এই অভিপ্রায় কবির। সমাজ তাকে যা যা শেখায়, সবটাকে সে উলটে দিতে চায়, সে উল্টোমুখে চলতে চায় , অভিকর্ষণের নিয়ম না মেনে সিলিং এ গিয়ে উঠতে চায় ভেসে, সে নিয়মকানুন ভাঙে, আর যা যা শান্তশীলতার শিক্ষা তাকে দেওয়া হয়েছিল সেগুলো হাট করে খুলে দিয়ে অসভ্য হতে চায় খুব।
    কেননা কবি স্বাধীন। স্ব ইচ্ছা সম্পন্ন। কবি আসলে নিজের মত থাকতে চেয়েছিল। সমাজ তাকে থাকতে দেয়নি, দেয়না, তাই সে কবিতা লেখে। কবি আসলে নিজের ঘরে থাকতে চেয়েছিল। তার ঘর ভেঙে দেওয়া হয়েছে, সেই ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে সমাজের বিধিনিষেধ। তাই সে বেঘর, সে চির ট্র্যাম্প, সে হেরো মানুষ...বেগানা, দূরচারী।
    ২০০০ পরবর্তী কবিতা সেই ছেতরে পড়া ঐতিহাসিক ভবঘুরের কাহিনিই, বার বার আবৃত্ত।
    আশিক খুদাবক্স লেখেনঃ
    দীর্ঘায়ত সপ্তাহশেষ -
    অসংখ্য ঝাঁঝালো শব্দ বাড়ি মারছে মগজের কোষে
    শেষ বাস । অপেক্ষা । অচেনা শহরজোড়া রাতে
    শুধু আমি একা আর পৃথিবীর সব ছবি আশ্চর্য তফাতে
    আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে এই দেখ এরকমও ছবি হতে পারে
    ... যে খুব স্টিলেটো-হাঁটা মুগ্ধতা দিয়েছিল বার-এ
    বার থেকে বেরোতেই সেও তার জুতোজোড়া খুলে নেয় হাতে
    শুধু আমি একা আর পৃথিবীর সব ছবি আশ্চর্য তফাতে
    আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে কতটা আকাশ হয়ে উড়ি -
    আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে
    ভেসে থাকা কতটা জরুরী ।

    অথবা শুভ আঢ্য লেখেনঃ

    একটা হ্যাঙ্গার, জামা, বালিশ, অ্যাসট্রে, ফোন, মাইনাস পাওয়ার,
    এমারজেন্সি ল্যাম্প, পেন, ডায়রি, কাঁচা ছটফট, অ্যাকোরিয়াম,
    জলের বোতল, বই, ব্লেড, ঘুম, ওয়াল ক্লক, নাটকের টিকিট,
    বডি-স্প্রে, কম্পিউটর, দুঃস্বপ্ন, রাত্তির আড়াইটে, সিনেমা,
    বাস, ভুড়ভুড়ি আওয়াজ, অ্যালঝাইমার, জানলা, উঠে বসা,
    ক্যালকুলেটর, তেলরঙ
    উপসংহারে, ফ্রয়েড আর হিচককের সংকরায়ণ

    রবি ঠাকুর যে পথ আর ঘরের দ্বৈততার কথা বলেছিলেন , সেই দ্বৈততার থেকে আমাদের প্রজন্ম আরো একশ বছর পরের। আমাদের প্রজন্ম, যাদের জন্ম ষাটের দশকে, তারা দেখেছে পথই আসলে সবকিছু, কেননা ঘরের পরিসমাপ্তি হয়ে গেছে অনেক আগেই। ঘরের চারটে দেওয়াল খসে পড়ে গেছে, সমান হয়ে গেছে। রাস্তাগুলোই ঘর এখন।
    তৈলতা, মলিন সন্ধ্যাকাল
    কলকাতা কবলে আছে জনশূন্য পার্ক স্ট্রিটগুলো
    আমাকে সামান্য চাপ দাও
    আমি এই শব্দকে মসৃণ করব, লুব্রিকেট, হোচিমিন বাগানে বাগানে
    ঠান্ডা ঠান্ডা আঙুল ছোঁয়াব আর টাটা সেন্টারের পদমূলে
    রেখে আসব অনন্য ক্রেডিটকার্ড, ধার...
    ধা্র করে ঘৃত খাচ্ছি, ধার করে খাচ্ছি ধারা ধারা
    বিশুদ্ধ ধারায় পড়ছে তোমার মলিন, সান্ধ্য, তৈলাক্ত বাতাস
    বায়ুচাপভূত , শুকনো, ডিসেম্বর, লুব্রিকেট করো আগাগোড়া

    মেট্রোর গর্ভের থেকে উঠে আসছি আমরা সব উর্বর, নষ্ট মহিলারা

    ওপরের এই লেখাটি যশোধরা নাম্নী আর এক নব্বই-চিহ্নিত কবির। লেখা ১৯৯৫ এর আসপাশে। কেন লিখেছিলাম এই কবিতা? কেননা রোজ মেট্রোতে যাতায়াত করতে করতে আর মলিন শীত সন্ধ্যার দূষণপৃক্ত কলকাতা, তার হলদেটে ফগলাইট, পুরো দিনযাপনটাকেই হলদেটে আলোয় ভরে দিত। প্রতিটি হলদে আলোর নিচে দাঁড়াণো মেয়েই তখন প্রচন্ডভাবে নষ্ট বেশ্যার মত মনে হয়, হত।

    রাস্তা, রাস্তা আর রাস্তা, আমাদের লেখায় কেবলি সামঞ্জন্স্যহীন পথের কথা থাকে। থাকে চাউমিন গন্ধ, থাকে বিবশ একটা অন্ধকার ছায়াময় অন্য পৃথিবী। মানুষরা থাকলেও তাদের মুখ নেই। মুখহীন, নিজস্বতাহীন, হাসিকান্নাহীন এই ছায়ামানুষেরা ঘোরেফেরে, কোথাও কোন তরঙ্গ ওঠে না, কোন গ্র্যান্ড নেরেটিভ তৈরি হয়না, নতুন কথা বলার কেউ থাকেনা, বড় বাণী, মহৎ অঙ্গীকার রচিত হয়না, মহানাটকীয় কিছুই ঘটে না। শুধু একটা পাঁচমাথার মোড়ে নয়, হাজারমাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকি আমরা।

