"জীবন যে প্রকৃতই সমুদ্রযাত্রা, যে কোনো সময় জাহাজডুবির আশংকা থাকে, ধূসর বন্দরের অপেক্ষায় শুধু অপেক্ষা, এই অপরাহ্নবেলায় তাও হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও জন্ম থেকেই এই এক অলৌকিক যাত্রায় মানুষকে বেরিয়ে পড়তে হয়।"
'নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে' দেশভাগ সম্পর্কিত বহু আলোচিত উপন্যাস হলেও অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমুদ্র বিষয়ক লেখা নিয়ে কমই কথা হয়। পৃথিবীর তিনভাগ জল হলেও জলের উপাখ্যান বেশি লেখা হয়নি। ব্রিটিশদের মত দ্বীপবাসীদের সাহিত্যে স্ট্রেজার আইল্যান্ড, হার্ট অফ ডার্কনেস, রাইম অফ এনশিয়েন্ট মেরিনার, রবিনসন ক্রুশো, ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সি, মবি ডিক, গালিভার্স ট্র্যাভেলস। বিজয় সিংহের লঙ্কা জয় বা চোলদের জাভা সুমাত্রা ইন্দোনেশিয়ায় সাম্রাজ্য বিস্তার ছাড়া ভারতীয় / বাঙালিদের সমুদ্রযাত্রা নিয়ে বিশেষ ইতিহাস / লেখাপত্র নেই। বাঙালিরা দ্বীপে বাস করে না বলে অতীন অনালোচিত অথচ সমুদ্রের ভাসমান এবং কিনারার জীবন নিয়ে এত বিশদে আর বাংলায় কেউ লিখেছেন বলে জানি না। নদীকে কেন্দ্র করে যারা বেঁচে থাকে, তাদের নিয়ে আছে।
"নিশিদিন জাহাজ চলতে থাকলে ভাবাই যায় না, মানুষেরা ডাঙায় থাকে। সমুদ্রের মায়ায় ভীষণভাবে মানুষেরা পড়ে যায়। তখন বুঝি পৃথিবীতে মাটি গাছপালা পাখি বলে কিছু আছে মনে থাকে না। একনাগাড়ে ডেকে বসে থাকলে মনে হয় এক গোলাকৃতি নীল বিরাট এক টানেলের মধ্যে দিয়ে জাহাজটা নিশিদিন ছুটে যাচ্ছে যেন কোন এক অতিকায় স্পেস রকেট। রাতটাই সব সময় সমুদ্রে সবথেকে বেশি কষ্টদায়ক। কি যে গভীর অন্ধকার।"
জাহাজে কতরকমের সমুদ্রমানুষ। কোল বয়, ফায়ারম্যান, মিস্ত্রী , ছোট টিন্ডাল, পার্ক সার্কাসের সারেং, বাবুর্চি। মেসরুমমেট, মেসরুম বয় সবারই সম্বল ডেক ভান্ডারী, ইঞ্জিন ভান্ডারী। জাহাজে উঠে যারা উল্কি করায় তাদের ধারণা জাহাজের ভূত প্রেত তাদের তাড়া করে না। জাহাজ ছাড়ার সময় কার্পেন্টার ডেকে ঘোরে। হাতে পেতলের জল মাপার স্টিক। সে নোট নিচ্ছে কতটা আর জলের প্রয়োজন। জলের ট্যাংকগুলো সবই প্রায় ইঞ্জিন রুমের তলায়। মাঝদরিয়ায় জল নেই, কয়লা নেই ভাবাই যায় না। সমস্ত কেবিনের চাবি থাকে চার্টরুমে, চিফ মেটের এক্তিয়ারে।
