অনেকের অনেক কিছু থাকে। আমার শুধু কিছু চকোলেট ছিল। আর ছিল এক হাতল-ভাঙা চেয়ার। নড়বড়ে একটা কাঠের টেবিল। আমি চেয়ারে বসে টেবিলে ওপর পা তুলে দিতাম। তারপর একা একা একটার-পর-একটা চকোলেট খেয়ে যেতাম। আমার সদর দরজা খোলা থাকত। সেখানে রাস্তা। সরু গলি। সারাক্ষণ দুটো-একটা লোক যাওয়া আসা করত। একটা লোম-ওঠা নেড়ি কুকুর ছিল। সে রাস্তার একপাশে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকত। রাস্তার পাশে রক ছিল। সেখানে পাড়ার ছেলেরা আড্ডা দিত। মেয়ে দেখলে অশ্লীল অংগভংগি করত। গান গেয়ে উঠত। শিস দিত। অমি ঘরে বসে শুনতে পেতাম। ট্রানজিসটরে হিন্দি গান হত। আমি ঘরে বসে শুনতে পেতাম। আমার কথা বলার কেউ ছিল না। আমি চেয়ারে বসে টেবিলে পা তুলে দিতাম। একটার-পর-একটা চকোলেট খেয়ে যেতাম। সোনালি রূপোলি সব রাংতাগুলো ছুঁড়ে ফেলতাম রাস্তায়। দেখতাম গলি দিয়ে দুটো-একটা লোক যাওয়া আসা করছে। রোঁয়া-ওঠা কুকুরটা গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। রকের ছেলেরা শিস দিচ্ছে। ট্রানজিসটরে হিন্দি গান হচ্ছে। আমার সংগে কথা বলার কেউ নেই। শুধু আমার চকোলেট। হাতল-ভাঙা চেয়ার। নড়বড়ে টেবিল। আমি চেয়ারে নড়েচড়ে বসলাম। টেবিলের ওপরে রাখা পা-খানা নাড়াতে লাগলাম। দেখতে লাগলাম আমার পায়ের পাতা কেমন তির তির করে কাঁপে।
সামনে পাকিস্তানের নির্বাচন। ওরা তাড়াচ্ছে আর দলে দলে লোক বনগাঁ-হাসনাবাদ রেল লাইনের গায়ে এসে আটকে যাচ্ছে। রামকৃষ্ণ মিশন সেনা করছেন। রাজনৈতিক দলগুলো গিয়ে বক্তৃতা করছে। খবরের কাগজের হেডিং- নতুন উদ্বাস্তুর স্রোত: দুর্দশার শেষ নেই। জানুয়ারি থেকেই সুরু হয়েছিল, এখন প্রতিদিন আবার হাজার হাজার উদ্বাস্তু আসছে পাকিস্তান থেকে। গত বুধবার শুধু বসিরহাটেই এসেছে দুহাজার উদ্বাস্তু, অবর্ণনীয় দুর্দশার মধ্যে এসে দিন কাটাচ্ছে ওই সব সহায়-সম্বলহীন মানুষ। পাকিস্তানের নির্বাচনের প্রাক্কালে একশ্রেণীর রাজনৈতিক দল সংখ্যালঘুদের ওপর চাপ দিয়ে দেশত্যাগে বাধ্য করেছে। তাদের ভয়, সংখ্যালঘুরা প্রগতিশীল বিরোধীদলে ভোট দেবে। আর এইসব মানুষ ভিটেমাটি ছেড়ে নিরাপত্তা কিংবা খাদ্য বস্ত্রের অভাবে এসে আশ্রয় ও সাহায্য চাইছে এদেশে। ইতিমধ্যে উদ্বাস্তুদের ভারতের বিভিন্ন এলাকায় পুনর্বাসন দেওয়ার কথা। সে কাজও যেমন শ্লথ তাদের বর্তমান থাকার অবস্থাও তেমনি শোচনীয়। বসিরহাট-হাসনাবাদ ক্যাম্পে এত উদ্বাস্তু থাকার জায়গা নেই। তারা মাথা গোঁজার জন্য ছড়িয়ে পড়ছে স্কুল বাড়িতে, আদালতে, রেলস্টেশনে, আমবাগানে নয়ত রাস্তায়।
আজকে স্কোর কত? সতের। খবরের কাগজে রিপোর্ট লিখতে লিখতে সাংবাদিক দুজন চা খায়, খোস-গল্প করে। বেলেঘাটায় তিনজন পাইপগানের গুলিতে তাদের মধ্যে একজনকে বাস থেকে নামিয়ে বরানগরে তিনটুকরোয় কাটা ডেডবডি আর খণ্ডযুদ্ধ নদিয়ার শান্তিপুরে পুলিশের সংগে লড়াই তেরজন নিহত হাসপাতালে গেছে জনাদশেক সমস্ত এরিয়ায় কার্ফু মাথা ভাঙা হয়েছে মাত্র ১টি স্ট্যাচুর রামমোহনের হাওড়ার ওদিকটায় আমার বড় মেয়েটার জ্বর সারাদিন হাগছে গিন্নিও অসুস্থ ছুঁচিয়ে দেবার একটা লোকও বাড়িতে নেই সিজন-চেঞ্জের সময় দাদা একটু সাবধানে বেশি রাত্তির অব্দি বাইরে থাকবেন না কাজও কিছু কিছু হচ্ছে জানেন এক হুমকিতে ৬৪ টাকার ডাক্তার ৮টাকা ফিস নিচ্ছে বড়বাজারের চোরাকারবারিদের চোখে ঘুম চলে গেছে... একটা অন্ধ ভিখিরি চৌমাথার মোড়ে বসে গান গেয়ে যাচ্ছে: জ্বলে-এ-এ-এ যায় মাতৃঅংগ। তার চোখের সামনে অন্ধকার, সে আগেও কিছু দেখেনি, পরেও কিছু দেখবে না। শুধু সেই বৃদ্ধ তার পিচুটিভর্তি ছানিপড়া চোখ নিয়ে এগিয়ে চলেছে, সে তার মৃত