

নজরুলকে যাঁরা কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁরা একটা কথা অবশ্যই স্বীকার করবেন, তাঁর চরিত্র আবেগময়। অনুভূতিপ্রবণ হৃদয় বহিরঙ্গেও স্পষ্ট ছাপ ফেলে যেত। ভেতর-বাইরে সবই হাট করে খুলে রাখতেন। কখনোই কিছু আড়াল করেননি। জীবনের তানপুরার তারগুলি সর্বদাই চড়া সুরে বাঁধা। একটু আঘাতেই তা রিনরিন করে ওঠে। ছিঁড়েও যায়।
ভাঙাগড়ার খেলার মাঠে লাভ লোকসানের হিসেবে কবির মন ছিল না। বোহেমিয়ান চরিত্রের জাত চিনিয়ে দিত তাঁর কবিতাগুলি। তার মধ্যে সবার আগে আসে 'বিদ্রোহী' কবিতাখানি। ১৯২১-এর ডিসেম্বরে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা দিয়েই তাঁর বাংলা কাব্যসাহিত্যে অভিষেক। নজরুলের বয়েস তখন মাত্রই তেইশ বছর। এ কবিতা এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে কবিতার নামেই কবির পরিচয় নির্দিষ্ট হয়ে গেল - বিদ্রোহী কবি নজরুল।
সেই কবিতা রচনার ইতিহাসটিও কম রোমাঞ্চকর নয়। যদিও কবির জীবনীগ্রন্থ সেভাবে কিছু নেই, ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের স্মৃতিকথায় আমরা তাঁকে পাই। এ ব্যাপারে বিখ্যাত রাজনীতিবিদ মুজফ্ফর আহমদের স্মৃতিকথার বইটি অগ্রণী। দীর্ঘকাল একসঙ্গে বসবাস করার ফলে মুজফ্ফর আহমদ নজরুলকে নিয়ে যতটা প্রামাণ্য তথ্য দিয়েছেন, এমনটি আর কারো লেখাতেই পাই না। তিনিই আমাদের বিদ্রোহী কবিতা রচনা ও প্রকাশের গল্পটি শোনালেন।
১৯২১ সাল, নজরুল ও মুজফ্ফর আহমদ তখন ৩/৪সি তালতলা লেনের বাড়িতে থাকেন। নিচের তলার দক্ষিণপূর্ব কোণের একখানি ঘরে। অনেকেই যাতায়াত করেন সেখানে। কবি মোহিতলাল মজুমদারেরও যাতায়াত ছিল, তবে তখন সে বন্ধুত্বে ভাঁটির টান। একসময় নজরুল মোহিতলালের কবিতায় উচ্ছ্বসিত ছিলেন, তাঁকে গুরু মানতেন। এখন ঠিক ততটা আর মুগ্ধ নন। পুজো কেটে শীত এল। ব্রিটিশ রাজত্বে ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে সব জায়গায় বড়দিনের ছুটি। ছুটির এক ভোরে মুজফ্ফর আহমদকে পাকড়াও করলেন নজরুল, "একটা কবিতা লিখেছি, শুনবে?" উৎসাহে চোখ চকচক করছে।
উচ্ছ্বাস, উৎসাহ নজরুলের স্বভাবেই আছে। দুকূল ছাপানো ভরানদীর মত তা সামান্য কারণেই উছলে পড়ে। মুজফ্ফর তাই অবাক হলেন না। তবে নজরুল ভোরে ওঠার মানুষ নয়। এত সকালে সে কবিতা শোনাতে চাইছে মানে নিশ্চয়ই বিশেষ কোনো কবিতা। কখন লিখল সেটি? মুজফ্ফর আহমদ মনে মনে ভাবছেন, তিনি রাত দশটার সময় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তারপর নজরুল কী করেছে তিনি জানেন না।
গুছিয়ে বসলেন দুজনে। নজরুলের হাতে একখানি কাগজ। মুজফ্ফর লক্ষ্য করলেন, তাতে পেন্সিল দিয়ে কবিতাটি লেখা আছে। তার মানে দোয়াতে কলম ডুবিয়ে ডুবিয়ে লেখার ধৈর্য ছিল না। সম্ভবত বন্যার মতো এসেছে সৃষ্টির ধারা। নজরুল পড়লেন পুরো কবিতাটি। মুজফ্ফরই প্রথম শ্রোতা। বুঝলেন, সম্ভবত নজরুলের কবিজীবনের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। তবে স্বভাবটি তাঁর নজরুলের বিপরীত, কোনোকিছুতেই বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে উঠতে পারেন না। তাঁর সংযত প্রশংসায় নজরুলের মন ভরেনি। মুজফ্ফর তাঁর বইতে লিখে গেছেন সে কথা, নিজেকে দোষারোপও করেছেন, কেন আরো আবেগময় অভিনন্দনের বন্যায় কবিকে ভাসিয়ে নিতে পারলেন না! এমন কবিতাটি সত্যিই যে কোনো কবির সাধনার ধন।