    ‘নিজের সত্তাকে ভাঙি খণ্ড করি তারপর উত্থানের ছবি
    কিউব পদ্ধতি ধরে এঁকে দেব বলে এই ক্ষুদ্র অনুনয়
    আজ অমাবস্যা রাত চান্দ্রমাস আমি জেনে গেছি
    কালোর পরেও এক কালো আছে তারার ও’পাশে অন্য তারা
    ভাগ্যচক্র ঠেলে দিই এরপর শিয়ালদা স্টেশন
    নিজেকে দাঁড় করাই অগণিত গণিকার দলে যাতে
    ফ্ল্যাশব্যাকে জীবনের চল্লিশ বছর জ্বলে ওঠে
    আত্মার ভিতর এমন পিপাসা জলের বোতল দিই
    মনে মনে বলি এত তৃষ্ণা কেন
    সামনে যে সে আমার জীবনের প্রথম খদ্দের’

    নব্বইয়ের কবি চন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্য মানুষী।

    ৩যেকোন দিকেই আমি চলে যেতে পারি, লিখেছিলেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, চল্লিশ দশকের কবি। পঞ্চাশ দশকের আত্মকেন্দ্রীভূত স্বীকারোক্তির কবি সুনীল শক্তি তারাপদ লিপিবদ্ধ করেছিলেন, তাঁরা কীরকমভাবে বেঁচে আছেন সেই কাহিনি। সেখানে নাটকীয়তা পরিহার করেও নাটক ছিল, ছিল নাটকীয় থেকে যাবার দুর্মদ বাসনাটুকু অন্তত।
    কিন্তু ষাটের দশকে এসে সেই নাটুকেপনা, আত্ম প্রচার টুকুও চলে যায়। নষ্ট হয়ে যায় কবির নিজের সমস্ত আত্মকেন্দ্রিক পৃথিবী। ষাটের কবি ভাস্কর চক্রবর্তী লিখেছিলেন, যে-কোন লাইন থেকেই একটা কবিতা শুরু হতে পারে, আর যে-কোন লাইনেই শেষ হয়ে যেতে পারে সেই কবিতা। কবিতা হবে আপাত সরল। হাজারমুখো। বিষয়ের কোন বাছবিচার থাকবে না। আর কবিতার একটা লাইন থেকে আরেক লাইনের দূরত্ব হবে কয়েকশ কিলোমিটারের। কিন্তু অদৃশ্য একটা তলদেশে থাকবে মিলিমিটারের নিবিড় সম্পর্ক।
    সময়ের থেকে অনেকটাই এগিয়ে থাকা কবি ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতায় গৃহহীনের সাড়া। রাস্তার ইশারা। হ্যাঁ, তা সত্যি, একরকমের চুপ থাকা, থেমে থাকা, ঘুমিয়ে থাকা, শূন্যতা, বিষাদ, আত্মমগ্নতা ভাস্করদার কবিতার একদম ভেতরকার বৈশিষ্ট্য। কিন্তু সেই বিষাদও এই সময়ের... দু হাজার পরবর্তী সময়ের সঙ্গে তার কোন দূরত্ব নেই যেন। যেহেতু এই সময়টাই গতির সময়, ভাস্করদার স্থিতি বা ঘুম বা একাকিত্ব আসলে অতিরিক্ত গতির থেকে আসা একরকমের প্রতিক্রিয়া, শ্লেষ বা ক্লান্তি।
    আর একইসঙ্গে, ভাস্করদার সৃষ্ট যে চিত্রকল্প, যে ছুটে চলা ইমেজারি, তার ভেতরে যে চাপা গতিবেগ, পারম্পর্যহীনতার , অর্থহীনতার বোধের যে বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে তাকেও লক্ষ্য না করে কি আদৌ থাকতে পারি, আমরা?
    আমরা অফিস থেকে ফিরে এসে/ মোজা খুলতে খুলতে হঠাৎ নিঃশ্বাস ফেলি/ আমরা রাস্তায়/ হঠাৎ চুলকে নিই হাত।
    আমরা পুরনো হোটেলে যাই/ শুধুমাত্র হেমন্তকালের জন্যে/ আমরা ভালোবাসি সিগারেট আমাদের চারপাশে হেমন্তকাল।
    আলপিন, রান্নাঘর, পুরনো জুতো, বাথরুম। যত সামান্যতার কথা বলেন ভাস্কর, ততটাই বলেন চলে যাওয়ার কথা, ঘটনা ঘটার কথা। একটা বাড়ির বিভিন্ন জায়গায় চলে যাওয়া আছে তাঁর কবিতায়, “ এইখানে , মূর্খ এক, তার/ অসুখী জীবন নিয়ে খেলা করেছিল/ ছাদে , তার রঙিন পাজামা পড়ে আছে - / ঘরে-বাথরুমে তার / পড়ে আছে হাত ও পায়ের কসরৎ।“ একই কবিতার তিনটি পংক্তির ভেতর দিয়ে তিনি নিচে থেকে ছাতে যান আবার নিচে নেবে আসেন, বাথরুমে... আসলে এই কবি, তাঁর কোন স্পষ্ট বাসস্থান নেই বলেই গোটা কাহিনিটির ভেতরে বোনা থাকে চলমানতা।
    এমনকি বিছানা, বিছানার অনুষঙ্গও কত গতিময় ভাস্করদার কলমে। চলমান। “খোলা শরীরের ওপর, খেলা করছে, খোলা শরীর/ হলুদ বিছানা, ভেসে চলেছে স্বর্গের দিকে”... এই দৃশ্য পট, এই বদলে যাওয়া দৃশ্যাবলী, একাধিক ছবির জন্ম দেওয়া চলচ্চিত্র প্রতিম কবিতা। এটাই ভাস্করদার কবিতা। চোখ বুজলে মাথার ভেতর চলে আসে ফিল্মের দৃশ্যের মত গলি ও রাস্তা, দেওয়াল, ল্যাম্প পোস্ট, গাড়ি, বারান্দা, ছাদ, নীলচে, হলদেটে, ম্লান ...
    এই হেরো মানুষরা বাংলা কবিতার সত্তরের দশকেও এসেছেন, গিয়েছেন। সত্তর থেকে মৃদুল দাশগুপ্ত জয় গোস্বামী ব্রত চক্রবর্তীদের কবিতায় আরো বেশি ভাংচুর শুরু হয়ে, খুলে দেয় অন্য কিছু দরজা।
    জয় গোস্বামী সূর্য পোড়া ছাই-তে লিখেছিলেন,

    আমার স্বপ্নের পর স্বপ্ন হল আরো বেলা যেতে
    আমাকে ধ্বংসের পর ধ্বংসক্ষেত্রে বর্ণনার শেষে
    শান্তি নেমে চলে গেল, মৃতদেহ টপকে টপকে, দূর তেপান্তরে…
    তার, গা থেকে স্ফুলিঙ্গ হয়ে তখনও ঝলক দিচ্ছে
    রক্ত আর উল্লাসের ছিটে।
    দিগন্তে মেঘের কুণ্ড। থেমে থাকা ঝড়…
    আমাকে দৃশ্যের পর দৃশ্যের ওপিঠে
    এইমতো এঁকে রাখছেন
    এক মুণ্ডহীন চিত্রকর!