ছেলের হাড় খুঁজে বার করবে। তার সামনে কেউ নেই, পেছনেও কেউ নেই। রাস্তা ফাঁকা। সে একক সেই ফাঁকা রাস্তার দিয়ে একক সেই বৃদ্ধ কেবল এগোতে থাকে। চাদ্দিক থেকে হাওয়া আসে। ফুলের গন্ধ আসে। ভয় পাওয়া মানুষের ফিসফিস কথাবার্তা আসে। অন্ধ ভিখিরির গান আসে। জ্বলে যায় মাতৃঅংগ। একদিকে মানুষ খুন হয় আর অন্যদিকে কলকাতার ফুটপাথ ভরে যায় সেক্স ম্যাগাজিনে। ওগুলো কারা কেনে? বলতে বলতে দুজন ইনটেলেকচুয়্যাল চলে যায়। তারা চার্মিনার খায় আর রাজনীতি সমাজনীতি নিয়ে আলোচনা করে। কাছাকাছি মানুষ খুন হচ্ছে দেখলে সটকে পড়ে। ফালতু ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে চায় না। রাস্তা দিয়ে ঘটর ঘটর ট্রাম চলে। হিংসার কোন যুক্তি নেই হিংস্রতা বর্জন করুন। ক্রিম রঙের ওপর হলুদ রঙের লেখা চোখের সামনে থেকে সরে যায়। বুড়োটা মাঝে মাঝে বিড় বিড় করে বলে: সেই কবে আমার ছেলেকে খুন করে এদেশে মানুষ খুন শুরু হয়েছিল সেই ধারা এখনো চলে আসছে। বুড়োটার ছানি পড়া চোখদুটো জ্বল জ্বল করে।
সে দ্যাখে ধূর্ত শেয়াল গেরস্থের মুরগি চুরি করে দ্রুত আলোর তলা দিয়ে বাদামি অন্ধকারে মিশে গেল। তার গলা শুকিয়ে গেলে সে পুকুরের ভাঙা ঘাটে জল খেতে যায়, পুবে রাধাগোবিন্দ মন্দিরের মাথায় চাঁদ ওঠে, সে দীঘির জলে সেই চাঁদের ছায়া দ্যাখে। দেখতে দেখতে ভাবে ছুরিটা জলে ফেলে দিলে কেমন হয়...সব আপদ চুকে যায়, আর অস্বস্তি হয় না। কিন্তু প্রাণে ধরে ফেলা হয় না কিছুই, জ্যোৎস্না পেয়ে সেই আধা-মরচে-ধরা ছুরির ফলা চকচক করে। সে বলে আমি একে ফেলতে পারি না, কেননা আমিই একে নিয়ে এসেছি। তারপর ভাবে, কিন্তু এটি রেখে আমি কি করব। রমেনদের বাড়িতে, ড্রইংরুমের দেয়ালে এইরকম অনেক ছুরি সাজানো আছে, এর থেকে অনেক অনেক বড়, বড়, পিস্তল বন্দুক সব কত রকমের, রমেনের বাবা কেমন গোঁফে তা দিতে দিতে সব বুঝিয়ে বলেন এগুলো কতসব অতীতের, যুদ্ধে ব্যবহার হয়েছিল। ইতিহাস, সব ইতিহাস। সে জলের ধারে দাঁড়িয়ে জলে জ্যোৎস্না পড়ে আছে দেখতে দেখতে ভাবে, কেন সে নিয়েছিল, কেন- কেন। ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে, আমের বোলের গন্ধে ম ম করছে সমস্ত দীঘির পাড়, তার পুরানো পৈঠা, তেতে যাওয়া সিঁড়ি; শুকনো পাতা মাড়িয়ে সে চলে আসে, কেবল পাখিটা, তার পোষা খাঁচার পাখিটা পেছন থেকে ডাকে: হুই সুদাস, কোথায় যাচ্ছিস, হুই সুদাস। মা বলেন সুদাস এত রাত হল কেন? এমনি, দীঘির পাড়ে বসে ছিলাম; জানো মা ওখানে আজকাল কারা যেন দল বেঁধে নীলকণ্ঠ পাখির ডাক শুনতে আসে। তাদের হাতে পুরোনো সব রক্ত লেগে থাকে, মাথায় লাল নীল পাখির পালক। তুই বড় দুষ্টু হয়েছিস- ওদিকে যাস না। কেন মা? ... একটুখানি থেমে থেকে তার চোখে মুখে তাকিয়ে বলেন: তোকে আজকে কেমন কেমন লাগছে সুদাস। সে তখন বলে তা তো লাগবেই মা, আমি যে মানুষ আর কুকুরকে একই ডাস্টবিন থেকে খাবার খুঁটে খেতে দেখেছি।
এবড়ো খেবড়ো রাস্তা স্টিমরোলার চালিয়ে সমতল
করা হচ্ছে। ম্যাটিনি শোতে হাউসফুল হচ্ছে বাঙলা সিনেমা। পিসিমারা কৌটো খুলে পান জর্দা মুখে দিচ্ছেন।
পর্দাজুড়েউত্তমকুমার।
বাঙলার হিরো বাঙালীর হিরো।
সেকখনোপ্রেমিককখনোডাক্তার কখনোসন্ন্যাসীকখনোএমএলএকখনো
কালো চশমা পরা গোয়েন্দা। সে
চা খায় সিগারেট খায় হুইস্কি খায় কখনো কখনো নায়িকাকে জড়িয়েও ধরে
কিন্তু কখনো চুমু খায় না। অন্ধকার
প্রেক্ষাগৃহে দীর্ঘশ্বাস পড়ে। কী দেখালে গুরু তোমার তুলনা হয় না।
ডায়াস জুড়ে ন্যাতা।পর্দা জুড়ে উত্তমকুমার।
