এমনিতেই জাতপাতের নিয়মে বিশ্বাসী হিন্দুদের কাছে মুসলিমরা ছিল অচ্ছুৎ। ভারতবর্ষে ইসলাম আসার আগে থেকেই ব্রাম্মাণ্যবাদে বৌদ্ধরা ছিল প্রচন্ড ঘৃণ্য। মনুসংহিতায় মনু বলেন, ‘কেউ যদি বুদ্ধকে স্পর্শ করে তবে সে স্নান করে নিজেকে শুচি শুদ্ধ করে নেবে।’ বিষ্ণু পুরানে বৌদ্ধদের মহামোহ উপাধি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘যারা এমনকি বৌদ্ধ সন্তানদের সাথে কথাও বলবে—তাদের নরকে যেতে হবে।’ (প্রজ্ঞামিত্র বৌদ্ধ ভিক্ষু- শ্রামণ প্রশিক্ষণ ও সাধণা পরিবেণ, রামু, কক্সবাজার)
ইতিহাস সাক্ষী, পূর্ববাংলার অধিকাংশ মুসলিমদের পূর্বপুরুষ ছিল, ব্রাম্মণদের কাছে ঘৃণ্য পরাজিত বৌদ্ধধর্ম অনুসারী (বাঙ্গাল ভাষায় ন্যাড়া বলে সেজন্য ) এবং ব্রাম্মণদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ নির্যাতিত শুদ্র-নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের। তবে কি ঘৃণা তুচ্ছতার এই ফাঁক গলে রুক্ষ, শুষ্ক, আরবীয় ভূমিতে আবির্ভূত হওয়া জাতপাতহীন ইসলাম ধর্ম ঢুকে পড়েছে ভারতবর্ষে ?
এটি কিন্তু ভেবে দেখার মত একটি বিষয়। এত এত মুসলমান এলো কোথা থেকে ? এ সব কি তলোয়ারের কারিশ্মা ? ঘৃণা নেই ? জাতপাতের বৈষম্যের সুযোগে নীচু বলে দেগে দেওয়ার অহংকারী আস্ফালন আর নিপীড়ন কি ছিল না ?
তবে কি ঘৃণা একটি ভূমিজ মানসিক সংস্কৃতি ? এরই পরম্পরা বয়ে বেড়াচ্ছি আমরা ? হিন্দুর হাতে বৌদ্ধ, মুসলমানের হাতে হিন্দু, আবার হিন্দু-মুসলিম, মুসলিম-হিন্দু – অনাদি কালের এই ঘৃণা নদী আমরা কি পেরুতে পেরেছি এই যুগে এসেও ? পারিনি বলেই কি সৃষ্টি হচ্ছে গুজরাট, মুজাফফরনগর, দিল্লী, নাসিরনগর, কুমিল্লা, নড়াইলের মত একের পর এক রক্তাক্ত ক্ষতগুলো ?
ঘৃণাটৃনা যাই থাকুক না কেন, মোষ্ট ইন্টেরেষ্টিং ব্যাপার হল, নারীদের ক্ষেত্রে সব ধর্মের কিন্তু এক এবং অভিন্ন ফতোয়াবাদী মুখ। এই এক চিমটি উনিশ কুড়ি ছাড়া। একই রকমের তুচ্ছতার নির্দেশনা রয়েছে প্রতিটি ধর্মে। বিধি বিধান আইনকানুন সব নারীদের জন্য। প্রাচীন ধর্মগুলোর কথা ছেড়ে অপেক্ষাকৃত নবীন ইসলাম ধর্মের কথাই বলি। মোল্লা হুজুররা শীত গ্রীষ্ম যখনই ওয়াজে বসে, তাদের মূল টার্গেট থাকে নারী। কসাই যেভাবে মাংস টুকরো করে তেমনি নারীর স্তন, জঙ্ঘা, উরু, নিতম্ব, ভ্যাজাইনা, নাভী ঠোঁট, চোখ মাথা সবই তাদের ওয়াজে থাকে— থাকে না শুধু হযরত মুহাম্মাদ(সাঃ)এর বিদায় হজ্জ্বে দেওয়া মানবিক দিকগুলোর বিশদ আলোচনা।