    ‘আজ যদি আমাকে জিগ্যেস করো’, কবিতায় জয় গোস্বামী লিখেছিলেন,
    “আজ যদি আমাকে জিগ্যেস করো কোন্‌ ব্যূহ কোন্‌ অন্ধকুপ
    রাষ্টের কোন্‌ কোন্‌ গোপন প্রণালীর ভেতর তুমি ঘুরে
    বেরিয়েছো তুমি বেড়াতে গিয়েছো কোন্‌ অস্ত্রাগারে তুমি চা খেয়েছো এক কাপ
    তুমি মাথা দিয়ে ঢুঁসিয়েছো কোন্‌ হোর্ডিং কোন্‌ বিজ্ঞাপন কোন্‌ ফ্লাইওভার
    তোমার পায়ের কাছে এসে মুখ রেখেছে কোন্‌ হরিণ
    তোমার কাছে গলা মুচড়ে দেওয়ার আবেদন এনেছে কোন্‌
    মরাল
    তাহলে আমি বলবো
    মেঘের উপর দিয়ে মেঘের উপর দিয়ে মেঘের উপর
    আমি কেবল উড়েই বেড়াইনি
    হাজার হাজার বৃষ্টির ফোঁটায় ফোঁটায় আমি
    লাফিয়ে লাফিয়ে নেচে বেরিয়েছি মাঠে আর জনপদে”

    মৃদুল দাশগুপ্ত , গোপনে হিংসার কথা বলি-র লেখক, সেই সময় থেকে, লিখেছেন অসংখ্য পথের কথাঃ
    প্রতিশ্রুতির ওপরে মেঘ, এবং নিচে জটিল মাটি
    তার নিচে জল, মধ্যে ছায়া, শরীর ভাঙছে দৃষ্টিপাতে
    দশ দিকে পথ ক্ষুরের ফলা...
    ( কাচের পাত্রে ভ্রমর)

    কবি নিজেকে বিনির্মাণ করে চলে যান উইপোকার স্তর পর্যন্ত, অস্তিত্ব ফুটো করেঃ

    আমি সেই উইপোকা যে ফুটো করেছে সন্ধিপত্র;
    আমি খাই হাসপাতালের মাংস, প্রহরীর শিরস্ত্রাণ,
    গান্ধীমূর্তির ঠ্যাং ও লাঠি;
    পাউরুটির দুঃখিত দুই হাত আমাকে টেনে নিয়েছে
    পাউরুটির শাদা স্তনের ভেতরে;
    আত্মহত্যা করার পরেও নিজেকে প্রশ্ন করেছি,
    এটা কোন ঋতু?
    অশ্রু ছাড়া গোপন করিনি কিছুই;
    দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলনের এই ঠান্ডা দেশে
    আমাকে বিস্ময়সূচক চিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করা হোক ( উইপোকা, মৃদুল দাশগুপ্ত)

    মনে পড়বে সত্তরের আর এক অসম্ভব শক্তিশালী কবি রণজিৎ দাশ লিখেছিলেন জিপসিদের তাঁবু নামে এক বই।
    লিখেছিলেন অন্য এক বইতে ( সন্ধ্যার পাগল) , কেননা এইসব চিত্রকল্পই বার বার ফিরে ফিরে আসে তাঁর কবিতায়ঃ
    যেখানে সাহারা এসে সমুদ্রে মিশেছে, সেই রুক্ষ তটভূমি
    আমার ঠিকানা। জানো তুমি?
    মাথায় টার্বান, গায়ে আলখাল্লা – মিশকালো, আফ্রো-আরব –
    উবু হয়ে বসে থাকি নাইলন-জাল নিয়ে, সারাদিন, নিষ্পলক চোখে
    রক্তে বেদুইন, কিন্তু পেশায় সমুদ্র-জেলে। বোবা দুঃখ শোকে।
    বসে থাকি প্রতীক্ষায়, কখন ঢেউয়ের সঙ্গে ছুটে আসে উজ্জ্বল ডলফিন...( আমার ঠিকানা)
    কেন জিপসি? কেন উন্মাদ? কেন আরব গেরিলা? কেন কুষ্ঠ রোগী আর আধপাগল বুড়োদের গল্প?
    মনে করে দেখব, মধ্যযুগের শেষে, আধুনিক সময়ের শুরুতে যখনই নতুন করে সমাজ পরিষ্করণ, শোধন আর মূল্যবোধের ইনস্টলেশন , তখন থেকেই সমাজের মূল স্রোত থেকে বিবর্জিত, প্রান্তবাসী হয়ে গেলেন কিছু বেশ্যা, কুষ্ঠরোগী, ভিখিরি আর ভবঘুরে মানুষ। তৈরি হল এই সব স্টিরিওটাইপ। এইসব মিথ। সমাজ থেকে বর্জিত তারা, বার বার নিয়ন্ত্রিত, শাসিত, সুসভ্য সমাজ এদের সন্দেহ করেছে, উনবিংশ থেকে বিংশ শতক অব্দি লক্ষ লক্ষ রোমানি বা রোমা উপজাতীয়, মূলত যাযাবর , জিপসিরা খুন হয়ে চলেছিলেন, সমাজকে পাপ আর দুষ্টতা থেকে পরিষ্করণের মহতী উদ্যোগে। আজও, ফ্রান্সের ডকুমেন্টারিতে পড়ি, কীভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা বেছে বেছে রোমা-দের চিহ্নিত করে, বেশ্যাবৃত্তি আর বে আইনি কাজে লিপ্ত বলে দোষারোপ করে চালান করে দেয় হয় কারাগারে নয়ত সীমান্তের বাইরে। আজও, আমেরিকার পার্কগুলো যতই সুসজ্জিত হোক, কোণে কোনও একটা বেঞ্চির ওপরে প্লাস্টিক স্টাফ করা ওভারকোটে, অনেক প্লাস্টিকের শিশিবোতল আর থলি পুঁটলি নিয়ে, একজন না একজন গৃহহীনকে পাবই আমরা, কেননা কর্মহীনতা, বাড়ি ভাড়া দিতে না পারা, অসুস্থতা অথবা নিছকই তীব্র গতিশীল প্রতিযোগিতামূলক সমাজে টিঁকে থাকতে না পেরে ইঁদুর দৌড় থেকে ছিটকে পড়া বলেই সেই ব্যক্তির মাথার ওপর খর শীতেও ছাত নেই, খাদ্য জোটে কি জোটেনা, রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত লঙ্গরখানায়। আজও, শুনি, আমেরিকায় এক গবেষিকার অধ্যয়নের বিষয় গৃহহীন মানুষের জীবনযাপন, তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকা গান, কথামালা, লোকসাহিত্য, ভাষা। যা প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে... এই হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলির সঙ্গে সঙ্গে। সমাজে যে সব মানুষ গুনতির বাইরে, যাদের ইতিহাস নেই, কীর্তি নেই, অতুল ক্ষমতার সাক্ষর নেই, যারা আজ এক স্টেট তো কাল অন্য হাইওয়েতে, নিয়ত বড় বড় ট্রাকে বা ট্রেলারে করে ভ্রাম্যমান।

