

ঘটনাটা, যতদূর মনে পড়ছে, ২০১০ সালের। বামজমানার মোটামুটি শেষের দিকে, সম্ভবত দু’হাজার সাল থেকে এ রাজ্যের সরকার অনুমোদিত স্কুলগুলোতে স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে শিক্ষক-নিয়োগ শুরু হয়, এবং কর্মসংস্থানের – অথবা আরও নির্দিষ্ট করে বললে – সরকারী চাকরির নতুন দিগন্ত খুলে যায়। এ ঘটনাটা যখনকার, তখনও পর্যন্ত স্কুলের করণিক, অর্থাৎ গ্রুপ সি এবং চতুর্থ শ্রেণির কর্মী বা গ্রুপ ডি স্টাফদের নিয়োগের ক্ষমতা কমিশনের হাতে যায়নি। এই নিয়োগগুলি তখনো নির্দিষ্ট স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির মারফৎ-ই হত। ফলত রাজনৈতিক আনুগত্য এবং টাকার খেলা দুটোই যে বেশ ভালরকম চলত, তা আর নতুন করে না বললেও চলে।
স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমেই শিক্ষকতার চাকরি নিয়ে আমি তখন সুন্দরবনের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে থিতু। সেই সময়ই জানা গেল, স্কুলে একটি গ্রুপ ডি পদে নিয়োগ হবে। আশেপাশের দশটি গ্রাম জুড়ে রীতিমত হৈচৈ পড়ে গেল। চাকুরীপ্রার্থীরা যে যেভাবে পারে, নিজেদের যোগাযোগ প্রয়োগ করে চাকরিটি হস্তগত করার চেষ্টায় লেগে পড়ল। যাদের সেই যোগাযোগ নেই, তারা টাকার জোরে কাজ হাসিল করতে মরিয়া। সেই সময়ই একদিন স্কুলের বাইরে বাসস্ট্যান্ডে বাসের অপেক্ষায় বসে আছি, গ্রামের এক যুবক এসে ধরে পড়ল, ‘মাস্টারমশাই, একটা কিছু ব্যবস্থা করে দিন, আমি দশ লাখ অবধি দিতে রাজি আছি’।
হেসে বললাম, ‘প্রথম কথা, আমি সামান্য মাস্টার, চাকরি করে খাই। এসব ব্যাপারে আমার কোনো হাত নেই। কিন্তু আমার প্রশ্ন হল, তুমি যে এতগুলো টাকা দিতে চাইছ, তুমি কি জানো তুমি কত টাকা মাইনে পাবে? তোমার তো ঢাকের দায়ে মনসা বিক্রি হয়ে যাবে!’ আমাকে বিস্ময়ে হতবাক করে দিয়ে সেই যুবক বলল, ‘দূর মাস্টামশাই, আপনি কিস্যু জানেন না। চাকরিটা হয়ে গেলেই বিয়ে করব। সরকারী চাকরি-ওলা পাত্রের বাজারদর জানেন? এক রাতের মধ্যে ওই টাকা ঘরে উঠে আসবে’।
শিক্ষাক্ষেত্রে সাম্প্রতিক দুর্নীতি নিয়ে লিখতে বসে কেন জানি না, প্রথমেই সেই যুবকটির কথা মনে এল। আমাদের সমাজে প্রথাগত অর্থনীতির বাইরে একটা সমান্তরাল অন্য অর্থনীতিও যে সর্বদাই সচল থাকে, তার পাঠ সেদিন আমাকে সেই গ্রাম্য যুবকটি দিয়ে গিয়েছিল। সেই দ্বিতীয় অর্থনীতিতে ন্যায়-অন্যায়, সততা-দুর্নীতির কোনো সীমারেখা নেই। রাষ্ট্রীয় আইন, সংবিধান, পুলিস সবই সেখানে গৌণ। সেখানে যাবতীয় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় দাতা এবং গ্রহীতার আপোশ-বোঝাপড়ার মাধ্যমে। আমরা – মনের গভীরে কিছু মূল্যবোধ লালনকারী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজের একাংশ – যেগুলিকে প্রচলিত অর্থে ‘দুর্নীতি’ বলে মনে করি, আমাদের চারপাশের সমাজে তা বরাবরই প্রবলভাবে ক্রিয়াশীল ছিল, আছে এবং সম্ভবত থাকবেও।