ইসলাম ধর্মের সূত্রপাত হয় ৬ শত খ্রিস্টব্দের প্রথম দিকে হয় ( নবীজীর জন্ম আনুমানিক ৫৭০ খৃষ্টাব্দে) সে ক্ষেত্রে অন্যান্য ধর্মের তুলনায় ইসলামকে নবীন বলতেই হয়। পৃথিবীতে জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা শুরু হয়ে গেছে তারও আগে। রাজনীতি, ক্ষমতা এবং জ্ঞানচর্চায় নারীরা প্রকাশ্য ছিল। কিন্তু নবীন ধর্ম ইসলাম এসে পর্দা দুলিয়ে দিল। নারীরা কেবলই হয়ে উঠল, উর্বরা শস্যক্ষেত্রে। পশ্চাৎপদ। অবগুন্ঠনবতী। ধর্মসূত্রে শক্তিশালী মুসলিম পুরুষের ক্রীড়া সামগ্রী। ইচ্ছে অনিচ্ছের দাসানুদাসী। খাও। শোও। এবার চিৎ থাকো। উপুড় হও। হামা দাও আর লাগাতার গর্ভবতী হও। নইলে তালাক ! তালাক !! তালাক !!! এবার দূর হয়ে যাও স্বামীর দেহমনে সুখ যোগাতে না পারা বদনসীব আওরত।
তাই ত শরিয়া আইনে এত ভয়। বুক কাঁপে আফগানিস্তানের অবস্থা দেখে।
অথচ মোল্লা হুজুররা একথা কখনও বলে না, নারী-পুরুষ উভয়কেই মুহাম্মাদ (সাঃ) শিক্ষা অর্জনের জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, জ্ঞানঅন্বেষণ প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ধর্মীয় কর্তব্য । ( যাওয়াদ হাইফা এ ( ১৯৯৮০। দ্য রাইটস অব ইসলাম অ্যান অথেনটিক অ্যাপ্রোচ লন্ডন ইংল্যান্ডঃ পলগ্রেভ ম্যাকমিলান। পৃষ্ঠা ৯। আইএসবিএন ৯৭৮ -০- ৩৩৩- ৭৩ ৪৫৮- ২।)
চোখের সামনে বাংলাদেশ ডুবে যাচ্ছে। ‘সুজন সুজন, তেঁতুলপাতায় ন’ জন’ সখ্যতার হিন্দু মুসলিম ঐক্য আর থাকছে না। না জেনে না বুঝে হিন্দু ছেলেমেয়েদের কেউ কেউ কোরআন এবং নবীজীকে নিয়ে কটুক্তি করছে। আর উন্মাদের মত ঝাঁপিয়ে পড়ছে একদল মুসলিম। জ্বালাও পোড়াও, মারো, কাটো। কেউ ভেবে দেখছে না, এক সময় পৃথিবীতে বহুবিবাহ এবং বাল্য বিবাহের মচ্ছব ছিল। মুহাম্মাদ (সাঃ) কতগুলো বিয়ে করেছে তা দিয়ে ত ভাত জুটবে না। চাকরীও হবে না। থাকুক মুসলিমরা ওদের বহুবিবাহকারী নবী নিয়ে। ওদিকে মুসলিমরাও বুঝতে চাইছে না, এসব কথায় তাদের প্রিয় নবীজী বা ধর্মের কি আসে যায়। ঈমান ঠিক থাকলেই সব ঠিক। বলে বলুক যত খুশী বলে যাক।
মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে, এসব বড় কোন যড়যন্ত্রের অংশ নয় ত ! পাতানো খেলা ! বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে টালমাটাল করে দেওয়ার ঘরভেদী, আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক কোন নীলনক্সারই একটি চুম্বক অংশ।
এ ষড়যন্ত্র থামানো দরকার। কিন্তু কে বা কারা থামাবে ? রাজনীতি এখন ঠিকাদারি ব্যবসার মতই লাভজনক। নির্বাচনের আগে দেওয়া সম্পত্তির হিসাব আর নির্বাচিত হওয়ার এক বছরের মাথায় বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের সম্পত্তির হিসাব দেখলে চক্ষু চড়কগাছ হতে বাধ্য। এ দৃশ্য কেবল বাংলাদেশের তা নয়। ভারতে জনপ্রতিনিধি কেনাবেচা হচ্ছে কোটি কোটি টাকায়। টাকার পাহাড় পাওয়া যাচ্ছে ঘরকে ঘর। শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া। পাকিস্তান লাগাতার অস্থিতিশীল। আফগানিস্তান অন্ধকারে। মিয়ানমারে গণতন্ত্রের মোড়কে মোড়া ধর্মবাদী স্বৈরতন্ত্র।