সদ্য-শাড়িপরা কিশোরীরা চোখের পলক ফেলতে ভুলে যায়। খেল জমে ওঠে। সাগরিকা থেকে দত্তা ভায়া পথে হল দেরি।... বিশ্বাস কর অরুণ আমি নষ্ট হয়ে গেছি- এ ফুল দিয়ে আর দেবতার পুজো করা যাবে না।... ঘাড়ে পাউডার দর্শকজন জেঁকে বসে। প্রেম করেছি-বেশ করেছি-কর্বোই তো...টিন-এজার নায়িকারা নাই দেখিয়ে পাহাড়ে জংগলে নেচে নেচে বেড়ায়। মাঝে মাঝে নায়ককে বুকে জড়িয়ে ধরে। মাঝে মাঝে চোখের পাতা ঘন করে গান ধরে: ... সুমন, ভালোবাসা কি পাপ?... খেল জমে ওঠে। বাঙলা খেল। এখানে সরল চাষি আদর্শবাদী ডাক্তার প্রজাবৎসল জমিদার- যে খরার সময় প্রজাদের বিনামূল্যে বস্তা বস্তা ধান বিলিয়ে দেয়। মকুব করে দেয় বকেয়া খাজনা। এখানে বেথুনে-পড়া মেয়ে দারিদ্র্যের জ্বালায় চালের চোরা কারবার করে। জমিদারের লম্পট ভাই এক কথায় মদ ছেড়ে সাধুবাবা বনে যায়, কৃষক সংগ্রামের ন্যাতা হয়। জনতা বিস্ফারিত চোখে দ্যাখে, দ্যাখে আর মুগ্ধ হয়।
গরু এক ধরনের চতুষ্কোণ প্রাণী যারা চোখের পাতায় মহাজাগতিক রশ্মি লুকিয়ে রাখে। গরুর মাথায় টুকরো টুকরো অনেক কোষ আছে যা দিয়ে এরা পৃথিবীর তাবৎ বিষয়ে জাবর কাটে। হন্ডুরাস থেকে একবার বাবা একটা গরু এনেছিলেন যে তার পূর্বপুরুষের কাজকে হুবহু বাস্তবে রূপ দিয়েছিল এবং ভেঙে ফেলেছিল বছরে-৩০-য়েক ধরে তৈরি করা একটা প্লাইউডের রঙিন খোলস যাকে লোকে কথায় কথায় গণতন্ত্র বলে। আর সেই থেকে গরু বিষয়ে আমরা ক্রমশ অভিজ্ঞ হয়ে উঠলাম, বাবা আমাদের বুঝিয়ে দিলেন গরুর পা সম্বন্ধে আমরা যতটা নিশ্চিন্ত হয়ে থাকি তা ঠিক নয় কেননা গরুর ২টি ৩টি ৪টি বা ৫টি পা-ও থাকতে পারে- তার কিচ্ছুটি ঠিক নেই। গরুরা অবশ্যই জরুরি অবস্থা জারি করতে পারে অথবা ইচ্ছে করলে যখন তখন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর সামর্থ রাখে। লুকিয়ে লুকিয়ে এরা খবরের কাগজ বা সংবিধানের দুমড়ানো পাতা চিবোতে ভালোবাসে। মাটির নিচে সেঁধিয়ে যাওয়া শেকড় বাকড়, সিনট্যাক্স- অক্ষর-ব্যবস্থা- নিজেদের লেজ, কাঁটাগাছ, অব্যবহৃত কার্তুজ- এই সব, সবকিছুই, এদের খাদ্য এবং এসব খেয়ে এরা খুব আনন্দ পায়। কিন্তু একথা মনে করলে চলবে না যে গরুদের কোন সৌন্দর্যজ্ঞান নেই বা গরুরা স্বশ্রেণীর স্বার্থ বোঝেনা। গরুরা ফাগুন লেগেছে বনে বনে গাইতে খুব ভালোবাসে। যখন দেশে ওষুধের কারখানা দরকার তখন সেখানে বেশি বেশি কসমেটিকস তৈরির জন্য মন্ত্রীদের গরুরাই উদ্বুদ্ধ করে, মানুষকে অভুক্ত রেখে মারণাস্ত্র বানাবার পরামর্শ গরুরাই দিয়ে থাকে। গরুর লেজ দেখে তার উপকারিতা সম্বন্ধে তেমন কিছুই মনে হয় না কিন্তু সেটি পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের কাজে লাগে বলে অনেকের বিশ্বাস। গরুরা সাধারণত নিরীহ নিরীহ ভাব দেখালেও অভ্যাসে তারা মোক্ষম রক্তপায়ী হয়ে উঠতে পারে। সুযোগ সুবিধে পেলে আর্কিমিডিসের মত নিঃঝঞ্ঝাটকেও হত্যা করে। গরু পরমত আদৌ সহ্য করেনা।
পার্টি আপিসে ঢুকতে দেয়াল জুড়ে আধময়লা লেনিনের ছবি। যা শুধু ছবি হয়েই ঝুলে আছে আধ-শতাব্দী কাল। ট্রেন প্লাটফরম ছাড়ছে। আপিসঘর টিকিটঘর চায়ের স্টল সব সরে যাচ্ছে দ্রুত। কনট্রোলরুম পেরুতে না পেরুতে দুপাশে ব্লিচিংকরা নিওন আলোর জৌলুস মেকি বিপ্লবীদের মত হঠাৎ-করে মজে গেল। ভুখা মিছিল যাচ্ছে বিডিও আপিসে - গাড়ি-ঘোড়া সব দাঁড়িয়ে পড়েছে-রাস্তার দুদিকে কৌতূহলী জনতা।
সন্ধে বেলায় মৌতাতের তাড়ি হয়ে যায়
আমরা, সব বাচ্চা বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীরা
রাতারাতি
মুখে কুলুপ এঁটে যে যার গর্তের মধ্যে সেঁধিয়ে যাই
এখন প্রাণে বাঁচলে পরে বিপ্লব টিপ্লব দেখা যাবে সুযোগ সোর্স মাফিক কেউ কেউ ঢুকে পড়ি ব্যাংকে এজিবেংগলে
কেউ কেউ অধ্যাপক হয়ে যাই মাষ্টার সাঁইবাবার শিষ্য
কেউ কেউ ভিক্টোরিয়ার আনাচে কানাচে দিব্যি খেলে বেড়াতে থাকি গোল্লাছুট
কেউ বা মায়ের অনুরোধ ঠেলতে না পেরে
সুন্দরী দেখে একটা 'দাসী' নিয়ে আসি
দিব্যি মেতে উঠি আপন আপন ঘর সংসার নিয়ে
বন্ধুর দেশের বাড়িতে দুদিনের জন্য বেড়াতে গিয়ে
গ্রামের একরাম মিঞাকে ফিলটার সিগারেট অফার করি
তার অবস্থা কত খারাপ জেনে নিই
শহরে ফিরে ফুটানি মারি বর্গাদারদের হাঁড়ির খবর জেনে যাওয়ার
মানুষের হৃদয়ে হৃদয়ে প্রেম প্রীতি ভালোবাসা ঠিকঠাক বজায় থাকে
মার্কিনী ষণ্ডের ঔরসে
আপন পেটে ষণ্ডামার্কা ভারতবাসী বানাতে ব্যস্ত থাকে হেমনলিনী
মাঝে মাঝে মুখ ঝামটা দেয়: এত রস কিসের লা ঢ্যামনা গরু
এককড়িমণ্ডলের ছেলে ট্রেনের কামরায় কামরায়তেমনি পাঁউরুটি ফিরি করে বেড়ায়
মাঝে মাঝে ট্রেন যাওয়া-আসা করে। আমরা আমাদের বাচ্চাদের ছেড়ে দিই। সবাই আমরা বলাবলি করি আমরা যথাসম্ভব রেলপাতের কাছ ঘেঁষে থাকব। অন্যমনস্ক ভাবে ঘুরে বেড়াব। তাতে যদি এক-আধটা ঘটনা ঘটে যায়। কিন্তু কিছুই ঘটে না। বৃথাই ট্রেন যায় আসে। বৃথাই বাচ্চারা রেললাইনের ওপর ঘুরে বেড়ায়। বৃথাই আমরা অন্যমনস্ক হই। আমাদের কোন ঘটনা ঘটে না।
তখন দাদুর বয়সি সেই বুড়োটার দিকে আমাদের নজর যায়। ওহে রূপোলি চুলওলা বুড়ো, তোমাকে নিয়ে একটা মজা ঘটতে দাও। সে কিছু বুঝতে না পেরে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। তার মুরগির ঠ্যাং চোষা বন্ধ হয়ে যায়। সেই পিচুটিভর্তি চোখের সামনে তখন আমরা আমাদের কসরৎ দেখাই। বাঁ-পকেট থেকে বইখানা বের করে বলি: এই হচ্ছে বই। এইরকম সব করতে হবে এতে লিখেছে।
দরজা ঠেলে বাইরের থেকে একটা লোক ঢুকল। তাতে বাইরের ঠাণ্ডা হাওয়া
খানিকটা ঢুকে পড়ল কামরায়।
চাই চানাচুর গরম চানাচুর খাস্তা মচমচে মুখরোচক
তোর চানাচুর কত করে
পনের... কুড়ি
বড় বেশি দাম
দশ পয়সায় দিবি
আজ্ঞে না
চানাচুরওয়ালা নেমে গেল। দরজাটা আবার ফাঁক হল। বাইরে থেকে ঠাণ্ডা
হাওয়া আবার ঢুকল কামরায়।
ও নেমে গেল
তাতে কি
তাতে এই যে ট্রেন চলছে না
আলবৎ চলছে
ট্রেন চলতে থাকলে ও নামল কি করে
ওরা নামতে পারে চলতি ট্রেন থেকে এ কামরা থেকে ও কামরায় চলে যায়
অসম্ভব
বড় বাজে বকছেন মশাই... ঝিমোন
ঝিমোবো
হাঁ...এই আমার মত এমনিভাবে
কারণ
কারণ এতেই একমাত্র সুখ
এটা জড়ের লক্ষণ মানুষের নয় জানেন গীতায় কি বলেছে কি বলেছে
চৌধুরীদের বড় তরফের ধানের গোলায় সারারাত হিম পড়ে। আমি ইভা বসে বসে স্বচ্ছন্দে একটার পর একটা কাচের গ্লাস ভেঙে যাই। কাচের টুকরো চতুর্দিকে ছড়িয়ে ছিটকে পড়ে ক্রমশ আর্শীনগর হয়ে ওঠে। আমাদের এখন কি হবে গো- বলে চাষির মেয়ে বসে পড়ে, তাদের উঠোন জুড়ে রক্তপাত ঘটে যায়। ইভা আনন্দে হাততালি দিয়ে ওঠে। বুড়ো নায়েব মশাই, চশমার সুতো কানে আটকাতে আটকাতে, ঝুঁকে-পড়া শরীর, বিড়বিড় আওড়ান: এবার আদায়পত্তর খুব খারাপ ছোটবাবু, চাষিরা ক্ষেপে গিয়েছে। পার্কস্ট্রিটে ঝন ঝন বাজে কাচ, ইভা হি হি করে হাসে, বলে: আমার হাসিটা জিনার মত না? এ্যালকহলে চুর হয়ে থাকা ষোড়শ লুই বলে চলে: কে বলেছে তোমাদের রুটির বদলে কেক খেতে- তোমরা রুটিই খাবে- বুঝলে? কাচ ভাঙে, আরো কাচ ভাঙে। কাচের পাহাড় জমে যায় ঘরময়। আর সেই কাচে নিজস্ব প্রতীক ঠিকরে উঠলে দুহাত তুলে আমি, ছোটতরফ, ভয়ানক বিপর্যস্ত, আত্মরক্ষার জন্য হাত বাড়িয়ে দিই। বেয়ারা এসে ধরলে আমি চিৎকার করে বলি:
রাত কত হৈল?উত্তর মেলে না।
এই শহরের উপকণ্ঠে কোথাও এক ফাঁকা মাঠ আছে, গাছ-গাছালি আছে কোথাও, সেখানে পাখিরা থাকে। পাখির ডাকে ভোর হয় সেখানে। সে এই রকম ভাবে। ভাবতে ভাবতে কল থেকে ছরছর জল পড়তে দ্যাখে। সে ঠিক শুনতে পায় না। কুয়াশার ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অনেক মাঠ-বন-জংগল মাড়িয়ে সে প্রার্থিত ভোর পেয়ে যায়।
একটা টেবিলেই এখন সে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে কেননা সে তৈরি করে নিয়েছে একটি ব্যবহারিক হাত ও জটিল মাংসপরম্পরা। টেবিলের ভেতর থেকেই এখন সে বের করে আনে তার ব্যক্তিগত হাড়গোড়, আকাচা রুমাল, প্যাকেট-ভর্তি সিগারেট, ম্যাড়মেড়ে সৃষ্টিশীলতা, সানলাইটের মোড়ক, সুরমার মেজর অংশ- যা বস্তুত ৩-৪ খানির বেশি নয় আর একটা তাজ্জব জিনিস, একটা তুলোট কাগজের বই, মলাট ছেঁড়া, যা বানানো হয়েছিল এক যুগ আগে, যাতে সে-কি-রকম-ভাববে সব লেখা হয়ে রয়েছে। উষ্ণতাকে সে ব্যবহার করে অনেকটা নীল ফসফরাসের মত, ধাতব নিস্পৃহতার মত, যা আসলে ব্যক্তিগত শৃঙ্খলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, অনেকটা যতিবহুল। যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে কেমন করে বেঁচে আছো হে এমন নিজস্বভাবে, তবে তার উত্তরে সে বলবে এই যে দেখুন প্রোফাইল, প্লাস্টারের, অথবা হাতের মুঠোয় ধরা যায় না এমন দুর্জেয় এই সাদা রঙ। উত্তরে যদি আপনি দ্বিধাগ্রস্থ হন, যদি তাকিয়ে থাকেন তার চোখ বরাবর, তবে একটু থেকে সে, কিছুটা নিস্পৃহ, একটা আস্ত সাদা কাগজ নিয়ে তার ভেতরে একটা ফুটকি আঁকবে আর দেখিয়ে বলবে, এই যে ফুটকি যা আসলে নীল ফসফরাস মাত্র। তার চাদ্দিকে তখন সাদা, গাঢ় আর নিরবয়ব প্রতিবাদ। এমন একটা ধবধবে কাগজের ভেতর দিয়ে ফুটকি কেমন পদ্ধতিময় হয়ে ওঠে, চারপাশে তার মৃত্যুর মত সাদা জমাট বেঁধে থাকে কেমন করে, তা সবাইয়ের কাছে বোধগম্য নাও হতে পারে কিন্তু তাতে তার কিছু যায় আসে না।
সবার আগে মধ্যবিত্ত কেরিয়ারিজমের বারোটা বাজানো দরকার- লিখে ফেলে সুবিমল ভাবছে এ লেখা কোথায় ছাপবে সে- কোন কাগজে? আপশোষ থেকে গেল একসংগে যুগান্তর আর অনুষ্টুপে ছাপা যেতে পারে এমন গ্রাম-বাংলার বাম-গল্পো ফাঁদার মহাশ্বেতা এখনো সে রপ্ত করতে পারলো না। বেশ সেফ পজিসানে থেকে বিপ্লবী লেখক হয়ে যাওয়া যেত- টাকাকে টাকা, নামকে নাম। কে সহ্য করবে তার এই পাতিবুর্জোয়া গালাগালি, সাহিত্যের নামে? বেশ কিছু নয়, হাজতে ঝুলিয়ে রেখে কয়েকদিন পায়ের তলায় মারা হবে, স্পাইনাল কর্ডে একটা ছোটখাটো অসুখ, চিরকালের জন্য মধ্যবিত্ত-মার্কা বিপ্লবী বুলি খতম। শুধু কয়েক শ বন্দীর সংগে গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে তারাভরা একফালি আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকার সান্ত্বনা, সেও প্রতিবাদ করেছিল। ময়দানে দাঁতের মাজনওয়ালারা এবার ভালো ভালো সব ম্যাজিক দেখাচ্ছে। ইয়া মোটা মোটা লোহার বালা গায়ের জোরে দুমড়ে দেওয়ার ম্যাজিক, কাটামুন্ডুর কথা বলার ম্যাজিক। দেখতে লোক জমে যাচ্ছে। বাঙলা উপন্যাসের নায়িকারা ক্রমশ প্রোগ্রেসিভ হয়ে উঠছে। লেকের ধারে সন্ধেবেলায় ছেলে-বন্ধুর সংগে কি করেছে নিঃসংকোচে মাকে এসে বলছে নায়িকা। ডিস্ট্রিক বোর্ডের রাস্তা পাকা হয়েছে। ফসল কাটার মরসুমে চাষিরা নিজেদের শ্রমের ফসল জোতদারের ঘরে তুলতে অস্বীকার করলে সোঁ সোঁ ধুলো উড়িয়ে চলে আসছে পুলিশের জীপ-
