

চল্লিশ-বিয়াল্লিশ বছর আগের কথা, পরাধীনতার ঘা তখনও শুকোয়নি গা থেকে – একটা পালার অপটু অভিনয়ে মেতে উঠতাম কচিকাঁচার দল। শীতের বিকেলে চুলোয় ফুঁ দেওয়া এক অব্যবহৃত ‘ফুঁকনি’ ধরে চিৎকার করত আমার পিঠোপিঠি ছ’বছরের ভাই: ‘হ্যালো-ও, মাইক টেস্টিন, হ্যালো-ও – আর কিছুক্ষণের মধ্যে শুরু হবে আমাদের যাত্রাপালা – পলাশী-ই-ইর যুদ্ধ!’ এই পথেই, সেকালে আমাদের হিরো ছিলেন দু’জন – নেতাজি ও নজরুল। টিভি, ভিডিও তখনও ঢোকেনি গাঁয়ে, খাওয়া-পরা যেমনই হোক, অনন্ত সময় ছিল হাতে। কত কিসিমের গল্প যে হত! একদিন ফাইভে পড়া ছেড়ে দেওয়া এক সিনিয়ার জিজ্ঞেস করল, ‘কে বড় কবি কহতো – রবীন্দোনাত, না নুজরুল?’
– রবীন্দ্রনাথ!
– ঠিক কহ্যাছিত। তেবে অকে টেক্কা দিছল নুজরুল – গরিম মানুষের ছ্যাল্যা হল্যে কী হব্যে!... রবীন্দোনাত তখন কী চাল্লাকি লিলে জানিস? নিজের লাতিনের সঁতে বিহ্যা দিয়্যা দিলে! আর ম্যাঙ্ঙ্যার ভুলানিতে গাচ খ্যায়্যা খ্যাপা হয়্যা গেল নুজরুল।’
আজগুবি হলেও একথা বিশ্বাস করার মত লোক তখনও ছিল গাঁয়ে, যেমন ধারণা ছিল, ফিরে আসবেনই নেতাজি – ‘ভারত পাকিস্তান একসঁত হয়্যা য্যাইবে ফের... যত্ত সোনাদানা লুট কইরা লিয়্যা গেলছে বিল্যাতীরা, গলায় গামছা লাগিয়্যা ফ্যারত লিবে কড়্যায়-গণ্ড্যায়!’
তো, নেতাজিকে নিয়ে আশায় ছাই পড়ে গেল একদিন – আব্বা বললেন, তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান উনি, স্বাধীনতারও আগে, আর নজরুল নিয়ে ওই গল্পটা ‘ফালতু, মনগড়া... নজরুলকে ছেলের মত ভালোবাসতেন রবীন্দ্রনাথ।’
প্রাইমারিতে পড়ার সময় হাইস্কুলের রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যায় যেতাম আমিও, পিসতুতো দিদির সঙ্গে। ‘মম চিত্তে নিতি নিত্যে’র পাশাপাশি দু’চোখ ভরে দেখেছি ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ নাচ। দু’জনের ছবি টাঙানো থাকত স্টেজের দেওয়ালে – যেন গুরু আর শিষ্য। তবু, গাঁইয়া জীবনে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে নজরুলই ছিলেন আপন হয়ে। এমন নয়, যে খুব একটা চর্চা হত ওঁকে নিয়ে – অন্য কথা কী আর বলি, একটা ‘সঞ্চিতা’ও ছিল না আমাদের পাড়ায়, আমার নিজের কাছেও পড়ার বইয়ের বাইরে ছিল ‘আবোল তাবোল’, ‘খাই খাই’ ইত্যাদি, পড়ে পড়ে মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল প্রায় – কিন্তু নজরুল অনুরাগী সবাই। এখন ভাবি, কোরান না বুঝে বা পড়ে যেমন মুসলমান সবাই, তেমনি কি এই ব্যাপারেও? বক্সার মহম্মদ আলি বা গায়ক মহম্মদ রফির মত?
