আমার নাম শ্রাবণী এন্দ। বিয়ের পর শ্রাবণী এন্দ চৌধুরী হয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বাবা প্রয়াত হিতেন্দ্র চন্দ্র এন্দ প্রিজনে চাকরি করতেন, পটুয়াখালী জেলের সুপারিনটেন্ডেন্ট হিসাবে পোস্টেড ছিলেন। আমি ’৬৯ ব্যাচ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সাইকোলজি ডিপার্টমেন্টে পড়তাম। রোকেয়া হলে থাকতাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সৈনিকদের নৃশংস হত্যাকাণ্ড আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। আজকে আমি আমার অভিজ্ঞতার কথাগুলো বলব, আমার যন্ত্রণার কথাগুলো—যা থেকে আজও আমি মুক্তি পাইনি।
আমি রোকেয়া হলে ছিলাম। অসহযোগ আন্দোলনের সময় আমরা হলেই ছিলাম। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতেও আমরা গিয়েছিলাম। ভাষণ শুনে ফেরার পর জেনেছিলাম, সব যানবাহন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমরা যদি এখনই বাড়ি না যাই, তাহলে হয়তো আর যেতে পারব না। আমরা যারা বরিশাল পটুয়াখালীর ছাত্রছাত্রী ছিলাম, পরদিন রওয়ানা হয়ে আমরা একসাথে চলে যাই পটুয়াখালী।
সেখানে আমাদের তেমন ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। ২৫ মার্চ ঢাকায় যে ঘটনা ঘটেছে, আমরা কিছুটা শুনতে পেয়েছি—কিন্তু পরিষ্কারভাবে জানতে পারিনি। এপ্রিলের কোনো এক সময়ে, আমরা ছেলেমেয়েরা ঘরে বসে ক্যারাম খেলছিলাম। এসময় আমাদের পটুয়াখালী শহরে এয়ার অ্যাটাক হয়। চারদিকে বোমা বিস্ফোরণ ঘটতে থাকে। আমরা বুঝে উঠতে পারছিলাম না—কী করব? আমার বন্ধু পঙ্কজ বড়ুয়া, ওর বাবা ছিলেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। সে কোথাও থেকে দৌড়ে এসে বলল, ‘তোরা শিগগির বের হ, আর্মি চলে এসেছে’। আমার মা ঘরে ছিলেন, তিনিও আমাদেরকে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাও’। আমরা ৬/৭ টি ছেলেমেয়ে, আমাদের সবার বয়স ১২ থেকে ১৮-র মধ্যে। আমরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই পেছনের পথ দিয়ে। যাওয়ার সময় আমি আমার মায়ের কপালের সিঁদুর মুছে দিয়ে যাই। আমরা যেখানে থাকতাম সেখানে সব সরকারি কর্মকর্তাদের বসবাস ছিল। আর আমাদের বাড়ির পেছনে একটা শ্মশান ছিল, শ্মশানের পরেই নদী। চারদিকে তো নদী আর সমুদ্র। কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না আমাদের পটুয়াখালী থেকে। আমরা শ্মশানের দিকে গিয়ে দেখি একটা খালি নৌকা পড়ে আছে, কোনো বৈঠা নেই। আমরা তখন ঐ নৌকায় গিয়ে উঠি। দেখি—চারদিকে বোমা পড়ছে, আগুন ধরে গেছে, বড় বড় বিল্ডিংগুলো জ্বলছে। মানুষ আত্মরক্ষার জন্য নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, পাকিস্তানী বিমানগুলো নিচু হয়ে সেখানেও শেলিং করছে। এর ভেতর দিয়েই আমরা হাত দিয়ে নৌকা চালিয়ে নদীর ঐপাড়ে গিয়ে পৌঁছই। আমরা তখনো জানি না—কোথায় যাব, কোনদিকে যাব? কিছুই তো চিনি না। আমরা তখন কাঁদতে কাঁদতে হাঁটতে শুরু করি। কিছু দূর যাওয়ার পর নদী থেকে নৌকা থামিয়ে একজন আমাদের জিজ্ঞেস করেন—আমরা অমুকের ছেলে মেয়ে কিনা? ভদ্রলোক ছিলেন পঙ্কজের বাবা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের মুহুরী। এই অবস্থার মধ্যে উনি নৌকা করে বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলেন। উনি আমাদের পরিচয় জেনে নৌকায় উঠতে বলেন। আমরা তখন ওনাকে চিনতাম না, জানতাম না কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু আমাদের আর কিছু করারও ছিল না। আমরা ওনার নৌকায় উঠি। তারপর সারাদিন এই নদী, ঐ নদী ঘুরে হঠাৎ একটা জঙ্গলের ভেতর উনি মাঝিকে বলে নৌকাটাকে ঢোকান। উনি আমাদেরকে বলেন, “তোমরা এখন এখানেই থাকো, সন্ধ্যার পর আমি এসে তোমাদেরকে আমার বাড়িতে নিয়ে যাব”। উনি চাইছিলেন না যে গ্রামের মানুষ জানুক—আমরা ওনার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি।
উনি সন্ধ্যার পর আসেন এবং নৌকা নিয়ে রাতের অন্ধকারে ওনার বাড়ির ঘাটে ভেড়ান। আমাদেরকে ঘরের ভেতরে নিয়ে যান। পরে আমি বুঝতে পারি—এটা ঘরের ভেতরে আর একটা ঘর ছিল। সেখানে আমরা দশ/ বারো দিন ছিলাম। পঙ্কজের বোন ডেইজি আর আমি সমবয়সী ছিলাম। আমরা দুজনেই ছিলাম। ছেলেদেরকে ওনারা রাখতে পারেননি, ওনাদের জীবনেরও ঝুঁকি ছিল। ছেলেদেরকে ওনারা বলেছিলেন, তোমরা চলে যাও।
আমাদের দু-জনকে ভোর চারটার দিকে ওনারা তুলতেন। পুকুরে নিয়ে যেতেন। পুকুর ভর্তি জোঁক, আমরা অভ্যস্ত ছিলাম না। এর ভেতর কোনোভাবে হাত মুখ ধুয়ে ঐ ঘরে এসে ঢুকতাম, ঘরের ভেতরেই থাকতাম। জানতাম না—বাবা মা বেঁচে আছেন কিনা। কোথায় যাব, কী করব? পরে একসময় খবর পেলাম, বাবা মা বেঁচে আছেন। আর্মি এসে আমাদের বাড়িগুলোতে ঢুকেছিল। মা খুব কাঁদছিল। মাকে ওরা জিজ্ঞেস করেছিল, কী হয়েছে? মা কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, আমার মেয়ে হারিয়ে গেছে। তারপর ওরা জিজ্ঞেস করেছে, মেয়ের বয়স কত? তখন মায়ের খেয়াল হয়েছে—আসল বয়স বলা যাবে না। মা বলেছে, এই ১০/১১ বছর হবে। মাকে আবার জিজ্ঞেস করেছে, তুমি মুসলিম কিনা? মা বলেছে, হ্যাঁ।
