এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক

  • দেবী পক্ষ 

    Anuradha Kunda লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ১২ মার্চ ২০২৩ | ৯০২ বার পঠিত
  • | | | |
    #দেবীপক্ষ #

    জীবনের টানে, শিল্পের টানে / রেবা রায়চৌধুরী

    সময় যত এগোচ্ছে, বিবর্তনের নিয়ম মেনে মানুষের আরো বুদ্ধিমান, আরো সপ্রতিভ হয়ে ওঠারই তো কথা? সেই গানটা? মানুষ মানুষের জন্যে? এখন সবসময়ই ধন্দে থাকি। এতো ডিগ্রী। এতো প্রযুক্তির ছড়াছড়ি। কিন্তু এই যদি সপ্রতিভতা হয়, এই যদি আধুনিকতা হয়, তবে এসবের সংজ্ঞা যা জানতাম, তা কি সব ভুল? স্মার্টনেস মানে হয়ে দাঁড়িয়েছে চমৎকার সেল্ফি তোলা। তারচে ভালো এডিট করা। সেল্ফি তোলা বিন্দুমাত্র দোষের বলছি না, তবে পাগলামি সদৃশ মাত্রাধিক্যে গন্ডগোল তো বটেই। তার চেয়েও বড় স্মার্টনেস হড়বড় করে কিছু পারি ছাই না পারি নিজেকে সবার সামনে এগিয়ে দেওয়া। এটার ভদ্র নাম নিজেকে প্রেজেন্ট করা। মানে প্ল্যাটফর্ম ক্যাপচার করা আর কি! এ কাজ যে যত অনায়াসে করতে পারে সে তত্ত স্মার্ট। ট্র্যাডিশনাল মানে হয়ে দাঁড়িয়েছে ধনতেরাস। কড়ওয়া চৌথ। (আমাদের মায়েদের কস্মিন কালে এসব করতে দেখি নি। ভালোই তো ছিলেন!) তার সঙ্গে জুটেছে বিয়েতে মেহেন্দি বা সঙ্গীত। টাকার শ্রাদ্ধ।

    যার আছে, সে করছে। যার নেই সে দুঃখে মরছে। সিঁদুরমাহাত্ম্য, মেয়েদের পতিভক্তি আর ত্যাগ মহিমান্বিত হয়ে ভার্চুয়াল জগত আলোকিত করছে। আমরা কতো আধুনিক অথচ দ্যাখো কতো "ট্র্যাডিশনাল"! এই তকমা গায়ে লাগানোর জন্য সবাই হা পিত্যেশ করে ডোভার লেন কনফারেন্স শুনতে চলে যাচ্ছে। এথনিক হচ্ছে। যেতে হয়, খেলতে হয়, নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়! ধর্মেও আছি, জিরাফেও আছি।

    রেবা রায়চৌধুরীর নাম কতো জনপ্রিয়, তাঁর কাজকর্ম কোন মাত্রার ছিল, সে বিষয়ে কোন মন্তব্য না করাই শ্রেয়। তবে বলে রাখা ভালো যে রেবা গৌতম ঘোষের "পার" ছবিতে নাসিরুদ্দিনের মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। তাঁর লেখা বই পড়ে, আপাদমস্তক এক আধুনিক মানুষকে আবিষ্কার করলাম। যার অন্য নাম সপ্রতিভতা। তাঁর জীবনসঙ্গী সজল রায়চৌধুরী। তিনি "পার" ছবিতে নাসিরুদ্দিনের বাবার ভুমিকাতে ছিলেন। রেবা অভিনয় করেছেন মৃণাল সেনের "পরশুরাম" এবং অজয় দত্তগুপ্তর "দেবীগর্জনের" মতো ছবিতে।

    দেশভাগ দেখেছেন রেবা। মধ্যবিত্ত কৃষক মহিলাদের সংগঠিত করার কাজ করেছেন। অভিনয় করেছেন, গান করেছেন গলা ছেড়ে গণনাট্য সংঘে। কাজকে জীবনের সঙ্গে এমনভাবে মিলিয়েছেন, যে রোগশয্যাতেও ব্যক্তিগত বলে কিছু নেই তাঁর। হাংরি বেঙ্গল, দুর্ভিক্ষ, তেভাগা আন্দোলনের সঙ্গে মিশে গেছে তাঁর অস্তিত্ব। উনিশশো আটচল্লিশ সালে একটি সালোয়ার কুর্তা পরিহিত মেয়ের ছবি। বাংলাদেশের রংপুরে তাঁর জন্ম। পুতুলখেলা দিয়ে জীবন শুরু বটে কিন্তু প্রসার অন্যরকম। অনেক বাঁধা। শরীরচর্চার সুযোগ শুধু দাদাদের। গানবাজনা চলবে না। সিনেমা দেখা নিষিদ্ধ পড়াশোনা। বাড়িতে পুলিশ এলে দিদি দ্রুত রিভলবার লুকিয়ে ফেলেন বুকের মধ্যে। ছোড়দা লুকিয়ে গান শেখান। গল্প শোনান। কলেজে উঠে ছাত্র আন্দোলন। সাম্যবাদ তেতাল্লিশের মহামন্বন্তর। রেবা লঙ্গরখানাতে কাজ করছেন। গান গেয়ে তারপর বক্তৃতা দিচ্ছেন। গড়ে তুলছেন মহিলা সংগঠন। ফ্যাসিবিরোধী গান গাইছেন সেই মেয়ে যার বিলেতে গিয়ে পড়াশোনা করার কথা। গণতান্ত্রিক নারী আন্দোলনের পুরোধা।

    "আমাদের সময় মেয়েদের প্রতিপদে লড়তে হত। সামাজিক ও রাজনৈতিক বিরোধিতাই শুধু নয়, কুৎসা মাড়িয়েও চলতে হত। মেয়েদের নামের কুৎসা করে পোস্টার পড়ত। আমার নামেও কুৎসা করা পোস্টারে ছেয়ে গিয়েছিল। বাড়ির লোকের বাঁধাও কম ছিল না। কিন্তু আদর্শের প্রতি এমন দুর্ধর্ষ নিষ্ঠা ছিল যে কোনো কিছুই তোয়াক্কা করিনি।" পুলিশ তাড়া করলে দৌড়ে পালিয়েছেন। রেবা তাঁর বইতে টেররিজম এর অ্যাডভেন্চার যাঁরা করেন তাঁদের সমালোচনাও করেছেন। নিজের দিদিকেও বাদ দেন নি। এই প্রকৃত আধুনিকতা। ভয়েস অফ বেঙ্গল মানে রেবা। নাটক, নাচ, গান, ব্যালে। সাধারণ জীবনযাপন আর উঁচুমানের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সারা ভারত জুড়ে কাজ করেছেন। কেন্দ্রীয় ব্যালে ট্রুপ তৈরি হল। কঠোর নিয়মানুবর্তিতা আর শৃঙ্খলা। সেই জীবনের কথা পড়ে গালে হাত দিয়ে ভাবতে হবে এমনটিও হয়? পন্ডিত রবিশঙ্কর ও অন্নপূর্ণাও ছিলেন তাঁদের স্কোয়াডে। সারা রাত রেওয়াজ করতেন। রবিশঙ্কর আসার পর কিভাবে আবহে লোকসঙ্গীত থেকে অধিক উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত এলো, তাও সুন্দর বিশ্লেষণ করেছেন রেবা। গণনাট্য আন্দোলনের বিস্তারিত বিবরণ অতি সুদক্ষ ভাবে দিয়েছেন। খুব সাধারণ ভাবে বিবাহ করেছেন। তিনি কোন রাজনীতি করতেন সেটা তাত্ত্বিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বইটির মজা তার ন্যারেটিভে। এত সহজভাবে এতসব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কথা লিখেছেন! যখন গণনাট্য শিল্পীদের কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না, দেবব্রত বিশ্বাস একা গাইছেন, মাউন্টবেটন সাহেব ও! ভাবা যায়! জেলে গেছেন। অনশন করেছেন। ফোর্সড ফিডিং হয়েছে। রাজবন্দী হয়েছেন। ছাড়া পেয়ে আবার নাটক। গান। জেনিভাতে বিশ্বনারী সম্মেলনে গিয়ে লালপাড় সাদা শাড়ি পরে সলিল চৌধুরির গান করে দর্শক মাতিয়েছেন। বিনা প্রস্তুতিতে। থিয়েটারজীবন নিয়ে লিখেছেন আলাদা অধ্যায়। সে এক মহার্ঘ জীবন। শম্ভু মিত্রের বাড়িতে দুজন কর্মী নিয়ে গিয়ে বলেছেন, এদের রাখতে হবে। শেল্টার। নাটক আর ছবিতে অভিনয়ের ভাঁটা পড়ে নি। গান শিখিয়ে জীবিকা অর্জন করেছেন। ক্যানসারে আক্রান্ত। কোনো অভিযোগ নেই। হাঁটতে পারেন না। বলছেন, এখনও অভিনয় করতে ইচ্ছে করে! নতুন হাতিয়ার তুলেছেন হাতে। লিখন।

    কি বলবো! পড়ে আশ্চর্য হয়ে যাই। এমন মানুষ! আধুনিকতার নির্মাণ করতে পারেন এঁরাই। এবং পারেন ঐতিহ্য বাঁচাতে।

    (থীমা)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | | | |
  • ধারাবাহিক | ১২ মার্চ ২০২৩ | ৯০২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ১২ মার্চ ২০২৩ ১৫:৩২517314
  • আহ কি জীবন। এরকম মানুষকেই প্রণাম করতে ইচ্ছে হয়। 
    পড়তে হবে বইটা। 
  • স্বাতী রায় | 2402:3a80:1cd0:feec:bac0:8953:d0bf:***:*** | ১২ মার্চ ২০২৩ ১৬:২১517315
  • বইটার নাম কি "জীবনের টানে/ শিল্পের টানে "? পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে। নামটুকুই  জানতাম খালি। আর আবছা আবছা কিছু কথা। ব্যস। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু প্রতিক্রিয়া দিন