কারুর কাজ উইঞ্চ মেশিন বা ওয়ারপিং ড্রাম নিয়ে। কারুর কাজ চার্ট দেখা, চার্ট মত জাহাজ চলছে কিনা, সকাল সন্ধ্যায় গ্রহ নক্ষত্র দেখে জাহাজের অবস্থান বোঝা। কেউ মাস্তুলের ক্রোজ নেস্টে [কাকের বাসা] উঠে যায়। তাদের থাকার জায়গা ফোকশালে [ফক্সহোল] ভীষণ গরম। পোর্ট হোলের ঘুলঘুলি বন্ধ। কাঁচ দিয়ে আঁটা। জাহাজের ক্যাপ্টেন পড়তে ভালবাসেন জেরুজালেমের প্রাচীন ইতিহাস , ট্রেজার আইল্যান্ড বা ফরাসী দেশের ছোট রাজপুত্রের গল্প যে থাকত একটা ছোট গ্রহাণুতে। তার শখ বেহালা বাজানো। ওয়েলসে বন্দরের কাছে তাদের বাড়ি।
কত সব জায়গা থেকে জাহাজীরা আসে। কারো বাড়ি সুদূর আরাকানে, কেউ ভোলা সন্দ্বীপের লোক, কেউ মেদিনীপুর, নোয়াখালি। কেউ চট্টগ্রামের সাত বংশের জাহাজী। তখনও কলের জাহাজ হয়নি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চলে কাঠের জাহাজে। কাঠ চেরাই হত কলকাতা, চিটাগাং বন্দরে। জাহাজ তৈরী করত দেশি মিস্ত্রিরা। শামীমগড়ের নৌকা চলত কর্ণফুলীর বাওড়ে। লোনা জল ডিঙিয়ে নাও যেত সুন্দরবনে। জাহাজ তৈরির কাঠ বয়ে আনত। সেই মাঝির কাজ থেকে বংশের প্রথম জাহাজী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজের ডেক সাফাইয়ের কাজ থেকে পাল খাটানোর কাজ পেয়েছিলেন। তারপর কলের জাহাজ হল। এখন ডিজেলের।
মানুষের এই সব অতিকায় জাহাজ অতি ছোট কাগজের নৌকার মত ভেসে বেড়ালে সমুদ্রের ছেলেমানুষী হাতগুলো আকাশের দিকে লাফিয়ে ওঠে। পোষা বেড়ালছানার মত ধরতে চায়। সমুদ্রপাখিরা খাবারের খোঁজে জাহাজ ধাওয়া করে। ডাঙায় নোঙর ফেললে মেজ মালোম বন্দর এলে দূরবীন দিয়ে নারী খোঁজেন, বন্দরে নামলে মাতাল মাল্লাদের পিছু নেয় দালালরা। মেয়েরা সমুদ্রমানুষদের দেখলেই চিনতে পারে। ওদের গায়ে সমুদ্রের গন্ধ লেগে থাকে, চোখে সমুদ্রের নেশা।
দেশের কথা ভাবলেই দীর্ঘ সফরগুলো ভীষণ খারাপ লাগে। সমুদ্রের নোনা জলে উঁকি দিয়ে অনুভব করে এই জলটাই তার দেশের মাটির সঙ্গে মিশে আছে। অথচ সে আজ কতদূরে। কিনারায় নেমে রাতের অন্ধকারে হেঁটে যেতে যেতে মনে হয় - "আচ্ছা সামাদ, মনে হচ্ছে না দূরে কুকুর ডাকছে ? মনে হয় না, এই মাঠের জ্যোৎস্না পার হয়ে গেলেই তোর গ্রাম পড়বে? এই মাঠের শেষেই তোদের বাড়ি ? সালিমা সেখানে কুপি জ্বেলে সরষে বেটে পুঁটিমাছ রান্না করছে ?"
খারাপ দিনের জন্য ঝড় বৃষ্টির জন্য জাহাজীদের ফোকশালে আটকে রাখা যায় না। যে কোনো অজুহাতে বন্দরের মাটি ছুঁতে পারলে তারা খুশি হয়। কারণ সমুদ্র অতিক্রম করে যে বন্দর, বন্দরের কোলাহল এবং মাটির স্পর্শ ওদের কাছে তীর্থের মত। শুধু বুড়ো নাবিকরা ফোকশালে বসে তামাক টানে আর দেশের বর্ষার জন্য, জলের জন্য মাছ শিকারের আশায় জাল বুনতে থাকে। কিনারা থেকে ফিরলে যুবক জাহাজীদের সঙ্গে বন্দরের গালগল্প করে।
গভীর নীল সমুদ্রে সাদা জ্যোৎস্নায়, সাদা জাহাজ যখন গভীর রাতে যায় তখন এক ছোট্ট সচল নগরী বা যেন জাহাজের সুন্দর সুচারু গতি দেখলে ঈশ্বরের পৃথিবীকে ভীষণ ভালবাসতে ইচ্ছে করে। তেলের জাহাজে আগুন লাগলে মনে হয় হাজার হাজার সোনার পদ্ম ভাসছে, ঢেউ এসে সেগুলো আরো ছড়িয়ে ভেঙে দেয়। আগুন ক্রমশ বিন্দুবৎ হতে হতে ফুলকি হয়ে যায়।
একঘেয়েমি কাটাতে জাহাজিরা কখনো বাচ্চা তিমি পোষে। কখনো মেয়ে ও পুরুষ চড়াইকে দেখে এক কাঠের বাক্স রেখে দেয় গলুইয়ের কাছে। পুরুষ এবং স্ত্রী আলবাট্রস পাখিরা জোড়ায় এসে বসে মাস্তুলের ওপর। মোজাম্বিকের লরেঞ্জ মারকুইস বন্দর [বর্তমানে মাপুটো] থেকে নেওয়া দুটো বাচ্চা উটপাখি, জাহাজ যখন বুয়েন্স এয়ার্স গেল তখন শীতে বরফ পড়ে মারা গেল।
বোট অসীম সমুদ্রে হারিয়ে গেলে বিচিত্র সব হ্যালুসিনেশন - কখনো মনে হয় একটা বড় ক্রস সমুদ্রে ঝুলে আছে। অতিকায় সব উড়ুক্কু মাছ ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসছে। উড়ন্ত পাখিরা হাঙরের ঝাঁক তাড়া করে নিয়ে যাচ্ছে। পাখিগুলি ধারালো ঠোঁটে হাঙরের মাংস ছিঁড়ে খাচ্ছে।
এত লম্বা সফরে সমুদ্রমানুষরা ঘুমের সময় নানা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে। তাদের স্বপ্নে একটা তিমি মাছের কঙ্কাল বড় পাইন গাছে কেউ ঝুলিয়ে রেখে যায়।
"এভাবে স্বপ্নে ম্যান্ডেলার দেশে শীত এসে যায় কখনও। বরফ পড়তে থাকে। পাইন গাছগুলো সাদা হয়ে যায়। একটা লাল রঙের বল আকাশে কেউ ছুঁড়ে দেয় তখন। বলটা গড়িয়ে নিচে পড়ে যায় না। আকাশের গায়ে লটকে থাকে সূর্যের মত। তুষারপাতের সময় কখনো মৈত্র দেখতে পায় ম্যান্ডেলা আর তার মা জানলার কাঁচ বন্ধ করে বসে আছে। তুষারপাত দেখতে দেখতে বুঝি কখনো মনে হয় মাহিমের ঘোড়া পাহাড়ে যাচ্ছে সাদা মস খেতে। বরফের ছবি ফুলের মত ভেসে থাকে জানলায়। হাত দিয়ে বারবার মুছে দিতে ভাল লাগে ম্যান্ডেলার। " [অলৌকিক জলযান]
"বর্ষাকাল। জমিতে জল। ধানক্ষেত। ধানক্ষেতের আল। নৌকা যাচ্ছে। প্রথমে কোষা নৌকা, পরে ডিঙি নৌকা, বড় বড় পানসি নাও, বজরা। ধীরে ধীরে একটা জাহাজ গেল। মেঘনার কালো জল থেকে জাহাজটা জমিতে উঠল। জাহাজিরা লগি মেরে যাচ্ছে। বাঁশঝাড়ের নিচ থেকে ঠাকুমা কাকে যেন বলছেন, আরে ওই তো তোমার হারানো ছেলে। ও ধন বৌ এসে দেখো, তোমার ছেলেটা ওই দেখো লগি ঠেলছে। বামুনের ছেলে মাঝি হয়ে গেছে। কি হবে ধন বৌ।
ঠাকুমা ও ধন বৌ জাহাজিকে দেখার জন্য আস্তে আস্তে গভীর জলে নেমে গেল। ওই জলটায় তারাও দুটো ফুটকরি তুলছে। দুটো ফুটকরি, দুটো শেষ নিশ্বাস এবং বিশ্বাসের কথা বলে আবার জলের সঙ্গে মিশে গেছে। " [সমুদ্রপাখির কান্না ]
বন্দরে নামলে কখনো তারা স্বজনের মৃত্যুর খবর পায় অথচ দেশে ফিরতে পারে না। সমুদ্রযাত্রার মধ্যেই মারা গেলে তার সঙ্গে কতগুলো কালো ভারী পাথর থলের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়। দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দেওয়া হয় থলির মুখ। পাটের থলিটা তার কফিন। পাথরগুলো ওর তৈজস। পাথরগুলো দিয়ে সে সমুদ্রের সিঁড়ি ভাঙবে। সমুদ্রের অতল অন্ধকারে নেমে যাবে ধীরে ধীরে। হাঙর তিমি অক্টপাস একটি অপরিচিত জীবকে দেখে প্রথমে আঁতকে উঠবে। পরে ওরা চোখ ট্যারা করে বলবে, রাজ্য জয় করতে বের হলে বুঝি।
নানা উপন্যাস, বড়গল্প এবং ছোটগল্পের 'সাগরজলে' সংকলনের উপাখ্যানগুলি পরপর বা একসঙ্গে পড়া যায় না। একটা শেষ করে কিছুদিন ফেলে রাখতে হয়, তারপর আবার আরেকটা পড়তে হয়, নাহলে একঘেয়ে মনে হতে পারে। এছাড়াও আখ্যানগুলির মধ্যে মিলে মিশে যাওয়া আছে, বোঝা যায় অতীন পুরোই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন। সেজন্য একটানা পড়তে গেলে আগে কোথাও পড়েছি মনে হতে পারে।
"এক দ্বীপে এক ধরনের অতিকায় প্রজাপতি। দুটো একটা প্যাঙ্গালীন, এক ধরনের চকরা বকরা পাখি সবুজ বনভূমিতে কুটির নির্মাণ করে থাকে। পাতার তৈরী খুব ছোট ঘর, বিচিত্র ফুল চালে গোঁজা। আগে না জানলে মনে হত কোনো লিলিপুট শ্রেণীর লোক এখানে বসবাস করছে। আর আছে অতিকায় সামুদ্রিক কচ্ছপদের আনাগোনা।
কিছুটা দূরে এসে জেনি দেখল দ্বীপটা ক্রমে সিঁড়ির মত নেমে গেছে। মনে হচ্ছে ভেতরে নীল জলের একটা হ্রদ আছে। গাছপালার ফাকে ফাঁকে কেমনে ঝিলমিল মরীচিকার মত ভেসে যাচ্ছে, কখনো দলে দলে মানুষের মিছিল ভেসে যাচ্ছে মনে হয় কখনো মনে হয় ওরা সব সেই প্রাচীন গন্ধ -হরিণের পাল, কেবল ধেয়ে যাচ্ছে। মরীচিকার বোধহয় কোনো মায়া থাকে। ভেতরে কেবল ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছে। কি সব হলুদ বন। দ্বীপটা সত্যি বড় নিরীহ। সত্যি বিশাল কোনো সাপখোপ নিয়ে সে ভয়াবহ হয়ে নেই।" [ধ্বনি প্রতিধ্বনি ]