    সাকিনহীন, ভিটেমাটি ছিন্ন, উদবাস্তু মানুষের সংখ্যা, আজও , এই পৃথিবীতে নানা দেশের নানা জাতির ভেতরে কিছু কম নয়। এ কথা আমরা জেনেছি। জানি, জানছি অহরহ।

    ৩ নিরীশ্বর, অসুন্দরঃ একধরণের বেঘর-অবস্থা
    সত্তর দশকের আর এক কবি তুষার চৌধুরী লিখেছিলেন, নিরীশ্বর পৃথিবীর বুলেটিন। কাব্যগ্রন্থটির কবিতার ভেতর থেকে বাইরের দিকে যাত্রা মাথার ওপর আধুনিক মানুষের ঈশ্বর হারানোর বেদনাই শুধু নয়, মানুষের ভিখিরিপনারও যাত্রা, ক্রমানুসারিক, সারিবদ্ধ।
    চেতনা, সচেতনতা, বুদ্ধির শাসনও একধরনের ঈশ্বর, মার্ক্সবাদ, নানাধরনের ইজমের চেতনাও এক ধরনের ঐশ্বরিক শাসন। সব ঈশ্বর হারানো মানেই সবরকমের শাসন হারানো। একইসঙ্গে অশক্ত দুর্বল করুণ, একইসঙ্গে দুঃসাহসী ও আইকন ভেঙে ফেলা ধৃষ্টতা... এই হল এ সময়ের কবিতার চিহ্ন।
    স্নায়ু জননীর তুমি আদুরে খোকন, আবছা চেতনার গাদ
    আর্দ্রতার তুলনায় বৃষ্টি কম, তবু ফোটে কদম কেশর
    বিষাদ লুকোতে চেয়েসোহাগমুখোশ পরে আছে গুলমোহর
    ভোর বলে সেরকম কিছু নেই, ভৈরোঁ টৈরো ঘোরের প্রমাদ

    সরব স্মারকলিপি চতুর্দিকে, মরা ছুঁচো ঠুকরে খাচ্ছে কাক
    অস্তিত্বের টকমিষ্টি চরাচরে ঘোরো ফেরো, কে তুমি স্টকার
    পরীর বাগানে রাত্রি শিস দেয় ফেরাতে পারোনা তার ডাক
    বিনিদ্র তামাক ফুঁকে সময় ওড়াবে তুমি, সাধ্য কি তোমার

    নিরীশ্বর পৃথিবীর বুলেটিন জমে ওঠে লেখার টেবিলে
    ওঠো উঠে পড়ো, গেঁতো শিকারী, মেরুর হাঁস খেলা করে বিলে

    যেভাবে রণজিৎ দাশ লেখেন,
    একটি অশুভ ফুল দিতে চাই ঈশ্বরের বিষণ্ণ কবরে!( একটি অশুভ ফুল)
    প্রসঙ্গত সেই বোদলেয়ারের সময় থেকে সুন্দর মৃত, ঈশ্বর মৃত, কিন্তু কবিদের চোখ জেগে আছে। র‍্যাঁবোর কবিতাতেও ঈশ্বরকে মেরে ফেলার যাবতীয় চ্যালেঞ্জ। এবং বাকি পরবর্তীতে কেবলি তার পুনরুদ্‌বোধন।
    আমার দুয়োরে এসে হেগে যায় কুকুরবেড়াল
    প্রভাতে কপাট খুলে আমার দর্শনলাভ ঘটে
    প্রণাম প্রণাম যত প্রাণচিহ্ন ... নোংরায় প্রকাশ
    হয়েছে তো কী হয়েছে... আমরা কি এত অসুন্দর

    আমার দুয়োরে এসে হেগে যায় সুন্দর জীবেরা
    একি সৌভাগ্য নয়... তোমার দরজায় করে না তো
    তোমার গেটে তো থাকে সিকিউরিটি... দেখলেই তাড়ায়
    কুকুর বেড়াল পাখি ভিখিরি ও ফেরিওয়ালা সবই

    সর্বজীবে দূর করে তুমি চাও তকতকে জীবন
    ঝুপড়ি উচ্ছেদে তুমি ভদ্রলোকেদের দলে থাকো
    প্রাণ ক্রমে হেরে যায়... তোমারই বিস্তার ঘটে চলে...
    জঞ্জাল পড়ে না পথে রাত্রি কাঁদে খিদের জ্বালায়

    সব নোংরা প্রাণচিহ্ন মুছে দিলে এত ব্যস্ত হাতে
    অসুন্দর জেগে উঠবে মানুষের মগজে মগজে
    (নোংরায় প্রকাশঃ প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দ ভিখিরি থেকে)