না, বরং এখানেই অনন্য নজরুল। পড়ে নয়, সাক্ষর-নিরক্ষর নির্বিশেষে, তাঁকে পেয়েছি আমরা শুনে – সীমান্ত এলাকার মানুষ বলে রেডিওতে বাংলাদেশ ধরে। রমজান মাসে ইফতারের পর গান হত রোজ – ‘শোনো শোনো য়্যা ইলাহী আমার মোনাজাত’, ‘রোজ হাশরে আল্লাহ আমার করো না বিচার’ ইত্যাদি। সারাদিন খাটাখাটনি করে রোজা-রাখা মানুষ এসব শুনে ফের প্রস্তুত হত তারাবীহ নামাজের জন্য। ঈদ এগিয়ে এলে বাজত ‘দে জাকাত, দে জাকাত, তোরা দে জাকাত। তোর দিল খুলবে পরে ওরে আগে খুলুক হাত।’ আর চাঁদ উঠলে? আহা! ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ!’...
গান ছিল বকরাঈদ, হজ, শবেবরাত, মিলাদুন্নবী, মহরম, এমনকি প্রতিদিনের আজান-নামাজ নিয়েও। এছাড়া হামদ ও নাতের গজলগুলো শুনুন! এত সহজে, এত গভীরে গিয়ে ইসলামের মর্মবাণী বিশ্বসাহিত্যে আর কেউ ফুটিয়ে তুলেছেন বলে জানা নেই আমার। হ্যাঁ, ইকবাল এবং রুমির কথা মাথায় রেখেই বলছি। ওঁরা মহাকবি, কিন্তু নজরুল লিখেছেন আনপড় চাষিমজুর ও কারিগরের ভাষায়; এবং মন দিয়ে এগুলো শুনেছেন যাঁরা, একবাক্যে বলবেন, ধর্মের শাঁসটুকুই পরিবেশন করেছেন উনি – তাঁর দেশপ্রেমের গান-কবিতা যেমন বিশ্বপ্রেমের অন্তরায় নয়, তেমনি গায়ে ইসলামী লেবাস থাকলেও আখেরে মানবতার জয়গান এগুলো।
শুধু কি ইসলামী? একটু বড় হতে, ফাইভ-সিক্সে, সান্নিধ্য পেয়েছিলাম অকৃতদার এক মাস্টারমশায়ের, সরোজ কুমার লাহিড়ী। হারমোনিয়াম বাজিয়ে সকাল-সন্ধ্যা শুধু নজরুলগীতিই গাইতেন উনি। সব ভক্তিগীতি – ‘শ্মশানে জাগিছে শ্যামা মা’, ‘ব্রজগোপী খেলে হোরী’ ইত্যাদি। রোজা-নামাজ শুরু করা আমি তন্ময় হয়ে শুনতাম নদীর ধারে। মনে পড়ছে নজরুলের সেই উক্তি ‘সাহিত্য যদি সত্যকার সাহিত্য হয়, তবে তা সকল জাতিরই হবে। তবে তার বাইরের একটা ফর্ম থাকবে নিশ্চয়।’ আর এই ফর্ম দিতে গিয়ে হিন্দু-মুসলমান দুটি কুসুমকেই সমান মর্যাদা দিয়েছেন উনি। কারণটা বলি নজরুলেরই ভাষায় (বাংলা সাহিত্যে একাজে তাঁর ধারেকাছেও যে নেই কেউ) – ‘ইংরেজের শাসন সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছে এই যে, তার শিক্ষা-দীক্ষার চমক দিয়ে সে আমাদের এমনি চমকিত করে রেখেছে যে, আমাদের এই দুই জাতির কেউ কারুর শিক্ষা-দীক্ষার সভ্যতার অতীত মহিমার খবর রাখিনে।... ইংরাজের কৃপায় ইংরাজি, গ্রিক, ল্যাটিন, হিব্রু থেকে শুরু করে ফ্রেঞ্চ, জার্মান, হনলুলু, গ্রিনউইচ, চিনা, জাপানী ভাষা জানি, ইতিহাস জানি, তাদের সভ্যতার খবর নিই কিন্তু আমারই ঘরের গায়ে গা লাগিয়ে যে প্রতিবেশীর ঘর তারই কোনো খবর রাখিনে বা রাখবার চেষ্টা করিনি।’
‘জন-সাহিত্য’ অভিভাষণে বড় আক্ষেপে বলেছিলেন উনি, ‘আজকাল আমাদের সাহিত্য বা সমাজনীতি সবই টবের গাছ। মাটির সাথে সংস্পর্শ নেই।’ কথাটা ফলে গেল আমার নিজের ক্ষেত্রেও। ইলেভেনে ধরল কবিতার ভূতে – কী, না আধুনিক কবি হতে হবে! তো, লিখতে গেলে পড়তেও হয়, একহাজার লাইন পড়লে তবেই নাকি এক লাইন আসে কলমের ডগায়। পড়তে পড়তে, চর্চা করতে করতে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যের পাঠ নিতে গিয়ে আরও বেশি করে, দূরে সরে গেলাম নজরুল থেকে। সাধে কি আর বলেছিলেন নজরুল, যে, ‘য়ুনিভারসিটির দ্বার থেকে ফিরে য়ুনিভারসের দ্বারে হাত পেতে দাঁড়ালাম।’
যাক, ব্যাপারটা নিছক ব্যক্তিগত হলে দরকারই ছিল না এত কথার। কিন্তু দশকের পর দশক ধরে কবিতার নামে কী দেখছি আমরা? স্বকাম-মর্ষকাম কিম্বা ভঙ্গিসর্বস্বতা। একটু অন্যরকম ভাবেন যাঁরা, তাঁদেরও, যোগ থাকলেও আত্মীয়তা নেই জনগণের সাথে। অথচ, সমস্যার কি অন্ত আছে দেশে? কোথায় সেই ক্রোধ ও ফরিয়াদ? কঠিন কঠিন কথায় কীসব নিদান দেন মনীষী কবিরা! আর নির্জীব হলে যা হয়, প্রকৃত প্রেম, নির্মল আনন্দ থেকেও বঞ্চিত আধুনিক কবিকুল। প্রেমের কথা উঠলই যখন – বেশি ফেনিয়ে-গেঁজিয়ে না ভেবে, নরনারীর প্রেমকে যদি স্বাভাবিক চোখে দেখি, গানে-কবিতায় অদ্বিতীয় নজরুল। এত আত্মকথা লেখেন কবিরা, কাউকেই তো লিখতে হল না ‘আমার কৈফিয়ৎ’! অথচ নজরুল লেখেন জীবনের সাতাশটি মাত্র বর্ষা ও বসন্ত পার হওয়ার আগেই। কী ব্যাপ্তি কবিতাটার! কবিতা যদি শুধু আত্মপ্রকাশও হয়, তবুও তুলনা নেই ‘বিদ্রোহী’র। নজরুলের কবিতায় নাকি বিবর্তন নেই! কাকে বলে বিবর্তন? অভিজ্ঞতায় ক্রমশ গভীর ও ব্যাপ্ত হওয়া তো? বিষয়ের কথা থাক, আর্টের বিচার হোক আর্ট দিয়েই – খুব বেশি কসরৎ করতে হবে না, ‘অগ্নিবীণা’র ‘খেয়াপারের তরণী’ ও ‘সর্বহারা’র ‘কাণ্ডারী হুশিয়ার’ পাশাপাশি রেখে পড়ুন। সেই তরী ও কাণ্ডারী, সেই পারাপারের কথা, কিন্তু শৈলী ও শব্দচয়নে কী ফারাক!
