বগটুই হত্যাকাণ্ডের এক বছর হল। জয় গোস্বামীর 'দগ্ধ'রও প্রায় এক। এক বছর আগে সন্ধের দিকে ঘটনাটার খবর পেয়েছিলাম ফোনে, তখন আমি কলকাতা বিমানবন্দরে। কোভিড-পরীক্ষা নিয়ে ঝকমারি হচ্ছিল। অন্তত ১০জন মারা গেছেন, এইটুকু শুনেই দৌড়ে দৌড়ে প্লেনে উঠে পড়ি, তারপর ঘণ্টা চব্বিশ পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্কহীন। কোভিড-ঝামেলা মেটার পর, ঘণ্টা ষোল ধরে একটু ঘুম, একটু জাগরণের ফাঁকে-ফাঁকেই মনে হচ্ছিল, কিছু একটা করা দরকার। চব্বিশঘণ্টা পরে ফোন খুলেই যে খবর পাই, তা হল, এই কাণ্ডের পর, রাত জেগে জয় গোস্বামী লিখে ফেলেছেন এক গুচ্ছ কবিতা। গুরুর লোকেদের জানিয়েছেন সে কথা। আমরা সবাই বিভিন্ন জায়গা থেকে ফোনে কথা বলি ভারতীয় সময়ের সেই রাতে। আমি তখন অন্য এক বিমানবন্দরে। এবং তৎক্ষণাৎ স্থির হয়, এই বইটা করা দরকার। কবিতাগুলো তখনও পড়িনি যদিও। বিবৃতি হিসেবেই একটা প্রতিবাদ হওয়া দরকার, মনে হয়েছিল।
হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি কম্পোজ করা থেকে প্রচ্ছদ বানানো এবং ছাপা পর্যন্ত, পুরো কাজটা আমরা শেষ করি ৭২ ঘণ্টারও কম সময়ে। গুরুর লোকেরা ওসব পারে। হুতো পরে হিসেব করে বলেছিল, সময়টা আরও ২৪ ঘণ্টা কমানো যেত। এটা বলার কারণ এই, যে, বইটা বেরোনোর পর একদম প্রথম যে সমালোচনা কানে আসে, তা হল, এত তাড়াতাড়ি বেরোলো কী করে? আগে থেকেই তৈরি ছিল নাকি? এর উত্তরে কী বলতে হয়, আমি জানি না। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় নানা কাজকর্ম আমরা আগেও করেছি, নন্দীগ্রামের সময়ও করেছি। এবারও করলাম। এগুলো প্রতিবাদের ব্যাপার, যুদ্ধকালীন তৎপরতাই কাম্য। বাকিরা সেটা কেন মনে করেন না, বা করলেও কেন নামাতে পারেন না, সে তাঁরা বলতে পারবেন।
যা হোক, এ তো পরের কথা। বইটা প্রকাশের আগে থেকেই যা হচ্ছিল, তা খুব অদ্ভুত। আমি লম্বা যাত্রাপথ শেষ করে, বোধহয় ঘটনার ৪৮ ঘণ্টা পরে এই মর্মে খুবই ছোটো একটি লেখা লিখি, যার মর্ম ছিল, "এটা আর যাই হোক, গণতন্ত্র না"। খুবই সাধারণ লেখা, একটু আধটু গায়ে লাগলে একমাত্র সরকারপক্ষের লোকেদেরই লাগার কথা। কিন্তু অদ্ভুত হল, প্রথম তীব্র প্রতিক্রিয়া আসে বিরোধী এক পরিচিত বামদলের সদস্যের দিক থেকে, যিনি শ্রমজীবী ক্যান্টিনেরও এক নেতৃস্থানীয় পরিচিত মুখ। তিনি সরকারনিন্দার নিন্দা করে লম্বা এক লেখা লেখেন, যার প্রথমই ছিল "ধেড়েসৈকত কোত পেড়ে এক সুঢৌল ন্যাড়ের ন্যায় বিশ্লেষণ উপহার দিয়েছেন"। সুঢৌল বলে কোনো কথা হয়না। কিন্তু বানান ভুল এবং খিস্তি না করে অনেকেই আজকাল লিখতে পারেন না, এখানে তো খিস্তিও ছিল না, কাজেই আমি ভেবেছিলাম, স্মার্টনেসের চর্চা হচ্ছে। সঙ্গে একটা খটকাও ছিল, যে, রাজ্যসরকারের নিন্দেতে বিরোধীদের অসুবিধেটা একটু অদ্ভুত না? হয়তো ভুল করে, কে জানে।
বইটা বেরোনোর পর, দেখা যায়, এটা ঠিক 'ভুল' করে না। জয় গোস্বামীর লেখায় সরকারপক্ষের গায়ে লাগার কথা। কিন্তু আসলে দেখা যায়, লেগেছে কলকাতানির্ভর কিছু বামকর্মী এবং সদস্যের। বগটুই কাণ্ড চলে যায় পিছনের সারিতে, তাঁরা ইন্টারনেট জুড়ে জয় এবং গুরুচণ্ডা৯কে ট্রোল করতে নেমে পড়েন। সে সব নানা বিচিত্র দৃষ্টিকোণ। কেউ বলেন, প্রতিবাদে কবিতা কেন? রাস্তায় নামতে পারতেন। দেখা যায়, তিনি নিজেই একখানা কবিতা লিখে ছাপাতে দিয়েছেন। হয়তো সেটা পথে নেমেই লেখা, কে জানে। কেউ বলেন, কবিতায় কোনো দলের নাম নেই কেন? সবচেয়ে ভালো ব্যাপার হয়, কী করে কবিতা লিখে প্রতিবাদ করতে হয়, এই নিয়ে জয় গোস্বামীকে টিউটোরিয়াল দেওয়াও শুরু হয়। সব মিলিয়ে সে এক বিচিত্র ব্যাপার। শেষমেশ বাম দলের রাজ্য-সম্পাদককে আসরে নামতে হয়। তাতে বিষয়টা কোনোক্রমে ধামাচাপা পড়ে। পোয়েটিক জাস্টিস হয়, এর কিছুদিন পরে। 'কী করে প্রতিবাদ/কবিতা লিখিবেন' টিউটোরিয়াল যাঁরা দিয়ে ইন্টারনেটে বিতরণ করেছিলেন, তাঁদের একজন দক্ষিণ কলকাতার পুজোর স্টলে শাসক দলের কর্মীদের হাতে হেনস্থা হন। তখন আবার চারদিকে সেই নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের আহ্বান জানানো হয়, মুখ খুলতে। মুখ খুললেই আবার টিউটোরিয়াল দেওয়া হবে কিনা, জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিল, কিন্তু সে আর করা হয়নি।
সব মিলিয়ে এ এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। শাসকের বিরুদ্ধে লিখলে, শাসক ক্ষেপে যায়, কখনও উপেক্ষা করে, এ দেখা জিনিস। অনেকবার দেখেছি। শাসক প্রতিবাদের প্রকরণও নির্ধারণ করে দিতে চায়, সেও দেখেছি। কিন্তু বিরোধী, প্রতিবাদ যাদের পক্ষে যাবার কথা, আঙুল উঁচিয়ে, "এইভাবে লিখুন বলছি, চোপ!" বলে চোখ রাঙাচ্ছে—এ জিনিস দেখা একেবারে নতুন। হয় কায়েমী কোনো স্বার্থ, কিংবা নিছক নির্বুদ্ধিতা, কিংবা দুটোই – না থাকলে, এ জিনিস হওয়া কঠিন। এর মধ্যে কোনটা ছিল, বলতে পারব না। কিন্তু এইসবের চক্করে ফাঁকতালে যেটা হল, সেটা হল, বগটুই কাণ্ডটাই কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেল। বছর খানেক পরে, সে নিয়ে আর কোনো আলোচনা নেই। সিবিআই 'মূল অভিযুক্ত'কে গ্রেপ্তার করেছিল, তিনি হেফাজতেই রহস্যজনকভাবে মারা গেছেন। সে নিয়েও বিশেষ কথাবার্তা দেখি না। শাসক-বিরোধী—কোনো দিকেই। কোথায়, কী বোঝাপড়া আছে, বলা কঠিন। কিন্তু সব মিলিয়ে যেটা দাঁড়িয়েছে, যে, একটা বড় কাণ্ড, স্রেফ ধামাচাপা পড়ে গেছে। যেন ওটা ঘটেইনি। বিরোধীদের কাজ সরকারের বিরোধিতা করা। তা না করে, তাঁরা কোনো অদ্ভুত মন্ত্রে যদি সরকারবিরোধিতারই বিরোধিতা করতে শুরু করেন, এবং মিডিয়ার পিছনে দৌড়োন, তাহলে এইরকমই ভবিতব্য।
যাহোক, একবছর পরে, এইসব মনে পড়ল। এতে কিছু যায় আসে না। বহু কিছু ধামাচাপা পড়ে গেছে। এটাও যাবে। আমরা সর্বত্রই রাষ্ট্রশক্তি, ক্ষমতার উল্টোদিকে। আমরা দু-চাট্টে বই বা লেখা বার করি। করব। তাতে কিসুই হবে না হয়তো। ব্যবস্থা, মানে সিস্টেমটাই এরকম। কী আর করা যাবে।