    আমেরিকার বৃহৎ হেজিমনির পুরাণের ভেতরেও এখন অনেক ভাঁজ। ইন্টারনেটের জমানা হেরে যাওয়া মানুষদের এক ছাতার তলায় নিয়ে আসে। সহজেই ইউটিউবে শোনা যায় প্রায় অবলুপ্ত কোন রেড ইন্ডিয়ান প্রজাতির গান। অথবা যে কেউ শুনতে পারেন, ট্রাকে ট্রেলারে সারাজীবন ঘুরে বেড়ানো মানুষের কথাবার্তা। দেখতে পারেন এমন ছায়াছবি যা তৈরিই হয়েছে এক সমাজবিচ্যুত কোন মানুষের জীবনকে ডকুমেন্টারি করে।
    সবটা মিলিয়ে এক গভীর ও চূড়ান্ত বিশৃঙ্খল পৃথিবীর ভেতর থেকে ধীরে ধীরে উদ্ভুত হচ্ছেন হেরো মানুষরা।
    আলবের কাম্যু-র আউটসাইডার থেকে শুরু করে বহু বিখ্যাত আধুনিক ও অধুনান্তিক লেখকের কলম ক্রমাগত বহিরাগতদের কথা বলতে থাকে।

    ২০০৯ এর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রাপক হের্তা মুলার লিখেছিলেন তাঁর পুরস্কৃত উপন্যাস ‘দ্য হাঙ্গার এঞ্জেল’ এ রুশ আধিপত্যের গুলাগ –এ নির্বাসিত এক মানুষের আখ্যান। সুইডিশ নোবেল আকাদেমি বলেছিল এই লেখক সম্বন্ধে, "who, with the concentration of poetry and the frankness of prose, depicts the landscape of the dispossessed."
    ২০১৫ তে সভেতলানা আলেক্সিয়েভিচ ও, বিপন্ন , হেরে যাওয়া, বাস্তুচ্যুত নানা মানুষের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে লিখিত বইয়ের জন্যই নোবেল পেয়েছিলেন।
    এই তালিকা দীর্ঘ, কিন্তু মূল বিষয়টিতে ফিরি।
    যে কোন মুহূর্তে, যে কোন পরিস্থিতিতে সমাজের নতুন নতুন সমস্যার মুখে, ধাক্কা খেয়ে, কিছু মানুষ পর্যুদস্ত, বিচ্ছিন্ন, উৎখাত, উদবাস্তু হচ্ছেন যে পৃথিবীতে, আমাদের চোখ হেরে যাওয়া মানুষদের দীর্ঘ সারি শেষ হবে না কোনদিন।
    আমরা কি নিজেদের চেতনার জিতে যাওয়া মানসিকতা ছেড়ে, সেই দীর্ঘ ট্রলারে –ট্রেকারে চড়ে বসতে পারিনা?
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২৭ মে ২০১৮ | ৩১৭২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • r2h | ***:*** | ২৮ মে ২০১৮ ০৭:১০62784
  • হ্যাঁ, এই হালকা সন্দেহ আমারও আছে।

    হেরে যাওয়া, অকিঞ্চিত্কর মানুষদের নিয়ে বিভূতিভূষণের চরিত্রদের এরকম সন্দেহের বাইরে রাখি।
  • S | ***:*** | ২৮ মে ২০১৮ ০৭:৪০62785
  • হেরে যাওয়া মানুষের অটোবায়োগ্রাফি আছে?
  • | ***:*** | ২৮ মে ২০১৮ ১০:৪৬62783
  • ভারী ভাল, যশোধরার লেখা যেমন হয় আর কি।

    কিন্তু এইখানে আমার একটা হালকা সন্দেহ আছে হেরে যাওয়া মানুষদের সাহিত্যে অবস্থান নিয়ে। এটা কি অনেকটাই 'দেখো আমি কেমন অপর-দের কথা বলি, কেমন হটকে' সেই অবস্থান থেকে নয়? সত্যিই কি এঁরা যারা লিখেছেন সকলেই হেরো মানুষদের খুব নিজের খুব কাছের বলে মনে করেন? আমার এই সন্দেহের কারণ আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা। আমি ক্লাস টেন অবধি পড়েছি এক ভাগাড়পাড়ার স্কুলে, সেই অভিজ্ঞতা যখন গুরুতেই লিখছিলাম তখন বেশ কিছু প্রতিক্রিয়া প্রকাশ্যে ও ইনবক্সে এরকম পেয়েছি যে এরপর তো মাধ্যমিকে একটা দারুণ চোখ ধাঁধানো রেজাল্ট হবে টবে। সেটা যেহেতু হয় নি, কাজেই অনেকেই বেশ হতাশ। এর পরেও বিভিন্ন দিকেই দেখেছি 'তুমি বাপু আগে হেরো ছিলে সে বেশ কথা, কিন্তু তুমি দারুণ প্রতিভাময়ী অথবা দারুণ গুণবতী কেউ না হলে আমরা ঠিক ....' এরকম একটা ভাব।

    আর শুধু নিজের নয়, অন্য আরো কিছু আপাত-হেরো লোকেদের জন্যও এরকম দেখেছি।
  • pi | ***:*** | ২৯ মে ২০১৮ ০২:৪০62788
  • পরে লিখব কিছু কথা।

    খুব খুব ইন্টারেস্টিঙ্গ
  • Sakyajit Bhattacharya | ***:*** | ২৯ মে ২০১৮ ০৬:১৯62786
  • অসাধারণ লেখা । গুরুতে বহুদিন বাদে এত সুন্দর লেখা পড়লাম।

    প্রসঙ্গত, কামু-র আউটসাইডারের একটি প্যারালেল সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। আরেকটি হেরে যাওয়া মানুষ অথবা জাতিগোষ্ঠীর উপাখ্যান। উপন্যাসটির নাম 'দ্য মরস্য ইনভেস্টগেশন'। লেখক আলজেরিয়ার কেমাল দাউদ। আউটসাইডারের প্রোটাগোনিস্ট, মরস্য একটি আরব মানুষকে হত্যা করে। গোটা উপন্যাসে তার কোনও নাম নেই। শুধু 'আরব' বলে চিহ্নিত। কেমাল দাউদ তার উপন্যাসে এই চরিত্রটির একটি নাম দিয়েছেন, মুসা। এবং এই উপন্যাসটি মুসার ভাই, হারুনের চোখ দিয়ে এই খুনের ঘটনাটিকে ফিরে পড়বার একটি আখ্যান। একটি বিজিত জাতিগোষ্ঠীর একজন হেরে যাওয়া মানুষ কীভাবে পশ্চিমী বিশ্বের দেখার চোখকে ডিকন্সট্রাক্ট করছে তার কাহিনী । এই লেখাটা পড়তে পড়তে আউটসাইডারের প্রসঙ্গ আসল বলে হঠাত উপন্যাসটার কথা মনে হল
  • র২হ | ***:*** | ২৯ মে ২০১৮ ০৭:১৪62787
  • আগরতলায় একটি মেয়ে বিগবাজারের ধাস্টামোয় আত্মহত্যা করেছে। তো প্রতিবাদী পোস্টে বারবার মেয়েটি মেধাবী এবং প্রমিসিং অ্যাথলিট (ছিল) সেটা বলা হচ্ছে। অ্যাজ ইফ মেধা বা প্রতিভা না থাকলে মৃত্যুটা কিছু জাস্টিফায়েড হতো।
    যদিও আমি নিশ্চিত কেউ ঠিক ওরকম ভাবছেনা সচেতনভাবে, কিন্তু তবু নো কান্ট্রি ফর আ পুরোপুরি হেরো, এইটা মনে হয়।

    একটু বোধয় অবান্তর হলো এখানে।
  • Bijit | ***:*** | ৩১ মে ২০১৮ ০৪:৩১62790
  • Amar purota pore mone holo. Byapar ta na thik hero lokeder issue na. Amra kichu event chai, golper nayok / nayoika haruk ba jituk, kintu kichu koruk, kichu ekta hok.
    Kintu flat life gulo niye kono sahityo nei. Mane ekta lok sokale uthlo , brush korlo, snan korlo, ofc galo, dupure dim bhat khelo, ofc theke firlo , cha khelo, rate ruti torkari kheye ghumiye porlo. Se harlo na jitlo na. Kichui korlo na, but korte parto kichu ekta. Eder niye kono sahityo nei.
    Etai mone holo
  • h | ***:*** | ০১ জুন ২০১৮ ০২:২০62791
  • "আমরা কি নিজেদের চেতনার জিতে যাওয়া মানসিকতা ছেড়ে, সেই দীর্ঘ ট্রলারে –ট্রেকারে চড়ে বসতে পারিনা?"

    জেনেরালি আমার মনে হয় ইসুটা হারা বা জেতার না। হারতে হারতে জেতার স্বপ্ন দেখার ও না, আবার স্বীকৃতির দৌড়ে জিতে যাওয়া ও শুধু না, সংকট টা অথেন্টিসিটির। কবি কেন, যে কোন লোক ই, যারা মিনিমাম লেখা লিখি করে, তাদের একটা অথেন্টিক, নিজের স্বর খুঁজে বের করার বা আরো আরো খুঁজে চলার দায় এসে পড়ে। অন্য পেশা বা কর্মে ও হয়তো হয়, তবে লেখালিখিতে একেবারে ছাগল না হলে, এই সমস্যা এসকেপ করা অসম্ভব। এই খুঁজতে গিয়ে কে কেন কোন স্বর বেছে নেবে, সেটা নানা বিষয়ের উপরে নির্ভর করে। সময়ের চলমানতা , মতাদর্শের সমসাময়িক, ক্যাথারটিক অভিজ্ঞতা , শুধুই চয়েস বলেও যদি কিছু থাকে, বিভিন্ন ধরণের ভাবনার বা জীবনের নিরুপায় অবস্থা, সব ই হতে পারে।
    ব্যক্তিগত ভাবে আমার ক্ষেত্রে বিষয়টা মনে হয় অথেন্টিসিটির খোঁজ , একটু সিরিয়াস এনগেজমেন্ট হলে, খোঁজটা নিরন্তর, শুধুই হারা বা জেতার পক্ষাবলম্বন না।
  • h | ***:*** | ০২ জুন ২০১৮ ০৩:১৪62792
  • আমাকে একটা জিনিস হন্ট করে জানিস, মানে ফিকশন লিখতে গেলেই করে, সেটা হল অথেন্টিসিটি আইডেন্টিটি আর প্রতিনিধিত্ত্ব র পার্থক্য টা। এতটাই বাড়াবাড়ি ন্যাকাচৈতন্য ডিপ্রেসনে চলে যাই লেখা শেষ করে উঠতে পারি না। আর কবি নই বলে এই টা এক্সপ্রেস করার সবচেয়ে ভাল বাহন হতে পারত কবিতা, তাতে ভাবনা প্রকাশ করতে পারি না, একটা অসহয় দমবন্ধ অবস্থায় চলে যায় তার পরে প্রাথমিক লেখাটির মৃত্যু ঘটে। শান্তিনিকেতন এর লোকেরা ঠিক কোথাকার লোক সে ব্যাপারে একটা সাসপেন্ডেড প্রশ্ন থাকায়, আমার পরে শাগাল এর ছবি ই বল, রিফিউজি বা অভিবাসী লিটেরাচার পড়তে অসুবিধে হয় নি, সুখী অবসর এই সাসপেনসনের তীব্রতা কিসু কম্রতে পারে নি, আবার ধর নিজের অভিজ'ণতা কেই একমাত্র ভিত্তি করে আইডেন্টিটি পলিটিক্স এর ভাষা য় লিখতে ইছে করে না, মনে হয় আমি যে ধরণের লোক তার কথা অলরেডি ওভার রেকর্ডেড, সমর সেন ই তিরিশ পাতায় আত্মজীবনী শেষ করে দিলেন , আমি বাল কি অভিজ'ণতা শোনাবো, এই পল্লবগ্রাহীতার ভারে জীবন এখন ই অতি দীর্ঘায়িত, আর মজাটা হল যাদের নিয়ে লিখতে চাই তাদের ভারী বয়ে গেছে আমার লেখায়। তারা নতুন পৃথিবী গড়ুক , বা পুরোনো পৃথিবীতেই টি'ন্কে থাকুক সেই জগতে তাদের নিজেদের লেখা পত্র ই যথেষ্ট, আমি কি নতুন দেব, প্লেফুল কিছু লেখা যায় , ধর এক্টা আনরিপেন্টেন্ট সাও'ন্তাল সেক্স ম্যানিয়াক কে নিয়ে একটা গল্প লিখ্লাম, ধর তায়েব সালিহ র সেই সিজন অফ ইমিগ্রেশন টু নর্থ এর মত প্লেফুল কিছু লিখেই ফেল্ললাম , কিন্তু সেই অস্ত্র টা আর্ট ফত আর্ট সেক পন্থীদের হাতে তুলে দিতে ইচ্ছে করে না, আর স্থান ইক প্রতিনিধিত্ত্ব এড়িয়ে স্থান মাহাত্ম্য লেখার এলেম নেই। এই পরিস্থিতিতে অথেন্টিসিটি জিনিস্টাই যখন প্রশ্নের মুখে তখন আর কিছু ভালো লাগে না, পক্ষাবলম্বনের সমস্যা আমি পেরিয়ে এসেছি প্র্যাকটিকালি লাইপ্গে দা'ন্ত ক্যালানো চাড়া কিসু না করেও।;-)
  • h | ***:*** | ০২ জুন ২০১৮ ০৩:২১62793
  • শাক্য কে।
  • হে হে | ***:*** | ০২ জুন ২০১৮ ১০:৫৩62794
  • হনুবাবুর কথা শুনে মনে হয় কোথাও এক যুধ্ধু লেগেচে , সেকেনে আপনের ট্রাইবের লোগেরা সব গে তুমুল মারপিট হুরুদ্দুম করচেন , আর আপনি পঞ্চাশোর্ধ অমল ,যার যার ট্রাইকনিফেরাস প্যারাইন্ফ্লুএন্জার কারনে যুদ্ধু যাওয়া হয়ে ওটেনি , তাই একটা বল্লম বা বর্শা বা নিদেনপক্ষে একটা হাতুড়ি বা সাঁড়াশি বানিয়ে দিতে পারলেও এই অনিচ্ছাকৃত অমল ধবলত্বের পালে খানিক অনন্তের হাওয়া লাগে :)

    এ একটা চিন্তার ধরন বটে । তবে আরেক ধরন ও আচে। যেখানে যুদ্ধু টা ভেতরের , আর সে গোলমাল সাঁড়াশি তে পাকড়ানোর নয় । যারা ঘেঁচু কে ঘেঁচু বলেই জেনেচে তারা যে পেঁচুকে অকিঞ্চিত্কর মনে করে তা হয়ত নয় । জগতের মিউজিকাল চেআরে তারা চেয়ার বাছার চে , মধ্যিখানে বসে এই প্রবল চেয়ার দৌড়ের কৌতুক দেকতে ভালবাসে । যে লোক এগবার হাত মুঠি করে ফাঁক দিয়ে সূর্যাস্ত দেকে নিয়েচে তার কাচে বাড়ির ছাদের সুয্যি এআর গড়ের পেচুনের সব এক হয়ে যায় । তাতে সূর্য মিছে হয় না । বরং ফটোস্ফিয়ার -ক্রোমোস্ফিয়ার আরেক ভার্টিক্যালিটি খুলতে থাকে । পেছনে পরে থাগে বাড়ির ছাদ আর গড়ের হরাইজোন্টাল । সেও আরেক রাজনীতি বৈকি ।
  • r2h | ***:*** | ০৩ জুন ২০১৮ ০২:১৭62796
  • দেখো বাপু, ঘেঁচু কে ঘেঁচু বলে চেনা লোকেদের অন্য গল্প। নিজের উদাহরন দেওয়াটা এখানে একটু অড, হারান জিতেন দ্বন্দ্ব চলে আসার সম্ভাবনা, কিন্তু তা নয়, যেমন আমি জেলিফিশ বা আরশোলাপন্থী, আরেকটু উদ্যোগ নিলে প্রাইভেট ইয়ট না হোক বেলেঘাটা খালে একটা পিনিস হয়তো ধারকর্জ করে নামানো যেত, কিন্তু আমি শুধু কোনা খামচি খুঁজে টিঁকে থাকতে আগ্রহী, চাপ নিয়ে কি হবে। তো এখানে আমি হয়তো ঘেঁচু পেঁচোর ব্যাপারটায় আসার একটা প্রয়াস নিতে পারি, 'উপার্জনে মন নাই/ কিছু টাকা কর্জ যদি দাও'।

    ওদিকে বিভূতিবাবুর গল্পে যে ভদ্রলোক (কী যেন নাম) একটা বাড়ি বানাতে শুরু করলেন, সে আর শেষ হয়না, ইঁটের পঁজায় শ্যাওলা হয়ে গেল, আগাছায় অন্ধকার, গল্পকার বড় হয়ে গেলেন - ঐখানে অন্যরকম। স্বপ্নভঙ্গ, যদিও বিভূতিবাবুর চরিত্রদের স্বপ্ন দেখা চলতে থাকে। সাহিত্যে পুরোপুরি হেরে যায়না লোক, বাস্তবে যায়। এইসব।

    নিম কা পেঢ় বলে উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করে সিরিয়াল হতো, ঐটা মনে পড়লো।
  • h | ***:*** | ০৩ জুন ২০১৮ ১২:৪৭62795
  • "শোলের মত ছবিও তো সমাজবহির্ভূতদের গল্প।" এই জায়গাটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সাধারণত, ফিল্ম থিয়োরিটিশিয়ান রা, বলেন, ইন্দিরা গান্ধী সঞ্জয় গান্ধী র আমলে কংগ্রেস যে লুম্পেনদের তোল্লাই দিয়ে রাষ্ট্র বিরোধী যুব ক্রোধ কে ম‍্যানেজ করা হয়েছিল, তার একটা প্রতি ফলন ছিল মনমোহন দেশাই, রমেশ সিপ্পি দের সিনেমা গুলি তে। সমাজবহির্ভূত দের না, সরাসরি সমাজ বিরোধী দের আমেরিকা ন ওয়েস্টার্ন সিনেমার নকলে ক্ল‍্যান ফাইটে ব‍্যবহার করা এবং শেষ দৃশ্যে সর্বশক্তিমান রাষ্ট্র এসে আইনানুগ শাস্তির দায়িত্ব নিচ্ছেন, যে দায়বদ্ধতা প্রয়োজন ধরুন দাবাং এ এসে আর থাকছেনা। মাধব প্রসাদ এর কাজ রয়েছে এই প্রসঙ্গে। লেখা টা ভালো লেগেছে, কবিতা র বাছাই অপূর্ব, কিন্তু আলোচনা পদ্ধতিটি র একটা দিক আমার ব‍্যক্তিগত ভাবে জাস্টিফায়েবল লাগেনি, যে কবিতা রচনার ঐতিহ্য এর যে স্প‍্যান টা ধরা হয়েছে, তাতে কন্টিনিউটির থেকে ডিসকন্টিনিউইটির ভাগ বেশি, এই জিনিসটা কি আরো এম্ফাসিস রাখা যেত,/, বিশেষত যখন আর্রাবান প্লুরালিটি কে, শরীরের সেন্ট্রালিটি কে স্বীকার করলেও, আধুনিক কবিতা অনেক সময়েই উত্তরনের দায় ঝেড়ে ফেলছে, বহির্ভূত র সচেতন পক্ষাবলম্বন তার থেকে স‍রে আশছে অনেক টাই, নইলে সোশালিস্ট রিয়ালিজম বিতর্ক সংক্রান্ত তৈরি হত কিভাবে, আইডেন্টিটি বিতর্ক তৈরি হত কিভাবে?যশোধরার এঁর ক্লাস করতে পারলে অনেক শেখা যে ত। এসব লেখা অনেক অনেক ভাবায়।
  • h | ***:*** | ০৫ জুন ২০১৮ ০৫:৪৪62797
  • হ্যাঁ। কিন্তু লেখাটার মূল পয়েন্ট টা তো সেটাই। যে সাহিত্য বা অন্তত গুরুত্ত্বপূর্ণ সাহিত্যের মহৎ অংশ, হেরে যাওয়া বা হারতে থাকা দের জীবন মনন রেকর্ড করে। পক্ষাবলম্বনের প্রশ্নটা লেখকের দিক থেকে।
  • দেবপ্রিয়া রায় | ***:*** | ০৬ জুন ২০১৮ ০৬:১২62798
  • মাধ্যমিকে ভূগোল পরীক্ষার দিন ভোরবেলা উঠে স্নান করে পড়তে বসব, একটা কবিতার লাইন এল মাথায়। তারপর ঝাড়া একঘন্টা কবিতাটা লিখে উঠলাম। বায়ুর ক্ষয়কাজ না সঞ্চয়কাজ কী একটা ছিল, পড়াই হলো না। ওটাই এলো পরীক্ষায়। টেস্টের পর আর পড়ি নি। যথারীতি ছড়ালাম। মনে আছে, পরীক্ষার এক সপ্তাহ আগেও বইয়ের তলায় লুকিয়ে দেশ পড়তাম। যখন মাত্র ৭৭% পেলাম ( হ্যাঁ, আমাদের স্কুলে ওটাই বেশ খারাপ রেজাল্ট ছিল), মা দু:খে শোকস্তব্ধ। লোকজন ভাবছে ফেলই করেছি। আমিও ভাবছি ইহা তো ফেলেরই সমান। সেসব সত্ত্বেও জীবনে মাধ্যমিকের মার্কশিট টা আর প্রাসঙ্গিক থাকল না এক সময়, কিন্তু কবিতাটা থেকে গেল। রাত জেগে বাংলা প্রশ্নোত্তর লেখাটা দিনের পর দিন উপন্যাস লেখায় বদলে গেল। জীবনের প্রতিটা lowest low থেকে মাধ্যমিকের নম্বর নয়, নিজের মতো করে বাঁচার আকাঙ্খা টেনে তুলল আমায়।

    এই লেখার উদ্দেশ্য কিন্তু নেহাৎ ই নস্টালজিক স্মৃতিচারণ নয়। আজ মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরিয়েছে, আর আমাদের দারুণ ভালো স্কুল যে নাকি ছোট থেকে আমাদের পাখি পড়ার মতো শিখিয়ে এসেছে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে, সেই স্কুল তার মাধ্যমিক উত্তীর্ন দের লিস্টে ছাত্রী সংখ্যা লিখেছে 104+1, ওই +1 কারণ মেয়েটি ফার্স্ট ডিভিশন পায় নি। নিচে বড় বড় করে লিখে দেওয়া হয়ছে সে ডিপ্রেশনে ভুগছিল, সাইকিয়াট্রিক ট্রিটমেন্ট এ ছিল, তার বাড়ির লোকেদের বারবার অনুরোধেই নাকি তাকে পরীক্ষায় বসতে 'allow' করা হয়ে ছিল!!!

    যখন গোটা পৃথিবী জুড়ে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে এত awareness campaign হচ্ছে, সেখানে এ কী মানসিকতা! একবারও ভাবা হলো না, যে সত্যি ই সিরিয়াস ডিপ্রেশনের শিকার, এই ডিমার্কেশন এ তার মেন্টাল হেলথ আরও ditoriorate করতে পারে?? স্কুলের দায়িত্ব কি শুধু নম্বর পাইয়ে দেওয়া, তার জীবন গড়ে দেওয়া নয়? তাকে স্বপ্ন দেখানো নয়? কী যায় আসে, এক নম্বরের জন্য ফার্স্ট ডিভিশন না পেলে? কী যায় আসে পড়াশোনায় বাকিদের মতো তথাকথিত ভালো না হয় উঠতে পারলে? সে নিজের মতো করে নিজের জীবনটা বেঁচে নেবে! নিজের লড়াই টা লড়ে নেবে!

    আশা করি এই মেয়ে টি একদিন বড় হয় ওই +1 এর তকমা ছেড়ে বেরোতে পারবে। কোনোদিন স্কুলে গিয়ে বলে আসবে জীবন তার কাছে ওই +1 এর চেয় অনেক বেশি কিছু। সে ওই +1 ছাড়িয়ে হেঁটে গেছে বহুদূর। আর যে শিক্ষিকারা নিজের ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হলেন, যাঁরা নিজেরাই প্রকৃত শিক্ষার অর্থ বুঝলেন না শুধু তোতাপাখির মতো বুলি আউরে গেলেন, তারা নিজেদের জাস্টিফাই করার চেষ্টা না করে বুঝবেন একদিন - কোন কূপমণ্ডকতার নিগড়ে আটকে পড়ে আছেন।

    ওনারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন। আমার মতো নাস্তিক নন। ওনাদের ব্যক্তিগত ভগবান ওনাদের সুমতি দিন।
  • arpita | ***:*** | ০৬ জুন ২০১৮ ০৬:২৫62799
  • amar chhele meyera jakhan libraryte ase library class korte anekei ajkal mone kore boipara mane samay nashto..ami tader ekta katha boli..asale school to ekta machine sabaike ek bhabe machine fela hoy..pesha hoy..kintu oi ekbhabe peshaner majheo tomra dekhbe tomaderchhokh gulo alada alada kichhu khujchho keu janla perie neel akasher ghurita katota urlo dekhchho keu schooler pnachiler baire chhelegulor football khela dekhchho..asale sakalei ei ekbhabe baro hote hote hapie uthe ..mone mone ekta nouka khujchho bhalobasar prithibite muhurter janye harie jabar janye...sekhanei library...ekhano eso ..ami tomader moner palkite charie nie jabo bahudure tomader bhalobasar pure...kajo hoy dushtu chhele jakhan origammyr bio khule origammy kore ar ami oke bhagnagsho dekhai..o hihi kore hese othe...amader shikhha byabastha r ei dainnya baro dukkher..sabaike keno je eksathe egie nie jete parina..
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন