জুনোনা আর দেওয়াড়া গেটের ওভারল্যাপিং এলাকায় সরু মাটির পথে গাড়ি ধীরে ধীরে এগোতে এগোতে একেবারে থেমে যায়। এক লাজুক ভালুক (স্লথ বেয়ার)বাঁ পাশের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে একবারে গাড়ির মুখোমুখী গুটগুটিয়ে এগিয়ে আসছে। খচাখচ ছবি তুলতে থাকি, সারথী বলেন সীটের উপরে দাঁড়িয়ে উঠতে, ছবি ভাল হবে। উত্তেজনায় খেয়ালই করি নি যে গাড়ির আধ-ঝাপসা কাচের পেছন থেকে ভালুকের ছবি বেশ ভুতুড়ে টাইপ উঠছে। অতঃপর তিড়িং করে সিটে চড়ে দাঁড়াই। পেছনের সীটের সহযাত্রীরা সকলেই দাঁড়ানো। অত খচাখচ শব্দে বিরক্ত হয়ে না লজ্জা পেয়ে কে জানে, ভালুকবাবাজি আর না এগিয়ে ঘুরে ডানদিকের জঙ্গলে ঢুকে গেলেন। জুনোনার জঙ্গল ঘন সবুজ, কত যে সবুজের শেড।
লাজুক ভালুক (Sloth Bear)
জঙ্গলের ভেতরে গাড়ির চাকায় চাকায় তৈরী হয়ে যাওয়া সরু শুঁড়িপথ ধরে চললে নাকে আসে টাটকা জঙ্গলের গন্ধ, সোঁদা জঙলি। বুক ভরে শ্বাস নিই, একটা কাঠঠোকরা তাই দেখে বেজায় ব্যস্ত হয়ে ঘন ঘন ঠোকর মারে সেগুনগাছের গুঁড়িতে। জুনোনা বাফার এলাকা তাই স্পীড লিমিট নেই, জঙ্গলে ঘুরেফিরে ৯.২০ নাগাদ রওনা দিলেও আরামসে ৯.৩০এর মধ্যে গেটে পৌঁছে যাবো। সূর্য্যের তেজ তেমন নেই কিন্তু বেশ গুমোট। ঘাম হচ্ছে ভালই। এদিক ওদিক বেশ কিছু পলাশ গাছ, সামনের বছর মার্চ এপ্রিলে আসতে হবে। এপ্রিল মে মাসে তাড়োবা আন্ধারির তাপমাত্রা ৪৭-৪৮ ডিগ্রিতেও উঠে যায়। শুনলাম মাথায় টুপি ছাড়াও মোটা করে ভেজা তোয়ালে জড়িয়ে নিয়ে বেরোয় লোকে। ক্যামেরাকেও তোয়ালে মুড়িয়ে রাখতে হয়।
বিকেলের সাফারি দেওয়াড়া গেট, জঙ্গলের একদিকে জুনোনা আর অন্যপ্রান্তে দেওয়াড়া। হোটেল থেকে আসতে গাড়িতে প্রায় মিনিট ৭-৮ লাগে। দেওয়াড়ার উল্টোদিকে রাস্তার ওপাশে দেওয়াড়া গেটের মুখোমুখী অগরজারি গেট। আবারও আইডি দেখানো, ক্যামেরার ফী দেওয়া এবং অবশেষে তিনটে নাগাদ ঢোকা। প্রতিবার ক্যামেরার ফী ২৫০/- টাকা। ক্যাশ দিতে হয়, কার্ড বা ইউপিয়াই চলে না। এযাত্রা আমাদের সারথির নাম মুরলিধর আর গাইডের নাম অর্জুন। মজা করে বলি কৃষ্ণ চালাচ্ছেন রথ আর অর্জুন পথপ্রদর্শক এযাত্রা বাঘ নিশ্চয়ই দেখা যাবে, দুটো সাফারি হয়ে গেছে বাঘছাড়াই। অর্জুন মিটিমিটি হেসে বলেন এ অঞ্চলে দাপুটে সুন্দরী বাঘিনী মধু এক সপ্তাহ হল তিনটে ছানার জন্ম দিয়েছে, তাদের এখনও চোখ ফোটে নি, থাবার মুঠো খোলে নি তাই খেয়াল রাখার জন্য গর্বিত পিতা তাড়ু আশেপাশেই ঘুরছে।
ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গায় এগোতে গিয়েও অর্জুন গাড়ি আস্তে করে থামাতে বললেন, গাছের পেছনে বাঘকে এলিয়ে বসে থাকতে দেখা গেছে। পেছনের গাড়িটাকেও ঈঙ্গিতে জানানো হল সেকথা। তাদের আর একটু এগিয়ে যাওয়ার কথা বললেও ততক্ষণে তারাও দেখেছে। কাজেই তারা সেখানেই থেমে গেল। ফলে পেছনের গাড়ির প্রত্যেকেই বাঘের শরীরের কিছুটা অংশ দেখতে পেলেও আমাদের গাড়ির পেছনের সীটের যাত্রীরাই কেবল দেখতে পাচ্ছেন। মাঝের সীটে অর্জুন ছাড়া মা ও এক সাত বছরের বাচ্চা মেয়ে। সে দিব্বি তিড়িং করে মাঝের রড টপকে পেছনের সীটে ঢুকে গেল। দেখা গেল আমি ছাড়া প্রত্যেকেই হয় ল্যাজ নয় কান নয়ত পিঠের এক খামচা মানে কিছুটা অন্তত দেখতে পাচ্ছেন। ইতোমধ্যে পেছনের গাড়ির গাইড জানিয়েছেন এ তাড়ু।
আরো খান পাঁচেক গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে গেছে আমাদের পাশে সামনে। অর্জুন বলেন ও উঠবে, উঠে রওনা হলেই আমরাও পিছু ধাওয়া করব। অতঃপর চলল ধৈর্য্যের পরীক্ষা। বাঘবাবাজি একটু গা মোচড়ালেই সবাই শ্বাস টেনে খাড়া হয়ে দাঁড়ায়। মিনিট পঁয়তাল্লিশ বাদে তিনি উঠে দাঁড়ালেন, অর্জুন পাশের গাড়ি সরাতে বললেন আমরা রওনা দেব বাঘের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। রাস্তার (মানে জঙ্গলের ভেতরের কাঁচা পথ) দিকে খানিক এগিয়ে এসে এত গাড়ি দেখে বিরক্ত হয়ে তাড়ুবাবু আবার জঙ্গলের গহীন গহনে ঢুকে গেলেন। অর্জুন কিছু নির্দেশ দিয়ে গাড়ি নিয়ে গেলেন এক জলাশয়ের পাশে, তাড়ু জঙ্গলের ভেতর দিয়ে দিয়ে এখানেই নাকি আসবে। আর সত্যিই এলোও। ধীরেসুস্থে এসে জলে নামল তারপর মুখ তুলে তাকালো।
তাড়ু - যব উই মেট (আমার প্রথম দেখা বাঘ তার স্বাভাবিক পরিবেশে) উফফ স্বাভাবিক পরিবেশে একদম খোলা জায়গায় খোলা গাড়িতে বাঘের সাথে প্রথম চোখাচোখি ... সে রোমাঞ্চ মানুষের জীবনে একবারই আসে, পরের পরের বারেরা শুধুই প্রথমবারের সাথে তূলনীয় হয়ে চলে। ততক্ষণে এখানে হাজির বাকী গাড়িগুলোও। আবারো অপেক্ষা, মাঝেমাঝে তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক দ্যাখেন আর আমরা ভাবি আরেকটু কাছে আসত যদি। এরকম ভাবেই চলল ঘন্টাখানেক। এবার বনবিভাগের গাড়িতে চেপে দুজন অফিসার এসে এক জায়গায় এতগুলো গাড়ির জটলা ভেঙে অন্যদিকে যেতে বললেন। আমরা যেহেতু সবার আগে এসেছিলাম এখন বেরোতে হবে সবার শেষে। একে একে আশে পাশের গাড়িগুলো আস্তে আস্তে ব্যাক করে বেরিয়ে যাচ্ছে ...বনবিভাগের গাড়িটাও চলে গেল।
তখনই অর্জুনের নির্দেশে আমাদের গাড়ি ব্যাক না করে আরেকটু এগিয়ে পাড় বরাবর একটা বড় ঝোপের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো। আমরা একটু রিস্ক নিয়েই থেকে গেলাম, বনবিভাগের গাড়ি দেখলে ফাইন করতে পারে। বনের রাজার জন্য এটুকু রিস্ক নেওয়াই যায়। কাটল আরো এক ঘন্টা। তিন চারটে গাড়ি আরো দু একবার এসে দেখে গেল এদিকে সন্ধ্যে হয়ে আসছে, আজ আকাশে তেমন মেঘ নেই যদিও। অবশেষে ঘন্টা দুয়েকের কিছু বেশী সময় জলে অর্ধেক ডুবে বসে থাকার ‘ধুত্তোর যথেষ্ট হয়েছে’ বলে মহারাজ গা ঝাড়া দিয়ে উঠলেন জল থেকে। আহাহা এরই অপেক্ষায় তো এতক্ষণ একঠায় দাঁড়ানো। ছবি তোলা হল। অর্জুনের ধারণা ছিল তাড়ু এবারে কালাপানি নালায় মধুর কাছে যাবে। এই কালাপানি নালাটা বেশ মজার, নীচে নালা আর মস্ত মস্ত ঘাসের জঙ্গল আর সংযোগকারী সেতুটা আসলে চন্দ্রপুর রোডের অংশ।
"ধুত্তোর যথেষ্ট হয়েছে" "এবারে ওঠা যাক" তা সে রাস্তা দিয়ে হামেশাই গাড়ি যায়, ছোট গাড়ি মূলত। ব্রিজের মাঝে মাঝে লেখা আছে জনসাধারণের গাড়ি এখানে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় ধরা পড়লে ৫০০০/- টাকা ফাইন। তবুও কয়েকটা জিপ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে দেখলেই গুটি গুটি কয়েকটা আমেজ, ইনোভা, ট্যাভেরাও দাঁড়িয়ে পড়ে। তাড়ু কিন্তু আর সেখানে এলো না, আমাদের সময় শেষ। এবার ফেরার পালা। আমার এবং আর একজনের এই প্রথম, কিন্তু বাকীদের কারো সপ্তম কারো বা একাদশবার বাঘ দেখা। সকলেই অল্পবিস্তর উত্তেজিত। কিন্তু জঙ্গলে চীৎকার করা তো ঠিক নয়। তাড়োবায় দেখলাম প্রায় সবাই মেনে চলে, কেউই জোরে কথা বলে না, ফিসফিসেই দিব্বি কাজ চলে যায়। প্রায়ান্ধকার রাস্তা, কি একটা জংলিপাতার গন্ধ, ঘরেফেরা পাখিদের কিচিমিচি আর কিছু নানা বয়সী পরিতৃপ্ত মানুষ, আজকের মত সাফারি শেষ।
আঁধার হয়ে এলো বনের পথ রইল বাকী এক। তো পরেরদিনও ভোর সাড়ে চারটেয় উঠে তৈরী আমরা। কিন্তু অন্য দুটো গাড়ি ঠিক সময়ে এলেও আমাদের গাড়ি এলো প্রায় ১৫ মিনিট দেরীতে। আজকেও দেওয়াড়া গেট। আমরা ঢুকলাম পৌনে ছটা নাগাদ। আর ঢোকার মুখেই আমাদের স্বাগত জানাল একজোড়া Gaur অর্থাৎ ইন্ডিয়ান বাইসন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গাইডের কাছে খবর এলো মধুসুন্দরী দেখা দিয়েছেন কালাপানি নালায়। দৌড় দৌড় দৌড়। অন্য একটা জিপসি কোনদিকে যেন যাচ্ছিল, আমাদের গাড়িকে দৌড়াতে দেখেই বাঁই করে ইউটার্ন নিয়ে পেছন পেছন দৌড়াতে লাগল। কিন্তু হায়, কালাপানি পৌঁছে শোনা গেল মধুরানী এক ঘাসের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে জলের কাছাকাছি এসে আরেক ঘাসের জঙ্গলে ঢুকে গেছেন। প্রথমে ঢোকা গুটি চার পাঁচ গাড়ির আরোহীরাই কেবল দেখতে পেয়েছেন। এখানে মিনিট কুড়ি অপেক্ষা করে আমরা আবার রওনা দিলাম অন্যদিকে।
গৌর (ইন্ডিয়ান বাইসন) এই রোদ চিকমিকে ঠান্ডা ঠান্ডা সকালে রাস্তা ছেড়ে আমরা ঢুকি গহীন সবুজে, মস্ত মস্ত সেগুনগাছের গায়ে কেমন বিচিত্র ছত্রাক জন্মিয়ে জটিল নকশা এঁকে রেখেছে। একগাছের গুঁড়ি থেকে আরেকগাছের ডালে ছড়িয়ে যাওয়া লতা যেন হালকা বেড়ায় আটকে রেখেছে গভীরবনের শুঁড়িপথ। সেসব জাল ছিঁড়ে জিপ এগিয়ে চলে আর ছেঁড়া লতা থেকে ইয়া লাফ দিয়ে অর্জুনগাছের গুঁড়িতে আটকে বড়সড় ছোপছোপ মাকড়শা গুল্লু