আজ থেকে বিশ-বাইশ বছর আগের কথা। এক নিকট আত্মীয়ের একটি মামলা সংক্রান্ত ব্যাপারে কথাটি প্রথম কানে আসে। বাড়ির দলিলের প্রয়োজন পরে এবং তখনই প্রথম শুনি কথাটি, ইংরেজিতে ‘Certified copy’। আভিধানিক অনুবাদ করলে হওয়া উচিৎ, ‘প্রত্যয়িত প্রতিলিপি’ অর্থাৎ, ‘আসল’ দলিলের প্রতিরূপ। সহজ বাঙলা করলে হবে, ‘আসলের বা মূলের প্রতিরূপ’। বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে সত্যতার সম্পর্ক খুব নিবিড় বলেই হয়তো আদালত-কর্তৃপক্ষের সই-সমেত প্রতিরূপের প্রয়োজন। যা নিশ্চিত করবে, এই প্রতিরূপ আসলেরই। বর্তমান যুগে জেরক্স-যন্ত্রের বিপুল ব্যবসা নাগাড়ে আসলের প্রতিরূপ তৈরি করে চলেছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান প্রতিরূপের সঙ্গে আসলটিও দেখতে চায়, কেউ কেউ আবার ঐ আদালতের মত কোনো গেজেটেড অফিসারের সই-সমেত প্রতিরূপ চায়। অর্থাৎ নির্ভেজাল বা প্রামাণ্য আসল বা মূল একটা আছে, আর আছে তার প্রতিরূপ।
বোঝাই যাচ্ছে ‘পুনরুৎপাদন’ (reproducibility) হল এর মূল কথা। আসলের প্রতিরূপ তৈরির এই ভাবনাটি কিন্তু আজকের নয়। ধরা যাক প্রাচীন যুগের একটা চিত্রকলা। সেই যুগে এটি যার আঁকা সেই গুরুর কাজের নকল তৈরি করত তারই শিষ্যরা। গ্রীকরা যেমন ছাপ মেরে একই জিনিসের একাধিক উৎপাদন করত। পরবর্তীকালে কাঠের কাজে খোদাই করে বা এচিং করে নানান ধরণের পুনরুৎপাদন হয়েছে। ক্রমে-ক্রমে এর পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে বটে কিন্তু ব্যাপারটা যে বাণিজ্যিকভাবে ব্যাপকহারে সফল ভাবে হয়েছিল তা নয়। বিখ্যাত ‘ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল’-এর অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব ওয়াল্টার বেঞ্জামিন (১৮৯২-১৯৪০) জানাচ্ছেন, এই ব্যাপারটা প্রথমবারের মত বিশাল আকারে শুরু হয় ছাপাখানা আবিষ্কারের পর। পত্রিকা ছাপা হয়েছে অনেক পরে, পত্রিকার মধ্যে ছাপা হয়েছে ছবি, এগুলিও ‘পুনরুৎপাদন’। কিন্তু ‘পুনরুৎপাদন’ নিয়ে আজকের দিনে বলতে গেলে, সর্বাগ্রে বলতে হবে ‘স্থিরচিত্র’ বা ‘ফটোগ্রাফি’-র কথা। আধুনিক যুগে ‘পুনরুৎপাদন’ ব্যাপারটা প্রথম শুরু হয়েছে স্থিরচিত্র থেকে। কারণ স্থিরচিত্র প্রথম এই ব্যাপারটা করেছে যে একটা নেগেটিভ প্রিন্ট থেকে যে একশ ছবি বেরিয়ে এলো তার মধ্যে কোনোটিই আসল বা প্রধান বা মূল নয়! ঐ একশটিই আসলে একই জিনিস! ফলত একটি প্রামাণ্য ‘আসল’, এই ব্যাপারটা স্থিরচিত্রে আর নেই। বেঞ্জামিন জানাচ্ছেন, তবে চূড়ান্ত বিচারে ‘পুনরুৎপাদন’ শুরু হয়েছে চলচ্চিত্র আবিষ্কারের পর।
আধুনিক নন্দনতত্ত্ব বিষয়ক ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘The work of art in the age of mechanical reproduction’-এ এই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে। আমরা মোটামুটিভাবে এই সূত্রকে কেন্দ্রে রেখে আলোচনা করব ইরানের বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার আব্বাস কিয়ারোস্তামির (১৯৪০-২০১৬) মূলত দুটি ছবি নিয়ে, Certified copy (২০১০) এবং Like someone in love (২০১২)। ২০০০ সালে দেখা The wind will carry us(১৯৯৯)-র স্মৃতি আজও টাটকা। সেই আমাদের প্রথম কিয়ারোস্তামির ছবি দেখা। অতঃপর বিখ্যাত ‘কোকের ত্রয়ী-চিত্রাবলী’ ও একে একে বাকি ছবিগুলি। উত্তর-ইরানের একটি ছোট্ট গ্রাম কোকের রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যায় তিনটি ছবির জন্য, ‘Where is the friend’s home’ (১৯৮৭), ‘Life, and nothing more..’ আর (১৯৯২) ‘Through the olive trees’ (১৯৯৪)। এই তিনটিকে মিলিয়েই ‘কোকের ত্রয়ী-চিত্রাবলী’। নামটি অবশ্য চিত্রতাত্ত্বিকদের দেওয়া। তিনটি ছবির পটভূমিই কোকের গ্রাম, এই ব্যাপারটিকে কিয়ারোস্তামি কাকতালীয় মনে করতেন। ঐ তিনটি ছবিকে ত্রয়ী-চিত্রাবলী না বলে শেষের দুটি ছবির সঙ্গে ১৯৯৭ সালে নির্মিত ‘Taste of Cherry’ ছবিটিকে মিলিয়ে ত্রয়ী-চিত্রাবলী বলার পক্ষপাতী ছিলেন তিনি। দুর্মূল্য মানুষের জীবন, একটি সুপ্রাচীন জনজাতির আবহমানতা ও ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত ইরানের বিশেষ কিছু অঞ্চল, এই গুলিকে মাথায় রাখলে কিয়ারোস্তামিই ঠিক বলে মনে হয়। পূর্ব-গোলার্ধের সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের যাপন-চিত্র, তাদের ছোট ছোট সুখদুঃখ আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা, আমার আপনার কথাই ইরানের সংস্কৃতির রং মাখিয়ে ছুড়ে দিয়েছেন তিনি। এই ছবিগুলির গ্রাম-ইরান এমনকি পরবর্তী কালে তেহরান শহরের প্রেক্ষাপটে নির্মিত ১০ (২০০২) দেখলেও বোঝা যায় কিয়ারোস্তামি অস্বীকার করতে চান উত্তর-ঔপনিবেশিকতার রূপধারী নব্য-সাম্রাজ্যবাদকে, অস্তিত্বের সন্ধানে নিমজ্জিত একটি আধুনিক মন আধুনিকতাকে পুনঃবর্ণন করতে চায় সমগ্র তৃতীয় বিশ্বের অনুভব যন্ত্রণার জায়গা থেকে। বিষয় ও তার এরূপ নির্মিতি আমরা আগে কখনো দেখিনি! আর তাঁর অনেক ছবিতেই খোদ চলচ্চিত্র নিজেই যেন একটি বিষয়। চিত্রের ও শব্দের এই নতুন যুগলবন্দীকে চলচ্চিত্র নয়, যেন বলা উচিৎ চলচ্ছব্দচিত্র (চলৎ+শব্দচিত্র=চলচ্ছব্দচিত্র)!
ইরান ছেড়ে চলে যাওয়া পুরোটাই স্বেচ্ছায় নয়। রাজনৈতিক সমস্যা তাঁর ছবিকে ঘিরে সেভাবে তৈরি হয়নি বটে কোনদিনই, কিন্তু দৃশ্যশব্দ-নির্মাণের ক্ষেত্রে কিছু শর্ত ইরানে অলঙ্ঘনীয়। সামান্য বিচ্যুতিও গ্রহণযোগ্য নয়। এই অবস্থায়, মূলত শিল্পীর স্বাধীনতার প্রয়োজনেই তিনি ইতালিতে গিয়ে তৈরি করেন ‘Certified copy’ এবং জাপানে ‘Like someone in love’। চিত্রের ও শব্দের নব-নির্মিতির পথ ধরে যেতে যেতে ‘Certified copy’-তে এসে অবতারণা করেন একটি চিরকালীন প্রতর্কের এবং উপনীত হন আধুনিক নন্দনতত্ত্বের নবতর প্রস্তাবনায়। অন্যদিকে 'Like someone in love' আত্মপরিচয়, ভালোবাসা, হিংস্রতা এইসব গোলকধাঁধার চিত্রশব্দময় মৌলিক প্রদর্শন! আসুন একটু একটু করে আমরা এইসব আলোচনায় প্রবেশ করি।
ব্রিটিশ লেখক জেমস মিলার (অপেরা গায়ক William Shimell অভিনীত) ও প্রাচীন জিনিসের দোকানের মালিক এলি (Juliette Binoche অভিনীত), 'Certified copy'-র দুই প্রধান চরিত্র। এলি ফরাসী, যদিও নামটি অনির্দিষ্ট, ছবিতে পরিষ্কার করে বলা হয়নি (আমরা আলোচনার সুবিধার্থে এই নামটিই ব্যবহার করব)। জেমস ইতালির টুস্কানি অঞ্চলে এসেছে তার নতুন বই 'Certified copy' নিয়ে একটি আলোচনা-চক্রে যোগ দিতে। ছবির শুরুতে লং-শটে আমরা দেখতে পাই ক্ষণিক বিলম্বে আসা জেমসকে দিয়ে এলি এক কপি বই সই করিয়ে নিচ্ছে, পাশে এলির ছেলে দাঁড়ানো। সভাকক্ষে সামনের সারির সংরক্ষিত প্রথম আসনটি ফাঁকা পরে আছে, এলি এসে সেখানে বসে। সভা নিয়ে এলির পূর্বনির্ধারিত উৎসাহের ব্যাপারটি বোঝা যায়। অনতি বিলম্বে বইটির বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করে জেমস। বিষয় - আসল ও তার প্রতিরূপ। এলির ছেলে সভাকক্ষের এক কোণায় দাঁড়িয়ে থাকে, সে প্রীত নয়। মায়ের সাথে তার আকারে-ইঙ্গিতে কথাবার্তা চলতে থাকে। নেপথ্যে চলতে থাকে জেমসের আলোচনা। এলি ও তার ছেলের ভাব বিনিময়ে জেমসের প্রতিক্রিয়া পরিচালক আমাদের দেখান না। এই অফ-স্ক্রিন উপস্থিতি কিয়ারোস্তামির ছবির একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য। চলচ্চিত্র-ভাষার অঙ্গ এই অলংকারের আরো চমকপ্রদ ও স্বকীয় ব্যবহার দেখি 'Like someone in love'-এর শুরুর দৃশ্যে। প্রায়ান্ধকার ও জনাকীর্ণ একটি ক্যাফে, লোকজন মদ খাচ্ছে, সেল ফোনে কথা বলছে। আকিকোও (Rin Takanashi অভিনীত) কথা বলছে সেল ফোনে। এখানে দৃশ্য ও শব্দ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে! আমরা সেল ফোনে আকিকোর গলা শুনতে পাই, সে তার প্রেমিক নোরিয়াকির (Ryo Kase অভিনীত) সঙ্গে কথা বলছে। কিন্তু ক্যামেরা তার দৃষ্টিকোণ থেকে জনাকীর্ণ ক্যাফের অন্দরমহলের দিকে তাক করা রয়েছে। যার গলা শোনা যাচ্ছে আর যাদের দেখা যাচ্ছে তারা আলাদা! আকিকো আমাদের কানে আছে কিন্তু আমাদের চোখে নেই! পূর্বে উল্লেখিত জেমসের অফ-স্ক্রিন প্রেজেন্সও একই ভাবে বিভক্ত, তফাতটা হল সেখানে দৃষ্টিকোণ নিরপেক্ষ। এই পদ্ধতির মজাটা হল, চলতি প্রথার ব্যতিরেক হিসেবে চলচ্চিত্রে চরিত্রদের কথা বলতে না দেখে, আমরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এখানে কথা শুনতে দেখছি! এরই পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত মৌলিক রূপ আমরা দেখছি কিয়ারোস্তামির অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত নিরীক্ষামূলক ছবি Shirin (২০০৮)-এ। সে আলোচনায় যথা সময়ে আসা যাবে।
জেমস এক জায়গায় বলে original শব্দটির ল্যাটিন মূল হল originem। এই originem-এর অর্থ beginning বা birth। অর্থাৎ জন্মের সাথে অপত্যের সাথে original-এর একটা সম্পর্ক আছে। শিল্পের পুনরুৎপাদনের সঙ্গে মানুষের প্রজননকে সমান্তরালে রেখে ভাবার কথা বলে জেমস। ডাবল হেলিক্স , জিনোম সিকয়েন্সিংয়ের পর বৈজ্ঞানিকভাবে জানতে পারা গেছে যে আজকের আমরা প্রকৃতপক্ষে আমাদের অতীতের পূর্ব-পুরুষদের ডি.এন.এ প্রতিরূপ। কিন্তু শিকড়ের অনুসন্ধান মানুষের বহুকালের, ডি.এন.এ আবিষ্কারের পূর্বেও তা ছিল। বংশগত মূল খুঁজে বের করার তাগিদ ঐতিহ্যের বা অস্তিত্বের অনুসন্ধানের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংঘবদ্ধ। কিয়ারোস্তামির 'The wind will carry us' ছবিটি, এই উৎসের অভিমুখে যাত্রার ভাবনায় বাঙময় হয়ে আছে। আমি বা আমরা কোথা থেকে এলাম? এই চেতনার সঙ্গেই যুক্ত শিল্পের আসল বা মূল খুঁজে বের করার ব্যাপারটিও! লক্ষ্য করার বিষয়, সম্ভবত উৎস বা মূল বা গর্ভের রূপকল্পেই এলি ও তার ছেলেকে শুরু থেকে একসঙ্গে দেখানো হয়েছে। এলি সিঙ্গেল মাদার হিসেবে প্রতিভাত। শুরু থেকেই জেমসের প্রতি এলির মুগ্ধতা চোখেমুখে হাবভাবে স্পষ্ট। এলির ছেলের থেকে আমরা জানতে পারি জেমসের বইটি পড়ে এলির তেমন ভালো লাগেনি। তথাপি সে ছ-কপি কিনেছে! স্বাক্ষরিত ছটি কপি সে বিভিন্ন মানুষকে দিতে চায়, কিন্তু তাদের অনেকেই সে তেমন পছন্দ করে না । সবমিলিয়ে এলির ছেলের সঙ্গে আমাদেরও মনে হয় সাক্ষরিত কপি সংগ্রহের অছিলায় সে জেমসের সঙ্গে পুনরায় দেখা করতে চায়। একসঙ্গে সময় কাটাতে চায়।
মধ্যবয়সের সংকট, একাকীত্ব কিংবা বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক - এরকম নানা সম্ভাবনায় প্রাথমিক পর্যায়টি উপস্থাপিত। টুস্কানি অঞ্চলের একটি গ্রামের উদ্দেশ্যে এরপর জেমস ও এলি গাড়িতে করে বেড়িয়ে পরে। ২০১২-র নিউইয়র্ক চলচ্চিত্র উৎসবে কিয়ারোস্তামি মন্তব্য করেছিলেন,
'What I find interesting in reflections, is when shooting from the exterior of the car while focusing on the characters’ faces, for us not to see only the characters’ faces, but using the windshield to see what’s going on around. It’s an element of atmosphere, thanks to the reflections, rather than just using the [windshield] as an obstacle to the faces.'
কিন্তু শুধু তাই নয়। গাড়ি হল এমন একটা পরিসর যেখানে পাত্র-পাত্রী পাশাপাশি বসতে বাধ্য হয় এবং সেটাই স্বাভাবিক। ফলত একটা পার্কে বা কোনো বাড়ির লনের সেট-আপে কৃত্রিমতার যে সম্ভাবনা থাকে তা এখানে এড়ানো যায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কিয়ারোস্তামির নিজের বলা গাড়ির কাঁচে পরিপার্শ্বের প্রতিফলিত মহিমার ব্যাপারটি, যা স্বাভাবিক ডিস্টরশান নিয়েই একটা অঞ্চলের ভূগোলকে আমাদের চোখে মেলে ধরে। গাড়ির দৃশ্য তাই কিয়ারোস্তামির চলচ্চিত্রের অন্যতম স্বকীয় বৈশিষ্ট্য। তাঁর ছবির ড্রাইভাররা জানে ঠিক কত বেগে গাড়ি চালাতে হবে। উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না, 'The wind will carry us'-এ শুরুর দিকে একটি দৃশ্য আছে যেখানে লংশটে আমরা দেখতে পাই একটি গাড়ি ডানদিক থেকে বাঁদিকে যাচ্ছে, পর মুহূর্তে দেখি ঐ গাড়িটিই বাঁদিক থেকে ডানদিকে যাচ্ছে! সম্পাদনার মাধ্যমে তৈরি হওয়া একটা স্থানের ভূগোল সম্পর্কে ধারণা এখানে বিনষ্ট হয়। চলচ্চিত্রে কন্টিনিউইটির যে চিরাচরিত ধারণা (মূলত হলিউড থেকে পাওয়া), এ তার বিপরীত। কিন্তু অর্থবহ! গ্রাম-ইরান পর্বের ছবিগুলি থেকেই চলচ্চিত্রের বহু প্রতিষ্ঠিত প্রথাকে এড়িয়ে চলে কিয়ারোস্তামি তৈরি করেছিলেন তাঁর ছবির 'অন্য রূপ'।
টুস্কানি অঞ্চলের অপরূপ শোভার মধ্যে দিয়ে গাড়ি এগোতে থাকে। ড্রাইভারের সিটে বসা এলি জানায় তার বোন মারির জন্য স্বাক্ষরিত একটি কপি তার চাই, কারণ মারি জানিয়েছে, 'A good copy is better than the original'। এলি আরো জানায় মারি কসমেটিক জুয়েলারি পছন্দ করে এবং মনে করে "fake jewellery is just as good as the real thing..no difference between a copy and a original"! পরিচালক ছবির ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতির আগাম আভাস এখানে রেখে যান। টুস্কানির উপকণ্ঠে একটি জায়গায় গিয়ে তারা পৌছয় । এখানে বিবাহ করার জন্য সাধারণত মানুষ আসে। সৌভাগ্য ও বিশ্বস্ততা জনিত বিশ্বাসে মানুষ এখানে বিয়ে করে। জেমস এলিকে জিগ্যেস করে তার বিয়েও এখানে হয়েছিল কিনা। পরিচালক এলির বৈবাহিক অতীত রহস্যময়ই রেখে দেন। এর জবাব আমরা পাইনা এবং ইঙ্গিত বহুল ভাবে ঠিক এই সময়ই এলির ছেলের ফোন আসে। একটি চরিত্রের পুনঃপ্রবর্তন শুধুমাত্র নয় বরং প্রজনন বা পুনরুৎপাদন সংক্রান্ত ভাবনার পূর্বে উল্লিখিত মনুষ্য পরিসরটিকে পুনরায় এখানে নিয়ে আসেন পরিচালক। জেমসের শুরুতে বলা বক্তৃতার মতই আমরা দেখব শিল্পের পুনরুৎপাদন সম্পর্কিত ভাবনার সমান্তরালে পরিচালক ধীরে ধীরে অভিনব কায়দায় দাঁড় করাচ্ছেন মানুষের সম্পর্ককে।
স্থানীয় একটি মিউজিয়ামে একটি নারীর পোর্ট্রেট এলি জেমসকে দেখায়। এই পোর্ট্রেটটি টুস্কানির মোনালিসা হিসেবে খ্যাত! কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার হল প্রায় দুশ বছর কেউ বুঝতেই পারেনি যে এই চিত্রকলাটি আসলে নকল! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাছাকাছি সময়ে জানা যায় এটি প্রকৃতপক্ষে আসলটির অবিকল প্রতিরূপ। এই জালিয়াতি যে করেছিল তারও সন্ধান পাওয়া যায়। তথাপি কর্তৃপক্ষ প্রদর্শনের জন্য এই অসাধারণ নকলটিকেই মিউজিয়ামে রেখে দেয়। জেমস এই ঘটনাটির মধ্যে চমকপ্রদ কিছু খুঁজে পায় না! তার বক্তব্য এই ঘটনাটি মানুষকে কেন জানতে হবে? এটা জানলে কি তফাৎ তৈরি হবে? প্রকৃতপ্রস্তাবে আসল ছবির নারীটিও তো সত্যিকারের একজন নারীর মুখের প্রতিরূপ। এমনকি মোনালিসাও প্রতিরূপ, লিসা দেল জিওকন্ডো (১৪৭৯-১৫৪২) বলে এক মহিলার মুখ দেখে আঁকা। এভাবে দেখলে সবকিছুই তো কিছু না কিছুর প্রতিরূপ! কিয়ারোস্তামি এখানে একটি দার্শনিক প্রতর্কের উৎসমুখ খুলে দিয়েছেন। একজন শিল্পী যখন কোনো মুখ আঁকেন বা একজন ভাস্কর যখন কোনো মানব মূর্তি, শূন্য থেকে কি তা সম্ভব? সামনে কোনো মডেল না থাকলেও, মূর্ত-বিমূর্ত যাই হোক, এতদিনের দেখা অজস্র মুখের সারি ভিড় করে থাকে নাকি তাঁর মগ্নচৈতন্যে (unconscious)? অন্যদিকে আবার এই লেখার শুরুতে উল্লেখিত বক্তব্যের সামনে এসে আমরা দাঁড়িয়েছি এখন ।
ওয়াল্টার বেঞ্জামিন আধুনিক পুনরুৎপাদনের সূত্রপাত হিসেবে ফটোগ্রাফি বা স্থিরচিত্রকে চিহ্নিত করার সঙ্গে সঙ্গে জানিয়েছিলেন, স্থিরচিত্র আসার ফলে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে চিত্রকলা। কারণ বাস্তবের হুবহু নকল চিত্রকলার চাইতে অনেক ভালোভাবে করতে পারে স্থিরচিত্র। চিত্রকলায় মানুষের হাত আছে কিন্তু স্থিরচিত্রে মানুষের হাত নেই, এই যুক্তিতে স্থিরচিত্রকে হীন করার চেষ্টা করা হলেও বলাবাহুল্য ব্যাপারটা ধোপে টেকেনি। পুনরুৎপাদন যোগ্যতা আরো একটি বৈপ্লবিক ব্যাপার ঘটিয়ে দিয়েছিল। বেঞ্জামিন জানাচ্ছেন একটা শিল্প একজনের কাছে আছে এই ব্যাপারটা ঐ শিল্পের মালিককে যে অসাধারণ মাহাত্ম্য বা স্বাতন্ত্র্য দেয়, পুনরুৎপাদন সেটাকে ধস্ত করে দেয়! মোনালিসা এখন আর লুভের মিউজিয়ামের দেওয়ালে সীমাবদ্ধ নেই, পত্রিকার পাতায়-পাতায় বাড়ির দেওয়ালে-দেওয়ালে এখন অসংখ্য পুনরুৎপাদিত মোনালিসা! মোৎজার্টের 'দি ম্যাজিক ফ্লুট' কোনো রয়াল অপেরা হাউজের রয়াল ব্যক্তিবর্গের কুক্ষিগত নয়, মোটামুটি একই দৃশ্যগত রেজোলিউশন ও একই স্বরক্ষেপনে তা এখন অসংখ্য মানুষের ড্রয়িংরুমে পুনরুৎপাদিত! ফলে শিল্পের এই গণতন্ত্রায়ন অর্থাৎ বিপুল পরিমাণ মানুষের প্রায় একইভাবে শিল্প উপভোগের যে উপায় তা এই পুনরুৎপাদন-ব্যবস্থা অবারিত করে দিয়েছে। অবারিত করেছে, আর তার ফলে নষ্ট হয়ে গেছে শিল্পের 'অরা' বা 'মহিমা'! এই 'অরা' ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের একটি প্রসিদ্ধ কয়েনেজ। ধরা যাক, ডাচ বারোক শিল্পী Johannes Vermeer(১৬৩২-১৬৭৫)-এর ১৬৫৮ সালে আঁকা বিখ্যাত চিত্র 'দা মিল্কমেইড' চুরি হয়ে গেছে। পরবর্তীকালে বিপুল অর্থ ঘোষণার প্রেক্ষিতে আবার ছবিটি খুঁজেও পাওয়া গেছে। তাহলে ছবিটির ব্যক্তি মালিকানা, হস্তান্তরিত মালিকানা, চুরি যাওয়া, অর্থের মূল্যে ফিরে পাওয়া এই সমস্তকিছু একটা সেনসেশন হিসেবে যুক্ত হচ্ছে ছবিটির সঙ্গে, ছবি-সংলগ্ন ইতিহাসকে করছে দীর্ঘ! বেঞ্জামিন বলছেন একটি মাত্র আসলের এই যে অনন্যতা, এইটা একটা শিল্পকে 'অরা' প্রদান করে। পুনরুৎপাদন এই 'অরা'-টাকেই ধ্বংস করে দিয়েছে। কারণ পুনরুৎপাদন যখন হবে তখন তো আমরা আর একটা পাচ্ছি না, একটার মালিকানার ইতিহাস পাচ্ছিনা, সবগুলোই তো এখন 'আসল'-এর অবিকল প্রতিরূপ! আসল 'দা মিল্কমেইড'-কে কেন্দ্র করে আজকের দিনে অনুরূপ ঘটনাগুলি ঘটলে, তা সেনসেশনের চাইতে অনেক বেশি করে ইনফরমেশন হিসেবে থাকবে মানুষের মনে।
পূর্বে উল্লেখিত আসল ও তার প্রতিরূপ সংক্রান্ত বক্তব্যের পর জেমস ও এলি একটি কফি সপে এসে বসে। জেমস জানায় বইটি লেখার ভাবনা তার মাথায় আসে বছর পাঁচেক আগে ফ্লোরেন্সে দেখা এক মা ও তার ছেলের থেকে। বইটি লেখার পিছনের ভাবনার চাইতেও, এলি বিশেষ করে আগ্রহী ঐ মা ও ছেলের সম্বন্ধে জেমসের কৌতূহলের সঠিক কারণটির ব্যাপারে। জেমস জানায়, হোটেলের ঘর থেকে প্রতিদিন এদেরকে সে দেখতে পেতো। নির্দিষ্ট দূরত্বে আলাদা আলাদা হেঁটে আসছে দুজনে। ডেভিডের ভাস্কর্যের তলায় একবারই ঐ মা ও ছেলেকে একসঙ্গে দেখেছিল সে! এলি আবেগাপ্লুত হয়ে পরে, এই ঘটনার সঙ্গে সে একাত্ম বোধ করছে! লক্ষ্য করার বিষয় উভয়ের ভাষা দুজনেরই অল্পস্বল্প জানা থাকা সত্ত্বেও, তারা যেন তাদের দেশজ ভাষায় একে-অপরের সঙ্গে কথা বলতেই বেশি আগ্রহী! যেন এতে করেই তাদের প্রধান সত্ত্বা সবথেকে ভালোভাবে প্রকাশ পাবে। তাদের কথাবার্তা কফি সপের মালকিনের তেমন বোধগম্য হয় না, আন্দাজে ওদের স্বামী-স্ত্রী ভাবে সে! স্ত্রী-পুত্র ইতালিতে থাকে, অথচ পাঁচ বছর পরেও জেমস ইতালিয়ান বলতে পারে না এটা তাকে অবাক করে! এলি হেসে জেমসকে বলে, "She thought you are my husband, I didn't correct her"! জেমস কৌতুকপূর্ণ ভাবে এলিকে বলে "স্পষ্টতই আমরা ভালো দম্পতি হতে পারি"! মালকিনকে বলে, "আমার পরিবার তাদের জীবন যাপন করছে, আমি আমার, তারা তাদের ভাষায় কথা বলে, আমি আমার ভাষায়"! এই কথায় আমরা এলিকে যথেষ্ট বিরক্ত হতে দেখি। জেমসের বক্তব্যকে সে ব্যক্তিগত ভাবে নেয়! এদের সম্পর্কের ব্যাপারটা শুরুতে যা মনে হচ্ছিল এখন যেন সেরকম লাগছে না! এরা কি তাহলে পুরানো দম্পতি নাকি তার ভান করছে? জেমসের উপরে বলা কথার মর্মার্থের সঙ্গে এলির ছেলের মাত্রাতিরিক্ত স্বাধীনচেতা জীবনের কোথায় যেন একটা মিল আছে, জেমস ঐ জীবনকে প্রকারান্তরে সমর্থনও করে! যদি তারা সত্যি দম্পতিও হয়, তাহলে এলির ছেলে জেমসের হোক বা না হোক, উভয় ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা জেমসের কাছে অস্বস্তির। এখান থেকেই আমাদের বিভ্রান্তির সূত্রপাত!
বস্তুত আসল ও তার প্রতিরূপের ভাবনাকে রূপ দিতে গিয়ে কিয়ারোস্তামি খোদ সিনেমার বিষয়েই নিয়ে আসতে চাইছেন অনুরূপ পরিবর্তন। সৌভাগ্যের প্রতীক 'গোল্ডেন ট্রি'-এর সামনে নববিবাহিত দম্পতি পনেরো-বছরের বিবাহিত জুড়ি জেমস ও এলির সঙ্গে ছবি তুলতে চায়। এলিই বলেছে তারা পনেরো বছরের পুরানো দম্পতি! এই ধাঁধা কিন্তু আন্তনিওনির 'ব্লো-আপ' বা 'লাভেন্তুরা'-র মত নয়, যেখানে চরিত্রগুলি বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে। এখানে বরং আমাদের মনে হয় অন্তর্নিহিত বাস্তবতা ব্যাপারটিই সম্পূর্ণ অনুপস্থিত, কিয়ারোস্তামি চিত্তাকর্ষক ভাবে খেলা করছেন আমাদের সঙ্গে! প্রকৃতপক্ষে যে চলচ্চিত্রকে ওয়াল্টার বেঞ্জামিন বলেছিলেন পুনরুৎপাদনের চূড়ান্ত, কিয়ারোস্তামি তাকে এবং তার বিষয়কে এই সন্দর্ভের অনুকূলে ব্যবহার করছেন।
বেঞ্জামিন জানিয়েছিলেন স্থিরচিত্র আসার পর শিল্পের 'অরা' চলে যাওয়ার কথা। তিনি আরো বলছেন, চলে গেলেও শুধুমাত্র মানুষের মুখের স্থিরচিত্রই ছিল এই 'অরা'-র শেষ আশ্রয়! যবে থেকে ব্যক্তিকে পরিপার্শ্বের প্রেক্ষাপটে স্থান দেওয়া হল, তবে থেকে ঐ 'অরা'-টুকুও চিরবিদায় নিলো স্থিরচিত্র থেকে। এটাই আসলে চলচ্চিত্রের পূর্বসূরি একটা উপকরণ! Certified copy ছবিতে আমরা মানুষের মুখের স্থিরচিত্রের আদল দেখেছি দুবার। এলি ক্যামেরার দিকে মুখ করে ঠোঁটে লিপস্টিক মাখে কানে দুল পরে, জেমস ক্যামেরার দিকে মুখ করে নিজেকে দেখে চুল ঠিক করে। এই ধরনের দৃশ্য-সম্পাদনা কিয়ারোস্তামির আরো অনেকে ছবিতে আমরা দেখতে পাই। ইঙ্গমার বার্গম্যান মনে করতেন ক্লোজআপ হল 'মুখশ্রীর অন্তরালের আত্মার' পরিচায়ক। ক্যামেরা স্থির থাকে আয়নার দৃষ্টিকোণ থেকে, কিয়ারোস্তামির চরিত্ররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ক্যামেরায়/আয়নায় এসে মুখ দেখায়। একদিকে 'মুখশ্রীর অন্তরালের আত্মা', অন্যদিকে এর সঙ্গে কাজ করছে স্থিরচিত্রের 'অরা' বা 'মহিমা'-র ধারণা। সিনেমার প্রাক-মুহূর্তকে ট্রিবিউট দিচ্ছেন যেন পরিচালক এখানে।
ডেভিড সদৃশ একটি স্থাপত্যের সামনে গিয়ে জেমস ও এলি বসে। জেমস বলে, "তুমি তোমার ছেলের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছ"! কিছুক্ষণ আগে যা ছিল জেমসের দেখা একটি মা ও ছেলের ঘটনা, তা এখন এলি ও তার ছেলেতে নির্দিষ্ট! এলি স্থাপত্যটির শৈল্পিকতা নিয়ে আগ্রহী নয়, সে আগ্রহী মেয়েটি যে ভাবে ছেলেটির কাঁধে মাথা রেখে আছে তাতে। স্থাপত্যের এই বিষয়টিই একে মহিমান্বিত করেছে, "I thought what mattered wasn't the work but how we look at it" - সে বলে। "এই লোকটির আর কিছু করার নেই মেয়েটিকে রক্ষা করা ছাড়া"- স্থাপত্যের দিকে তাকিয়ে জেমস বলে। আবেগপ্রবণতা ও দায়িত্ব-জ্ঞানহীনতার এই দ্বন্দ্ব এদের দুজনের মানসিকতার পরিচায়ক। অন্যদিকে নকল দম্পতির মধ্যে পরিচালক আরোপ করতে শুরু করেছেন আসলের বিভ্রম!
ফরাসি উপন্যাসিক ও প্রখ্যাত চিত্রনাট্যকার Jean-Claude Carrière (১৯৩১-২০২১)-কে ভ্রাম্যমাণ একজন পর্যটকের চরিত্রে দেখতে পাই আমরা। শুরুতে মনে হয় তিনি স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করছেন! কিন্তু দৃষ্টিকোণের পরিবর্তনে দেখা যায় তিনি আসলে সেল ফোনে কথা বলছিলেন। তাঁর স্ত্রী স্থাপত্যটির মাহাত্ম্যর ব্যাপারে এলির সঙ্গে সহমত হন। বেঞ্জামিনের সঙ্গে এখানে যুক্ত হয়েছে যাবতীয় মেটা-ন্যারেটিভ কে অস্বীকার করার উত্তর-আধুনিক ঝোঁক। উত্তর-আধুনিক চিন্তার একজন প্রধান পুরুষ জাঁ ফ্রাসোয়া লিওতার (১৯২৪-১৯৯৮) বলেছিলেন, ‘incredulity towards meta-narrative’। আধুনিকতায় মেটা-ন্যারেটিভের যে স্থান ছিল, মিথ, আপ্তবাক্য যেভাবে ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করত, শিল্পকর্ম থেকে শুরু করে সবকিছুকে দেখার যে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, উত্তর-আধুনিকতায় তা এসে ভেঙে পরে। বাস্তবতাকে বা সত্যকে উত্তর-আধুনিকতা খণ্ডিত ও আপেক্ষিক হিসেবে দেখতে শেখায়। দৃষ্টিকোণের পরিবর্তনে একই ঘটনা আলাদা হয়ে যায়। Certified copy-তেও আসল কি, সঠিক বাস্তব কি, সত্য কোনটা, যা দেখছি তার কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল, চরম ধন্দ তৈরি করে। কোনো কিছুর একটাই মানে, একটাই চরম সত্য, উত্তর-আধুনিক চিন্তায় অস্বীকৃত। আসলের বিভ্রমকে আরো মজবুত করতে কিয়ারোস্তামি দুটি অনবদ্য দৃশ্য সংযোজনা করেছেন এরপর। এলিকে দেখানো হয়েছে একটি চার্চে গিয়ে ঢুকতে। জেমস বলে, "তুমি বদলে গেছ..আমি মনে করি না তুমি কোনো দিন চার্চে যেতে.."। এলি প্রত্যুত্তরে তার ব্রা-টি দেখায় ও বলে, "I wanted to take off my bra.."। এলির বক্ষ-বিভাজিকা শুরুর অপরিচিত আকর্ষণের বস্তু থেকে এখন জেমসের মানসিকতায় অনেক দিনের চেনা বক্ষ-যুগলে রূপান্তরিত। এখন তাদের হুবহু আসল দম্পতির প্রতিরূপ লাগছে ! নাকি তারা আসল দম্পতিই? আসল ও তার প্রতিরূপে কি কোনো তফাৎ আছে? এই প্রশ্ন তুলতে গিয়ে পূর্বে বলেছি কিয়ারোস্তামি ব্যবহার করেছেন পুনরুৎপাদনের সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম খোদ সিনেমাকেই। এবং সিনেমার বিষয়কে করে তুলেছেন এর প্রকল্প! বিবাহের দিন তারা যে হোটেলে রাত কাটিয়েছিল তা আশেপাশেই আছে এলি বলে, কিন্তু জেমস মনে করতে পারে না (ইঙ্গিত থাকে শুরুতে দেখানো বিবাহের স্থানটিতেই তাদের বিয়ে হয়েছিল)। মনে করতে পারে না পনেরো বছর আগের চারপাশের পরিবেশকেও। পুনরায় একসঙ্গে থেকে যাওয়ার এলির অনুরোধে জেমস সারা দেয় না। শেষ দৃশ্যে শহরের উপকণ্ঠের সমস্ত চার্চে বেজে ওঠে ঘণ্টাধ্বনি। এই শব্দ মৃত্যু-ঘণ্টার মত শোনায় না কি ? ব্যর্থ বৈবাহিক সম্পর্কের অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু ? নাকি পুরোটাই তৈরি করা বিভ্রম?
বেঞ্জামিন আরো জানিয়েছেন, 'অরা'-র অবলুপ্তির মধ্যে দিয়ে শিল্পের আচার মূল্যের তুলনায় শিল্পের প্রদর্শনবাদীতা জয়ী হয়েছে। অবশ্য শিল্পের একটা গোপনীয়তার দিকও ছিল। যেমন যে মূর্তির রিচুয়ালিস্টিক মূল্য আছে দেখা গেছে অনেকসময় সেগুলি গোপন প্রকোষ্ঠে রাখা থাকতো! সেই মূর্তি দেখার অধিকার কিছু বিশেষাধিকার প্রাপ্ত মানুষের থাকত কেবল। কিন্তু কালে কালে তাও বদলেছে, অনেক মানুষের কাছে একসময় পুজো করা হতো এই তথ্যটুকুর বাইরে সেই মূর্তির শিল্প হিসেবে ছাড়া আর কোনো মূল্যই নেই আজ। ফলত প্রদর্শনযোগ্যতাই শেষ বিচারে আজকের যুগের প্রধান।
ইতিপূর্বে আমরা আলোকপাত করেছি গাড়ির দৃশ্যগুলিতে প্রদর্শনযোগ্যতা বা স্পেক্টাকলের কিয়ারোস্তামীয় অভিনবত্বের উপর। কিন্তু বেঞ্জামিনের ব্যত্যয় হিসেবে কিয়ারোস্তামির একটা গোপনীয়তার শিল্পও আছে। Like someone in love-এর শুরুর দৃশ্যের অফস্ক্রিন উপস্থিতির আলোচনায় আমরা ইঙ্গিত দিয়েছি ব্যাপারটার। প্রদর্শনবাদীতা ও গোপনীয়তার সংমিশ্রণ দেখতে পাই তার ঠিক পরের দৃশ্যে। আকিকো একজন কলেজ ছাত্রী, তার সঙ্গে সে বেশ্যাবৃত্তিও করে। আকিকোর বস আকিকোকে রাজি করে বৃদ্ধ অধ্যাপক তাকাশির (Tadashi Okuno অভিনীত) কাছে নিয়ে যেতে। এই বসকে আমরা ক্যাফের বাইরে ফোনে কথা বলতে দেখি। আকিকোর বদলে ক্যামেরার দৃষ্টি এখন তার বসের অবস্থান থেকে। কাঁচের ভিতর দিয়ে ক্যাফেটা দেখা যাচ্ছে সেখানে আকিকোও বসে আছে, আর কাঁচে ভূতের মত প্রতিফলিত হচ্ছে বসের সাদা জামা!
Like someone in love-এও কিয়ারোস্তামির ট্রেডমার্ক গাড়ির দৃশ্য আছে। গাড়ির কাঁচে আকিকোর মুখের উপর দিয়ে সরে সরে যাচ্ছে পোলারয়েডে, নিয়নে, গ্লোসাইনে ঢাকা টোকিও শহরের পুনরুৎপাদিত সামগ্রীর সারি সারি প্রতিচ্ছবি। বেঞ্জামিনের প্রদর্শনশীলতার আদর্শ নিদর্শন গাড়ির এই দৃশ্যগুলি। কিন্তু কিয়ারোস্তামির অভাবনীয় স্বকীয়তার পরিচয় পাই বৃদ্ধ তাকাশি ও আকিকোর নৈশ-আলাপচারিতার পর্বে। আকিকো একে একে বস্ত্র পরিত্যাগ করে। তাকাশি আকিকোকে দেখছে, কিন্তু তার মধ্যে কোনোপ্রকার কামনা নেই। আমরা কিন্তু আকিকোকে সরাসরি দেখছি না, দেখছি বন্ধ টিভির ধূসর কাঁচে আকিকোর প্রতিফলন! ইউরোপে ছবি করা সত্ত্বেও নারীদেহ প্রদর্শনের গতানুগতিক পথে কিয়ারোস্তামি হাঁটেন নি, সম্ভবত নিজের দেশ থেকে পাওয়া সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সুবাদেই। কিন্তু তার চাইতেও অবাক করা ব্যাপার হল, আবারও প্রদর্শন ও গোপনীয়তার এক অভিনব সংমিশ্রণ ঘটছে এখানে! তথাকথিত অবসিনিটিকে এড়িয়ে গিয়েও বাস্তবতার নির্মিতিতে থাকছে না কোনো ফাঁক, উপরন্তু এক নতুন ধরনের বাস্তবের নির্মিতি দেখছি আমরা।
তাকাশির ফ্ল্যাটের দেওয়ালে টাঙানো একটি মেয়ের ছবির দিকে তাকিয়ে আকিকো বলে, মেয়েটিকে তার মত দেখতে! তাকাশি জানায়, এটি আজ থেকে দুশ বছর আগে আঁকা একটি ছবি। এই ছবিটি পাশ্চাত্যের প্রভাবমুক্ত প্রথম জাপানি ছবি হিসেবে স্বীকৃত। আকিকো তাকাশির মৃত স্ত্রীয়ের ছবি দেখিয়ে বলে তাকে তাকাশির স্ত্রীয়ের মত দেখতে! আকিকোর প্রেমিক নোরিয়াকি আকিকোর পেশার ব্যাপারে কিছুই জানে না। ফলে তার বন্ধুর দেওয়া আকিকোর মত দেখতে একটি মেয়ের বিজ্ঞাপনের ছবি দেখে সে বিচলিত হয়। আকিকোকে জিগ্যেস করে সেই কিনা! আকিকো স্বভাবতই না বলে। পূর্ববর্তী Certified copy-র ধাঁধা এখানে নেই। কিন্তু আত্মপরিচয়ের সঙ্কট যা বিষয়ী-বাস্তবতার অবিচ্ছেদ্য অংশ, এখানে সেই দিকে আলোকপাত করা হয়েছে। পরের দিন তাকাশি আকিকোকে কলেজে পৌঁছে দেয়। কলেজের গেটে দাঁড়ানো নোরিয়াকি ভাবে তাকাশি আকিকোর দাদু। নোরিয়াকি আকিকোর প্রতি আসক্ত, সে তাকে বিয়ে করবেই। গাড়ির ভিতরের দৃশ্যে, সামনে বসা তাকাশি ও নোরিয়াকির মাঝখানে পিছনের সিটে বসা আকিকোকে আমরা দেখতে পাই। ত্রিকোণ বটে, কিন্তু সরলরেখায় বাধা নয়। ক্রমাগত আসা ফোন কল, ভয়েজ ম্যাসেজের বার্তাগুলি থেকে আমরা বুঝতে পারি আকিকো তাকাশির জীবনে একটা ব্যতিক্রম, এ তার প্রতিদিনের অভ্যাস নয়, সে বেশ্যাসক্ত নয়। তাহলে আকিকো কি তাকাশির বৃদ্ধ বয়েসের একাকীত্ব কাটানোর