বেলা বাড়লে বাড়িতে এলেন আফজালুল হক, 'মোসলেম ভারত' পত্রিকার সম্পাদক। 'মোসলেম ভারত' পত্রিকা ব্রিটিশ ভারতের মুসলিম লেখকদের সাহিত্যপ্রতিভা বিকাশে উৎসাহ দেয়। কবিতা শুনে তিনি মুগ্ধ। হৈচৈ শুরু করে দিলেন, "এখনই কপি করে দিন, আমাদের কাগজের জন্যে।" নজরুল দিলেন। আফজালুল হক চলে গেলেন কবিতাটি নিয়ে।
তারপর দুপুরের আগেই এসে হাজির অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য। যিনি বোমার মামলায় বারীন ঘোষের সহবন্দী ছিলেন। সব শুনে বললেন, "পাগল নাকি, আফজালুলের কাগজ কবে বেরোবে তার ঠিক কী? এত ভালো কবিতা, তুমি আমায় দাও দেখি, 'বিজলী'তে ছাপাব।" তাঁকেও কবিতাটি কলম দিয়ে লিখে কপি করে দিলেন নজরুল।
এবং 'বিদ্রোহী' কবিতা সাপ্তাহিক 'বিজলী'তেই আগে বেরোল। জানুয়ারি মাসে প্রথম সপ্তাহেই। তখন কলকাতায় পৌষমাসের বৃষ্টি। শীতে কাঁপতে কাঁপতে বৃষ্টি মাথায় করে করে প্রচুর লোক 'বিজলী' কাগজ কিনলেন, পড়লেন। এত চাহিদা হল যে সেই সপ্তাহের 'বিজলী' আবার ছাপতে হল। মুজফ্ফর আহমদের দেওয়া তথ্যসূত্র অনুযায়ী, ঊনত্রিশ হাজার কপি ছাপা হয়েছিল দু'বারে। তুমুল জনপ্রিয়তার শিখরে উঠলেন নজরুল।
এ কবিতা পড়ে স্বয়ং কবিগুরু নজরুলকে বুকে চেপে ধরেছিলেন।
পরে আরও অনেক পত্রিকা 'বিদ্রোহী' পুনর্মুদ্রণ করেছিল, অবশ্যই তারা 'বিজলী' পত্রিকার কাছে ঋণস্বীকার করেছে। বিখ্যাত প্রবাসী পত্রিকাও সেই তালিকায় আছে। নজরুলের কবিখ্যাতি বেড়েই চলল। প্রকাশের দুবছর পরেও বিদ্রোহী জনপ্রিয়তার তুঙ্গে।
ঈর্ষান্বিত হলেন কিছু মানুষ। নজরুলের উল্কার মত উত্থান তাঁরা মোটেই ভালো চোখে দেখলেন না। কোথাকার কোন ভুঁইফোঁড় ছোকরা, পল্টন থেকে ফিরেই সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়ে জনপ্রিয় কবি হয়ে গেল? প্রতিষ্ঠিত কবি মোহিতলাল মজুমদার বললেন, নজরুল নাকি তাঁর 'আমি' নামে একটি লেখার ভাব চুরি করেছেন। একবছর আগে ‘মানসী’ পত্রিকার পৌষ সংখ্যায় বেরিয়েছিল তাঁর 'আমি' লেখাটি। সে যুক্তি ধোপে টিঁকল না। লোকে হেসেই উড়িয়ে দিল, মোহিতলাল কি 'আমি' কথাটার পেটেন্ট নিয়েছেন? আর কেউ 'আমি' ব্যবহার করে কিছু লিখতে পারবে না? হাস্যকর দাবি সন্দেহ নেই।
'শনিবারের চিঠি'র সম্পাদক সজনীকান্ত দাসও মাঠে নামতে দেরি করলেন না। সেই সজনীকান্ত, যিনি তাঁর হুলফোটানো লেখা আর ব্যঙ্গাত্মক কুটুস কামড়গুলির জন্যেই বিখ্যাত হয়ে আছেন। শনিবারের চিঠি জনপ্রিয় সাহিত্য পত্রিকা। যোগানন্দ দাসের সম্পাদনায় প্রথম আত্মপ্রকাশ। পত্রিকার উদ্দেশ্যই ছিল সুখ্যাত মানুষদের সমালোচনা, ব্যঙ্গবিদ্রূপ। প্রথম টার্গেট ছিলেন স্বয়ং দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ও তাঁর স্বরাজ্য দল। যেই নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতা জনপ্রিয় হল, সঙ্গে সঙ্গে কামানের মুখ ঘুরে গেল। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি ছিল এই:
"বল বীর -
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!
বল বীর -
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি’
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া,
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর!
মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!
বল বীর -
আমি চির উন্নত শির!"
'ভবকুমার প্রধান' ছদ্মনামে সজনীকান্ত ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্যারোডি লিখলেন কামস্কাটকীয় ছন্দে:
“আমি ব্যাঙ
লম্বা আমার ঠ্যাং।
ভৈরব রসে বরষা আসিলে,
ডাকি যে ঘ্যাঙর ঘাং।
আমি ব্যাঙ।”
'ব্যাঙ' কবিতাটি ভূমিকাসহ শনিবারের চিঠিতে প্রকাশিত হল এবং বেশ জনপ্রিয়ও হল। বিশেষ করে কবি মোহিতলাল মজুমদার ‘ব্যাঙ’ কবিতাটি নিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন এবং জনে জনে শুনিয়ে বেড়াতে লাগলেন। ঈর্ষার কী বিচিত্র রূপ!
ষড়রিপুর ষষ্ঠ রিপুটি অনেককেই জ্বালাতন করেছিল, সন্দেহ নেই।
গোলাম মোস্তফা নজরুলের সমসাময়িক আরেকজন খ্যাতিমান কবি ও গীতিকার। মূলত ইসলামী আদর্শ, মুসলিম ঐতিহ্য ও প্রেম নিয়ে কবিতা, গান, অনুবাদসাহিত্য রচনা করে গেছেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রক্ত রাগ’এর প্রশংসা করেছেন। গোলাম মোস্তফারও প্রাণে ঈর্ষা জেগেছিল বোধ করি। একখানি প্যারোডি তিনিও লিখেছেন। ‘নিয়ন্ত্রিত’ নামের সেই কবিতায় তিনি 'বীর'কে উপদেশ দিয়েছেন 'সংযত’ হতে, নইলে মুণ্ড নিয়ে বিপাকে পড়তে হতে পারে!
"ওগো বীর!
সংযত কর, সংহত কর ‘উন্নত তব শির।
বিদ্রোহী? শুনে হাসি পায়!
বাঁধন-কারার কাঁদন কাদিয়া বিদ্রোহী হতে সাধ যায়?
সে কি সাজে রে পাগল সাজে তোর?
বাঁধন-কারার কাঁদন কাঁদিয়া বিদ্রোহী হতে সাধ যায়?
সে কি সাজেরে পাগল সাজে তোর?
আপনার পায়ে দাঁড়াবার মত কতটুকু জোর আছে জোর?
ছি ছি লজ্জা, ছি ছি লজ্জা!"