গুল্লু পুঞ্জাক্ষি মেলে তাকিয়ে থাকে। গাইড জানান এইদিকে লেপার্ডের দেখা পেলেও পেতে পারি। তাড়োবায় প্রায় দেড়শো লেপার্ড আছে, তার মধ্যে একটি ব্ল্যাক প্যান্থারও আছে। প্যান্থেরা গণের এই প্রাণীটির গায়ে কালো কালো ছোপ হয় মেলানিনের আধিক্যে। ব্ল্যাক প্যান্থারকে তাদের মধ্যে মেলানিনগুরু বলা যায়। এদের গায়ে মেলানিন এতই বেশী যে একটু দূর থেকে আর ছোপটোপ কিছু দেখা যায় না, পুরোটাই কালোয় কালো।
এর টানেই বারেবারে আসা যায়
এমনিতে এই প্রাণীটিকে মহারাষ্ট্রে যেখানে সেখানে দেখা যায়। পুণেতে আমাদের হাউসিঙের পিছনের মারুঞ্জি হিলসে বছরে অন্তত একবার লেপার্ড দেখা যায়ই। আইআইটি মুম্বাইয়ের লেপার্ডদের দৌরাত্ম্য কাগজেপত্রে পড়েছেন নিশ্চয়ই। কিন্তু এদের নিজস্ব বাসস্থানে দেখা গেলে বড়ই ভাল হয়। সবুজ গভীর বন যখন ক্রমশ গিলে ফেলছে আমাদের গাড়িটাকে তখনই আবার ড্রাইভারের কাছে খবর এলো তাড়ুবাবু বেরিয়েছেন। ব্যাসস কোনমতে খানিকটা ব্যাক করিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে দে দৌড় দে দৌড়। আমরা অনেকটা অন্যদিকে ভেতরে চলে গিয়েছিলাম, স্পটে পৌঁছাতে প্রায় মিনিট দশেক লাগল। ততক্ষণ বাঘবাবাজি চলতে শুরু করেছেন। সহযাত্রীদের একসাথে জোরে শ্বাস টানার আওয়াজ শুনেই আমিও তিড়িং করে সিটের উপরে দাঁড়িয়ে পড়লাম।
এদিকটা ঘাস ছোট, লম্বা লম্বা অর্জুন আর সেগুন গাছ, নীচের দিকে পাতা প্রায় নেইই। ফলে হালকা রোদ্দুরে হলদে কালো ডোরা বেশ পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। তবে পুরো ছবি পাওয়া যাবে না। সক্কলে শাটারে হাত ছুঁইয়ে স্থির। ডানদিকে বাঘ যেতে যেতে হঠাৎ আরো ডানদিকে ঘুরে গভীর জঙ্গলে ঢুকে গেল। আর অমনি গাইডবাবুর ইশারায় ড্রাইভার গাড়িটাকে বোঁ করে বাঁদিকের জঙ্গলে ঢুকিয়ে দিলেন। ‘ম্যাডামজি ব্যায়ঠ যাইয়ে আভি গাড়ি ভাগানা হ্যায়।‘ ভাগানো বলে ভাগানো, সে একেবারে ওই শুঁড়িপথে যত জোরে চালানো সম্ভব ততটাই জোরে চালিয়েছেন। অন্য আরোহী যাঁরা সিটের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁরা তো টপাটপ বসে গেছেন। আমি তখনো সীটের উপরে দাঁড়ানো। গাড়ি ছুটছে ... হু হু করে হাওয়া আর পাতলা লতা লাগছে মুখে এসে, জঙ্গলের, গাছপালার গন্ধ ... আহা স্রেফ এই চলাটুকুর জন্যই বারেবারে ফিরে আসা যায়।
একটা অন্য জলার সামনে গিয়ে থামল গাড়ি। পেছনে পেছনে অন্য গাড়িগুলোও এসে গেছে। এবং আবার গাইডের অনুমান অভ্রান্ত প্রমাণ করে জলার উল্টোপাড়ের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে তাড়ুবাবু রীতিমত হেলেদুলে জলে নামলেন। একবার পাশ ফিরে তাকালেন ‘কী চাই হে তোমাদের?’ সমবেত মনুষ্যকূল ‘হেঁ হেঁ ভাল করে একটা ফোটো নিতাম স্যার’। পুরো পেছন ঘুরে বসলেন তিনি - ‘Talk to my a*s’.
আশে পাশে ক্রমশঃ বাড়ছে গাড়ির সংখ্যা। এদিকে তিনি বসে বসে থাবা চেটে চেটে পরিস্কার করলেন, জলে থুতনি অবধি ডুবিয়ে খানিকক্ষণ বসে রইলেন। ওদিকে পরে যে গাড়িগুলো এসেছে তাদের আরোহীরা গ্যালারির সামনে থাকা দর্শকদের দিকে একের পর এক বাড়িয়ে দিচ্ছেন নিজেদের ক্যামেরাগুলো। এক গাড়ির সীট থেকে আরেক গাড়ির বনেটে চড়ে ড্রাইভার এবং গাইডেরা পাস করছেন ক্যামেরা।
"ওফ বিরক্ত কোরো নাতো" এই করেই আমার হাতে এসেছিল একজনের ১০০-৪০০ লাগানো ক্যামেরা। সে কি লেন্স রে ভাই! বাঘের সামনের ডানপায়ের ওপরের দিকে দেখি অনেক কটা লম্বা আঁচড়ের দাগ, দিব্বি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এতক্ষণে কিছুটা অলস কৌতুহলে তিনি ফিরে তাকালেন, এতজন দর্শক দেখে এবার আমাদের দিকে ঘুরে বসলেন। গাইডদের বক্তব্য কিছুক্ষণের মধ্যেই উঠে আসবেন জল থেকে। তবে সেই কিছুক্ষণ মানে ২ মিনিট কিম্বা ২ ঘন্টা যা খুশী হতে পারে। মোটমাট মিনিট পঁয়তাল্লিশ কি পঞ্চাশ পরে জল থেকে উঠে আবার জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটা দিলেন বাঘবাবাজি আর আমরা আবারো মরি কি বাঁচি করে গাড়ি দৌড়ালাম। এবারে আর সীটে দাঁড়িয়ে থাকা গেল না। মোটা সরু নানা গাছের ডাল পটাপট লাগছে মুখে, দুয়েকটায় কাঁটাও আছে। চোখে লাগলেই চিত্তির। অতএব নেমে বসতে না বসতেই পাকা পিচের রাস্তায় পৌঁছে দাঁড়িয়ে গেল গাড়ি।
"হ্যাঁ কি ব্যপারটা কি?""নাও তোলো। কত ছবি তুলবে তোলো" রাস্তার বাঁ এবং ডান দুদিকের জঙ্গলেই অল্প করে ফাঁক রয়েছে রাস্তার এই জায়গাটায়। জানা গেল এটা বাঘেদের চলাচলের করিডোর। এবং হ্যাঁ, বাঁদিকের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে নির্বিকার দৃপ্তপদে মহারাজ রাস্তা পেরিয়ে ঢুকে গেলেন ডানদিকের জঙ্গলে। এত কাছে ... এত্ত কাছে যে খুব হালকা বেঘো গন্ধ পেলাম যেন। গাড়ি থেকে একটা ছোট্ট লাফ দিলেই একেবারে সামনে পড়া যায়। এত যে ক্যামেরা ফটাফট ছবি তুলছে তাতে কোনও ভ্রূক্ষেপই নেই। গাইডের বক্তব্য ও মধুর কাছে যাচ্ছে, আমরাও গেলাম কালাপানি। কিন্তু নাহ এখানে আর তিনি এলেন না এখন। শোনা গেল এক জায়গায় একদল বুনো কুকুর (ইন্ডিয়ান ঢোল) দেখা গেছে। কিন্তু আমরা গিয়ে আর তাদের দেখতে পেলাম না। অল্প অপেক্ষা করে ফেরার পথ ধরা গেল, সময় শেষ হয়ে আসছে।
হিজ হাইনেস রাস্তা পেরোচ্ছেন সাফারি করানোর সময় সাধারণত একটা কি দুটো কোর এলাকায় এবং বাকীগুলো বাফারে করানো হয়। বাফারের সুবিধে হল স্পীড লিমিট নেই বলে কোথাও কোনো প্রাণী দেখা গেছে খবর পেলে গাড়িগুলো অত্যন্ত দ্রুত সেখানে গিয়ে উপস্থিত হতে পারে। তাড়োবায় বাঘের সংখ্যা ২০২২ অবধি ১১৫। প্রথমবারে গিয়ে আমি দেখতে পেলাম একজনকেই। মায়া, মধু, ছোটি তারা সোনম ইত্যাদি ডাকসাইটে বাঘিনীরা কেউই দেখা দেন নি। কিন্তু একা তাড়ুই মন ভরিয়ে দিয়েছে। কোথাও একটিও প্ল্যাস্টিক র্যাপ কি বোতল এমনকি কাগজের কুচিও পড়ে থাকতে না দেখা আজকের ভারতের জনবহুল পর্যটনকেন্দ্রের পক্ষে এক অতি বিরল ঘটনা। এযাত্রায় এই পর্যন্তই। আসতে হবে আবার বারবার।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।