অরিনবাবু,
সমালোচনাকে যদি ধমক দিয়ে থামাতে চান, তো পাল্টা ধমক খাবার জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে, কিচ্ছু করার নেই। এইভাবে যখন কথা বলছেন, তখন কয়েকটা সাদা কথা সাদাভাবে বলা যেতেই পারে।
(১) ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর, সাইটস্কোর আর ব্রেন স্ক্যান নিয়ে এমন সব কতাবাত্রা চলছে, মনে হচ্ছে যেন বিজ্ঞান-টিজ্ঞান নিয়ে এক ভয়ঙ্কর টেকনিক্যাল চর্চা হচ্ছে। কিন্তু আসলে যা হচ্ছে সেটা হচ্ছে কমপ্লিট ভেগোলজি, ডিজাইন্ড টু চিট। বিশেষ ভঙ্গিতে চুপচাপ বসে থেকে থেকে শ্বাসপ্রশ্বাসের দিকে নজর রাখতে রাখতে এলোমেলো ভাবনা নিয়ে ভাবনা --- এইসব হচ্ছে পিওর ননসেন্স। ওইসব করে কিছুই হয়না, শুধু সরলবিশ্বাসী খদ্দেরের পকেট থেকে মোটা মোটা টাকা ধূর্ত ওয়েলনেস-ব্যবসায়ীর পকেটে ঢোকে।
(২) পরে যা লিখবেন লিখবেন, কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতিটুকু দিয়ে ইতিমধ্যে যা সব ভুলভাল লিখছেন তার প্রতিকার কীভাবে হবে? যদি এমন বলতে চেয়ে থাকেন যে, বলবার সুবিধের জন্যে কিছু কথা আগেভাগে বলে রাখছেন, সত্যিকারের প্রমাণটা পরে দেবেন --- তাহলে তো সবার আগে সেইটা স্বীকার করবার দরকার ছিল। বলতেই পারতেন যে, জানি এখনও তেমন কিছু প্রমাণ হয়নি, কিন্তু আপাতত মেনে নিন, পরে দেখছি। তা না করে মস্ত বৈজ্ঞানিকের মতন ভাবভঙ্গি করে এঁড়ে তক্কোই বা করছেন কেন, আর ‘না ইচ্ছে হলে পড়বেন না’ ব্র্যান্ডের বোকা-তেজই বা দেখাচ্ছেন কেন?
(৩) ওপরে এই বিষয়টি নিয়ে বিস্তর কথা বলেছি, আর ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর নিয়ে মাত্র একটি জার্নাল প্রসঙ্গে বোধহয় তিন-চার লাইন লিখেছি। যেমন সব চেয়ে দরকারি কথাটা ছিল এই যে, ব্রেন স্ক্যান করে মনের মধ্যে কী ঘটছে তার খুব বেশি হদিস পাবার কথা না। আমার মতে, সবচেয়ে জরুরি কথা ওটাই ছিল। কিন্তু আপনি সে সব নিয়ে উচ্চবাচ্য করলেন না, শুধু ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর নিয়ে বিস্তর কথা বলে গেলেন। একমাত্র ওই পয়েন্ট-টাই আপনার পক্ষে আছে বলে মনে হল বুঝি? আচ্ছা বেশ, সেই নিয়েই দুয়েকটা কথা বলি তবে।
(৪) ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর দিয়ে একটি বিশেষ লেখার সারবত্তা বিচার করা যায়না, জানি। জানি বলেই তো ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর না থাকা গুরু-তে বকবক করি। তবুও কী জানেন তো, ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর ব্যবস্থা থেকে বহিষ্কৃত হয়ে যাবার মধ্যে একটা কেলেঙ্কারি আছে। যেমন ধরুন, কোনও রিসার্চ পেপার-এর সারবত্তা বুঝতে হয় তার তথ্য-যুক্তি দিয়ে, বিজ্ঞানীর ডিগ্রি দিয়ে নয়, তবুও রিসার্চ পেপার বেরিয়ে যাবার পরে যদি দেখা যায় যে বিজ্ঞানীপ্রবর কেলাস এইট পাস, তাহলে তার মধ্যে একটা কেলেঙ্কারি থাকেই, এবং স্রেফ লম্ফঝম্ফ করে সে কেলেঙ্কারি ঢাকা যায় না।