উপায়? তাকাশি কি চায় পরিচালক স্পষ্ট করেন নি। তাকাশির মধ্যে যৌনকামনা নেই, আছে আকিকোর রক্ষাকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার বাসনা। অসমবয়সী হলেও, এও তো ভালোবাসার মতই দেখতে লাগে! কোনটা তাহলে কি? একমাত্র নোরিয়াকির আসক্তিটা পরিষ্কার, বাকিটা ধোঁয়াশা। তাই Like someone in love-এর জোরটা ঐ Like শব্দটার উপর! নোরিয়াকি একসময় আকিকোর পেশার ব্যাপারে জানতে পারে, বুঝতে পারে তাকাশি দাদু নয়। নোরিয়াকির হাতে মার খাওয়ার পর তাকাশি যখন আকিকোকে পুনরায় বাড়িতে নিয়ে আসে, তখন পাশের বাড়ির বৃদ্ধা আকিকোকে তাকাশির নাতনি বলে ভাবে। পরিচালক অবলীলায় নোরিয়াকিকে সরিয়ে আকিকোকে একই জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেন! বৃদ্ধার দৃষ্টিকোণে ক্যামেরা বসিয়ে আপেক্ষিক বাস্তবতার শরিক করেন আমাদেরও। গোটা Certified copy জুড়ে একটা না বলা অফস্ক্রিন স্পেস আছে, কিন্তু Like someone in love-এ এই অফস্ক্রিন উপস্থিতি চরমে পৌঁছয় ছবির অসামান্য শেষ অংশে। ভয়েজ মেল, টেলিফোন বেজে চলা, তাকাশির ব্যক্তিগত পরিসরে জনগণের অনুপ্রবেশের রূপক। এই অনুপ্রবেশ হিংস্র ও অতর্কিত হয়ে ওঠে নোরিয়াকির শেষ আগমনে। নোরিয়াকিকে আমরা দেখতে পাইনা। স্ক্রিনে দেখতে পাই ঘর-বন্দি ভীত-সন্ত্রস্ত তাকাশি ও আকিকোকে, আর কানে শুনতে পাই ফ্ল্যাটের বাইরে ফ্ল্যাটের নীচে চলতে থাকা নোরিয়াকির তাণ্ডবের শব্দ! ছবির অদ্ভুত শুরু ও অদ্ভুত শেষ, একটা শূন্যতার বোধ দেয়। মনে হয় বাইরে থেকে পর্যবেক্ষণ করে আমাদের পক্ষে সম্ভবই নয় চরিত্রগুলির সঠিক অবস্থা উপলব্ধি করা। চরিত্রগুলিকে নিজের ছন্দে বিকশিতই হতে দিল না আমাদেরই পক্ষপাতদুষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি যেন, এরকম একটা অনুভূতি হয়!
দর্শকের সঙ্গে ক্রমাগত খেলা করে যাওয়ার একটা ব্যাপার আলোচ্য ছবি দুটিতে আছে তা আমরা দেখলাম। খোদ এই দর্শকেই ছবির বিষয় করে কিয়ারোস্তামি তৈরি করেছিলেন Ten এবং Shirin নামে ছবি দুটি। একটি গাড়ি, একজন ড্রাইভার ও তেহরান শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে ওঠা একাধিক সহ-নাগরিক, এই হল Ten-এর চরিত্ররা! দুটি ডিজিটাল ক্যামেরার একটি চালকের দিকে তাক করা, অপরটি প্যাসেঞ্জারদের দিকে। দশটি এপিসোডে বিভক্ত বহুস্তরীয় এ ছবি তেহরান শহরের চলমান দিনলিপি, মানুষের আত্মার ধারাবিবরণী। এত একাগ্র যে ঐ গাড়ির একজন হিসেবে আপনি নিজেকে ভাবতে বাধ্য! Ten –এর চলমানতার ঠিক উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে Shirin ছবিটি। স্থান একটি প্রেক্ষাগৃহ। দেখানো হচ্ছে Khosrow and Shirin নামে পারস্যের একটি প্রাচীন রোমান্স। আমরা মানে ছবির দর্শকরা কিন্তু সেটা দেখছি না, Khosrow and Shirin আমাদের কখনই দেখানো হয় না। আমরা দেখছি প্রেক্ষাগৃহের দর্শকদের! দৃশ্য ও শব্দের বিযুক্তির খেলা এখানে আরও নিরীক্ষামূলক! দৃশ্যপটে একের পর এক নারীর ক্লোজআপ (মোট ১১৩ জন, Juliette Binoche-ও এদের মধ্যে একজন), শব্দপটে Khosrow and Shirin-এর সংলাপ-শব্দ-আবহসংগীত। Khosrow and Shirin-এর একেকটি দৃশ্যে একেকজন নারীর (দর্শকরা শুধুমাত্র নারী) একেক রকম অভিব্যক্তি। খেয়াল করুন আমরা ছবির দর্শকরা কিন্তু দ্বিতীয় ক্রমের দর্শক। চলচ্চিত্র দর্শকরা দেখে, কিন্তু দর্শকদের অভিব্যক্তিকেই চলচ্চিত্রের বিষয় করা, এই ভাবনাটাই তো অভিনব। ওয়াল্টার বেঞ্জামিন বলবেন আজকের দিনের সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতায় যেহেতু মানুষের সমবেত অংশগ্রহণ অনেক বেড়ে গেছে তাই মানুষ আর একা একা নয়, একসঙ্গে শিল্প উপভোগ করতে চায়। তাই চলচ্চিত্রই আজকের যুগের অনিবার্য ও উপযুক্ত শিল্পমাধ্যম ! চলচ্চিত্রের নান্দনিকতাকে আর আগের যুগের নন্দনতত্ত্ব দিয়ে বুঝলে চলবে না, বুঝতে হবে আজকের সমাজ-বাস্তবতার নিরিখে তৈরি নতুন নন্দনতত্ত্ব দিয়ে। একটি নবতর নন্দনতত্ত্বের উপযোগী করে চলচ্চিত্রকে যারা চলচ্ছব্দচিত্রে রূপান্তরিত করেছিলেন আব্বাস কিয়ারোস্তামি থাকবেন তাদের মধ্যে একদম প্রথম সারিতে।