তবে এ সবই হল খ্যাতির বিড়ম্বনা। বিখ্যাত হলে 'শনিবারের চিঠি' কখনোই তাকে ছেড়ে কথা বলবে না। প্রতি সপ্তাহে সজনীকান্ত নিয়ম করে নজরুলের নিন্দেমন্দ করে যেতে লাগলেন। নজরুলের গান ও কবিতার প্যারোডি ছাপতে লাগলেন। বেশ কয়েকবছর এই অত্যাচার সহ্য করে তিতিবিরক্ত নজরুল উনিশশো ছাব্বিশে কল্লোল পত্রিকায় কবিতা লিখলেন ‘সর্বনাশের ঘণ্টা’। সে কবিতায় শুধু সজনীকান্তই নয়, একসময় যাঁকে গুরু মানতেন সেই মোহিতলালকেও ছেড়ে কথা কইলেন না। বেশ দু'কথা শোনালেন দুজনকেই:
"রক্তে আমার লেগেছে আবার সর্বনাশের নেশা।
রুধির-নদীর পার হতে ঐ ডাকে বিপ্লব-হ্রেষা।
হে দ্রোণাচার্য। আজি এই নব জয়যাত্রার আগে
দ্বেষ-পঙ্কিল হিয়া হতে তব শ্বেত পঙ্কজ মাগে
শিষ্য তোমার, দাও গুরু দাও তব রূপ-মসী ছানি’
অঞ্জলি ভরি’ শুধু কুৎসিত কদর্যতার গ্লানি।"
এখানে 'গুরু' আর কেউ নন, মোহিতলাল।
নজরুলের কবিতার সবচেয়ে বড় সমালোচনা ছিল এই যে সেগুলি চড়া সুরে বাঁধা, শিল্পবোধ কম, আবেগ বেশি। নান্দনিকতা কম, চিৎকার বেশি। উন্নাসিক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নজরুলের জনপ্রিয়তাকে বোধহয় কিছুটা হীন চোখে দেখেছিল। আমজনতা নজরুলকে নিয়ে মাতামাতি করছে, কিন্তু আভিজাত্য ও নান্দনিকতার পরীক্ষায় নজরুলকে ফেল করিয়ে দেবার মত লোকের অভাব ছিল না।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, পরবর্তীকালেও এ ধরণের সমালোচনা চালু ছিল। যেমন, আধুনিক কবিতার প্রধান ব্যক্তিত্ব বুদ্ধদেব বসু তাঁর 'নজরুল ইসলাম' নামের প্রবন্ধে মোটামুটি এই সুরেই গেয়েছেন। নজরুলের কবিতা মানেই হইচই, জীবনদর্শনের গভীরতা তাতে নেই। নীরদচন্দ্র চৌধুরী নজরুলের কবিতাকে বললেন “অশিক্ষিত পটুত্ব”।
নজরুল বিখ্যাত হয়েছেন খুবই কম বয়সে, মাত্র তেইশে। এমনটা সচরাচর দেখা যায় না। কিছু একটা উপাদান তাঁর কবিতায় অবশ্যই ছিল, যা আমজনতার সঙ্গে অনুরণিত হয়েছে। শুধুই বিদ্রোহ রব তুলে কি এত বাঙালির মনোহরণ করা যায়? তাঁর কবিতা যুগের অনুসারী, সময়ের চাহিদামত অনুপ্রেরণা যোগায়, আত্মবিশ্বাস যোগায়। পরাধীন জাতির আত্মবিশ্বাসের বড়ই দরকার। নজরুল বলছেন, "বল বীর, বল উন্নত মম শির।" নিজেকে নয়, তিনি এখানে দেশবাসীকে বীরের আসনে বসাচ্ছেন, বিশ্বাস করাচ্ছেন, তোমরাই পারবে। এখানে তিনি ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে, ধর্মের ঊর্ধ্বে। সমগ্র ভারতবাসীকে সচেতন করতে চাইছেন। চাইলে তারা কী না পারে - তাদের উঁচু মাথা দেখে পর্বতও লজ্জায় মাথা হেঁট করবে - "শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!"
খ্যাতিও যত, নজরুলের সমালোচকেরও অভাব নেই। বেশ বিতর্কিত কবি হয়ে উঠেছেন, কবিত্বের কোনো সংজ্ঞাতেই তিনি পড়েন না। এসব সমালোচনার একটা জবাব দেওয়ার প্রয়োজন তিনি অনুভব করছেন। ১৯২৫-এর সেপ্টেম্বরে লেখা হল 'আমার কৈফিয়ত'। এও একরকম বিরল ঘটনা। তেইশে বিখ্যাত কবি ছাব্বিশে এসেই তাঁর সৃষ্টির ব্যাখ্যা করছেন, পাঠকের কাছে তাঁর রচনার কৈফিয়ত দিচ্ছেন!
