এবার ধরুন, আপনি এর যেকোনো একটা লেখায় ক্লিক করলেন। ধরার কিছু নেই, করবেনই, কৌতুহলের তো একটা নিবৃত্তির ব্যাপার আছে। তা সে করবেন, বেশ করবেন, ওইজন্যই তো ওর নাম বঁড়শি। খুলে দেখবেন, লেখার কোনো মাথামুন্ডু নেই। প্রথম লাইনে আছে " নায়িকা গীতশ্রীর জন্ম কৈখালিতে"। পরের লাইনেই "তিনি বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে পরশু গেছেন প্যারিসে"। আপনি পড়ে-টড়ে বিরক্ত যদি হয়ে ভাবেন, যে, আসল জিনিসটা আসবে কখন? ব্যস, ওখানেই আসল জিনিসটা মিস করে গেলেন। কী সেটা? না জাম্পকাট। ইয়ার্কি নয়, পরপর দুটো বাক্যেই একেবারে তেইশ বা তেতাল্লিশ বছরের লাফ (নায়িকার বয়সের উপর নির্ভর করে) । গোদারের দ্বারাও যে জিনিস কখনও হয়নি। একেই বলে ন্যারেটিভের গুষ্টির তুষ্টি, সরলরেখার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। গোদার শুধু এসবের খুচখাচ প্রয়োগ করেছেন, বাস্তব জীবনে বিপুল এবং প্রকৃত প্রয়োগের জন্য দেখুন, বঙ্গীয় ডিজিটাল মিডিয়া।
বলা বাহুল্য, শিরোনামে যা বলা হয়েছে, ডিজিটাল মিডিয়ার লেখাতে তা নাও পেতে পারেন। হয়তো কোথাও এক লাইনে আছে, পারম্পর্যহীন, তারপরে আবার অন্য আরেক লাইন। গীতশ্রীর হয়তো ছোটো চাঁদ দেখেই আনন্দ হয়েছে। স্পষ্ট করে বলা থাকলে বুঝতেও পারেন, আর একেবারে বলা না থাকলেই বা কী। গোদার দেখেননি? "কিং লিয়ার"এ যত্রতত্র "ফিন", অর্থাৎ কিনা "দা এন্ড" হয়ে যাচ্ছে। দর্শকরা বোকার মতো উঠে দাঁড়িয়ে মুর্গি হচ্ছে, কারণ, এই যাঃ সিনেমা আবার শুরু হয়ে গেল। বার-দুয়েক এরকম হবার পর, তৃতীয় বারে "সমাপ্ত" দেখে, চোয়াল শক্ত করে "আর মুর্গি হবনা" বলে যাঁরা বসে ছিলেন, তাঁরাও মুর্গি। কারণ, এবার সিনেমাটা সত্যিই শেষ। পুরোটাই আসলে চুক্কি দেবার কল। তা, কথা হল, গোদার চুক্কি দিলেই বাহবা, আর ডিজিটাল মিডিয়া চুক্কি দিলেই গাল, এ আর চলবেনা। দুনিয়া বদলে গেছে। বিশ্বের বাজার এখন সমতল। গোদার ইজ ডেড, লং লিভ গোদার। গোদারের পতাকা বহন করার শক্তি ভগবান বঙ্গডিজিটাল দুনিয়াকে ইতিমধ্যেই দিয়ে দিয়েছেন। ডিজিটাল মিডিয়া দিচ্ছে ডাক, গোদারবাবু জিন্দাবাদ, সরলরেখা নিপাত যাক।
এরকম এক-আধটা কেস নয়,ডিজিটাল মিডিয়া আস্তটাই প্রত্যক্ষভাবে গোদারানুসারি, সে আপনি পাপারাৎজি, ট্যাবলয়েড, দফা-চারশোবিশ যে নামেই ডাকুননা কেন। অবশ্য "আস্ত" কথাটা বলাই এখানে ঠিক নয়। সমগ্র বলে কিছু নেই আর। গোদারের আমল থেকেই নেই। যে কারণে উনি গোটা ন্যারেটিভ ভেঙে টুকরো-টাকরা দেখিয়েছেন। আস্ত নুড শরীর না দেখিয়ে প্রত্যঙ্গ দেখিয়েছেন। ডিজিটাল মিডিয়াতেও দেখবেন, অবিকল একই জিনিস চলছে। নুড ছবি দেখালে, সরকার ব্যান করে দিতে পারে, নগ্নতার গপ্পো লিখলে পানু বলে বদনাম হতে পারে, তাই ওঁরা খন্ডচিত্রে মনোযোগ দিয়েছেন। "অনুশ্রীর বুকের ভাঁজ দেখে উত্তাল দুনিয়া"। "তনুশ্রীর খোলা পা উত্তাপ ছড়াল পৃথিবীতে"। "মনুশ্রীর খোলা পিঠ ঝড় তুলল ইন্টারনেটে"। ইত্যাদি-প্রভৃতি। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ও এরকম লিখেছিলেন। "কারো ঠোঁট, কারো গ্রীবাভঙ্গী, কারো দৃষ্টি ভালো লাগে, কোনো নারীকে চোখে পড়েনা" (উদ্ধৃতি থাকলেও এটা হুবহু সন্দীপনের ভাষা নয়)। কুচ্ছো-পোর্টালের কথা ভেবে লিখেছিলেন কিনা কে জানে, কিন্তু ব্যাপারটা ওইরকমই। তার উপর আছে দরদী দৃষ্টিভঙ্গী। "বিকিনি পরে ট্রোলড দেবশ্রী, উচিত জবাব দিলেই ট্রোলকে"। এখানে খবরের বিষয়টা কী, বিকিনি, না উচিত জবাব, ভেবে আপনি ভেবলে যাবেন। কিন্তু বাস্তব দুনিয়া ওরকমই গোলমেলে। নেই আর কোনো বিশুদ্ধ দাস ক্যাপিটাল। একটু মুখশুদ্ধি, একটু সঠিকত্ব, একটু শরীরের টুকরো দিয়ে মেখে দিন মশলামুড়ি, ব্যস, পাবলিক গপাগপ খাবে। এক অর্থে এটা গোদারের চেয়ে সফলও বটে। এত খাটাখাটনির পরেও, ভদ্রলোকের সিনেমা পাবলিক খায়নি, আর ডিজিটাল মিডিয়ার বঁড়শি? আপনিই বলুন কবার ক্লিক করেছেন?
ফলে, শুরুতে যা বলা হচ্ছিল। বঙ্গীয় সিনেফিলদের আতঙ্কিত হবার কিছু নেই। গোদার আমাদের রক্তে আছেন, জিনে মিউটেশন করে দিয়েছেন। একদম হিমোগ্লোবিনে ঢুকে ছানা কেটে দিয়েছেন। উনি ঝালে-ঝোলে-অম্বলে, ফেসবুক রিলে, সর্বত্র। চন্দ্রিল ভট্টাচার্যের ওয়াই-টু-কের গানটা এবার বদলে লেখা যেতেই পারে, "(আমরা) গোদার হতে পেরেছি, ইয়া ইয়া ও"।
** সঙ্গের ছবিটি গোদারিয়ানার একটি স্যাম্পল। এইমাত্র যা হাতের কাছে পেলাম। লক্ষ্য করে দেখুন, গোটা ছবিতে, সুটকেস, বাচ্চা, দাড়িওয়ালা ব্যাটাছেল, ট্রেন, ইত্যাদি নানা জিনিস আছে। কিন্তু ফোকাস কোথায়? না, সরু এক জোড়া ঠ্যাঙে।