মা ছাড়া বাকি সবাইকে কলেমা পড়িয়েছে। মাকে পড়তে বললেই ধরা পড়ে যেত এবং মেরে ফেলত। পটুয়াখালী শহরে তিন-চার হিন্দু অফিসার ছিলেন, তাঁদের প্রত্যেককে জোরপূর্বক মুসলিম নাম গ্রহণ করতে বাধ্য করেছে। মুসলিম নাম না নিলে মেরে ফেলা হবে, তাই প্রত্যেককেই এটা করতে হয়েছে। এরপর গ্রামগুলোতে শুরু হল নির্যাতন। গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া এবং গ্রাম থেকে মেয়েদের ধরে ধরে আনা। তখন ঠিক হল, যে, আমাদেরকে আমাদের বাড়িতে ফিরিয়ে দেয়া হবে। ওরা আমাদেরকে আর রাখতে পারছে না। তারপর একদিন আমাকে আর ডেইজিকে বোরকা পরিয়ে, হাতে পায়ে ছাই মাখিয়ে, ছেঁড়া শাড়ি পরিয়ে নৌকায় তুলে দেওয়া হল। আমরা আবার শহরে ফিরে এলাম। একটা জঙ্গলের কাছে নৌকা থামল। জঙ্গলটা পার হয়ে আমরা বাড়ির কাছে এলাম। কিছু পথ হাঁটি আর বোরকার নেকাব তুলে দেখি—আমাদের তো অভ্যাস নেই। বাড়ির সামনে একটা মাঠ, মাঠের ওপাশে সার্কিট হাউস। সার্কিট হাউসেই ছিল পাকিস্তান আর্মি। তারা মেশিনগান ফিট করে, বায়নোকুলার চোখে এই বাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকত। ডেইজির বাড়ি ছিল পিছনের দিকে। সে চলে গেল। আমি কী করে যাই? আর্মির চোখের সামনে দিয়ে আমাকে বাড়িতে ঢুকতে হবে। আমি তো ভয়ে আতঙ্কে অস্থির।
কোনোভাবে এগিয়ে গেলাম। ওরা হয়তো আমাকে ভিক্ষুক ভেবেছে। কোনোভাবে বাড়িতে এসেছি। আমার মা-ও আমাকে চিনতে পারেনি। দরজা খুলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি যখন ‘মা’ বলে ডাক দিয়েছি, তখন বুঝতে পেরেছে যে এটা আমি। মা আমাকে ভিতরে নিয়ে গেলেন। আমার সারা গায়ে তখন ঘা হয়ে গেছে। জোঁকের, মশার কামড়ে। মা আমাকে বাড়ির ভেতর একটা অন্ধকার ঘরে ঢোকালেন। ঐ ঘরে একটা খাট ছিল। মা আমার হাতে কেরোসিনের একটা বোতল আর দেশলাই দিলেন। বললেন, “আজ থেকে এই ঘরেই তুমি থাকবে, দরজা জানালা খোলা যাবে না”। প্রায় দশমাস আমি সূর্যের আলো দেখিনি। আমি এই ঘরে বন্দি ছিলাম। মা আমাকে বলেছিলেন, “আমাদেরকে না মেরে তোমার গায়ে কেউ হাত দিতে পারবে না। আমরা যদি না বাঁচি, তোমারও বাঁচার দরকার নাই, তুমি গায়ে আগুন লাগিয়ে দিও”। পুরো দশ মাস আমি বসে বসে এই কেরোসিনের বোতল আর দেশলাইয়ের কাঠি দেখেছি। যে কোনো মুহূর্তে আমাকে গায়ে আগুন লাগিয়ে দিতে হবে। আমি মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছি, প্রত্যেকদিন আমি মৃত্যুকে দেখেছি।
সার্কিট হাউসে মেয়েদেরকে ধরে নিয়ে আসত। রাতের বেলা আমরা চিৎকার শুনতাম। মেয়েগুলো চিৎকার করত। তখন ওখানে যে পাকিস্তানী মেজর ছিল, সম্ভবত নাদির পারভেজ নাম। সে ভীষণ নৃশংস, অত্যাচারী ও পাশবিক ছিল। এই অত্যচারের প্রধান উদ্যোক্তা ছিল সে। তারা প্রতিদিন বের হয়ে নিরীহ মানুষদের গুলি করে হত্যা করত। যেদিন বাইরে লোক পেত না, সেদিন জেলখানায় ঢুকে জেলের আসামীদের দাঁড় করিয়ে গুলি করত। বিকেলবেলা আমরা গন্ধ পেতাম। চারদিকে রক্তের গন্ধ, বারুদের গন্ধ। মৃতদেহগুলো নিয়ে নদীতে ফেলে দিত, নয়তো জায়গাতেই পুঁতে ফেলত। কত মেয়ে যে নির্যাতিত হয়েছে, মারা গেছে ঐ সার্কিট হাউজে। আমাদের বাসার উপরের তলায় থাকতেন একজন সরকারি কর্মকর্তা, তাঁর স্ত্রী ও শ্যালিকা সহ। পাকিস্তান আর্মি যেদিন পটুয়াখালি আসে, সে রাতেই ঐ দুজন ধর্ষণের শিকার হন। পরে সেই বাসায় ঐ মেজর প্রায় রাতেই আসত মদ্যপ অবস্থায়। আমরা একতলায় থাকতাম। মেজর এসে তার গাড়ি রাখত আমাদের বাসার জানালার পাশে। আমি তখন হাতে দেশলাই আর কেরোসিনের বোতল নিয়ে বিছানায় বসে ঠকঠক করে কাঁপতাম। আমার মনে হত—আমাদের দরজা ভেঙে মেজর এখনই আসবে, এখনই বোধহয় আমাকে গায়ে আগুন লাগাতে হবে।
এই অভিজ্ঞতা, এই ট্রমা আমি এখনো ভুলতে পারি না। এখনো আমি ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখি—আমার চারদিকে আগুন জ্বলছে, আমি বের হতে পারছি না। মাঝে মাঝে ভিক্ষুকের বেশে গ্রাম থেকে মেয়েরা এসে পাকিস্তানীদের খবর সংগ্রহ করত। আমার মা তাঁদেরকে কিছু খবর দিতেন, যা শুনতে পেতেন আশেপাশের মহিলাদের থেকে। আটঘর কুড়িয়ানা বলে একটা প্রসিদ্ধ জায়গা ছিল। ওখানে হিন্দুরা ছিলেন বেশি, মুক্তিযোদ্ধাদেরও ঘাঁটি ছিল। মা জানতে পেরেছিলেন—পাকিস্তানীরা আটঘর কুড়িয়ানা যাবে। ঐ মহিলাদেরকে মা এই খবর পৌঁছে দিয়েছিলেন। ফলে পাকিস্তান আর্মি ঐখানে গিয়ে ঢুকতে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধারা প্রস্তুত ছিল, বেশ কিছু আর্মি ওখানে মারাও যায়। একসময় ওরা সন্দেহ করে, যে, এই বাড়ি থেকে খবর গেছে। আমাদের বাড়িতেই টেলিফোন ছিল, আর্মি আসার পর বাবা ওটা ডিসকানেক্ট করে দিয়েছিলেন।
বাবাকে ওরা ডেকে পাঠাল সার্কিট হাউসে। আমার এখনো মনে পড়ে, বাবা আমাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে শেষ বিদায় নিয়ে গেলেন। আমরা ভাবিনি, যে, বাবা সার্কিট হাউস থেকে জীবিত অবস্থায় ফেরত আসবেন। সার্কিট হাউসে যারাই গেছে, কেউ কিন্তু ফেরত আসেনি। আমার জানালায় ভারি পর্দা থাকত, সূর্যের আলো ঢুকত না। সেদিন আমি জানালার পর্দা সরিয়ে যতদূর আমার বাবাকে দেখা যায়, দেখেছিলাম সেদিন। মনে হয়েছিল, আমার বাবাকে হয়তো আর কোনোদিন দেখব না। অনেকক্ষন পর বাবা ফিরে এলেন, সঙ্গে একজন ক্যাপ্টেন। সে আমার মায়ের সাথে কথা বলতে চায়, আমাদের ফোন দেখতে চায়। ক্যাপ্টেন এসে মাকে জিজ্ঞেস করল—“আপনি কার সাথে ফোনে কথা বলেন?”। মা বলল, “ফোনে কীভাবে কথা বলব, ফোন তো অনেকদিন থেকে নষ্ট”। তখন ক্যাপ্টেন বলল, “আপনাদের মেয়েকে ডাকুন”। এটা শুনে মা বাবা ভয় পেয়ে গেছে—মেয়েকে কেন ডাকছে?
মা আমাকে একটা নোংরা শাড়ি পরিয়ে চুল এলোমেলো করে নিয়ে এসেছে। আমাকে নাম জিজ্ঞেস করেছে। রোকেয়া হলে আমার রুমমেটের নাম মনে এসেছে, আমি বলেছি—শামীম। এরপর জানতে চেয়েছে—আমি কী পড়ি? বলেছি—আমি কিচ্ছু পড়ি না, আমি পড়াশুনা করি না। আমি বাংলায় কথা বলছিলাম। জিজ্ঞেস করেছে—ইংরেজি জানি কিনা? বলেছি, না, আমি ইংরেজি জানি না। এরপর ক্যাপ্টেন ফোনের লাইন চেক করে চলে গেল। ঐ সময়টুকু দাঁড়িয়ে থেকে যেন আমি আমার মৃত্যুকেই মুখোমুখি দেখেছি। আর কয়েক মিনিট, আর কয়েক সেকেন্ড পরেই হয়তো আমি মরে যাব।
এরকম ঘটনা প্রত্যেক ঘরে ঘরে ঘটেছে। যে নৃশংসতা এরা করে গেছে, তার বিচার তো আমরা পাইনি এখন পর্যন্ত।
তারপর যখন স্বাধীন হল, আমার বাবা সহ অন্যরা সার্কিট হাউজে গেলেন। দেখলেন ওখানে শতখানেক মেয়ে বন্দি অবস্থায়। মেয়েদের গায়ে একটা সুতাও নাই। কী অত্যাচার যে করেছে এই মেয়েগুলোর উপর দিনের পর দিন। কিছু মেয়ে হেভিলি প্র্যাগনেন্ট, কিছু মেয়ে পাগল হয়ে গেছে, কিছু মেয়ে বুঝতেই পারছে না স্বাধীনতা কী?
ওদেরকে বলা হয়েছে—আমরা স্বাধীন হয়ে গেছি। ওরা বুঝতে পারছে না কিছু। আমি নিজে দেখেছি, কোনো কোনো মেয়ে দেয়াল টপকে পালাতে চেষ্টা করছে। সামনের গেট খোলা তখন। কিন্তু গেট দিয়ে নয়, কিছু মেয়ে দেয়াল টপকে নদীতে গিয়ে ঝাঁপ দিল। আত্মহত্যা করল। ওরা জানত, ওদের পরিবার ওদেরকে নেবে না।
অনেকের পরিবারই তো শেষ পর্যন্ত নেয়নি ওদের।
অনেকেই এখন বলেন, ৩ লক্ষ মেয়ে ধর্ষিত হয়েছে। আরো বেশি মেয়ে নির্যাতিত হয়েছে, মারা গেছে। কিন্তু লুকিয়ে রাখা হয়েছে, পরিবারের সম্মানের কথা ভেবে বলা হয়নি—আসলে কী ঘটেছে? মেয়েগুলো স্রেফ হারিয়ে গেছে। রোকেয়া হলে কত মেয়ে ছিল। আজ কেউ জানে না রোকেয়া হলে কত মেয়ে অত্যাচারিত হয়েছে, কত মেয়ে ছিল সেই রাতে।
আমি যখন রোকেয়া হলে ফিরে আসি, সেটা আমার কাছে আরো বড় এক দুঃস্বপ্ন।
স্বাধীনতার পর আমি রোকেয়া হলে ফিরে আসি। এক রুমে আমরা তিনজন থাকতাম। রুমে এসে দেখি আমাদের ডেস্ক উলটাপালটা, বইপত্র ছড়ানো ছিটানো, আমার বিছানা বেয়নেটে ক্ষতবিক্ষত। রক্তাক্ত বিছানা, বড় বড় রক্তের ছোপ, ততদিনে কালো হয়ে গেছে। এখানে কোনো মেয়েকে ধরে এনে ধর্ষণ করে বেয়নেট দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সারা ঘরে রক্তের পচা গন্ধ।
এখনো আমি চোখ বন্ধ করলে সেই দৃশ্য দেখি। এখনো মনে হয়—কোন মেয়ে ছিল সে? আমরা তো মোটামুটি সবাই সবাইকে চিনতাম। এই ঘরে, এখানে—কাকে এনে হত্যা করা হয়েছে? এসবের কোনো বিচার তো আমরা পাইনি।
এখনো বিচার চাই।
পাকিস্তান আর্মির যে মেজর ছিল, সে নাকি মন্ত্রী হয়েছিল পাকিস্তানের। তাদের কোনো বিচার হয়নি এখন পর্যন্ত। আমরা কোনোদিন এদের ক্ষমা করব না। এত পাশবিকতার পরও তারা মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে।