৫
" আজ তোমারে দেখতে এলেম অনেক দিনের পরে"
রিকশা থেকে নেমে থই পাই না। চাষীপাড়ার পুকুরের পাড় ঘেঁষে থকথকে কাদা আর কচুগাছের ঝোপের পাশ দিয়ে যে একচিলতে পায়ে চলা পথ ছিল সেটার কোন চিহ্ন নেই।
একটা বেশ পাকাপোক্ত পিচঢালা রাস্তা, সাপের জিভের মত দুভাগ হয়ে গেছে।
শংকরের বাড়িটা এখানেই কোথাও ছিল না? ওদের বাড়িটা ছিল ছোট, একটেরে।
সামনে মথুর সর্দারের বাড়ি।
সম্পন্ন চাষী পরিবার ।পাশের দু'তিনটে বাড়িও ওদেরই।
গোটা পরিবারে মোট একুশটি ভোট। তাই ইলেক্শনের আগে মথুর সর্দারের ওজন বেড়ে যেত।
কংগ্রেস , সিপিএম-- সবারই মিষ্টি মিষ্টি কথা।
কিন্তু সে বাড়িটাও উধাও।
একটা ক্লাবঘর। তাতে ঘাসফুলের চিহ্ন আঁকা।
তবে ল্যাম্পপোস্টের গায়ে দু'একটা ছোট ছোট লালপতাকা বাঁধা, রোদে জলে কেমন ফিকে হয়ে ঘাড় গুঁজে রয়েছে।
ক্লাবের সামনে গুলতানি করা ছেলেদের জিগ্যেস করতেই দেখিয়ে দিল পাশের চারতলা ফ্ল্যাটবাড়িটা-- ওটাই মথুরপরিবারের।
কিন্তু আমিতো খুঁজছি শংকরদের বাড়ি, যেটা মথুরদের পেছনে ছিল। সেটাও পাওয়া গেল।
সেটা ভেঙেও ফ্ল্যাট উঠছে। কাঠামোটা দাঁড়িয়ে গেছে। তাতে দো'মেটের কাজ চলছে। শেষ হয়ে দখল পেতে অন্ততঃ একবছর।
ততদিন শংকরের পরিবারও মথুর সর্দারদের অ্যাপার্টমেন্টের একটি ফ্ল্যাটে থাকছে।
সিঁড়ি দিয়ে উঠে ফ্ল্যাটের গায়ে নেমপ্লেট দেখে বেল টিপতেই দরজা খুলে দিল সদ্য যৌবনের দেহলিতে কদম রাখা এক তরুণী।
আমি সসংকোচে নাম বললাম।
মেয়েটির ভ্রূপল্লবের ধনুকের ছিলায় টান পড়ল। একটু বিরক্ত মুখে বলল-- বাবা বাড়ি নেই। একটু বেরিয়েছে।
-- কখন আসবেন?
উত্তরে চোয়াল শক্ত হল।
তা জেনে তুই কী করবি রে শালা?
আমি নিরুপায়।
--- তোমার মা আছেন? একটু ডেকে দেবে? বলবে রমেনকাকু এসেছেন।
মাঝবয়সী মহিলা এসে আমাকে দেখে নমস্কার করে বললেন -ভেতরে আসুন।
সোফায় বসে জল আর বিস্কুট খেতে খেতে চারদিকে তাকিয়ে দেখি।
ভদ্রমহিলা বুঝলেন।
-- ও শ্রীকলোনী বাজারে গেছে, আধঘন্টা হল; এক্ষুণি এসে পড়বে। আপনাদের গল্প অনেক শুনেছি।
আমি একটু রান্নাঘরে যাই। চা না কফি?
যান্ত্রিক ভাবে শেষের অপশনটার নাম বলি। আর অনুরোধ করি ব্যস্ত না হতে।
উনি সহজ ভঙ্গীতে হেসে বললেন- কোন সংকোচ করবেন না, খিদে পেলে বলবেন। কেক খাবেন? আমার মেয়ে বানিয়েছে।
কাল আপনার বন্ধুর জন্মদিন ছিল। আজকের খবরের কাগজগুলো এই রইল। আর টিভি চালিয়ে দিচ্ছি। আমি আসি।
অন্যমনস্ক ভাবে চ্যানেলগুলো ঘোরাই,।
বার্সেলোনার পুরনো ম্যাচ, ক্রিকেটে শচীন-সৌরভ-দ্রাবিড়ের গৌরবগাথা, মফঃস্বলের কলেজে শাসকদলের ছাত্র ইউনিয়নের রক্তচক্ষু।
রাজনৈতিক নেতাদের বাঁধাগতের বিবৃতি।
সেদিন বাংলা বন্ধ।
নেতাজী সুভাষ রোডে ছ'নম্বর বাসের রুটে মোড়ে মোড়ে পিকেটিং।
আজকে অফিস যাওয়া চলবে না, কাকু বাড়ি ফিরে যান।
আমি, শংকর, বিমলেন্দু আরও কয়েকজন মহানন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছি। রথতলা থেকে সেকেন্ড স্কীম, সুর্যনগর, বাঁশদ্রোণী হয়ে নেতাজিনগর।
বাস বিশেষ চলছে না। যে দুটো বেরিয়েছিল তারা গোটা দুই পেটো আর আধলা ইঁট পড়তেই সুড়সুড়িয়ে গড়িয়া ডিপোতে ঢুকে গেছে।
কিছু ছেলে সাইকেলচারীদের চাকার হাওয়া খুলে দিচ্ছে।
-- হাসপাতাল ? ওষুধের দোকান? রোগী কই? ওসব চালবাজি চলবে না। আসলে সাইকেল করে অফিস যাবেন!
আরে এত বেশি প্রভুভক্ত কুকুর হবেন না। প্রতিবাদ করতে শিখুন। শিরদাঁড়া সোজা করুন।
বাঙালী খালি তেল মারতে শিখেছে। এইজন্যেই আমাদের কিস্যু হয় না।
সিগ্রেট ধরিয়ে তিনজনে ভাগাভাগি করে টানি।
-- হ্যাঁরে, মেশোমশাই আজ কী করছেন?
