১
পটলবাবুর ঘাড়ের যন্ত্রনাটা দিনদিন বাড়ছে তার ওপর অফিসের এই কাজ। পরিবার বলতে গিন্নি ও ছেলে। মাঝে সাঝে বড়দা এসে থাকেন। উনি বিয়ে থা করেননি। ডিটেক্টিভগিরি করতে করতে একটি মেমের প্রেমে পড়লেও অবশেষে তা গাঁটছড়া হয়ে দাঁড়ায়নি।
পটলবাবুর ছেলে বাদলা এবার সিক্সে উঠল। জেঠুর সাথে তারও একটু আধটু ব্যোমকেশ হবার সখ। মাঝে মাঝে কম্পিউটার স্ক্রীন বা পাঠ্যবইয়ের সামনে এলে ওর মাথার চারপাশে ছিচকেবাজিগুলো আস্কারা দিতে শুরু করে। এই নিয়ে জেঠু অবশ্য কিছুই বলেন না, তবে গন্ডগোল শুধু মা ও বাবাতে।
একদিন বিকেলে বাদলা ও তাঁর বন্ধুরা জড় হল বাগানে। পাড়ার মস্তান পিলু বক্সীর নাকি জুতো চুরি যাচ্ছে - তাই নিয়ে গোটা একমাস খুব হইচই। এ ঘটনার একটা হেস্তনেস্ত না করলেই নয়। ওরা বন্ধুরা ঠিক করল চোরটাকে খুঁজে বার করতেই হবে। তবে বাদলা যা আইডিয়া দিল তা শুনে কেউ একমত নয়। পিলুর বাড়ির চারপাশে পাহাড়া বসাতে হবে – প্রতি ঘন্টায় এক এক জন করে …
বড় জেঠু এ কাজে সাহায্যের হাত বাড়ালেন। বাদলা খুব খুশি আর বন্ধুরাও। শুরুটা তবে জেঠুকে দিয়েই হোক।
জেঠু সেদিন রাত্তিরে তাড়াতাড়ি খাওয়াদাওয়া সারলেন। তারপর একটা কালো কোট চাপিয়ে হাতে তুললেন এট্যাচি। বাদলা পাশের টেবিল থেকে অনেকক্ষণ পর্যবেক্ষণ করার পর, জিজ্ঞেস করেই বসল,
- জুতোগুলো সব এট্যাচিতে আটবেনা জেঠু? ওটা কেন নিলে?
উনি বিনা উত্তরে চশমার ফাঁক দিয়ে শুধু এক ঝলক দেখে নিলেন বাদলাকে। তারপর হন হন করে হাঁটা শুরু। সিঁড়ি ঘুরে ততক্ষণে উনি এসে পৌঁছেছেন নীচে আর বাদলাও পিছু নিল।
- আমিও যাব তোমার সাথে।
পিলু বক্সীর বাড়িটা বড় অদ্ভুত মানে এ পাড়ার সাধারণ বাড়িগুলোর মত নয়। গেট আছে তাও প্রায় না থাকারই মতন। বেশির ভাগ সময়েই হাট খোলা। বাদলা জেঠুর কানে কানে বলল,
- বাড়ির পেছনের দেওয়ালটায় লুকোই চল, চোর তো রাস্তা ধরেই আসবে!
জেঠু ওকে টিপস্ স্বরূপ বললেন,
- আজকাল চোরেরাও স্মার্ট হয় বুঝলি তাই ওরা প্যাঁচানোর চাইতে সোজা রাস্তাই বেশি পছন্দ করে।
ততক্ষণে পিলুর বাড়ির আলোগুলো টপাটপ বন্ধ হতে শুরু করেছে, এখন শুধু গেটেরটা জ্বলছে। ওতে এ বাড়ির নেমপ্লেট সহ মূখ্য দরজাটা খানিক স্পষ্ট হল যার ওপরে বক্সীবাড়ি-র বি লেখাটা টানটান বোঝা যাচ্ছে।
জেঠু এট্যাচি খুলে কি সব যেন দেখে নিল। বাদলা এতে অল্প কৌতুহল করাতে উনি ঝপাঝপ তা বন্ধ করে দিলেন তারপর টর্চ হাতে গুমটি মেরে বসে পড়লেন। বাদলাও তা দেখে বসে পড়ল। চারপাশে তখন কেউ নেই, শুধু কতকগুলো ঝিঁঝিঁপোকা এসে কান ঝালাপালা করে যাচ্ছে।
রাত্রি তখন দুটো গড়িয়ে ঘড়ি খুব জোরে এগোচ্ছিল। আর জেঠু পেছন থেকেই পাক ঘুরছিলেন বাড়িটার। ভেতর থেকে নাক ডাকার শব্দটা এবার গাঢ় হল। এদিকে বাদলাও ঘুমে প্রায় একসাড় অবস্থা। জেঠু ওকে পেয়ারা গাছটায় হেলান দিয়ে বসতে বললেন, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ও ঘুমিয়ে পড়ল।
সারা রাত মশার কামড়ে এক আধবার জেঠু বিরক্ত হচ্ছিলেন, তাও একটানা আলো ফোটা অবধি বসে রইলেন। তারপর বাদলার ডাক পড়ল।
ও ধড়ফড় করে উঠে বসল চোর ধরা গেছে ভেবে, কিন্তু জেঠুর নিরাশ ভাবখানায় আর কিছুই বলল না। এদিকে পিলু বক্সীও তখন জেগে গেছে। ভেতর থেকে তাঁর কুলকুচির শব্দ আসছে জোরে।
বাদলা জেঠুকে নিয়ে বাড়ি ফেরার উপক্রম করাতে পিলু বক্সীর পিছু ডাক শোনা গেল।
- কি হে, সারারাত এখানে ছিলে বুঝি!
বাদলা মাথা নাড়াল, আর জেঠু ঠোঁট উল্টে,
- হ্যাঁ, তবে কাজ হল না। চোর ব্যাটা হয়তো আন্দাজ পেয়ে গেছিল যে এলে তাঁর আর রক্ষে নেই।
পরদিন খুব মনমরা দেখা গেল জেঠুকে। তাঁর কেরিয়ারে এটা নাকি দ্বিতীয় ফলস্ কেস। প্রথমবার একটি বড়লোকে মেয়ের পেছনে লাগা বদমায়েশ ছেলেগুলোকে কায়দা করতে গিয়ে নিজেই বিপদে পড়েছিলেন। আর তারপর এটা। বিছানায় গুম মেরে তাই শুয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। দাদার এ অবস্থা দেখে পটলবাবু আন্দাজ করছিলেন যে কাজের ক্ষেত্রে হয়তো কিছু গন্ডগোল করে এসেছেন। এমন ভাবনায় ওনার সঙ্গ দিলেন পত্নীও।
- হ্যাঁ, কাল দাদাকে দেখেছি সেই রাত্তিরে এট্যাচি চাপিয়ে বেরোতে।
পটলবাবু ডাক্তারকে ফোন লাগালেন। উনি এসে একটা ঘুমের ইঞ্জেকশন দেওয়াতে অল্প আরাম হল। এ ঘর ও ঘর জুড়ে তখন ভাইপো আর জেঠু ঘুমাচ্ছে।
২
প্রথম কেসটাতেই এমন গাড্ডা খাবে বাদলা বুঝতে পারেনি। পিলু বক্সী মহা চাল চেলেছিল সেইবার। জুতো চুরির নামে গুজব রটিয়ে নিজের বাড়িতে পাহাড়া দিয়ে নিয়েছে গোটা কয় রাত। তবে আর নয়। বাদলার মনে পিলুর প্রতি রাগ জমতে থাকল। তাই সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, একদিন এর শোধ নিয়েই ছাড়বে।
কিন্তু বন্ধুদেরও এখন বাদলার ডিটেক্টিভগিরিতে আস্থা নেই। তাই ওসব ছেড়েছুড়ে ও এখন মন দিতে চাইছে পড়াশুনায়।
একদিন খুব সকাল সকাল জেঠুকে দেখা গেল কম্পিউটারে। খুব মনোযোগ দিয়ে তিনি কি সব যেন করছেন। বাদলা ছুট্টে এসে চেয়ার নিয়ে পাশে বসে পড়ল। স্ক্রীনে কয়েকটা হলুদ আলো একসাথে জ্বলছিল। জেঠু তা দেখে তরতরিয়ে কি সব যেন লিখলেন। তারপর একটু মুচকি হাসি দিয়ে বাদলার দিকে তাকাতেই দেখতে পেলেন ও সেটা পড়তে চাইছে।
জেঠু একটু ইতস্তত বোধ করলেন তাই বাদলাকে জল আনতে পাঠিয়ে কম্পিউটার লগঅফ করে বসলেন। এরপর বাদলা এলে তাক থেকে মোটা বইটা নামানো হল। বাদলা জিজ্ঞেস করে বসল,
- এটাতে কি আছে জেঠু?
উনি খুব গম্ভীর ভাবে পৃষ্ঠাগুলো উল্টে চললেন।
সেদিন জেঠুর পরিচয় হয়েছিল একটি মেয়ের সাথে। এমনিতেই চ্যাটরুমের মেয়েরা পদ্মপাতার মতো নরম হয়। হাসলে গড়িয়ে পড়ে যেন সহস্র কুড়ি। জেঠুরও খুব ভালো লেগে গেল মেয়েটিকে। মেয়েটি জানাল ওর অনলাইন পরিচয় হয়েছে কোথাও, এবং তাঁর সম্বন্ধে ও পুরোটা জানতে চায়। জেঠু ডিটেক্টিভ জেনে ওর আবদার আরো বেড়ে গেল। তবে ও কখনই জেঠুর বয়স বা বাকি কিছু নিয়ে আগ্রহ দেখায়নি, জেঠুও বলেনি আর। দুজনেই বেশ বন্ধু হল। জেঠু আশ্বাস দিল,
- ওই ছেলের জনম পঞ্জিকা অবধি হাতে পেয়ে যাবে, চিন্তা কোরো না।
মেয়েটি খুব খুশি হয়ে তাঁর ই-মেইল ঠিকানায় একটা লম্বা চিঠি লিখল জেঠুকে। মিস্টার সেন উল্ল্যেখে ওর কোমল হাতের শব্দগুলো জেঠুর ভারী হৃদয়ে এসে আলতো ধাক্কা দিয়ে যেত রোজ আর জেঠুর মনে পড়ত সেই ফেলে আসা প্রেম, চিঠি ও কথাদের।
দুদিন অবশ্য বাদলার মাথায় অন্য কিছু ঘুরছে। কম্পিউটারে কি এমন আছে যে জেঠু দেখাতে চায় না। তারপর ওই মোটা বইটা! তাই সে সুযোগ খুঁজছিল, যেদিন বাড়িতে কেউ থাকবে না সেদিন খুঁটিনাটি ওসবের পরীক্ষা করা চাই।
জেঠুর সেদিন ডাক পড়েছিল পুলিশ স্টেশনে। থানার ওসি মানে বড়বাবু ওনার একটু সাহায্য চেয়ে ডেকে পাঠালেন। জেঠুকে তাই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়তে হল।