"জাহাজ মধ্য আমেরিকার কিনার ছুঁয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যায় লিমন বেতে পৌঁছবে। পানামা খাল কাটা হয়েছে পাহাড়ের ওপর। জাহাজটা সমুদ্র থেকে লক প্রথায় পঁচাশি ফুটের মত উঁচু কৃত্রিম হ্রদে তুলে দেওয়া হবে। উঁচু নিচু ঢেউখেলানো সবুজ একটা পাঁচিল যেন সমুদ্রকে বেঁধে রেখেছে। বেলাভূমিতে কোনো মানুষ নেই। প্রাণী নেই। কোনো জেলেডিঙি মাছ ধরছে না। সমুদ্র এখানে শান্ত, কোনো তাড়া নেই। জাহাজিরা জাহাজ থেকে ভেজা মাটির ঘাসের সবুজ গন্ধ পাচ্ছে। হ্রদের ভিতর ছোট বড় পাহাড়ি দ্বীপ ঘন জঙ্গলে ঢাকা। কেয়া ফুলের মত একরকম ফুলের সমারোহে পাহাড়ি দ্বীপেরা হলদে রং ধরেছে। " [সমুদ্রমানুষ ]
ছ হাজার বছর আগে মানুষ ভেলায় করে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে পেরু থেকে তাহিতিতে গেছিল। নিউ প্লিমাউথ বন্দরে নামার পর পুকেকুরা পার্ক। অকল্যান্ড থেকে ওয়েলিংটন যেতে গেলে ওয়েফোতো নদী, দুপাশে গরম জলের প্রস্রবণ। রোতোরা হ্রদের জল পাতলা বরফের চাদরে ঢাকা অথচ ধারে খালিপায়ে হাঁটা যায়। জ্যোৎস্না রাতে মাওরিদের গান ও ডিং ডিং বাজনা। পাইনের সব পাতা ঝরে যাচ্ছে। আপেলের বাগানে যারা কাজ নিয়ে এসেছিল ছুটিতে চলে যাচ্ছে। জুলাইয়ের মাঝামাঝি বরফ পড়ার আগে জাহাজগুলো ভেড়ার মাংস, গম অথবা আপেল নিয়ে তাড়াতাড়ি সমুদ্রে পাড়ি জমাবে। তা না হলে বরফ পড়লে চারপাশ বন্ধ। জাহাজগুলো বরফে আটকা পড়ে যায়। তখন একমাত্র বরফ কাটা কলের সাহায্যে এইসব জাহাজ গভীর সমুদ্রে নিয়ে যাওয়া। ছোট ছোট দ্বীপে তখন পায়ে হেঁটে বা সাইকেল চালিয়ে যাওয়া যেতে পারে। গুহার ভেতরে গ্লোওয়ার্ম গ্রোটো। [গম্বুজে হাতের স্পর্শ ]
পঞ্চাশের দশকের এই সমস্ত উপাখ্যানে কোনো কোনো বন্দরে সাদা চামড়া ছাড়া অন্য কারুর নামা বারণ। তাও সমুদ্রমানুষ লুকিয়ে কিনারা থেকে ঘুরে আসে।
"লুইজিয়ানার এই বন্দর শুধু সালফার রপ্তানির জন্য খ্যাত। বিকেলের সূর্য এবারে অস্ত যাচ্ছে। ঘন পপলারের ফাঁকে ফাঁকে সূর্যের নরম আলোতে ঘাস ফুল মাঠ হলুদ রঙের মত, তার ওপর দিয়ে ছোট ছোট ওয়ার্বলার পাখি কার্পাসের জমিতে ফিরে যাচ্ছে। ওরা বিরাট অশ্বশালার পাশ দিয়ে হাঁটছিল। ওরা পুরোনো দুর্গের মত বাড়ি অতিক্রম করে গেল। লিংকন আমলের বাড়ি। গৃহযুদ্ধে ওঁদের পূর্বপুরুষ লড়াই করেছেন। রেড ইন্ডিয়ান কর্মচারীদের পরিবৃত ন্যাশনাল স্টেটস রাইট পার্টির গোঁড়া সমর্থক এবং স্থানীয় শাখার সম্পাদক মহিলা ভারোদি। বিচিত্র সব ছবি দেয়ালে সাজানো। কোথাও রেড ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে প্রথম উপনিবেশ স্থাপনের সময়কার যুদ্ধের দলিল কোথাও বিস্তীর্ন মাঠে শান্তির বিকল্প হিসেবে কোনো নিগ্রো পুরুষের অঙ্গহানি করা হচ্ছে। এর ঠিক পরের ছবিতে একটা ঈগল পাখিকে খাবার লোভে রেটল সাপ লাফ দিচ্ছে। পাখিটা সাপটার গলা ফুটো করে দিয়েছে। চোখদুটো সাপের গাল থেকে যেন ঝুলে পড়ছে।
এ বংশের নানা বীরগাথা শোনাচ্ছিল ভারোদি। শ্বেতকায় জাতির অধঃপতন আর ওরা জার্মানি থেকে আগত, রক্তে পুরোপুরি আর্য, দাস প্রথার শেষ সুবিধাটুকু পর্যন্ত উঠে যাচ্ছে এবং বড় কষ্টকর জীবন এই শ্বেতকায় মানুষদের, জীবন মাত্রেই একে অন্যের দাস এবং এভাবেই সভ্যতা গড়ে উঠেছে। প্রাচীন সব পাথরের মধ্যে দিয়ে এক দীর্ঘ অতীতের ছবি ফুটে বেরুচ্ছিল। নৃশংস এবং ঘৃণ্য। খেতে খামারে কাজ করা নিগ্রো সবল যুবক যুবতীদের ধরে সন্তান উৎপাদনের যন্ত্রের মত ব্যবহার করা হত। পারিবারিক দাস ব্যবসা পোল্ট্রির মত। লুইজিয়ানার বহু পরিবার এভাবে প্রচুর অর্থ উপার্জন করতেন এক সময়। অথচ কি দিন কি হয়ে গেল।" [বিদেশিনী ]
'সমুদ্রে বুনোফুলের গন্ধ' উপন্যাসে একরকমের জলজ থ্রিলার লিখতে চেয়েছেন। মালবাহী জাহাজটা বিসমার্ক সাগরে যাচ্ছে বলে সবাই হতাশ। সেখানে অজস্র প্রবালদ্বীপের ছড়াছড়ি। একমাত্র নিউগিনি, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ ছাড়া তারা আর কোনো দ্বীপের নামও জানে না। অস্ট্রেলিয়ার উত্তরে জিরো থেকে বিশ ডিগ্রির মধ্যে এরকম অসংখ্য আছে। মেলানেশিয়া, সাইক্রোনেশিয়া আর পলিনেশিয়া। দ্বীপবাসীরা নিজেদের মধ্যে পিদগিন বলে ইংরেজি আর অস্ট্রেলীয় ইতর ভাষার জগাখিচুড়ি এক ভাষায় কথা বলে। এখানেই ইস্টার, গ্যালাপাগোস। ফসফেটের পাহাড়, সব বন্দরেই প্রায় জেটি বলতে কিছু নেই। জাহাজ নোঙর ফেলে রাখে। টাগবোটে মাল এলে পিপেগুলি জাহাজে তুলে নেওয়া হয়। সি ডেভিল লুকেনার এসব জায়গায় আত্মগোপন করে থাকতেন। কোনো দ্বীপ গড়ে উঠেছে আগ্নেয়গিরির লাভায়। শুধু কঠিন পাথর আর ক্যাকটাস। দুর্লভ সব কচ্ছপ। প্রাগৌতিহাসিক কালের পাখি জীবজন্তু। জাহাজ যাচ্ছে মাটি টানার কাজে। মাটি মানে ফসফেট। অজস্র পাহাড় দ্বীপ এবং লেগুনের ছড়াছড়ি। মাটি টানার কাজ আসলে অছিলা, অনেকেই জলদস্যুদের গুপ্তধনের খোঁজ করতে আসে।
প্রথম মহাযুদ্ধের আগেকার জাহাজ, লুকেনারের নৌবহরের তিনটির মধ্যে একটি, বর্তমানে যেন ইবলিশ, জিন পরীর আড্ডা। মধ্যরাতে বোট ডেকে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এতদিন জাহাজে লুকেনারের প্রেতাত্মা একাই বিরাজ করত। তিনি জলদস্যু ছিলেন, পর্তুগীজদের মত দরকারে কোরাল সমুদ্রে আত্মগোপন করে থাকতেন। জাহাজীদের বিশ্বাস সেই লুকেনারের হাড় প্রোথিত আছে এই জাহাজে। মাঝে মাঝে তাঁকে গভীর রাতে ফরওয়ার্ড পিকে দাঁড়িয়ে থাকতেও দেখা গেছে। জাহাজের ইস্পাতের চাদর কত জায়গায় 'রিপিট' মারা। তাপ্পি মারতে মারতে আসল জাহাজ আর নেই। ড্ৰাই ডকে গ্যাস কাটার দিয়ে কেবল কাটা ছেঁড়া করা হচ্ছে।
বিসমার্ক সমুদ্রটা কত জাহাজের কবরভূমি। হাড়গোড় ছাড়া তাদের আর কোনো অস্ত্বিত্ব নেই। অতিকায় বান মাছের আড্ডা। কুমিরের মত দেখতে হাজার হাজার বান মাছ কিলবিল করছে জাহাজের ইঞ্জিন রুমে। পাঁচ সাত হাজার করে সেনা জাহাজ মাইন বিস্ফোরণে উড়ে গেছে। ঝাঁকে ঝাঁকে বোমারু বিমান গোত্তা খেয়ে পড়েছে সমুদ্রে। দ্বীপগুলির চড়ায় জাহাজ উঠে গেছে, বনজঙ্গল গজিয়ে গেছে পাহাড়ের চারপাশে। যুদ্ধে নিউগিনি থেকে সলোমন দ্বীপপুঞ্জ এলাকা ছিল উত্তপ্ত। জাপ বাহিনী নিউ ব্রিটেন দ্বীপের রাবাউলে পাঁচখানা এয়ারস্ট্রীপও তৈরী করে ফেলে। নিউগিনির মোর্সবি দ্বীপে মিত্রশক্তির ওপর আক্রমণ। এই এলাকা এখন কত শান্ত। শুধু সমুদ্রের ঢেউ আর পরপয়েজ মাছের ঝাঁক। অজস্র বিষাক্ত মাছেরও ছড়াছড়ি, মাছে মাছি না বসলে খাবার উপযুক্ত ধরা হয় না। অথবা রুপোর মুদ্রা মাছে ছুঁড়ে দিলে, মাছ বিষাক্ত হলে সঙ্গে সঙ্গে মুদ্রা নীল হয়ে যাবে।
ঘোস্টস অফ ওয়ার। দ্বীপের যত্র তত্র ভাঙ্গাপোড়া সব মিলিটারি ছাউনি। বিশাল বিশাল এয়ারস্ট্রীপ অক্টপাসের মত ছড়িয়ে গেছে। মরা এয়ারস্ট্রীপ ধরে দূরের বনজঙ্গলে সহজে হারিয়ে যাওয়া যায়। স্বচ্ছ জলের পঞ্চাশ ফুট গভীরে বিমানের একটা মুন্ডু। ককপিট নানা রঙের স্পঞ্জে ঢেকে গেছে। মনে হয় গভীর জলে পাহাড়ের গোড়ায় একটা সবুজ লাল নীল ফুল ফুটে আছে। যুদ্ধের ভূতদের তৈরী কুহেলিকা।
কিনারার মেয়েদের সঙ্গে সমুদ্রমানুষরা ক্রমাগত ভালোবাসায় জড়িয়ে পড়ে। 'টুপাতি চেরী' গল্পে ইন্দোনেশীয় যুবতীর মনে হয় - "আমিও ভারতবাসী। আমার পূর্বপুরুষ ভারতবর্ষ থেকে বাণিজ্য করতে এসে এই সকল দ্বীপে থেকে গেল। আর ফিরল না। চেরীর ঠাকুমার স্মৃতি মনে পড়ল। সেই সব রাজপুত্রদের ঘোড়াসকলকে মনে পড়ল। অথবা রাক্ষসের প্রাণ রুপোর কৌটোয় সোনার ভ্রমরে, যেন পা ছিঁড়ছে হাত ছিঁড়ছে, রাক্ষসটা গড়িয়ে গড়িয়ে আসছে। অথবা নির্জন দ্বীপে রাজকন্যা নিদ্রিত, রাজপুত্র ঘোড়ায় চেপে ছুটছে, ছুটছে। বিকালের সমুদ্র পাহাড়ের ধরে ছোট ছোট মাছেরা খেলছে। নারকেল গাছের ছায়ায় ঠাকুমা ভারতবর্ষের দিকে মুখ করে বসে আছেন, যেন যথার্থই তিনি ভারতবর্ষকে, তার পিতৃপুরুষের দেশকে দেখছেন। ওরা বালিয়াড়িতে ছুটে ছুটে ক্লান্ত। ওরা ডাবের জল খেতে খেতে ঠাকুমার পাশে বালুর ওপর শুয়ে পড়ল। তখন সমুদ্রে সূর্য ডুবছে। নির্জন পাহাড়ি দ্বীপে কচ্ছপেরা ডিম পেড়ে গেল।"
বিদেশিনী উপন্যাসের শেষ দিকে জাহাজীকে স্প্যানিশ বলে বিশ্বাস করে তার সঙ্গে পালাতে উদ্যত মারিয়া - "উদার আকাশ আর উইলো ঝোপের ওয়ার্বলার পাখিরা এখন বৃষ্টিতে ভিজছে। ভারোদি নিজের জানলা খুলে দিল। বৃষ্টির ছাঁট আসছে, দেওয়ালে মৃত স্বামীর ছবি, দেওয়ালের রং মেজেন্টা, ঝড় জলে সবই এক হয়ে যাবার মত। মারিয়া তখন হালকা পাখির মত উড়ছিল। বৃষ্টি ক্রমশ ধরে আসছে। "
নিউজিল্যান্ডের গ্রামের বাসিন্দা ত্রাউস, প্রতি বছর বন্দরে জাহাজ ভিড়লে কয়েকজন ভারতবাসীকে নেমন্তন্ন করে খাওয়ান। কারণ তার পূর্বপুরুষেরা সবাই ভারতের মাটিতে সমাধিস্থ। 'ঈশ্বরীর থাবা' গল্পে জাহাজ তুষারঝড়ের মধ্যে মন্ট্রিয়লের বন্দরে দাঁড়িয়ে থাকে। 'আশ্চর্য দূরদর্শন' গল্পে জাহাজিরা দূরবীন দিয়ে নানা কাল্পনিক, ভুতুড়ে জিনিস দেখতে পায়।
'সমুদ্রযাত্রা' বলে নিবন্ধটি একরকম স্বীকারোক্তিমূলক লেখা, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'জীবন রহস্য'র মত। কলোনিতে থাকতেন, কোনোরকমে আই এ পাশ যুবক, অর্থাভাব। কিছু একটা করতে হয় বলেই জাহাজে উঠে পড়া। তার আগে হালিশহরে ট্রেনিং, ভদ্রা জাহাজে ট্রেনিং, জাহাজে ওঠার ছাড়পত্র, সিডিসি সংগ্রহ।
জাহাজ বন্দর ছাড়লেই পাখিগুলি উড়তে শুরু করে। জাহাজের সঙ্গে পাখির যেন কোনো যোগসূত্র আছে। সমুদ্রমানুষরা ঘোরে সাগর থেকে মহাসাগরে, বন্দরে বন্দরে। আর কারুর কারুর মাঝে মাঝে অজানা অচেনা দ্বীপে নেমে যেতে ইচ্ছে হয়।
"বাবা তার পুত্রের ফেরার অপেক্ষায় আছে। মা তার গাছের নীচে। অপেক্ষা, কবে তার চিঠি আসবে। কবে পুত্র বাড়ি ফিরবে। মা -বাবা তো বোঝে না, বুনো ফুলের গন্ধ টের পেলে কেউ আর বাড়ি ফেরে না। যে যার মত নদী নারী নির্জনতার খোঁজে বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়ে যায়।"
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।