পৃথিবীতে এক সময় আদর্শের জন্য রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা প্রাণ দিয়ে শহিদ হতেন এখন টাকা টাকা করে প্রাণ ভরে উঠলেও তৃষা মিটছে না বিভিন্ন দেশের রাজনীতিক চোর ছ্যাঁচ্চোড়দের।
বাস্তবে সংগঠিত আন্দোলনে যাওয়ার মত কোন রাজনৈতিক দল নেই বাংলাদেশে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের কম্যুনিষ্ট পার্টি( ফরহাদ-মনি সিং) নেই হয়ে গেছে। ছুটকো ছাটকা কম্যুনিষ্ট দল বলে যারা আছে তারা রাজনীতিতে প্রেশার গ্রুপ হিসেবে কাজ করছে। ঐক্য নেই তাদের। বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) তো অনেক আগেই জামাতে ইসলামীর পবিত্র পাদপদ্মে আত্মসমর্পণ করে নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। আসছে নির্বাচন যদি স্বচ্ছ হয় তবে ধর্মীয় দলগুলোর বিজয় সুনিশ্চিত। তাই যদি হয় তো, দৃশ্যমান ৯ পার্সেন্ট হিন্দু জনগনও হয়ত দেশ ছাড়তে বাধ্য হবে। কিন্তু প্রগতিশীলদের কি হবে ?
মুন্ডু কাটা পড়বে ঘরে, রাস্তায়, অফিসে, বাসে ট্রেনে। নারীরা হবে ঘরবন্দী। মুক্তিযুদ্ধে ভারত যেমন পাশে ছিল এবার সে সম্ভাবনাটুকু নেই বলে মালুম হচ্ছে। কারণ ভারত জুড়ে যে ধর্মীয় জাগরণের জয়যাত্রা তাতে বাঙ্গালী অধ্যুষিত পশ্চিম বাংলাও ক্রমশ গেরুয়া রঙে দুলে যাচ্ছে। ৩০ জুন, দমদম এয়ারপোর্ট। যে ট্যাক্সি নিয়েছিলাম, গন্তব্য জেনে ড্রাইভার ছেলেটা বলে উঠেছিল, জয় শ্রীরাম। দিদি বুঝি বুদ্ধিস্ট ?
জয় শ্রীরাম বলে মাথা যদ্দুর কাত করে হ্যা বলা যায় তাই বলে ওর নাম ধাম, ট্যাক্সি নম্বর জেনে বন্ধুকে জানিয়ে দিলাম। আজকাল সময় এবং জীবন নিয়ে খেলতে আমার ভাল লাগে। আমার চৌদ্দ পুরুষ মুসলিম ছিলেন না। বংশলতিকা পাঁচ ছয় পুরুষ পেছু হাঁটলেই পুরোহিত গন্ধ বেরিয়ে পড়বে হয়তবা। আমি আরামসে ট্যাক্সি ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করি, গোবিন্ মুসলিম জানলে তুমি কি আমাকে যাত্রী করতে ?
গোবিন্দ জানায়, সামনে ইলেকশনটো দেখুন না দিদি।
বাকি কথাগুলো শুনে দিব্য দেখতে পেলাম ঢাকায় আমার এপার্টমেন্টের নীচে আমজাদ ড্রাইভার আর গোবিন্দের মন আর ভাষার কি অথৈ ঐক্য। এই প্রথম কলকাতাকে কিছুটা ভয় লাগল। এ শহরে আসতে পেলে আমি মামাবাড়ি আসার আনন্দ পাই। হাজার বার শোনা রাস্তাগুলোয় যখন পা রাখি, মনে হয় অই তো আমার তরুণ পিতা কিশোরী মাকে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। দুটিতে সিওর নাটক দেখবে জমিয়ে।
আমি গোবিন্দকে একটি স্বপ্ন দেওয়ার চেষ্টা করি, গোবিন মনে কর মন্দির, মসজিদ, প্যাগোডা, চার্চ, গুরুদোয়ারাগুলো প্রতিটি শহর বা গ্রামের এক প্রান্তে থাকবে, যে যার মত ধর্মপালন করে ফিরে আসবে নিজের ঘরে --
মহাবোধী আশ্রমে এসে গেছি। ফিরে যাওয়ার আগে গোবিন্দ বলে যায়, মুসলিম লোগকো সাথ—কাভি নেহি দিদি।
(ক্রমশঃ)