(৫) আর একটা কথা কথা হচ্ছে, রিসার্চ পেপার-এর নিজস্ব মান মাপবারও মাপকাঠি আছে, তার নাম সাইটেশন ইন্ডেক্স। এক অর্থে, একটা পত্রিকার ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর হচ্ছে বিগত কয়েক বছরে ওই পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধগুলোর সাইটেশন ইন্ডেক্সের গড় মাত্র। কাজেই, ওই পত্রিকায় যা প্রকাশিত হয় তার মান সাধারণত কেমন হয় বা হতে পারে তার আন্দাজ ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর দিয়ে খানিকটা হয় বইকি, তা না হলে জিনিসটার তো কোনও মানেই থাকত না। আপনি যদি এ সব জেনেই ওই সব পেপার রেফার করে থাকেন, তার অর্থ হচ্ছে, আপনি জানেন যে, আপনি যা বলছেন তার সমর্থন শুধু নিকৃষ্ট জার্নালেই পাওয়া সম্ভব। সেটা মোটেই ভাল কথা নয়।
(৬) আপনি ওই জার্নালটির সাইটস্কোর উল্লেখ করেছেন, স্কোরটি খারাপ না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই স্কোর সাম্প্রতিক। আপনি যে বিশেষ পেপারটির উল্লেখ করেছেন সেটি ২০১৮ সালের, এবং সেই সময়ে তার সাইটস্কোর ছিল ৩.১ --- খুব নিচু স্কোর।
(৭) ‘এক্সপ্লোর’-এর মত ভুয়ো চিকিৎসার জার্নালও আপনার কাছে ব্রাত্য নয়, দেখে স্তম্ভিত হলাম। আপনার কাছে প্রত্যাশিতই, যদিও।
(৮) সাইটস্কোর কত ভাল জিনিস তার প্রমাণ হিসেবে আপনি এলসেভিয়র-এর বিবৃতি কপি-পেস্ট করেছেন, যে এলসেভিয়র নাকি নিজেরাই এই স্কোর-টি বানিয়েছে। এই স্পেক্টাকুলার নির্বুদ্ধিতায় চমৎকৃত হলাম।
(৯) ইন্টারনেট এক কামধেনু, সেখানে যে যা চায় তাই পায়। আপনি ধ্যান বিষয়ে ভাল ভাল কথা চেয়েছেন, তাই পেয়েছেন। কড়া কতাবাত্রা চাইলে, তাও পেতেন। লিঙ্ক দেওয়া নিষ্প্রয়োজন, কারণ, সকলেই নিজে নিজে খুঁজতে পারে।
(১০) হোমিওপ্যাথি, জ্যোতিষ, জন্মান্তর --- সব বিষয়েই অসংখ্যা ‘রিসার্চ পেপার’ আছে, নেট ঘাঁটলেই সব আঙুলের ডগায়। কাজেই, দশখানা পেপার-এর লিঙ্ক দিলেই বেশ একটা বিজ্ঞান-টিজ্ঞান হল, ব্যাপার অতখানি সোজা না। আমি ওপরে লিখেছি --- “ধ্যানের সুফল নিয়ে 'রিসার্চ পেপার' ইন্টারনেট-এ প্রচুর পাবেন, যেমনটি পাবেন হোমিওপ্যাথি ইউফো জাতিস্মর এইসব নিয়েও। আপনি ঠিকই বলেছেন, "উদাহরণ দিয়ে শেষ করা যাবে না"। সমস্যা হল, বৈজ্ঞানিক প্রমাণের জন্য তা যথেষ্ট নয়। যথেষ্ট সংখ্যক উচ্চমানের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, তার সিস্টেম্যাটিক রিভিউ, নির্ভরযোগ্য জার্নালে তার প্রকাশ, নানা প্রশ্ন ও আপত্তি পেরিয়ে একটা জায়গায় থিতু হয়ে দাঁড়ানো, 'ককরেন ডেটাবেস'-এ অন্তর্ভুক্তি, বিজ্ঞানী সমাজের মূলস্রোতের কাছে স্বীকৃতি, চিকিৎসার টেক্সটবুক-এ অন্তর্ভুক্তি --- এই হল কোনও বিশেষ চিকিৎসা-পদ্ধতির গ্রহণযোগ্যতার কঠিন ও দীর্ঘ পথ। এবং, না, ধ্যানের উপকারিতা সে পথ এখনও অবধি পেরোতে পারেনি।” কিন্তু সাদা বাংলা কথা বোঝেননা, কী করা যাবে!
(১১) ধ্যান-চিকিৎসার কার্যকারিতার বৈজ্ঞানিক প্রমাণ দাবি করাটাকে ‘অনর্থক একগুঁয়েমি’ বলে মনে হল বুঝি? তাহলে স্নায়ুবিজ্ঞানের নাম করে জোচ্চর মহেশ যোগীর নাম-কীর্তনকে কী বলা যাবে --- ‘সার্থক অত্যুৎসাহ’?
যাই হোক, লিখুন যা লেখার, আপাতত আর কথা বলছি না। যদি পারি, ধ্যান নিয়ে আমার নিজের বক্তব্য প্রকাশ করে আলাদা একটা লেখা দেবার চেষ্টা করব।