এদিকে আজ ছুটি, ওপরের ঘরটা আজ বাদলারই দখলে। যদিও জেঠু ফেরার আগে সবকিছু দেখা নেওয়া চাই তাই সিঁড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে ওপরে উঠে এলো বাদলা। এরপর দরজাটা আলতো করে বন্ধ করে, তাক থেকে নামিয়ে আনল বইটা। দেখল ৬২০ পৃষ্ঠায় বুকমার্ক সেঁটে রেখে জেঠু একটা অংশ কেমন গোল করে রেখেছে।
যার শুরুতেই লেখা –
গৃহপালিত পশু ও প্রভুতে যেমন গলায় গলায় ভাব, সেইরকম কিছু করিতে নীচের শর্তগুলো কাজে লাগে।
যেমন :
প্রথম শর্ত – মেয়েরা যা বলবে ওতেই হ্যাঁ। এরপর গলগলিয়ে বেরিয়ে আসবে সত্য-রা।
দ্বিতীয় শর্ত – ফুলের লোভ, বা চকোলেট। বিনিময়ে একগাল হাসি ও রাস্তা সাফ।
- - -
এসব পড়তে পড়তে বাদলার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। বাড়িতে এক মিষ্টি জেঠিমার আবির্ভাব হলে সংখ্যায় তিন হয়ে ওরা খুব হইচই করবে ভেবে বেশ আনন্দ হল বাদলার।
কিন্তু সে গুড়ে বালি পড়ল কারণ জেঠু যে প্রফেশনাল হয়ে অন্য কিছু খুঁজছে। অবশেষে হিল্লে হল। বাদলা দেখল, একটা ছেলে কলার অবধি ছবি সেঁটে আছে ফেসবুকে। দিব্য দেখতে। তবে মেয়েটা ওর কোন ছবিই জেঠুর কাছে পাঠায়নি। তাও কিঞ্চিৎ আন্দাজ করা গেল সেও এমনই নইলে কার্ত্তিক ঠাকুরের মতো পছন্দ হয় নাকি!
ততদিনে ছেলেটির সাথে বেশ আলাপ জমল জেঠুর। ঝিলপাড়ে মস্ত বাড়ি আছে ওদের। জেঠুকেও নিজের কাজে প্রায়ই ওখানে যেতে হয় শুনে ছেলেটি জেদ চাপিয়ে বসল একদিন আসার। জেঠুও বলল, অবশ্যই। কোনদিন গেলে ঠিক দেখা হয়ে যাবে।
ওদিকে ডিটেলস্ খবরাখবর নিয়ে মেয়েটির কাছেও চিঠিদের যাতায়াত শুরু হল এবং এমন একদিন এলো যে ঝিলপাড় এলাকায় ইন্টার্নেটের প্রথম বিয়ে হল জেঠুরই হাতে। সবাই খুব খুশি এবং উনিও। কারণ তাঁর নামেতে ডিটেক্টিভগিরির নীচে এখন আরো একটু যোগ হয়েছে।
এদিকে পিলু বক্সীর মেয়ে সোনাইয়ের সাথে বাদলার খুব ভাব হতে শুরু করেছে। কিন্তু বাবা মস্তান ভেবেও মাঝে মাঝে ঘাবড়ে যাচ্ছে বাদলা। ক্লাস সিক্স থেকে সেভেনে – বয়সটাই বা কিই! জেঠু এসব বোঝালেও বাদলা মানতে রাজি নয়। তাঁরই উস্কানিতে তো সোনাইকে ও দিনের পর দিন চকোলেট দিয়ে এসেছে।
তাও জেঠুর প্রশ্রয় ছিল এতে,
ভয় নেই তোদের এ প্রেম সফল করতে আমি আছি।
যদিও জেঠুকে এখন দেখা যায় খুব ছোটাছুটিতে... তাঁর মতে “বয়সকালীন প্রেম ও তার কুফল” নিয়ে প্রতি রোববারের কলাম লেখিকাই সেই “ফেলে আসা দিনগুলি”-র সাগরিকা সেন কিনা তা একবার পরখ করে নেওয়া দরকার।
- ঝর্না বিশ্বাস
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।