কোনো ভূতের রাজার বর পেয়ে কিংবা কোনো পাথরের মূর্তির জন্য আকাশ থেকে দেশের একশো চল্লিশ কোটির মানুষের জন্য খাবার যে পড়ে না, সে কথা সম্ভবত আমাদের দেশের রাজারা বিস্মৃত হয়েছেন। ‘রাজা’ শব্দটি শুনেই হয়তো অনেকে নাক সিঁটকোচ্ছেন। কিন্তু গণতন্ত্রের নামে এই রাজতন্ত্রই যে এখন ভারতবর্ষে চলছে—সে বিষয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয়। কিন্তু ধর্মব্যাবসা এবং রাজতন্ত্র যে আমাদের এই দেশের মানুষের উপর চেপে বসেছে—তা বুঝতে আর চোখে আঙুল দিয়ে দেখাবার প্রয়োজন হবে না কারোর। ভেবে দেখুন, যে দেশে হাজার হাজার কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে রামমন্দির তৈরি হয়, বেসরকারি পুঁজিপতিদের স্বর্গরাজ্য তৈরি হয়, সে দেশে কৃষকদের উপর নেমে আসে ঘৃণ্য অত্যাচার। সেখানে কী এমন চেয়েছে কৃষকরা? তাদের দেশের রাজধানীতে প্রবেশাধিকার নেই? তাদের পথ আটকানোর জন্য এত এত কাঁটাতারের বেড়া? কাদের ভয় পেয়ে এ দেশের রাজধানীর চারিদিকে কাঁটাতারের বেড়া তৈরি হয়েছে? কাদের জন্য রাজধানীতে লাগু হয়েছে ১৪৪ ধারা?
যারা আক্ষরিক অর্থেই দেশের একশো চল্লিশ কোটি মানুষকে খেতে দেয়। দেশের খাদ্য জোগায়। অন্নের সংস্থান করে।
এমন যে আমরা আগে দেখিনি তা নয়। কৃষকদের সেই দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া যুদ্ধের সাক্ষী ছিলাম আমরা। কিন্তু তাঁদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। তাঁরা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে আবার ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজধানীর উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের রাজধানীতে ঢুকতে দেওয়া হবে না। নিশ্চয় তাঁদের গায়ের যে মাটি ও কাদার গন্ধ—তা রাজধানীতে বসে থাকা রাজাদের সহ্য হয় না। সহ্য হয় না সেই সব শাসকদের, যাঁরা দেশকে ধর্মের আফিমে বুঁদ করিয়ে রাখেন, কিন্তু যাদের গায়ের গন্ধ প্রকৃতই আমাদের রুটি দেয়, তাঁদেরকেই দূরে রাখতে হচ্ছে রাজধানী থেকে। তাঁদের রাজধানীতে প্রবেশ নিষিদ্ধ। তবে কি ভারতের যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তা অস্বীকার করা হচ্ছে? যেকোনো বিপ্লব এবং বিরোধী স্বরকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে?
রাজধানীর চারিদিকে কৃষকদের আটকানোর জন্য যে ব্যারিকেড তৈরি করা হয়েছে, তা মূলত মানুষের আন্দোলনকে রুখে দেওয়ার জন্য। আপনাদের কি মনে পড়ছে মূর্তি উন্মোচনের সময় হীরক রাজার সেই দরিদ্র কৃষক এবং পীড়িত মানুষদের তুলে নিয়ে এলাকা থেকে তাদের অস্তিত্ব মুছে দেওয়ার দৃশ্য?
সমস্যা হল, ভারতের মানুষের আত্মসম্মানবোধ হারিয়ে গিয়েছে। তাঁরা দেখতে পাচ্ছেন এ দেশে ধর্মের কদর রুটির চেয়ে বেশি। এ দেশে যারা প্রকৃতই আমাদের খেতে দিচ্ছেন, তাঁদের উপর নেমে আসছে অত্যাচার। এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পেশা কী? এ প্রশ্নের উত্তরে পুরোহিত, রাজনীতিবিদ, সেনা, বিজ্ঞানী, শ্রমিক নয়, আসবে কৃষকদের কথা। কৃষকরাই আমাদের মুখে অন্ন তুলে দিচ্ছেন। আর তাঁরাই এ দেশের রাজধানীতে ব্রাত্য। এ জন্য এ দেশের শাসকমহলে কোনও লজ্জা তো নেই, বরং শাসনের অহঙ্কার রয়েছে। রামমন্দির প্রতিষ্ঠার সময়েও আমরা দেখেছিলেম শাসকের অহঙ্কারের প্রতিষ্ঠার দৃশ্য। আর এখনো দেখছি, শাসকের অহঙ্কার বা রাজতন্ত্রের অহঙ্কার কীভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের গণতন্তের উপর অত্যাচার এবং ঘৃণা রূপে নেমে আসে।
শাসকরা হয়তো ভুলে গেছেন—এই কৃষকরাই যদি ধর্মঘট করেন, তাহলে শাসকরাও খেতে পাবেন না। ভাবুন, রাজধানীতে লোক খেতে পাচ্ছে না, শাসকদের ঘরে রুটি আসছে না। আমাদের দেশের ধার্মিক রাজারা ধর্মকে পুঁজি করেও পেট ভরে খেতে পাচ্ছেন না। সমগ্র দেশের মানুষ খেতে না পেলে কি ধর্ম দিয়ে পেট ভরাবেন? হয়তো আরো কিছুদিন ধর্মের আফিম তাদের বুঁদ করে রাখবে। তারপর? তখন কি মগজ ধোলাই করবেন, বেশি খেলে বাড়ে মেদ?
কিছুদিন আগে দেখা যাচ্ছিল ইউএস থেকে আপেল আমদানির ক্ষেত্রে সরকারের অবস্থান। একের পর এক পদক্ষেপ আমাদের ভীত করছে নাকি! আমাদের দেশ কৃষি ও কৃষকদের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। আর সেখানে কৃষকরাই উপেক্ষিত হয়ে পড়ছেন?
এই গণতন্ত্র তবে কাদের, যদি এ দেশের কৃষকরাই তাদের কণ্ঠ এবং মৌলিক অধিকার নিয়ে এদেশের গণতন্ত্রের রাজধানীতে প্রবেশ করতে না পারেন? এই গণতন্ত্রের অর্থ কী, যদি তা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অন্নদাতাদের সম্মান করতে না পারে? আর এই ধর্মেরই বা অর্থ কী, যা দেশের মাটির মানুষদের মুখ থেকে অন্ন কেড়ে নেন এবং তাদের ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন? এ দেশ কাদের?
যাদের ঘাম, যাদের পরিশ্রম আমাদের রুটি দিচ্ছে, যাদের খাচ্ছি, যাদের পরছি, তাদেরকেই অপমান করলে এই শাসকরা আবার আশা কেন করবেন এ দেশের মানুষ তাদেরকেই নির্বাচিত করে এ দেশের শাসক করবে? ধর্ম সেঁকে, ধর্ম ভেজে, ধর্ম দিয়ে চচ্চড়ি তৈরি করে, ধর্মের লাশ বয়ে নিয়ে যান বরং আপনারা। ভারতের মানুষের যারা প্রকৃতই অন্নদাতা, তাদের অসম্মান করবেন না। যে ধর্ম নিয়ে এত মাতামাতি সেই ধর্মই তো আমাদের শিখিয়েছে অন্ন এবং অন্নদাতাকে অবহেলা না করতে।
সবচেয়ে অবাক লাগে মিডিয়ার অবস্থান। টেলিভিশন খুললে নিউজ চ্যানেলের রিপোর্টারদের চিৎকার চেঁচামেচি করে যেভাবে কৃষকদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথা বলছেন এবং দেখাতে চাইছেন এই কৃষকদের জন্য দেশ রসাতলে চলে যাচ্ছে, কৃষকদের জন্যই নাকি দিল্লির আজ এই অবস্থা, কৃষকদের জন্য জনগণের দুরাবস্থার শেষ নেই, কৃষকদের জন্যই দেশের অর্থনীতি রসাতলে যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি— তখন মিডিয়া নিয়েও সন্দেহাতীত সংশয় জাগে বৈকি! হাস্যাস্পদও কি নয়?
যে দেশে বিরোধীদের হত্যা করা হয়, বিরোধী কন্ঠস্বরকে দমন করা হয়, যে দেশে কৃষকদের দাবি মানার জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়, অথচ যে দেশে একবছরের মধ্যে বিশাল, বিরাট, বিপুল ঐশ্বর্যমণ্ডিত মন্দির প্রতিষ্ঠা করার জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হয়, শিল্পপতিদের ঋণ লহমায় মকুপ হয়ে যায়— সে দেশে আর যাইহোক কৃষকদের এই অবস্থা স্বাভাবিক বলেই মনে হয়।
কিন্তু তার মধ্যেও কৃষকদের এই অবস্থান আমাদের আশাবাদী করে তোলে, এই ভেবে যে ধর্মের ভেলকিবাজি তাদের দমন করতে পারেনি। নিজের স্বর তারা নিজেরা তৈরি করে নিতে পারছেন। তারা বিরুদ্ধ স্বর তুলছেন। এখন আমরা তাকিয়ে থাকবো ভবিষ্যতের দিকে। এ দেশে গণতন্ত্র তো নেই, বর্তমান রাজতন্ত্রের অবসান নিশ্চিত হবে এই ভেবে। আর আগামী দিনে রাজধানী কৃষকদের হোক।