এবার ফিরে আসি স্কুলছুট সেই ‘সিনিয়ারে’র কথায়। ‘গাচ খ্যায়্যা’ নির্বাক হননি নজরুল, হয়েছিলেন অপ্রেমে ভরা পৃথিবীর ভারে, প্রমাণ ‘যদি আর বাঁশী না বাজে’। কিন্তু মোহিনী এক বিষবৃক্ষের মায়ায় ‘খ্যাপা’ হয়ে গেছি আমরা আজ। নইলে, কোন স্পর্ধায় দেশপ্রেমের সংজ্ঞা বানায় সাম্রাজ্যবাদের পা-চাটা কুকুরেরা? হারানো সেই হুঁশ ফিরে পেতে, নতুন করে যেতে হবে ‘নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায়’ নেওয়া সেই নীলকণ্ঠের কাছে। ভবিষ্যতের ‘নবী’ হতে চাননি বলেই আজও ‘বর্তমানের কবি’ তিনি।
মোহাম্মদ জিয়াউর রহমান | 223.233.***.*** | ২৭ মে ২০২২ ১৯:৪৭508124
তৌহিদ হোসেন | 2402:3a80:1cd0:ad0a:178:5634:1232:***:*** | ২৭ মে ২০২২ ২১:১৯508125
নুরুল হাসান | 103.18.***.*** | ২৭ মে ২০২২ ২১:২৬508126
শুভঙ্কর | 2402:3a80:1c8f:112a:5bb5:b979:fcea:***:*** | ২৭ মে ২০২২ ২১:৪৯508127
বোঝো কান্ড | 69.195.***.*** | ২৭ মে ২০২২ ২২:০৮508128
অনুপম নিয়োগী | 146.196.***.*** | ২৭ মে ২০২২ ২২:২৫508129
আলী হোসেন | 117.226.***.*** | ২৭ মে ২০২২ ২২:৩৪508130
ঝত দা | 202.142.***.*** | ২৭ মে ২০২২ ২২:৫১508131
তারিফ হোসেন | 2401:4900:3a0c:9ec:57b0:80a8:ae39:***:*** | ২৭ মে ২০২২ ২৩:১৫508132
বিষেষন কম পড়িয়াছে? | 162.244.***.*** | ২৮ মে ২০২২ ০০:০৭508133
Sangrami Lahiri | 69.112.***.*** | ২৮ মে ২০২২ ০০:১৬508135
তৌহিদ হোসেন | 2402:3a80:1cd0:b542:178:5634:1232:***:*** | ২৮ মে ২০২২ ০০:১৯508136
আজিম শেখ | 2409:4061:10d:4699:e0bf:2692:a0d:***:*** | ২৮ মে ২০২২ ০১:৪৭508137
aranya | 2601:84:4600:5410:88fd:c9f2:7b67:***:*** | ২৮ মে ২০২২ ০৩:১০508138
আসাদুজ্জামান | 103.15.***.*** | ২৮ মে ২০২২ ০৫:৪২508139
মুহাম্মদ সেলিম রেজা | 2402:3a80:1102:88ec::670c:***:*** | ২৮ মে ২০২২ ০৫:৪৮508141
হরি শঙ্কর | 2405:201:9004:2010:f564:a8b8:b57e:***:*** | ২৮ মে ২০২২ ০৮:০৭508147
তৌহিদ হোসেন | 2402:3a80:1cd0:ad5c:178:5634:1232:***:*** | ২৮ মে ২০২২ ১৪:২৭508174
Sabnam Hossain | 2409:4060:2d92:c0bf::e1ca:***:*** | ২৮ মে ২০২২ ২১:৩০508184
হেনা আজমি | 2401:4900:3bf0:7cc5:900f:b316:8d65:***:*** | ৩০ মে ২০২২ ২২:৪১508257
এম এম আব্দুর রহমান | 2409:4060:2d8e:8eab:f9a4:a956:3213:***:*** | ৩১ মে ২০২২ ১৯:০৭508320