শেষ বিকেলের রোদ্দুরে কাগজ-কুড়োনোর বস্তা নামিয়ে রেখে শ্রান্ত মুখে ট্রাম লাইনের ধারে বাঘবন্দী খেলছে দুটো কাগজ-কুড়োনো ছেলে। একজনের খালি গা, তাতে মাসখানেকের পুরু ময়লা, পরনে একটা ইজের। অন্যজন ছেঁড়া পাঞ্জাবির মতন একটা গায়ে গলিয়েছে, ঝুল গোড়ালি ছুঁই ছুঁই করছে। তাদের পেছনে গ্রান্ডহোটেলের ছায়া লম্বা হচ্ছে। তাতে তাদের কোন ভ্রূক্ষেপ নেই, একমনে তারা বাঘবন্দী খেলে যাচ্ছে, বা...ঘ...ব...ন্দী...এই শিক্ষা-ব্যবস্থায় যে যত পড়ে সে তত মূর্খ হয় একথা দেয়ালে দেয়ালে লিখেছিল যে ছেলে এখন সে অধ্যাপক হয়ে গেছে, পি-এইচ-ডি করে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া যায় কিনা তার তদ্বিরে আছে। হঠাৎ হঠাৎ সব কটা নিওন অফ হয়ে যাচ্ছে। ঘাপটি মেরে থাকা পুলিশের হুইসেল বেজে উঠছে টান টান। মেদিনীপুরের কমরেডের বাঁ বুকে বিঁধে যাচ্ছে জ্বলন্ত সিসের টুকরো। সেন্ট্রাল টাওয়ারে বেজে উঠছে অন্ধ পাগলি। বহরমপুরের জেলের গরাদ চুঁইয়ে ভেসে আসছে ইনটারন্যাশনালের সুরের তীব্রতা। নিঃশব্দে ফাঁসি হয়ে যাচ্ছে কৃষ্ণাণ চেট্টির। সমাজতন্ত্রের মশলামুড়ি চিবোতে চিবোতে বাবু-বিপ্লবীরা - বিশাল চেহারা, পেটের দিকটাই বেশি- তাকিয়ে দেখছেন, তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছেন মার্কসবাদ-লেনিনবাদ। লেনিন সরণির ট্রাফিক ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছে জটিলতর জ্যামের দিকে। আজকে কৃষ্ণাণ চেট্টির ফাঁসি-একটা রোগাপটকা উসকো খুসকো চেহারার ছেলে দাঁতে
এ পা রে তে লংকা গা ছ টি রা ঙা টু ক টু ক ক রেগুণবতী ভা-ই আ মা র ম ন কে ম ন ক রে
দাঁত চেপে পথ হাঁটছে, অন্যমনস্ক ভাবে ডান হাতের আঙুল দিয়ে বাঁ হাতের আঙুল মটকাচ্ছে। তার চোখের সামনে এখন ভেঙে পড়ছে সারপেনটাইন লেন ও তার অন্ধকার। ভাঙতে ভাঙতে শুধু গগন ঠাকুরের সিঁড়ি হয়ে যাচ্ছে এখন, আপাতত এই মুহূর্তে।
**********গোদারকে গুরু মেনে সুবিমলমিশ্রের এসমস্ত লেখাও সিনারিও , যেখানে আঙ্গিক নিজেই বিষয়বস্তুর থেকে বড় হয়ে উঠেছে। তাঁর প্রথম দিকের দেখন চাচা বা নুয়ে গুয়ে দুই ভাই , আর্কিমিডিসের আবিষ্কার ও তারপর এই গল্পগুলিতে সুস্পষ্ট কাহিনী অবয়ব ছিল। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী বলেছিলেন “আমরা যেখানে শেষ করেছি , সুবিমল সেখান থেকে শুরু করেছে”। প্রথম থেকেই প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার জায়গা থেকে গল্পবিরোধিতার কথা মাথায় রেখে এই অ্যান্টি-গল্প ঘরানায় লিখতেন। কিন্তু পড়লে মনে হয় আসলে এসব গল্প মূলত অ্যান্টিফ্রিজের মত , যা জলে মেশালে হিমাঙ্কের নিচেও জল জমে বরফ হয় না। সুবিমল তার সমকালীন সময়কে জমতে দেন নি , অ্যান্টি-গল্পগুলিতে অবিরাম রাজনৈতিক ধারাভাষ্য আর পরিকল্পিত সন্ত্রাস চালিয়ে গেছেন। পরীজাতকের মত বহু গল্পে সুবিমল রক্ত , মৃতদেহ , খুন , ফ্রিজের ভেতর পড়ে থাকা মরা ইঁদুর দিয়ে সেইসব 'প্ল্যানড ভায়োলেন্সে'র ছুরি চালিয়ে দেন পাঠকের মনের মধ্যে। তাঁর প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা নিয়ে যত কথা হয় , ভগ্নাংশও তার লেখা নিয়ে হয় না। হলে বোঝা যেত নবারুণ ভট্টাচার্যের অনেক আগেই সুবিমল সাবল্টার্ন ভাষা এবং মানস বাংলা গদ্যে প্রয়োগ করে দেখিয়ে দিয়েছেন। বাংলা গদ্যের পাতাললোকে [নিজের বাড়িকে আন্ডারগ্রাউন্ড বলতেন] সুবিমলের প্রভাব এবং বিস্তার এত সুদূরপ্রসারী যে পড়লে বোঝা যায় চন্দ্রিল ভট্টাচার্য সুবিমলের ধারাতেই গল্পের বদলে গদ্য বা রিপোর্টাজ লেখেন।
নিজের গল্পের মত সুবিমল নিজেই আসলে বাঙালি মধ্যবিত্ততার সাজানো গোছানো সিনেমাহলে ঢুকে পড়া ষাঁড়। 'কেননা ষাঁড়ের আছে নিজস্ব কক্ষপথ আর ষাঁড়যোদ্ধার তার নিজের , এবং এই দুই কক্ষের মাঝখানে স্থির থাকে বিপদের এক কেন্দ্রবিন্দু , মৃত্যু বাজির এক উত্তাল গিরিশৃঙ্গ।' “লোকে যাকে সাহিত্য করাটরা বলে তেমন কোন-কিছুতে আমার কোন আস্থা নেই চিন্তার মধ্যবিত্ততাকে ঘৃণা করি আমি, যে চিন্তা বৌয়ের ঠোঁটের লিপস্টিক দেখে রক্ত প্রত্যক্ষ করে। রবিঠাকুর-টাকুরদের মতো সাহিত্য-করিয়েদের লাইনে থাকতে নিজেকে রীতিমত অসম্মানিত মনে হয় আমার। আমি তেমন কোনো লেখা লিখতে চাই না যা পড়ে লোকে আমার পিঠ চাপড়ে বললে বাহা বেড়ে সাহিত্য করেছো তো হে ছোকরা, আমি চাই লোকে আমার লেখা পড়ে আমার মুখে থুথু দিক, আঙুল দেখিয়ে বলুক, - এই সেই লোক যে উপদংশ-সর্বস্ব এই সভ্যতার ঘাগুলো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দিনের আলোর মত খোলাখুলি করে দিয়েছে।”
১৯৭১ সালে নকুল মৈত্র [গুরুচন্ডা৯ সম্প্রতি প্রকাশ করেছে তাঁর 'মুণ্ডহীন মানুষের চলাফেরা'] এবং ভরত সিংহের 'একাল' থেকে বেরিয়েছিল প্রথম গল্পের বই 'হারাণমাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া বা সোনার গান্ধীমূর্তি'। কমলকুমার , অমিয়ভূষণ , অসীম রায় এবং বহু পাঠক চিঠি দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বই 'নাঙা হাড় জেগে উঠছে' ছাপানোর জন্য গ্রাহক ফর্ম বিলি করা হয়েছিল। ৬০-৭০ জন গ্রাহক হয়েছিলেন , যাদের মধ্যে ছিলেন বুদ্ধদেব বসুও। বইয়ের উৎসর্গ পত্রে এদের সবার নাম ছাপা হয়েছিল [সমবায় ভিত্তিতে গুরুর দত্তক নেবার পদ্ধতি , ৫০ বছর আগেই], তৃতীয় বই 'দুতিনটে উদোম বাচ্চা ছুটোছুটি করছে লেবেল ক্রসিং বরাবর'ও পাঠক সমবায় প্রকাশন থেকে ছাপা হয়। 'সুবিমল মিশ্র কোনও কারণেই অর্ধমনস্ক মানসিকতা প্রার্থী নয়।' তাকে নিয়ে এত আরবান মিথ আছে , ময়দানের বইমেলায় নিজের ছাপানো বই নিজেই সাজিয়ে বসতেন। বিক্রির আগে কথা বলে পরীক্ষা করতেন ভাবী ক্রেতা সুবিমল মিশ্রের লেখা আদৌ পড়েছেন কিনা। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য একবার কিনতে গেলে নাকি তাকেও বিক্রি করেননি কারণ তিনি সেই পাঠক উত্তরণের পরীক্ষায় সফল হতে পারেননি। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার জোরে দেবেশ রায়ও তাঁকে দিয়ে প্রতিক্ষণে লেখাতে পারেননি।
এই তিনটি বইয়ের অধিকাংশ গল্পই ছাপা হয়েছিল অখ্যাত সব লিটল ম্যাগাজিনে- একাল, বিজ্ঞাপন, বিজ্ঞাপন পর্ব, এ্যাঙ্কিলোসার, চিল, সত্তর দশক, সত্তরের কবিতা, বোবাযুদ্ধ, স্থানাঙ্ক, কবিপত্র, ক্রান্তিকাল, সাহিত্যচর্চা এসব-এ। দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচয়-এ দুটি গল্প ছাপিয়েছিলেন।
পরের দিকে 'বাব্বি' , 'এই আমাদের সিকি লেবু নিংড়ানি'র বইগুলির গল্পগুলিতে বা 'মেমরি গেম', 'স্বরমেলকলানিধি'র মত নভেলায় অ্যান্টি-গল্পের কাঠামোর প্রয়োগ নিয়ে নিরীক্ষাই প্রবল। এতই প্রবল যে স্বপ্নময় চক্রবর্তী বলেছিলেন সুবিমল মিশ্র এখন অক্ষর ছোট বড়ো করা ছাড়া কিছু পারেন না। কখনো কমলকুমারের স্মৃতিতে বারোজ কাট আপের বিপরীত মেরুর দিকে যাত্রা করে বানানো অ্যান্টি-গল্পের কাট আপ। কখনো সমরেশ বসু মারা যাবার পর তার স্মৃতিতে একটি আশ্চর্য তান্ত্রিক গল্প "দাঁড়ান সমরেশবসু ভরযুবতীর ছাতি হয়ে"। ভিত্তি ও উপরিতল , হেরম্ব নস্কর মৌসুমী নস্কর জটাধারী নস্কর , মদনকটকটি এসব পরের দিকের গল্পেও কাল্পনিক গল্প বলতে যা বোঝায় আছে। অর্থাৎ পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত ঘটনাপ্রবাহ। অথচ এমনভাবে লেখা যে সেগুলি গল্পবিরোধী। 'কাঠ খায় আংরা হাগে'র দুখানা গল্প যেমন ইচ্ছাকৃত পর্নোগ্রাফিক - "লেখাটি থেকে প্রথমেই আমি যে জিনিসটি বাদ দিতে চেয়েছি তা হচ্ছে সাহিত্য।"
*************আলো গদাধর লেখক আলোকময় এবং পাঠক - এর মধ্যে পাঠকও আসবে - পাঁচজন একটি মইয়ের এক এক ধাপে বসে আছে। গণনার সুবিধের জন্য এদের পর্যায়ক্রমে ক খ গ ঘ ঙ নাম দিলাম। মইটিতে খ -এর ওপরে আছে ক , কিন্তু নিচে ঙ। গ আছে ক এবং ঘ-এর মধ্যিখানে , এবং খ এর ঠিক ওপরেই ঘ আছে। সবার ওপরে কে আছে ?
লেখকরা গল্প জানে না জীবন জানে আর জীবন গল্পের থেকেও অশ্লীল।
উত্তর কলকাতার মেয়েদের একটি স্কুলে বুধবার সকালে গোলমাল হয়, গোলমাল চালায় তিনটি হনুমান। হনুমান ছাত্রীদের শাড়ি ধরে টানাটানি করতে থাকে, ব্লাউজ ফালাফালা করে দেয়। কয়েকজন মিলে টিফিন কেড়ে নিয়ে প্রকাশ্যেই খেতে শুরু করে। শ্রেণিকক্ষে ঢুকে ভাঙচুর করে নির্জন বাতিস্তম্ভ। আঙুলে তাদের অলৌকিক সব ক্ষত। ডাফ স্ট্রিটের ওই স্কুলে কয়েকটি বেশ বড় বড় গাছ আছে। মংগলবার হনুমানগুলি ছিল ওইসব গাছে। তারপর আলো জ্বলে উঠল লালচে-কালো মুখে। বৃহস্পতিবার হলে বারান্দাতেও লাফালাফি শুরু করে দেয় তারা। কেউ কেউ যেচে তাদের খাবারের লোভ দেখিয়ে কাছাকাছি ডেকে এনেছিল। আবার কেউ কেউ গায়ের জোরে তাদের তাড়াতেও চেয়েছিল। ভেংচি কেটেছিল মুখের ওপর। তারপরই এক মদ্দা হনুমান বেশি বেশি করে মেয়েদের ওপর চড়াও হয়, তেড়ে তেড়ে যেতে থাকে। অভব্য আচরণ শুরু করে দেয়। দু-ফাঁক জানুর মতো হাড়িকাঠ, সিম্বল হয়ে ওঠে। বৃহস্পতিবারই দেখা যায় শ্রেণিকক্ষে সর্টস-পরা এক ছাত্রীর টেবিলের তলায় হনুমান বসে রয়েছে। পরমাণু ঘূর্ণি তৈরি হয় তখন, এক এক করে নারীস্কুলের সব কটা আলো নিভে যেতে থাকে। অন্ধ-স্কুলে ঘণ্টা বাজে।
এখন কি ভেবে বেঁচে আছেন একথা জিজ্ঞাসা করা হলে সে দেখতে পায় তার হাতে ঝোলানো আছে এক ফোলডিঙ-করা বাড়ি, যেখানে সেখানে ইচ্ছেমত সে ঘুরে বেড়ায়, যখন রাত্তির হয় বা চলতে ইচ্ছে করেনা তখন সে একটা খোলামেলা জায়গা দেখে ভাঁজ খুলে বাড়িটা পেতে নেয়, ঠিকঠাক ঘর হয়ে যায় তখন, শোয়ার ঘর বসার ঘর বারান্দা- একটা টসটসে বৌ পর্যন্ত- যতক্ষণ ইচ্ছে থাকে সে, সাধারণত সকাল অব্দি, তারপর আবার সে গুটিয়ে নেয় সবকিছু, ফোলডিঙ করে নেয় ঘরবাড়ি, মাফলার দিয়ে ভালো করে ঢেকে নেয় সোনালি কাঁকড়ার দাঁড়ায় ক্ষত-হয়ে-যাওয়া সেই অপরিচিত ফুসফুসটুকু, তাকে কেউ চিনতে পারে না, বুঝতে পারে না। ফোলডিঙ ঘর বাড়ি বাঁহাতে ঝুলিয়ে ডানহাতে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে পথ হাঁটে সে। লোকে যখন জানতে চায় এমন ভাঁজ করা সুবিধেজনক বাসাবাড়ি কি করে পাওয়া যায় তখন কোন কথা বলে না, সে, শুধু মিটিমিটি হাসে। লোকেরা তার দিকে তাকিয়ে দ্যাখে আর অবাক হতে শুরু করে।
আমাদের স্টকে এখনো অনেক কিছু আছে, আছে বিদ্যাসাগর রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ সত্যজিৎ রায় আছে চা পাট বিশ্বকবি-পুষ্ট সাচ্চা সংস্কৃতি। আমরা মধ্যবিত্তরা, যারা খাই-দাই আপিস যাই বাচ্চা পাড়ি, এই নিয়ে মোটামুটি আরো কিছুদিন চালিয়ে যাব আর রাঙালুর মত চেহারার রীমু-সীমুরা গড়িয়াহাট মোড় থেকে সংগি খিঁচে নেবে, নিয়ে রবীন্দ্রসরোবরের অন্ধকারের দিকে সড়াৎ নেমে পড়বে, একা, শুধু একা পড়ে থাকবে তুমি, সুবিমল, পাশে আর একজন একা, রবীন্দ্রনাথ- একা এবং পাৎলা।
সেই সময় ইঞ্জিনের তীব্র আলো, প্রাচীন বৃক্ষের মত ঋষিকল্প সেই আলো তাহাদের শরীরে আসিয়া পড়িবে। তাহারা সেই আলোর চত্বরে দাঁড়াইয়া আকাঙ্ক্ষিত স্ফূর্তির জন্য, পরস্পর রক্তসান্নিধ্যের জন্য অপেক্ষা করিবে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।