'আমার কৈফিয়ত' কবিতাটি নজরুলের কবিজীবনের দ্বিতীয় মাইলফলক, ‘বিদ্রোহী’র পরেই। শুধু কৈফিয়ত বললে একে ছোট করা হয়, এ কবিতাটি তাঁর জীবনদর্শন। কবিতার প্রথমেই তাঁর আত্মপরিচয় ঘোষণা - তিনি বর্তমানের কবি, যুগের প্রয়োজনে কলম ধরেন, তাঁর লেখা সমকালীন। তাঁর সৃষ্টিকে যেন সমকালের আলোতেই বিচার করা হয়। ভবিষ্যতে তাঁর লেখা কালজয়ী হবে কি না, তা নিয়ে কবি বিন্দুমাত্র চিন্তিত নন।
সোজা কথায়, প্রথমেই তিনি পাঠকের প্রত্যাশার সীমাটি বেঁধে দিলেন। বুদ্ধিমানের কাজ, সন্দেহ নেই।
এরপর একে একে আসবে তাঁকে নিয়ে বিভিন্নজনের বিভিন্ন উক্তি। কবিগুরু স্বয়ং বলেছেন, নজরুল তার প্রতিভার অপব্যয় করছে, তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁচতে বসেছে! সজনীকান্ত প্রতি শনিবার গালির স্রোত বইয়ে দিচ্ছেন। মৌলবিরা ভাবে, হিঁদুর মেয়ে বিয়ে করেছে, এ ব্যাটা বিধর্মী, কাফের! হিন্দুরা বলে, আরবি-ফার্সি শব্দের ছড়াছড়ি ওর কবিতায়, ও তো নেড়ে কবি!
রাজনীতিতেও নজরুল না ঘরকা, না ঘাটকা! তিনি অহিংস না সহিংস বিপ্লবী, তা নিয়ে দোলাচল। কোন খাপে যে তাঁকে ফেলা যাবে, কোন সংজ্ঞায় তাঁকে ঠিকঠাক ফিট করে দেওয়া যাবে, কিছুতেই বুঝে ওঠা যায় না! এ তো বড়ই মুশকিল! দুনিয়ার একটা নিয়ম আছে তো? সে নিয়মের বাইরে গেলে সবারই বুদ্ধি গুলিয়ে যায়।
নিজের বিরুদ্ধে অভিযোগের ফিরিস্তি দাখিল করে এবার নজরুল বসেছেন জবাব দিতে। পরাধীনতা, জাতপাত, ধর্মের হানাহানি, বিশ্বযুদ্ধ, সর্বোপরি মানুষের দুর্দশায় তিনি বিচলিত হন। ধর্ম বোঝেন না, স্বরাজ বোঝেন না, কাব্যসুষমা তাঁর কাছে অধরা, কারণ মানুষের পেটের ক্ষিধের জ্বালা তিনি অনুভব করেন।
"ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন" - কী অমোঘ উক্তি! শিল্প, চেতনা, স্বাধীনতা সবই যে মিথ্যে যদি খাবার না জোটে!
এখানেই তাঁর কাব্যচেতনার উত্তরণ ঘটে। জাতি-ধর্ম-সংস্কৃতি পেরিয়ে মানুষের বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখান তিনি। মানবধর্মে এক হয়ে যায় আপামর ভারতবাসী, তথা পৃথিবীবাসী। মনে করিয়ে দেয় কবিগুরুর শিল্পসুষমামণ্ডিত উক্তি - "জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে, সে জাতির নাম মানুষ জাতি।" নজরুলও তো একই কথা বলছেন! তবে? কেন তাঁকে প্রচলিত ধারণার দড়ি দিয়ে বাঁধতে হবে?
এ কবিতায় নজরুল সবরকম ক্ষুদ্রতাকে ছাপিয়ে গেলেন, নিজেকে নিয়ে গেলেন এমন এক উচ্চতায়, যা সব সমালোচনার ঊর্ধ্বে। সার্থক কৈফিয়ত, কাব্যসাহিত্যে এর জুড়ি পাওয়া ভার।
তথ্যসূত্র:
1. আহমদ, মুজফ্ফর। (১৯৬৯) কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা। ন্যাশনাল বুক এজেন্সি।
2. তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার। নজরুল রচনাবলী বৈদ্যুতিন সংস্করণ। https://nazrul-rachanabali.nltr.org/
3. দাস, রঞ্জনকুমার সম্পাদিত। (১৯৯৫)। শনিবারের চিঠি: ব্যঙ্গ সংকলন। নাথ ব্রাদার্স।
4. বসু, বুদ্ধদেব। (১৯৪৪)। নজরুল ইসলাম প্রবন্ধ।
তৌহিদ হোসেন | 2402:3a80:1cd0:ec27:178:5634:1232:***:*** | ২৬ মে ২০২২ ১৫:৫৬508081