তৃতীয় বছর। গোটাটাই ঘটনাবহুল। প্রথম সেমেস্টার। শুরু হয়েছে ক্যাম্পাসিং। যাদবপুরের প্লেসমেন্ট সেল। সেই প্রথম চেনা। এমসিএরা অবশ্য দুয়োরানীর ছেলে। সবার শেষে তারা আসে। তবু কখনও কখনও ডাক পায় তারাও। রু’র এদিকে মহা চিন্তা। ইংরাজীতে কথা বলতে পারে না মোটেই। গ্রামার ট্রামার গুলিয়ে ফেলে। টেনশনে আরও ছড়ায়। বন্ধুরা বলে, ওরে, একটা সেলফ ইন্ট্রোডাকশন মনে মনে এঁচে রাখ। সব ইন্টারভিউতেই জিজ্ঞেস করবে। মনে মনে গড়গড়িয়ে বলে। কিন্তু বলতে গেলেই ... ব্যাস। নিজের স্ট্রেংথ আর উইকনেসের হিসেব করতে বসে। গুণ তো মেলে না, খালি রাশি রাশি দোষ বেরোয়। মন খারাপ, মন খারাপ। Why should we take you and not others? কোন উত্তর খুঁজে পায় না। কোনও দিক দিয়েই কি সে ইউনিক? তার তুল্য গোটা বিশ্বে কেউ নেই? ধুর, এমন আবার হয় নাকি! নিজেকে নিজেই “বেস্ট স্যুটেবল” ভাবা! প্রবল আত্মবিশ্বাস। অনেকের থাকে। রু’র কোনদিনই ছিল না। নিজেকে সুপারলেটিভ ডিগ্রিতে ভাবতেই পারে না। কোন বাবদেই না। হতাশা আঁকড়ে ধরে।
বন্ধুরা সব পাসপোর্ট করাচ্ছে। পরে কাজে লাগবে। এক বন্ধুর বাবা পাসপোর্টের কাজ করেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে রু। তিনি শুনেই ফুটিয়ে দেন। কি করবে পাসপোর্ট দিয়ে? বাড়ি থেকে পালাবে নাকি? করাতে হলে বিয়ের পরে করাবে। যাও যাও কথা বাড়িও না। রু রাগে ফুঁসতে থাকে। ক্লাসের ছেলেরা কেন এসব কথা শোনে না কেউ।
ইতিমধ্যে বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে। একটা চাকরী জুটে যায়। লোভনীয় চাকরীই। নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে দেয়। জিও বেটা! চাকরী পেয়েছে। তাতে তো খুশিই। আরও খুশী গ্রুপ ডিসকাশনে নিজের পারফর্মেন্সে। দিব্য সুন্দর বলেছে। একদম গুছিয়ে, টু দ্য পয়েন্ট। আর কি আশ্চর্য! নার্ভাস হয় নি একদম! আরও খুশি, পছন্দের শহরে পোস্টিং।
তখনও একটু দোনোমোনা। চাকরী নাকি আরও পড়াশোনা? গেট-এর জন্য হালকা পড়াশোনা শুরু করেছিল আগেই। কয়েক বন্ধু মিলে। স্যার সাহায্য করছিলেন। ছুটির পরে, ফাঁকা সময়ে, পড়িয়ে, বুঝিয়ে।
এদিকে বিয়ের ঘণ্টা বেজে ওঠে। রু’র ইচ্ছেতেই। বাড়িতে ঝামেলা ক্রমবর্ধমান। তাকে এড়ানোর একটাই উপায়। পালানো। আর কোন সহজ উপায় জানা নেই। অতএব বিয়ে। পড়া শেষ হলে তারপর। হবু শ্বশুরমশাই আর শাশুড়ী বাড়িতে আসেন। রু’র সঙ্গে একান্তে কথা হয়। বিয়ের পরে কি কি করা যাবে না। তালিকা শোনে রু। চাকরী করা চলবে না। নির্দেশ আসে।
এই শর্ত মেনেই তো সব দিদিদের বিয়ে হয়েছে। নতুন তো কিছু নয়। তাহলে রু’রই বা আপত্তি কিসের? আর বিয়ের পরে তো একটু-আধটু মানিয়ে নিতেই হয়। তবু রু’র মনটা তিতো হয়ে যায়। নির্দেশগুলো অনধিকার-সঞ্জাত মনে হয়। শক্ত হয় রু। ভালো বৌমা হওয়ার স্বপ্নটা মিলিয়ে যায়।
রু ভাবতে বসে। মনে পড়ে, স্কুলের শিক্ষিকা অটোগ্রাফের খাতায় লিখে দিয়েছিলেন। জীবনটাকে যেন কবিতা বলে ভেব না। তাহলে প্রত্যহের কাজে জীবনের ছন্দ দেবে না ধরা। জীবনের ছন্দ। নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে। পাশে বিশেষ কাউকে পেলে ভালো। সেই চাওয়াটা এখনো আছে। তবু নিজেকে বিসর্জন দিয়ে নয়। রু’র মনে একটা খোপ আছে। সেখানে আবাহনও নেই, বিসর্জনও নেই। বিয়ের স্বপ্নটা তুলে রাখে সেই খোপে। হলে ভালো। আর নাহলেও … চলবে।
অনেকখানিই অবাকও লাগে। চিনচিনে কষ্টও লেগে থাকে। যৌথতার নাছোড় মায়া-কাজল। তা থাক। মানিয়ে নিতে হবে। এদিকে বুকের মধ্যে ধুকুপুকু-টুকু। নতুন জায়গা। একদম একা। একা যদি সামলাতে না পারি? না পারলে, ধাক্কা খাবে। ধাক্কা খেয়েই শিখবে। কে যেন জোর গলায় বলে। এত জোর এল কোত্থেকে? তা জানে না। জোরটুকুকে আগলে রাখতে হবে। এইটুকু জানে।
স্যারের পড়ানোটা জলে যায়। পরীক্ষাটাতেই বসে না রু শেষমেশ। কি হবে! আর পড়াশোনা হবে না! স্যারের কাছে লজ্জার শেষ থাকে না। তবু এরপর চাকরী ছাড়া যাবে না। তপ্ত চাটু থেকে জ্বলন্ত কড়াই। যদি বা বিয়ে হয়ও। চাকরীই সেখানে ধ্রুবতারা।
পড়াশোনা শেষ হয়। শেষ? তা কি আর হয়? তা নয়। তবে ইউনিভার্সিটির বাঁধন ছাড়ার সময়। সাত বছর আগের ভিতু ভিতু মেয়েটাকে দেখে রু। বড্ড আবছা যেন। থাক, ও থাক এখানেই। সব ভয়টুকূ জড়িয়ে বসে থাক। এই ধাপি। এই ঝিলের সবুজ। এই ক্লাসরুম। এসকল জানে রু'র বড় হওয়া। পার্সন হওয়া। মেয়ে থেকে। 'মানুষ' হওয়া? অতদূর ভাবতে পারে না রু।
অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার গুছিয়ে নিয়ে একদিন ট্রেনে চেপে বসে।
জীবনের দরজায় প্রথম পা।
(শেষ)
(সমতট বর্ষ ৫১ সংখ্যা ৩ ও ৪ এ পুর্ব প্রকাশিত , পরিমার্জিত )
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।