শংকর অন্যদিকে তাকায়। তারপরে কলকে ফাটানো গোছের ব্যোমটান দিয়ে সিগ্রেটটা প্রায় শেষ করে দিয়ে বলে--
বাবা, কাল রাত থেকেই রাইটার্সে রয়ে গেছে। আগামী কাল ফিরবে।
-- কেন রে?
-- আরে গতবারের ঘটনাটা মনে নেই? আমি বোঝালেও বুঝবে না। গোঁ ধরে বসে আছে।
আমরা চুপ মেরে যাই।
ওর বাবা বীরেশবাবু কংগ্রেসি ইউনিয়নের সদস্য। গত বাংলাবন্ধের দিনে ছেলের কথা না শুনে পায়ে হেঁটে নাকতলা থেকে রাইটার্সে গেছলেন ডিউটি করতে। ঢুকতে পারেন নি।
গেটে বাম ইউনিয়নের কিছু পিকেটার্স ওঁকে আটকে দিয়ে দুয়ো দিয়েছিল। মুখে গালে থুতু দিয়ে নকশা করে বলেছিল-- চন্দনের ফোঁটা দিয়ে সাজিয়ে দিলাম।
বীরেশবাবু বাড়ি ফিরে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। স্ত্রী কান্নাকাটি করেছিলেন।
ডাকাবুকো বড় মেয়ে চেয়েছিল বাবাকে নিয়ে যাদবপুর থানায় যেতে। নতুন ওসি সীতেশ ঝা নাকি খুব কড়া! বীরেশ রাজি হন নি।
বললেন-- ওরা যে আমার পাশের টেবিলে বসে! একসাথে চাকরি জয়েন করেছিলাম , সেই বছর কুড়ি আগে।
এবার আমরা ওঁর বাড়ি গিয়ে বলেছিলাম-- ছাড়ুন না মেশোমশায়! কত লোক সি এল নিচ্ছে, বাড়িতে বসে আছে। সন্ধ্যেবেলা পদ্মশ্রীতে সিনেমা দেখতে যাচ্ছে।
উনি রেগে গেলেন।
তোমরা বুঝবে না। তোমরা অন্ধ। নেহেরুর দেশগড়ার স্বপ্ন নিয়ে কিছু ভেবেছ? ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া পড়েছ? আর মেয়েকে লেখা চিঠিগুলো?
না। তোমরা পড়বে মাওয়ের রেডবুক। যে চীন আমাদের দেশ আক্রমণ করল, পেছন থেকে ছুরি মারল, এখনও বারোহাজার বর্গমাইল জমি দখল করে রয়েছে সে তোমাদের প্যারাডাইস।
আর সলিল চৌধুরিরও মাথা খারাপ। কী যেন একটা গান লিখেছে?
বিমলেন্দুর ফাজিল স্বভাব। আমার চোখের ইশারা দেখেও দেখল না। দু'কলি গেয়ে উঠলঃ
বলিষ্ঠ দুই হাতে তুলে নাও হাতিয়ার
রক্তের নিশান ওড়াও।
মহাচীন আর ভিয়েতনামের পথে আজ
মুক্তির কদম বাড়াও।
কারখানা প্রান্তরে নগরে ও বন্দরে
গ্রামে গ্রামে বিপ্লবের---।
-- থামো! ঢের হয়েছে।
এক ধমকে ওকে চুপ করিয়ে দিলেন বীরেশমেশো।
আমি বিরক্ত। বিমইল্যার যদি কুন আক্কল থাকে!
উনি ক্লান্ত কন্ঠে বিড়বিড় করতে লাগলেন-- এগুলো গান নয়, লোক খ্যাপানো। ছেলেছোকরাদের মাথা খাওয়া।
নিজে তো দিব্যি বোম্বে গিয়ে করে খাচ্ছেন। এদিকে এরা লেখাপড়ার পাট তুলে দিয়ে--।
কলিংবেলের আওয়াজটা কি বিচ্ছিরি!
ক্যারক্যার করে বেজে উঠেছে। উঃ, একটা ডি ডং লাগালে ভালো হত না?
বৌদি দরজা খুলে দিয়েছেন।
দু'হাতে দুটো থলে নিয়ে শংকর ঢুকেছে। তালঢ্যাঙা মানুষটি, তায় দুটো ভারি থলে। বেশ মজার দেখাচ্ছে।
-- আজকে চারাপোনাই আনলাম। জ্যান্ত। আর কচুশাক এনেছি, নারকোল দিয়ে, ভালো কাটোয়ার ডাঁটা পেয়ে গেলাম।
-- ওসব হবে’খন। আগে দেখ কে এসেছে!
ড্রইংরুমটা এল শেপের হওয়ায় ও আমাকে আগে খেয়াল করেনি।
কয়েক সেকেন্ডের নৈঃশব্দ। ও চোখ কুঁচকে মন দিয়ে দেখছে।
আমি বিব্রত। এসে কি ঠিক করিনি? ও কি খুশি হয় নি?
ওর হাতের মুঠো আলগা হয়ে বাজারের থলিটা মাটিতে পড়ে গেল।
স্খলিত পায়ে একটু টলমলিয়ে আমার দিকে এক'পা দু'পা করে এগিয়ে আসছে ছ’ফুটিয়া এক বালক চেহারার মানব।
দাড়িগোঁফ নেই। কিন্তু মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো সাদাচুল বলে দিচ্ছে বয়েসের হিসেব।
--রমেন? তুই রমেন? কতকাল পরে!
বৌদির চেহারায় টেনশন, প্রায় কান্না কান্না ভাব। দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে ওর পেছনে দাঁড়িয়ে পড়েছেন।
এর মধ্যেও খেয়াল হয় যে মহিলা স্বামীর কাঁধ পর্য্যন্ত।
আমি সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াই। দু'পা এগিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরি।
আমার পাঁচ -সাত উচ্চতায় মাথাটা প্রায় ওর বুকের মধ্যে; ও কিছু বিড়বিড় করে চলেছে।
ওকে ধরে সোফায় বসিয়ে দিই।
মহিলা এক গ্লাস জল ও একটা সাদা ট্যাবলেট ধরিয়ে দিয়েছেন। একটু একটু করে খাও, তাড়াহুড়ো কর না।
ধীরে ধীরে ওর মুখের চেহারা স্বাভাবিক হয়।
আমি হাসি। ওর দুই কাঁধে হাত রাখি। তারপর বলি-- কী রে শালা লম্বু! তাম্বু মে বাম্বু?
বৌদি বলেন-- কী বললেন?
-- কিছু না, তুমি যাও। একটু কড়া করে কফি বানিয়ে আন।
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে --আমার বৌয়ের সামনে বলিস না।
অমন হাইটের শংকর, কিন্তু ওর বাবা বীরেশবাবু ছিলেন মেরেকেটে পাঁচ দুই। তাই ভিড়ের মধ্যে চোখে পড়তেন না।
একদিন লম্বু অরবিন্দনগরের আড্ডায় অনুযোগ করল--রমেন, তোর ব্যবহারে বাবা দুঃখ পেয়েছে রে! বলেছে রমেন রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগ্রেট খায়, আমার বলার কিছু নেই।
কিন্তু আমাকে দেখে একটু আড়াল করলেও তো পারে! লুকোনোর চেষ্টাও নেই, ফুকফুক করে ধোঁয়া ছেড়েই চলে।
-- কী করব বল? তোর বাবা যে ভিড়ের মধ্যে চোখে পড়ে না।
সবাই হেসে ওঠে। শংকর অস্বস্তি লুকোয়।
-- তারপর? এদ্দিনবাদে? কী মনে করে?
-- কিছু না, দেখতে এলাম তোরা সব কেমন আছিস।
শংকর অন্যমনস্ক হয়ে যায়।
---সবাই যেমন থাকে, তাই। আলাদা করে কী আর থাকবো?
--- মেশোমশায় মাসিমা দুজনেই?
-- আর কুসুমদি? তোর দিদি?
শংকর আমার দিকে দশ সেকেন্ড তাকিয়ে থাকে, আমি চোখ সরাই না। তারপর দুজনেই হেসে ফেলি।
সেই ষাটের দশকের শেষপাদে এই পানাপুকুর-বাঁশঝাড়-আমবাগান-শেয়ালডাকা কলোনিতে কুসুমদি হৈ-চৈ ফেলে দিয়েছিল।
গোঁড়া মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে কুসুমদি পাড়ার উঠতি নায়িকা।
ওর জন্যে ছেলেছোকরার দল নিজেদের মধ্যে মারপিট করে মরত। কুসুমদি সবাইকে অকাতরে প্রশ্রয় দিত।
ওর চোখ কথা বলত, ওর হাসিতে এক মাদক গন্ধ টের পাওয়া যেত। শংকরকে ডাকতে কখনও অসময়ে ওর বাড়ি যেতাম না। কুসুমদির মুখোমুখি হতে চাইতাম না।
মনের অগোচরে পাপ নেই, বন্ধুর দিদি যে!
কুসুমদির বাস্তববুদ্ধি প্রখর ছিল। সামান্য বয়েস হতেই ও পাড়ারই নতুন সরকারি চাকরি পাওয়া একটু বোকাসোকা ছেলেটার সঙ্গে ইলোপ করে বোম্বে টোম্বে ঘুরে মালাবদল করে হাজির হল। সামাজিক মতে বিয়েটা হয়ে গেল। কিন্তু মেসোমশায় কেমন যেন নুয়ে পড়লেন।
আর পাড়ার হিংসুটে ছেলেগুলোর জ্বালায় জামাইবাবু এ'পাড়া ছেড়ে ভবানীপুরে ভাড়াবাড়িতে উঠে গেলেন।
তারপর শংকর একদিন আমাকে একলা ডেকে একগাদা চিঠিপত্র পড়তে দিল। নীল গোলাপি সাদা কাগজে লেখা অজস্র প্রেমপত্র।
বলল দিদির ড্রয়ার পরিষ্কার করতে গিয়ে পেয়েছে, বাবা মাকে দেখায় নি। পুড়িয়ে ফেলার আগে শুধু বন্ধু রমেনকে পড়তে দিয়েছে।
আমি অবাক। কি সব গদগদ ভাষা! হাস্যকর।
কিন্তু তারচেয়েও অবাক হলাম লেখকদের নাম দেখে। সবাইকে চিনি না। অনেককেই চিনি।
সব বয়সের লোকজন রয়েছে। ছোটভাই থেকে কাকার বয়েসি। কিন্তু বুকে ধক করে লাগল একজনের চিঠি দেখে, উনি আমার একজন শ্রদ্ধেয় স্থানীয় কমরেড।
আমার মাথায় কেমন দুষ্টুবুদ্ধি খেলে যায়।
--হ্যাঁ রে শংকর! এই চিঠিগুলো সত্যি পুড়িয়ে ফেলবি তো?
-- মানে? মিথ্যে পোড়ানো আবার কিছু হয় নাকি!
--- না, না! হয়ত তুই এগুলো যত্ন করে রেখে দিলি। আর কুসুমদিকে জানিয়ে দিলি যে ওগুলো তোর হেফাজতে সযত্নে রক্ষিত রয়েছে।
--ধ্যেৎ, কেন এসব বলতে যাব?
-- আজ না, ধর বেশ কিছুদিন বাদে কায়দা করে বলবি।
-- তোর কথার মাথামুন্ডু কিস্যু বুঝতে পারছি না।
-- মানে কুসুমদি এখন বিবাহিত, সুখের সংসার। বেশ প্রেমের -জোয়ারে ভাসালে- দোহারে গোছের ব্যাপার।
কিন্তু ওই চিঠিগুলো যদি তোর জামাইবাবুর হাতে পড়ে!
-- কেন পড়বে? কী যা তা বলছিস?
-- যাতে কোনদিন না পড়ে তার জন্যে কুসুমদি হয়ত তোকে বাড়ির ভাগ ছেড়ে দিতে পারে।
ওর চোখের রং মরা মাছের মত। অনেক কষ্টে শ্বাস টেনে বলে-- তোর মন এত নোংরা!
তুই আমার সম্বন্ধে এসব ভাবতে পারলি? আমি দিদিকে ব্ল্যাকমেল করব?
-- দূর বলদা! ইয়ার্কি মারছিলাম।
-- এমন ইয়ার্কি! কাল থেকে আমার বাড়িতে আর আসিস না রমেন।
'কিন্তু প্রথম যৌবনের বন্ধুত্ব অনেক উদার হয়। শংকর রমেনকে মাপ করে দিয়েছিল।
এত বছর বাদে সেই কথাটা শংকরের আদৌ মনে আছে কি?
---- প্রোমোটারকে পুরনো বাড়ি ভেঙে বহুতল তুলতে দিয়ে ক'টা ফ্ল্যাট পেলি?
--- দুটো; আমার দুই মেয়ে যে! আর কিছু টাকা। সেটা দিদিকে দিয়ে দিয়েছি।
রমেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে।সিগ্রেট ধরায়। শংকর হাত বাড়াচ্ছিল --কিন্তু শিকারী বাজের মত ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ওর স্ত্রী।
---প্লীজ, প্লীজ রমেনদা! ওকে দেবেন না। আমি হাত জোড় করছি, ওর অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি হয়ে গেছে।
রমেন থতমত খায়, শংকর যেন চুরির দায়ে ধরা পড়েছে।
খানিকক্ষণ কারো মুখেই কথা জোগায় না।
রমেন কিছু খেজুরে করার চেষ্টা করে। তার আগে দেখে নেয় বৌদি নিরাপদ দূরত্বে সরে গেছেন কি না!
--হ্যাঁরে শালা, তোর সম্বন্ধে কিছু মজার গল্প শুনেছিলাম। সত্যি নাকি? আরে বল না! বৌদি রান্নাঘরে।
কোন গল্প? শংকরের চোখ নেচে ওঠে।
-- আরে তোকে নাকি সিপিএম এর অ্যাকশন স্কোয়াড তুলে নিয়ে যাচ্ছিল, মার্ডার করবে বলে।
কিন্তু তুই নাকি ল্যাম্পপোস্ট আঁকড়ে ধরে বেঁচে গেছলি? সত্যি? জায়গাটা কোথায়?
--শালা! মাজাকি হচ্ছে? আমাকে মার্ডার করবে বলে তুলে নিয়ে যাচ্ছে সেটা তোর কাছে মজার ব্যাপার?
চুতিয়া কোথাকার !তুই শালা হারামির হাতবাক্স!
-- রেগে যাস না! তোর মত লম্বুকে নিয়ে যাচ্ছে চ্যাংদোলা করে? ভাবলেই হাসি পায়।
-- আমার সব তাতেই তোর হাসি পায়! পাবলিকলি আওয়াজ দিস, তুই আমার কিরকম বন্ধু রে?
--- অ্যাই, ফালতু কথা বলবি না, পাবলিকলি তোকে কোথায় আওয়াজ দিয়েছি?
সে তো খগেনমাস্টারের মালকে সবার সামনে 'বৌদি' বলে ডেকেছিলাম। তারপর সে কী কিচ্যেন!
-- ধ্যেৎ, সেসব ছেলেমানুষি এখনও মনে করে রেখেছিস? কাজটা ঠিক করিস নি।
-- বেঠিক কী করেছি? তুই বালের কিচ্ছু জানতিস না।
মাস্টার কোচিং চালাতে চালাতে ডুবে ডুবে জল খাচ্ছিল, ভেবেছিল শিবের বাবাও জানতে পারবে না।
এদিকে মেয়েটার নীচের তলায় ভাড়াটে এসে গেছল। নবারুণ সংঘের ভলিবল মাঠে এসে আমাদের কাছে কেঁদে পড়ল।
বাঙাল মেয়ে, বাবা-মা পাকিস্তানে; এখানে মামার বাড়িতে ঝি ছাড়িয়ে দিয়েছে।
বলল-- আপনাগো দাদা কইত্যাছি-- বইনের ইজ্জত রাখেন। আমি খগেন মাস্টারমশায়ের সঙ্গে প্র্যাম করছি, সর্বস্ব দিয়া।
আগে কইছিল বিয়া করব, আর এখন হারামজাদা খালি কথা ঘোরায়!
তুই তখন ধূপগুড়ি না রাজাভাতখাওয়া কোথায় যেন মেশোর বাড়িতে মাংস ভাত সাঁটাতে গেছলি। সেদিন খালি আমি আর বিমল ছিলাম।
ঠিক হল সবার সামনে খগামাস্টারের মুখোস খুলে দিতে হবে। মেয়েটা রাজি হল। কিচ্যেন হল।
তারপর খগা বিয়ে করতে বাধ্য হল। এবার বল!
-- কী আর বলব! হ্যাঁ, ছ'টা ছেলে আমাকে অরবিন্দনগরের দোকান থেকে গলায় ন্যাপলা ঠেকিয়ে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল, আমি বুঝলাম যে এখান থেকে নিয়ে বাঁশঝাড়টা পেরিয়ে পদ্মপুকুরের মাঠে নিয়ে ফেলতে পারলেই আমি খাল্লাস!
শীতের সন্ধ্যে, কোন শালা জানতেও পারবে না। পরের দিন সকালে কাক-চিল ঠুকরে চোখ তুলে নেবে।
কাশির দমকে ওর কথা বন্ধ হয়ে যায়।
আমি জলের গেলাস এগিয়ে দিই। ইশারা করি নীচু গলায় আস্তে আস্তে বলতে।
-- না, ওসব ল্যাম্পপোস্ট আঁকড়ে বেঁচে যাইনি। ওসব তোর জাতের যত ছ্যাবলা বন্ধুদের তৈরি চুটকি।
-- তারপর?
-- বেঁচে গেলাম বরাতজোরে। সেইসময় সুবীরদা অফিস ফেরত ছ'নম্বর বাস স্টপ থেকে হেঁটে ফিরছিল।
ব্যাপারটা দেখে আন্দাজ করে জোর গলায় বলল-- শংকর না? কী ব্যাপার রে? এরা কারা, তোকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?
হল কি, ওদের স্কোয়াডের ছেলেগুলো ছিল বে-পাড়ার,খালপাড়ের।
পরে জেনেছি-- আমাদের পাড়ার সিপিএম এর ছেলেরা রাজি হয় নি, তাই ওই বাচ্চা বাচ্চা আনকাগুলোকে পাঠিয়েছে।
দুটো কুচো রোয়াব দেখিয়ে বলল-- যান, যান! সোজা বাড়িতে ঢুকে পড়ুন, নইলে বাপের বিয়ে দেখিয়ে দেব।
সুবীরদা কিরকম রগচটা জানিস তো!
ক্ষেপে গিয়ে বলল-- অ্যাই, এ'পাড়ায় দাঁড়িয়ে আমার সঙ্গে রঙ নিয়ে কথা! একটা আওয়াজ দিলে গোটা পাড়া বেরিয়ে এসে তোদের ছিঁড়ে ফেলবে, সেটা জানিস?
এখান থেকে বেরোতে পারবি না। ওসব ন্যাপলা-রামপুরি তোদের পেছনে ভরে দেব।
এদিকে সুবীরদার গলার চড়া আওয়াজ শুনে পিটুদা বেরিয়ে এল, তারপর অমল।
ছেলেগুলোর প্রথম অ্যাকশন বোধহয়, ঘাবড়াতে লাগল। সুবীরদা গলা উঁচু করে বলল- যদি এভাবে বেপাড়ার ছেলেরা এসে আমাদের পাড়ার ছেলেকে তুলে নিয়ে যেতে পারে তাহলে আমাদের ঘরদোর বেচে দিয়ে সন্ন্যাসী হয়ে যাওয়া উচিত। সিপিএম এর লোকজনও বেরিয়ে এল।
কিন্তু সুবীরদা নিজেই তো স্ট্রং সিপিএম। এখানে পাড়ার সেন্টু দিয়ে আমাকে বাঁচিয়ে দিল। ছেলেগুলো কেটে পড়ল।
এই হল গল্প।
আমি নির্বাক।
হ্যাঁ, ওর দিদিকে লেখা প্রেমপত্রের গোছায় সুবীরদার লেখাও ছিল, মনে আছে।
--- তারপর?
--তারপর বাবা আমাকে মাসির বাড়ি পাঠিয়ে দিল। মাসখানেকের মধ্যে যোগাযোগ করে পার্টির শেলটারে পালিয়ে গেলাম। মার তখনই বুকের ফিক ব্যথাটা বেড়ে গেল।
বহুদিন কোলকাতার বাইরে ছিলাম। শেলটারগুলো এক এক করে ভেঙে যেতে লাগল। শেষে গোপনে বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করলাম।
হলদিয়ায় গিয়ে গ্র্যাজুয়েশন করে বিদ্যুৎ বিভাগের একটা অফিসে টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট হলাম।
বেশ কয়েকবছর পরে কোলকাতায় ট্রানসফার হলে রাত্তিরে যাদবপুরের ইন্ট্রিগেটেড ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে চারবছর পড়াশুনো করে ইঞ্জিনিয়ারের পোস্ট পেলাম।
একটু বয়সে বিয়ে করেছি, সংসারধম্মো করছি। ব্যস্।
--- একটা কথা বুঝতে পারছি না। এত লোক থাকতে তোকেই ওরা তুলতে এল কেন?
মানে তুই তো তখনো তেমন--।জীবনে কাউকে একটা থাপ্পড়ও মারিস নি।
ও হাত তুলে আমাকে থামায়।
-- তুইও! তুই তো শালা এ রাজ্যের বাইরে। কোলকাতার কিছুই খবর রাখিস না। তখন পদ্মপুকুর কান্ড হয়ে গেছে, শুনেছিলি কিছু?
--- কিছু একটা হবে, আবছা আবছা মনে পড়ছে। মানে তখন তো কত কিছুই ঘটছিল।
--- ব্যাগড়া না দিয়ে চুপ করে শোন তাহলে।
সিপিএম-নকশালদের মধ্যে তর্কবিতর্ক, দল থেকে বের করে দেওয়া -- এসব গোড়ায় নেতাদের মধ্যেই আটকে ছিল।
ছেলেছোকরাদের মধ্যে মতান্তর হলেও মনান্তর হয় নি।যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দেওয়ায় আমরাও দুঃখ পেয়েছিলাম।
মনে কর তুই আমাদের সকলকে নিয়ে সিপিএম এর ছাত্র প্রতিবাদ দিবস, যুব প্রতিবাদ দিবস সব্তাতেই মিছিলে গিয়েছিলি। একসাথে শ্লোগান দিয়েছিলি।
কংগ্রেসি গুন্ডাদের সম্ভাব্য আক্রমণের আশংকায় একজোট হয়ে রাতজেগে পাহারা দিয়েছিলি। তখনও অমন কৌরব-পান্ডব হাল হয় নি। রাষ্ট্রপতি শাসনেও না।
-- হুঁ!
-- হল কখন? ১৯৬৯ এর মে'দিবসে মনুমেন্ট ময়দানে কানু সান্যালের পার্টি প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করার দিন থেকে। সেই দিন পাশেই বিগ্রেড প্যারেড গ্রাউন্ডে সিপিএম এর বিরাট মিটিং। সেখান থেকে ওদের স্কোয়াডগুলো হামলা করে কানু সান্যালের মিটিং ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করল। আমাদের ছেলেরা প্রতিরোধ করল। উদোম ক্যালাকেলি! মারামারির রেশ ছড়িয়ে পড়ল ফেরার পথে, হুগলি অবদি।সেদিন থেকে দু'দলের ছেলেদের মধ্যে লক্ষ্মণরেখা টানা হয়ে গেল। শুরু হল পাড়ায় পাড়ায় এলাকা দখলের লড়াই। আজকের টিএমসি- সিপিএম এর মত। কারা অন্যদের পাড়া ছাড়া করতে পারে তার কম্পিটিশন।
সেই সময় একটা বড় ঘটনা ঘটেছিল।
বিজয়গড় লায়েলকা এলাকায় সিপিএম ছেড়ে আমাদের সমর্থক হওয়া চারটে ছেলে বাঘাযতীন -রামগড় এলাকার সিপিএম এর স্কোয়াডের হাতে ধরা পড়ল।
ওরা সকালবেলা মিছিল করে চারটে ছেলেকে পিছমোড়া করে বাঁধা অবস্থায় মারতে মারতে এনে বিধানপল্লী স্কোয়াডের হাতে তুলে দিল।
ওরা হাতের সুখ করে নাকতলা স্কোয়াডের হাতে রিলে রেসের ব্যাটন তুলে দিল। নাকতলায় বিচারসভা বসল। দলত্যাগী রেনেগেডদের বিচার।
শাস্তি ঠিক হল-- ডেথ সেন্টেন্স। যাতে অন্যেরা দলছাড়ার আগে দু'বার ভাবে। এবার যারা মিছিলে ছিল বেশিরভাগ সুট সুট করে কেটে গেল।
দশজনের জল্লাদ বাহিনী ছেলে চারটেকে মশানে নিয়ে গেল। মশান মানে ওই বাঁশঝাড়ের পেছনে পদ্মপুকুর মাঠ, এখন পুকুর নেই। ফুটবল খেলা হয়, ক্লাবঘর হয়েছে।
--- তারপর?
--- এর পরেও? শোন, সেই ১৯৬৯ এর শেষে কারও কাছেই ফায়ার আর্মস ছিল না বল্লেই হয়। তাই আধমরা ছেলেগুলোকে মাছমারার কোঁচ আর চাকু দিয়ে মেরে ফেলে রাখল।
ওদিকটায় এমনিতেই বাড়িঘর বিশেষ ছিল না। যে কয়টা ছিল তাদেরও দুয়োরে খিল। তুই কিছুই শুনিস নি?
-- মনে পড়ছে, ঠাকুমা পরে বলেছিলেন। আমাদের বাড়ির রান্নার মাসি নেপালের মা ভর দুপুরে কাঁপতে কাঁপতে এসে বলেছিল-- পদ্মপুকুরের মাঠে চাইরটা জুয়ান ছেলেরে কাইট্যা ফালাইয়া রাখছে। দুইডা মইর্যা গেছে, বাকিগুলান খাবি খাইত্যাছে। জল জল কইরতাছে, কেডা দিব?
ঠাকুমা বল্লেন-- চুপ, চুপ! রাও কইর না। ঈশ্বর মঙ্গল করুন।
আমার ধন্দ তবু কাটে না। সে না হয় হল, কিন্তু এই লম্বুটাকে ওরা কেন তুলে নিয়ে যাচ্ছিল! ও তো নকশালদের অ্যাকশন স্কোয়াডের ছেলে নয়।
আর ১৯৬৯ এর শেষের দিকে নাকতলা এলাকায় ওদের অ্যাকশন স্কোয়াড-টোয়াড কোথায়? হাতে গোণা কিছু ছেলে কাঁধে ঝোলা নিয়ে ঘোরে।
যাকে তাকে চোতা ধরিয়ে দেয়, বকবক করে। বিপ্লব নাকি ডাকপিওনের মত দরজায় এসে কড়া নাড়ছে!
লোকজন খালি চোখ কচলাছে, চোখে মুখে জল দিয়ে দরজাটা খুলছে না, এই আর কি!
শংকর অনুচ্চারিত প্রশ্নটি বুঝতে পারে। জল খায়।
ওর দৃষ্টি ব্যালকনিতে কাপড় শুকুতে দেওয়া দড়ির ওপর বসে দোল খাওয়া চড়াইটার দিকে। ওর গলা খাদে নামে।
--- হ্যাঁ, আমি একটা দোষ করেছিলাম। ওদের চোখে ক্ষমার অযোগ্য।
আমি ওদের বিচারসভায় চারটি ছেলেকে প্রাণদন্ডের আদেশ ঘোষণা করা বিচারপতি দি গ্রেট এর নাম প্রকাশ করে একটি লিফলেট এই এলাকায় বিলি করিয়েছিলাম। ওর শিরোনামে সলিল চৌধুরির একটি গানের লাইন টুকে দিয়েছিলাম-- বিচারপতি, তোমার বিচার করবে যারা---। ব্যস্।
-- কে সেই মহাপুরুষ?
--মহাপুরুষই বটে, নাম বললে পেত্যয় যাবি নে।
--বালের মত কথা বলিস না। নামটা বল।
--- জেনে কী করবি? অ্যাঁ, অ্যাদ্দিন বাদে? ওপর থেকে নীচে সব তো সাদা হয়ে গেছে। আর সেই মহাপুরুষও এখানে থাকে না।
সিদ্ধার্থ রায়ের আমলে যখন বামদের খেদিয়ে যুব কংগ্রেসের বানরসেনারা পাড়ার দখল নিচ্ছিল তখন আমাদের ফুটবল ক্লাবের গোলকীপার, আরে ওই গাম্বাট বাঁটকুল, ওনাকে রাত্তির আটটা নাগাদ এসকর্ট করে বৌদি আর বাচ্চাদুটো শুদ্ধু একটা ট্যাক্সিতে তুলে দিল।
--- ট্যাক্সি কোথায় গেল?
--কোথায় গেল আমি কী জানি! তবে পরে জেনেছি উনি বেলঘরিয়ার দিকে কোনও একটা স্কুলে পড়াচ্ছিলেন।
--- পড়াচ্ছিলেন? মানে আমাদের কোন মাস্টারমশায়?
--হ্যাঁ রে বাল! হ্যাঁ। তোর প্রিয় একজন। তুই ওঁর ফেভারিট ছিলি। ১৯৬৬'র খাদ্য আন্দোলনের সময় যখন তুই চাঁদা তুলে নুরুল ইসলাম ও আর একটি ছোট বাচ্চার স্মরণে নাকতলা স্কুলের বাগানে শহীদ বেদী বানিয়েছিলি তখন উনি বক্তৃতা দিয়েছিলেন।
বেদীটা এখনও আছে , বুঝলি। শুধু লোহার গ্রিল দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে, দেখতে যাবি নাকি?
--- ফালতু কথা ছাড়, সেদিন তিনজন স্যার বক্তব্য রেখেছিলেন। কোনজন?
--ইংরেজির স্যার।
বিশহাজার ভোল্টের শক্।
দীনেনস্যার? না, হতে পারে না। অসম্ভব।
শংকর আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে। হ্যাঁ, সেই সময়টা ।
সেই সময়ে অসম্ভব সম্ভব হয়েছিল। সেই সময়ে অন্ধেরা দলে দলে দেখতে পাচ্ছিল। আর যাদের দেখার চোখ ছিল তারা অন্ধ হয়ে যাচ্ছিল।
হ্যাঁ, পঙ্গুং লংঘয়তে গিরিং শুধু কথার কথা ছিল না। জলে শিলা ভেসে ছিল কি না জানিনা।কিন্তু বানরের গলায় গীত শোনা যাচ্ছিল।
আর কিছু বাঁজা মেয়ে গর্ভবতী হয়েছিল।
তবু দীনেনস্যার! উনি কাউকে মৃত্যুদন্ড দেবেন? এটা কী করে হয়?
ত্রিপুরা থেকে আসা ফুলশার্ট আর ধুতি পরা রোগা লম্বাটে চল্লিশ ছুঁই ছুঁই মানুষটি ছিলেন হাস্যময়, প্রাণবন্ত।
নাকতলার মোড়ে বিমলের বাবার চায়ের দোকানে বড়দের আড্ডা মাতিয়ে রাখতেন। কিশোর বয়স থেকেই উনি কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত।
বাঙাল টান সত্ত্বেও ইংরেজি ফার্স্ট পেপারটা ভালই পড়াতেন।
আর রমেনকে গল্প শোনাতেন পুরনো দিনের কমিউনিস্ট আন্দোলনের।
--- বুঝলি, রণদিভের বিপ্লব যখন ব্যর্থ হইল, কমিউনিস্ট পার্টি আর্মড স্ট্রাগল বন্ধ কইর্যা ১৯৫২র প্রথম সাধারণ নির্বাচনে ক্যান্ডিডেট দিল, তখন অন্ধ্রের থেইক্যা সরোজিনী নাইডুর আপন ভাই হারীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় আমাদের পার্টির হইয়া মেলা ভোটে জিইত্যা পার্লামেন্টে গেল, সোজা কথা না।
কিন্তু কবি মানুষ, একটু পাগল পাগল। সংসদে বইস্যা নিজের লেখা হিন্দি গান গাইত-- সূর্য অস্ত হো গয়া, গগন মস্ত হো গয়া। আর নেহেরু তারে কিছু কইত না।
-- কোন হারীন চ্যাটার্জি? ওই মেহমুদের ভূতবাংলো সিনেমার ভিলেন? কী যে বলেন স্যার!
--- আরে হ', হেই মানুষটাই।সময়ের লগে বদলাইয়া গ্যাছে।
হ্যাঁ, বেআইনি কমিউনিস্ট পার্টি আইনি হইল। তার মূল্য দিতে আর্মস সারেন্ডার করতে হইল। কিন্তু ত্রিপুরার পার্টি আর্মস সারেন্ডার করে নাই।
অগো আর্মস স্কোয়াডের নাম ছিল 'গণমুক্তি পরিষদ'। প্রত্যেক নির্বাচনের সময় ভোটের আগের দিন রাইতে গণমুক্তি পরিষদ হাতিয়ার লইয়া রুটমার্চ কইর্যা যায়।
ব্যস্, পরের দিন ভোট নিয়া আর ভাবতে হইত না। হাঃ হাঃ হাঃ।
বুঝলি রমেন, সত্য বীর্যবান।
গান্ধীর সইত্য হইল কাপুরুষের সইত্য। যীশুর সইত্য? একগালে মারলে আর এক গাল আগাইয়া দাও? এইসব ছাতামাথা কইয়া জনতারে ভুলাইয়া রাখে।
সেই দীনেনস্যার? নাঃ, সত্যি বিশ্বাস হয় না।
কেন হয় না? সময়ের সঙ্গে সবাই পালটে যেতে পারে, হারীন চাটুজ্জেও বদলে যেতে পারে, আর উনি পাথরের দেবতা?
আরো শোন। সে বছরে আরো একটা ঘটনা ঘটে।
নাকতলা স্কুলের মাঠে নবারুণ সংঘ ও খালপাড়ের মিলন সংঘের ফুটবল ম্যাচে ঝামেলা হয়।
খালপাড়ের ছেলেরা মার খেয়ে এটাকে তড়িঘড়ি সিপিএম এর সংগে মারামারির রাজনৈতিক রং লাগায়। কারণ খালপাড়ের ক্লাবটা ছিল সিপিএম এর শক্ত ঘাঁটি। আর নবারুণ সংঘ হল পাঁচমিশেলি। ওরা রাত্তিরে তিনশো ছেলে নিয়ে এসে নবারুণ সংঘের ছেলেদের ঘর থেকে টেনে বের করে বেদম পেটায়। বাসু কে এমন মারে যে কয়েক বছর ধরে চিকিৎসা করাতে হয়। এদের মাসখানেক পাড়া ছাড়া হতে হয়।
-- ধ্যেৎ! ফুটবল মাঠের মারামারি কোন শালা নতুন ঘটনা। আর তাতে রাজনৈতিক রং লাগানো? সে তো হয়েই থাকে। এর মধ্যে স্যারকে টানছিস কেন?
-- আরে শোন তো পাগলা! তোর স্কুলের বন্ধু অমলও একমাস পাড়াছাড়া ছিল। কখনও কখনও রাত্তিরে লুকিয়ে বাড়ি এসে জামাকাপড় বদলে খেয়ে যেত।
-- ওসব সেন্টু মারাস না। অমল বলে আলাদা কিছু হবে নাকি! নবারুণ সংঘের মেম্বার বলে কথা।
-- আরে শোন তো, ওর বিরুদ্ধে যাদবপুর থানায় এফ আই আর করা হল ও নাকি বোম আর রড নিয়ে হামলা করেছিল!
-- সে কি রে! অমল তো কারো সঙ্গে ঝামেলায় যায় না। স্কুলেও কখনও হাতাহাতিতে জড়ায় নি!
--- তা ঠিক, কিন্তু বড্ড একগুঁয়ে যে! ওরা মার্কসবাদী স্টাডি সার্কল শুরু করেছিল না? সেই যে রোববার রোববার পাশের প্রাইমারি স্কুল বিল্ডিংয়ে বসা? নেতাজী নগর থেকে বড় কমরেডরা ক্লাস নিতে আসতেন। তুইও তো একসময় যেতিস।
--- হ্যাঁ, চ্যাংড়া ছেলে।বয়স্কদের বেয়াড়া প্রশ্ন করে কাঠি করতে ভাল লাগত।
--- তোর সঙ্গে আমিও তো যেতাম। কিন্তু অমল যেত না। বলত -এত বড় বড় কথা আমার মাথায় ঢোকে না। কলেজের বইপত্তর নাড়াচাড়া করেই কুল পাইনে।
তখনই ওকে ওরা কড়কে দিয়েছিল, দেখে নেবে। এই ঘটনায় মওকা পেয়ে কেস খাইয়ে দিল।
--- যাঃ! এ আবার হয় নাকি? পাড়ায় ফিরল কী করে?
-- আরে অমলের ন্যাংটোবেলার বন্ধু--থার্ড স্কীমের বিশ্ব, বান্টি সিনেমার কাছে থাকে। ও তখন ক্যান্ডিডেট মেম্বার থেকে পুরোদস্তুর পার্টি মেম্বার! হেব্বি ঘ্যাম!
মাসিমা ওকে ধরলেন। ও অমলকে নিয়ে পার্টি অফিস, ক্লাব সবগুলো ঘুরল। বলল- এ আমার বন্ধু। এর গায়ে হাত তোলা মানে আমার গায়ে হাত তোলা।
ওর হাতে তখন একটা ইউনিয়ন, ওকে কে ঘাঁটাবে?
হ্যাঁ, এটা জেনে তোর ভাল লাগবে যে অমলের বিরুদ্ধে এফ আই আরটি করেছিলেন তোর শ্রদ্ধেয় মাস্টারমশাই দীনেনস্যার।
আর জানিস তো ক্রিমিন্যাল কেস সহজে পেছন ছাড়ে না। দীনেনস্যারের কোন খবর নেই।অমলও রিটায়ার করেছে।
কিন্তু পঁয়তাল্লিশ বছরের পুরনো কেসের ঠেলায় আজও ওকে বছরে দু-তিনবার গাঁটের কড়ি খরচা করে আদালতে হাজিরা লাগিয়ে নতুন তারিখ নিতে হয়।
রমেন চুপ। খানিকক্ষণ কেউ কোন কথা বলছে না। রান্নাঘর থেকে বৌদি এসে উঁকি দিয়ে গেলেন। তারপর আবার চা এল।সুগন্ধি লিকার চা।
রমেন অন্যমনস্ক ভাবে একটা সিগ্রেট ধরায়। গন্ধ বোধহয় রান্নাঘরে পৌঁছে গেছে। বৌদি বিরক্ত মুখে আরও দুটো জানলার পাল্লা খুলে পাখার স্পীড বাড়িয়ে দিয়ে গেলেন।
নাঃ, মিডিয়ার কল্যাণে সবাই প্যাসিভ স্মোকিং এর কুফলের ব্যাপারে সজাগ। রমেন সদ্য ধরানো সিগ্রেট নিভিয়ে অ্যাশ-ট্রে তে গুঁজে দেয়।
শংকর মুচকি হাসে।
-- কী হল? মাথার মধ্যে একটা বোলতা ঘুর ঘুর করছে? নাকি ঘুরঘুরে পোকা?
--বোলতা।
--- ছাড় ওসব পুরনো কথা। ভেবে লাভ নেই। আজ আমরা বেঁচে বর্তে আছি, হাত-পা-চোখ-কান সবই আস্ত আছে, সেটাই মোদ্দা কথা।
আমার কথা তো অনেক শুনলি, তোর গল্প শুনি। তুই নাকি শংকর গুহনিয়োগীর মত ছত্তিশগড়ি মহিলাকে বিয়ে করেছিলি?
-- ধ্যাৎ, যত্ত বাজে কথা।কোথায় গুহনিয়োগী আর কোথায় তোর বন্ধু এই হরিদাস পাল! আমার স্ত্রী বাঙালী, তবে প্রবাসী।
-- একদিন নিয়ে আয় না! আর ছেলেমেয়ে?
রমেন হাসে।
--সেটা সম্ভব নয়।
--কেন?
--আমরা অনেকদিন আলাদা হয়ে গেছি। ও মধ্যপ্রদেশের ভোপালে, স্কুলের প্রিন্সিপাল।
দুই মেয়ে। ওরা মায়ের সঙ্গেই থাকে।
বছরে দুয়েকবার জন্মদিন-টিনে টেলিফোনে কথা হয়। এই পর্য্যন্ত।
--- সে কী রে! এটা কেমন হল?
--- ওদের কোন দোষ নেই। আমি ভাল স্বামী, ভাল বাবা হতে পারি নি। উড়নচন্ডে স্বভাব। হস্টেল লাইফে বেশি স্বচ্ছন্দ।
হয়ত বিয়ে করা উচিত ছিল না।
-- আচ্ছা, এরপর কার সঙ্গে দেখা করবি? বিজনদার বাড়ি যাবি? বিজয়গড় পাড়ায়? হেঁটে বা রিকশায়, যেমন বলবি।
--- তুইই বল।
--তার আগে তোর মিশনটা কী সেটা বল। এমনি খেজুরে করতে আসিস নি সেটা বুঝতে পারছি।
-- ধরেছিস ঠিকই, একটা কিছু আছে।
--ভ্যান্তারা না করে বলেই ফেল।
-- আমার মিশনের নাম--ফেরারি ফৌজ।
শংকরের হাঁ-মুখ আস্তে আস্তে বন্ধ হয়।
--তুই বলে কিছু বলছি না, নইলে বলতাম--ফোট্ শালা! অমন চোটের হাবিলদার অনেক দেখা আছে।
তা কমরেড, আপনার এই ফেরারি ফৌজে কতজন সোলজার থাকবে? কী ভেবেছেন?
--- আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি সাতজন ঘোড়সওয়ারকে।
--- সেভেন সামুরাই?
-- না, না। কোন কুরোসাওয়া প্রজেক্ট নয়। সাতজন অশ্বারোহী।
--ওরে বালস্য বাল, হরিদাস পাল! বখতিয়ার খিলজিরও তেরোজন অশ্বারোহী লেগেছিল হাড়খটখটি বুড়ো লক্ষণ সেনকে হারাতে। তোর সাতেই হয়ে যাবে?
-- আরে আমার মিশন বঙ্গবিজয় নয়, ফেরারী ফৌজ--সেটা খেয়াল করিস।
শংকর হাত উল্টে দেয়।
--তারচেয়ে বিজনদার বাড়ি চল। ও হয়ত তোর ফেরারী ফৌজের কর্নেল হতে রাজি হবে। নিদেনপক্ষে ব্রিগ্রেডিয়ার।
(চলবে)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।