এবং বিষয়টি শিক্ষাক্ষেত্র বলে তা আমাদের একটু বেশি করে চোখে লাগছে। এ পর্যন্ত সংবাদে প্রকাশ, কোনোরকম পরীক্ষা বা ইন্টারভিউ না দিয়ে অনৈতিক উপায়ে প্রায় তিনশ’ জনকে স্কুলশিক্ষকের চাকরি দেওয়া হয়েছে। অভিযুক্তের তালিকায় স্কুল সার্ভিস কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতি পর্যন্ত রথী-মহারথীরা বিদ্যমান। প্রতিদিন এ বিষয়ে এত নিত্য-নতুন ‘আপডেট’ আসছে, যে তার সঙ্গে তাল রাখাই দায়। এ লেখাটি যখন তৈরি করছি, ততক্ষণে শিক্ষাদপ্তরের প্রাক্তন এক পূর্ণমন্ত্রী এবং বর্তমান এক উপমন্ত্রী সিবিআই-এর জেরার সম্মুখীন, জানা গেছে উক্ত উপমন্ত্রীর কন্যা অবৈধভাবে চাকরি পেয়েছিলেন এবং হাইকোর্টের নির্দেশে তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত হতে হতেছে। আগামীতে আমাদের জন্য আরও কী কী চমক অপেক্ষা করে আছে কে জানে!
শিক্ষার মত একটা অতি-স্পর্শকাতর রাষ্ট্রীয় পরিষেবা, যার পরতে পরতে জড়িয়ে থাকে মানবিক মূল্যবোধ – তাতে যদি দুর্নীতি ঢুকে পড়ে, তাহলে আর হাতে কিছুই থাকে না – এই মর্মে আফশোস শোনা যাচ্ছে চর্তুদিকে। এ আফশোস সম্পূর্ণ ন্যায্য। কিন্তু মুশকিল হল, ভারতের অন্যান্য প্রদেশের কথা জানি না, কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতির অনুপ্রবেশ আমাদের রাজ্যে অন্তত নতুন কিছু নয় এবং তা বহুধাবিস্তৃত। কর্মজীবনের শুরুতে এমন বহু মাস্টারমশাইকে দেখেছি, যারা বছরে অর্ধেক কাজের দিনও স্কুলে আসেন না, এবং তাদের এই অনুপস্থিতি দিব্য ম্যানেজ হয়ে যায়। তারপর ধরুন, সরকারী স্কুল-শিক্ষকদের গৃহশিক্ষকতা করে অতিরিক্ত রোজগারের প্রবণতা, সেটাও তো দুর্নীতিই। এহ বাহ্য, আগে কহি, শিক্ষকদের বদলির জন্য ‘উৎসশ্রী’ পোর্টাল চালু হবার আগে পর্যন্ত বদলি পাবার জন্য দু’টি রাস্তা খোলা ছিল শিক্ষকদের কাছে – এক) আপোষ বদলি বা মিউচুয়াল ট্রান্সফার এবং দুই) অসুস্থতাজনিত কারণে বিশেষ বদলি বা ট্রান্সফার অন স্পেশাল গ্রাউন্ড। নিন্দুকে বলে, ওই দ্বিতীয় পদ্ধতিতে জায়গামত কয়েক লক্ষ টাকা প্রণামী না দিলে নাকি সত্যিকারের অসুস্থ লোকও বদলি পেতে পারতেন না। কাজেই, একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, যে, আমাদের রাজ্যের কর্মরত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একটা বড় অংশ বরাবরই নানাবিধ দুর্নীতির শরিক ছিলেন। এবং যাঁরা ওই জাতীয় কোনো দুর্নীতি করেননি, তাঁরাও সহকর্মীদের তা করতে দেখে চুপ করে ছিলেন। সেটাও তো একরকম দুর্নীতিকে পরোক্ষ স্বীকৃতি দেওয়াই হল।
এবং একথাও হলফ করেই বলা যায়, যে, এ পর্যন্ত যেটুকু যা প্রকাশিত হয়েছে তা হিমশৈলের চূড়ামাত্র। প্রাথমিক এবং মাধ্যমিকে স্কুলে চাকরি দেবার নাম করে বিভিন্ন জেলার ছোট, মেজ, সেজ নেতারা কে কোথায় কত টাকা হজম করে বসে আছেন, সে টাকার কত শতাংশ বখরা কোথায় কোন রাঘব বোয়ালের হাঁ-মুখে ইতোমধ্যেই ঢুকে গেছে, তার হদিশ করা সম্ভবত সিবিআই-এরও অসাধ্য। বিশেষত, দুর্নীতিটা যখন দু’তরফা। আজ্ঞে হ্যাঁ, চাকরি দেবার নাম করে টাকা আত্মসাৎ করাটা যেমন অপরাধ, চাকরি পাবার জন্য টাকা দেওয়াটাও ততটাই ঘৃণ্য। ফলে এ নিয়ে গোপনে হুমকি-ধামকি চলতে পারে, প্রকাশ্যে কেউ বিশেষ মুখ খোলে না। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার একটি উচ্চ-মাধ্যমিক স্কুলের প্রধানশিক্ষকের কথা জানি, যিনি সেখানকার এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ তৃণমূল নেতার ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সেই সুবাদে বেশ কয়েকজনকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি ‘করিয়ে দিয়েছিলেন’ তিনি। এতে করে তাঁর ‘বাজারদর’ আরও বেড়ে যায়। সেই ‘সুনাম’-কে কাজে লাগিয়ে হাইস্কুলে চাকরি দেবার নাম করে একাধিক চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে প্রায় কোটিখানেক টাকা তোলেন তিনি। সেই টাকার সিংহভাগ যথাস্থানে পৌঁছেও গিয়েছিল। কিন্তু ইতিমধ্যে উক্ত দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতাটি দল বদলে ফেলেন। ফলে তাঁর আর চাকরি দেবার ক্ষমতা থাকে না। সেই প্রধানশিক্ষক এখন স্কুলছাড়া এবং গ্রামছাড়া। কিন্তু পথেঘাটে তাকে প্রচুর হুমকি এবং হেনস্থার শিকার হতে হয়েছিল বটে, তাঁর খোজে চাকরিপ্রার্থীরা একাধিকবার স্কুলেও হামলা চালিয়েছিল বটে, কিন্তু তাঁর নামে ‘অফিসিয়ালি’ কোথাও কোনো অভিযোগ দায়ের করা হয়নি। হবেই বা কীভাবে? অভিযোগ দায়ের করতে গেলে অভিযোগকারীকে ঘুষ দেবার ব্যাপারটা স্বীকার করে নিতে হবে যে!
মজাটা আসলে এখানেই। আমরা যে দুর্নীতিটা দেখতে পাচ্ছি এবং তা নিয়ে ধিক্কার ও প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠছে, তা আসলেই একতরফা। দুর্নীতির অভিযোগে জড়িত জনপ্রতিনিধি এবং সরকারী আধিকারিকদের প্রত্যেকের কঠোর শাস্তির দাবিতে তো সকলেই সরব। সমাজমাধ্যমে আমজনতা থেকে শুরু করে বিকাশভবনের সামনে বিরোধী রাজনৈতিক দল – সকলেই বিক্ষোভে সামিল। এবং সে দাবি অত্যন্ত ন্যায্যও বটে। কিন্তু পাশাপাশি যারা ঘুষ দিয়ে অথবা অন্য অনৈতিক যোগাযোগ খাটিয়ে চাকরি হাসিল করেছেন, তাদেরও যে একইরকম শাস্তি পাওয়া দরকার – তেমন কোনো দাবি কিন্তু গণমাধ্যমে বা সমাজমাধ্যমে কোথাও চোখে পড়ছে না।
এটাই আমাদের জাতীয় চরিত্র। আমরা ঘুষ নেওয়াকে ভয়ঙ্কর অপরাধ বলে মনে করি, কিন্তু ঘুষ দেওয়াকে নয়। ঠিক যেমন যারা বিয়েতে পণ নেয়, তাদের আমরা অপরাধী হিসেবে গণ্য করি, কিন্তু যারা পণ দেয়, তাদের আমরা অসহায় কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা-মাতা হিসেবে দেখতেই পছন্দ করি। তেমনি ঘুষ দিয়ে চাকরি পায় যারা, তাদের প্রতিও আমাদের অন্তরের অন্তঃস্থলে একটা চোরা সহানুভূতি সবসময়ই কাজ করে, ‘কী করবে, বেচারি! বাজারের যা অবস্থা, কোথাও চাকরি-বাকরি নেই। আজকাল সরকারী চাকরি পেতে গেলে ওরকম একটু-আধটু দিতে হয়।’ তাই না?
এ লেখার শুরুতে দুর্নীতিজনিত যে সমান্তরাল অর্থনীতির কথা বলেছিলাম, তার উৎসটা নিহিত আছে সমাজের এই মানসিকতার মধ্যেই। ব্যক্তিগতভাবে বহু মানুষকে চিনি – যাদের মধ্যে অনেকে আমার নিকটাত্মীয়ও বটে – যারা তাদের সন্তান-সন্ততির একটা চাকরির জন্য যে কোনো সময় আট-দশ লাখ টাকা দিতে প্রস্তুত, শুধু সঠিক লোকটিকে খুঁজে পাচ্ছেন না, যাকে দিলে প্রতারিত হবার সম্ভাবনা নেই। বস্তুত, মানতে অসুবিধা হলেও এটাও একটা চরম সত্য যে, ঘুষ দিয়ে চাকরি হাসিল করা লোকের সংখ্যা আমাদের চারপাশে যত, চাকরির জন্য টাকা দিয়ে প্রতারিত হওয়া লোকের সংখ্যা তার অনেকগুণ বেশি। আর যারা একটি চাকরির জন্য যে কোনো সময় কয়েক লক্ষ টাকা ঘুষ দিতে রাজি, তাদেরও সংখ্যা? মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
প্রশ্ন হল, সরকারী দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য লক্ষ লক্ষ ফেসবুক-ট্যুইটার ব্যবহারকারী আছেন, পথে নেমে আন্দোলন করার জন্য বিরোধী পক্ষে আছে। কিন্তু আমাদেরই সমাজে ছড়িয়ে থাকা এই দুর্নীতির আবর্জনা সাফ করবে কে? যতক্ষণ সেই আবর্জনা পরিষ্কার না হচ্ছে, ততক্ষণ শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি নিয়ে হা-হুতাশ করে কোনো লাভ নেই। নগর পুড়িলে দেবালয় রক্ষা পায় না।
santosh banerjee | ২১ মে ২০২২ ১৯:২৫507942
পলিটিশিয়ান | 2600:6c52:6000:138d:dc38:992e:d561:***:*** | ২১ মে ২০২২ ১৯:৪১507943
ধোয়া তুলসীপাতা | 117.194.***.*** | ২১ মে ২০২২ ২৩:২৩507955
পলিটিশিয়ান | 2600:6c52:6000:138d:fc94:e637:b188:***:*** | ২২ মে ২০২২ ০০:১৩507959
S | 2605:6400:10:36b:1cb3:5586:cdb7:***:*** | ২২ মে ২০২২ ০৩:১৮507960
Politician | 2600:6c52:6000:138d:dd36:6b36:b8a4:***:*** | ২২ মে ২০২২ ০৫:৩৪507962
প্রবুদ্ধ বাগচী | 103.135.***.*** | ২২ মে ২০২২ ১৩:৫০507969
Ruma bhadra | 2405:201:800c:b8cd:e8e2:92a1:1cdf:***:*** | ২২ মে ২০২২ ১৭:১৯507977
অনামিকা চক্রবর্তী | 103.22.***.*** | ২৩ মে ২০২২ ০৩:০৭507985