উনবিংশ শতকে ইওরোপের বিজ্ঞান বিশ্ব
উনবিংশ শতকে ইওরোপের বিজ্ঞান বিশ্বে বদল আসছে। বিশ্বায়িত সাম্রাজ্যে কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থ নিয়ন্ত্রণ এবং বিশ্বজুড়ে কেন্দ্রীভূত উৎপাদন ব্যবস্থার শেকড় চারানোর জন্যে বিজ্ঞানের তত্ত্বে পরিবর্তন আসতে শুরু করলে চিরাচরিত খ্রিস্টিয় ধারণার সঙ্গে নতুন কেন্দ্রীভূত বিজ্ঞান ব্যবস্থার দ্বন্দ্ব লাগল। চার্লস লায়েল (Charles Lyell) ১৮৩০-এ আনলেন প্রিন্সিপলস অব জিওলজি তত্ত্ব। ১৮৫৯-এ এল চার্লস ডারউইনের The Origin of Species। ১৮৫৩-য় ফরাসি অভিজাত আর্থার গোবিন্যু (Arthur de Gobineau) ফ্রান্স-জার্মানিতে প্রকাশ করলেন ‘An Essay on the Inequality of the Human Races’। একের পর এক বক্তৃতায় তিনি বললেন, বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রঙের মানুষের বিকাশ ঘটেছে। এই Polygenism তত্ত্ব আর্যতত্ত্ব বিকাশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে। বৈজ্ঞানিক জাতিবাদের ‘বিজ্ঞান’ভিত্তিক সময়ের সূচনা ঘটল আর্থার গোবিন্যুর তত্ত্ব অবলম্বনে। এর কয়েক দশক আগে ১৮৩৯-এ আমেরিকায় স্যামুয়েল জর্জ মর্টন ‘ক্রানিয়া আমেরিকানা’ (Crania Americana; Or, A Comparative View of the Skulls of Various Aboriginal Nations of North and South America: To which is Prefixed an Essay on the Varieties of the Human Species) প্রকাশ করে ‘বৈজ্ঞানিক জাতিবাদ’-এর সূচনা করেছেন। তিনি বললেন, জাতির মাথার খুলির মাপে তার সমাজের সামগ্রিক বুদ্ধিবৃত্তি বিচার করা যায়। তাঁর তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে ১৮৬৩-তে লন্ডনে অ্যান্থ্রোপলজিক্যাল সোসাইটির জন্ম। নানান জাতিবাদী, নৃতাত্ত্বিক তত্ত্ব সমাহারে ‘বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ’ করা হল – উচ্চ মাথা, উচ্চ কাঁধ, উচ্চ নাসা এবং ফর্সা ত্বকের নর্ডিকেরাই বিশ্বের একমাত্র বুদ্ধিমন্ত জাতি। এই সব ‘বৈজ্ঞানিক’ তত্ত্ব এশিয়া, আফ্রিকা, আমেরিকায় ইওরোপীয় প্রাধান্য এবং সাম্রাজ্য বিস্তার আর রক্ষায় হাতিয়ার হল। এ সবই আর্যতত্ত্বের ভিত্তি, ‘প্রমাণ’ হিসেবে পরিগণিত হবে।
আর্যতত্ত্বের উদ্ভব ও বিকাশ
১৭৮৬-তে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি এবং এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গলের প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম জোনস, সোসাইটির তৃতীয় বর্ষ উদযাপন সভায় বললেন, ‘The Sanskrit language, whatever be its antiquity, is of wonderful structure, more perfect than the Greek, more copious than the Latin, and more exquisitely refined than either, yet bearing to both of them stronger affinity both in the roots of verbs and in the forms of grammar than could have been produced by accident, so strong indeed, that no philologer could examine them all three, without believing them to have sprung from some common source, which perhaps no longer exists’। মাথায় রাখতে হবে, ম্যাক্সমুলারের মতই, তাঁরও সংস্কৃত শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা দরকার। জোনসের সময়ের বহু আগে থেকে সংস্কৃত ভাষাকে ইওরোপীয় ভাষাতাত্ত্বিকেরা প্রাচীন ইন্দো-ইরানীয় ভাষা হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। বেদ আবিষ্কৃত হয়েছে। মুঘল আমলে বেদ চর্চাও হয়েছে। জোনস তখনও সংস্কৃত ভাষায় শিক্ষানিবিশও নন, তিনি সংস্কৃতকে ইন্দো-ইরানীয় বর্গ থেকে সরিয়ে ইন্দো-ইওরোপীয় বর্গে স্থাপন করলেন।
তার প্রায় ৮০ বছর পরে – সিপাহি যুদ্ধের চার বছর পর – ইংলন্ডে ১৮৬১-তে মুলার রয়াল ইন্সটিটিউশন ইন গ্রেট ব্রিটেনে এক বক্তৃতায় আর্য শব্দ উল্লেখ করে বললেন, ‘While examining its ramification, learn at the same time why that name was chosen by the agricultural nomads, the ancestors of the Aryan race’। এই বক্তৃতায় তিনি কৃষিজীবী যাযাবর আর্যদের বিষয়ে বলতে গিয়ে স্পষ্টভাবে ‘আর্য জাতি’ ছাড়াও ‘আর্য উপভাষা’, ‘আর্য ক্রিয়া’, ‘আর্য বুলি’ এবং ‘আর্য ভাষা’ শব্দবন্ধগুলোও ব্যবহার করেন। বক্তৃতায় মুলার বললেন, ‘And as in Persia we found many proper names in which Arya formed an important ingredient, so we find again in German history names such as Ariovistus’। মুলার পাদটীকায় বললেন, ব্যুৎপত্তিগতভাবে এই যোগ হয়তো প্রমাণ করা যাবে না, কিন্তু এই বক্তব্যটি পাদটীকা হিসেবেই আজও গণ্য হয়, মূল আলোচনায় আসে না। আর্যতত্ত্ব শেকড় গজাতে শুরু করল।
রোমান্টিক জাতীয়তাবাদ
ইওরোপে লুঠেরা শিল্পায়ন আর বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের প্রতিক্রিয়ায় জার্মান কবি, প্রাচ্যবিদ, দার্শনিক উইলহ্যাম শ্লেগেল জার্মান জাতীয়তাবাদের পক্ষে দাঁড়িয়ে রোমান্টিক জাতীয়তাবাদ আন্দোলনের সূচনা করলেন। গ্রিম ভায়েরা লোককথা সংগ্রহ প্রকাশ করল। ১৮৩৬-এ গুস্তাফ ক্লেম হ্যান্ডবুক অব জার্মান অ্যান্টিকুইটিতে প্রাচীন ধ্রুপদী সাহিত্যের সঙ্গে জার্মানির কৃষ্টির মিল দেখালেন। শ্লেগেল আর্য মিথের সঙ্গে বহুকাল ধরে পরিচিত ছিলেন এবং তাঁর ‘On the Language and Wisdom of the Indians’ বইতে আর্য শব্দের শেকড় খুঁজলেন জুলিয়াস সিজারের কমেন্টস অন দ্য গলিক ওয়ার্স (Commentarii de Bello Gallico)-এ এবং বললেন, সেখানে উল্লিখিত আরিওভিস্টাস ছিলেন জার্মানজাত। তাঁর ধারণা হল, ‘আরিও’ (Ario) শব্দটা জার্মান ‘আহ্র’ (ehre) বা আর্য শব্দের সঙ্গে যুক্ত। Polygenism, ফিজিক্যাল অ্যান্থ্রোপলজিস্টদের প্রমাণ, রোমান্টিক জাতীয়তাবাদ আর ইওরোপীয় রাজনীতির ঘোরতর ককটেলে সিপাহি যুদ্ধের আগেই ইওরোপের সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতায় আর্যতত্ত্ব থানা গেড়ে বসল।
আর্যদের বাসস্থান
আর্যদের ইতিহাস তো তৈরি হল, কিন্তু তার ভূগোল অর্থাৎ তাদের বাসস্থান কীভাবে নির্ধারণ হবে? নতুন সাম্রাজ্যবাদী জ্ঞানচর্চা নৃতত্ত্বের ‘বৈজ্ঞানিক প্রমাণ’ অনুসারে জার্মান, পশ্চিম রুশ আর স্ক্যান্ডিনেভিয় দেশ প্রাচীন আর্যজাতির বাসস্থান হওয়ার দাবি জানাল। তাতেও বিষয়টা জোরদার হয় না। কারণ এখানে ভারত কোথায়? ভারতের সাম্রাজ্যরক্ষা কোথায়? সাম্রাজ্য স্বার্থরক্ষায় মুলার তুললেন আগ্রাসন তত্ত্ব - ‘Two roads were open to the Aryans of Asia in their westward migrations’। অর্থাৎ, আর্যরা মধ্য এশিয়া থেকে ভারতবর্ষে যেমন অভিবাসিত হয়েছিলেন, তেমনি তারা পশ্চিমের দিকেও যাত্রা করেছিলেন। এর আরেকটা উপাপাদ্য তৈরি করে বলা হল, পশ্চিমের দিকে যে আগ্রাসন ঘটল – তার দু’টি শাখা হল; একটি গেল জার্মানিতে অন্যটি ব্রিটেনে। এই উপপাদ্যটি সেই সময়ের ইওরোপীয়, জার্মান এবং ব্রিটেনের সাম্রাজ্যরক্ষার রাজনীতিতে খাপে খাপ খেয়ে যায়। আগেই বলেছি, জার্মানেরা তখনও ইওরোপে দলিত, অথচ জার্মানজাত বিপুল কবি-সাহিত্যিক-দার্শনিক-রাজনৈতিক মুক্তি চান, প্রাচীনত্বের গর্ব চান। তাঁদের আহত সত্ত্বা ভারতবর্ষের পরাধীনতায় নিজেদের পরাধীন, ছন্নছাড়া অবস্থার মিল খুঁজে পায়। আহত জার্মানসত্ত্বা আর আর্যত্ব, আগামী ১০০ বছরে – শুধু ইওরোপ নয় – বিশ্ব রাজনীতির নির্ণায়ক তত্ত্ব হিসেবে উঠে আসবে। ইংলন্ড তো তখনই স্বাভাবিকভাবে বিশ্বরাজনীতির মোড়ল হয়ে উঠেছে। প্রত্যেকটি ইওরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের ছেড়ে আসা উপনিবেশ কবজা করে সে বিশ্বের এক নম্বর রাজা।
মাথায় রাখতে হবে, সে’ সময় দু’জন বিখ্যাততম জার্মান ইংলন্ডে অভিবাসিত হচ্ছেন, প্রথমজন ফ্রেড্রিক ম্যাক্সমুলার - যাঁর রাজনীতি আমরা আগেই আলোচনা করেছি; দ্বিতীয়জন কার্ল মার্ক্স। দু’জনই প্রথম জীবনে সাম্রাজ্যের কেন্দ্রে বসে ইওরোপীয় সাম্রাজ্যবাদকে মুক্তির পথ হিসেবে গণ্য করবেন। ১৮৫৩ থেকে মার্ক্স, আমেরিকার সংবাদপত্র নিউ ইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউনে আর্য তত্ত্বের স্বরে পতনশীল এশিয়ার ‘প্রাচ্যবাদী একনায়কতন্ত্র’ ব্যবস্থাপনার সমালোচক এবং ব্যাখ্যাকার হয়ে উঠবেন এবং স্বদেশীয় মূলারের স্বরেই বলবেন, ইওরোপীয় সাম্রাজ্য ভারতভূমির মূঢ়, অজ্ঞ, সভ্যতার ঐশ্বর্য না দেখা, শতাব্দের পর শতাব্দ অন্ধকারে ডুবে থাকা জনগণকে সামন্ততন্ত্রের বন্দিদশা থেকে মুক্তি দেবে। ভারতবর্ষের হারিয়ে যাওয়া ঐশ্বর্য ভারতকে ফিরিয়ে দিতে ইওরোপীয় সাম্রাজ্য বদ্ধপরিকর। দুই জার্মানের (এক জার্মানের হাতে প্রত্যক্ষ অন্য জার্মানের হাতে পরোক্ষ) হাত দিয়ে তৈরি হল ব্রিটিশ-প্রণোদিত আর্য রাজনীতির আন্তর্জাতিক ভিত।
ঔপনিবেশিক বাংলা - ব্রাহ্মসমাজের উদ্ভব
পলাশী-উত্তর সময়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ছোট সঙ্গী হয়ে, ব্রিটিশ কোম্পানির গোমস্তা হিসেবে বাংলাজোড়া বিশিল্পায়ন রূপায়িত করে বর্ণময় দাদনি বণিক, দালাল এবং তাঁদের উত্তরাধিকারীরা যত লুঠের ধন সংগ্রহ করেছিলেন, সে সব সম্পদ চিৎপাতে দিলেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বিপুল অর্থ ব্যয় করে জমিদারি কিনে। এঁরা পলাশীর পর গোমস্তা পদ নিয়ে ব্রিটিশ কোম্পানির নির্দেশে একজোট হয়ে বাংলার চাষি-হকার-কারিগরদের বিশ্ববাজার এবং উৎপাদন ব্যবস্থা ধ্বংস করলেন। শান্তিপুরের তাঁতিসহ একের পর এক আড়ং-এর কারিগরেরা ব্রিটিশ আমলা-বাঙালি-গোমস্তাদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কোম্পানিকে বিফল ডেপুটেশন দিয়ে, নিজেদের কাজ থেকে উচ্ছেদ হয়ে চাষে চলে গেলেন। বিপুলসংখ্যক কাজ হারানো কারিগর দেশ ছেড়ে কুলি হয়ে চলে গেলেন দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, মরিশাস, আফ্রিকার নানান অঞ্চলে ইওরোপীয়দের বাগিচার দাস হয়ে। বিশিল্পায়নের নীতিতে ১৮২০-তে ঢাকা জনশূন্য হল। ইওরোপীয় শিল্পায়নের চক্করে নবজাগরিত বাঙালিদের চেষ্টায় বাংলায় ছোটলোকেদের কাজ গেল; বাংলার বিকেন্দ্রিত উৎপাদন ব্যবস্থার অন্যতম সাহারা পরম্পরার পাঠশালা ব্যবস্থা ইত্যাদি ধ্বংস হল। ব্রিটিশ উদ্যমে অমিয় কুমার বাগচি কথিত বাংলার ২৫ জিডিপিওয়ালা উৎপাদন কাঠামো ধ্বংসে, সম্পদ লুঠের কাজে এবং ইওরোপীয় কর্পোরেট কাঠামো তৈরির স্বার্থের ব্যাপৃত থেকে নবজাগরিত ভদ্রবিত্তরা উপহারস্বরূপ পেলেন খণ্ডিত জমিদারি, কর্পোরেট চাকরি, কোম্পানি দালালি আর সাহেবদের উমেদারির সুযোগসুবিধা। দাদনি বণিকদের উৎসাহে, দাদনি বণিকদের নবজাগরিত উত্তরাধিকারীদের প্রত্যক্ষ মদত নিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পরিকল্পনায় ভারতভূমিতে শুরু হল বিশ্বের প্রথম ১৯০ বছরের স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট পলিসি।
এই নীতির প্রথম কাজ হল উইলিয়াম জোনসের উদ্যমে ব্রাহ্মণ ভদ্রবিত্তের পুনর্বাসন। আরেকটি কম্পোনেন্ট ছিল মহিলাদের ক্ষমতা হ্রাস। স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট পলিসি রূপায়ণের দায়িত্ব পাওয়া শাসক হেস্টিংস, হ্যালহেদকে যে আইন প্রণয়ণের দায়িত্ব দিলেন তাতে স্পষ্টভাবে বলা হল — WHATEVER Woman be of a Disposition altogether malevolent, or wanting in female Modesty, or careless of her Property, or unchaste, such Woman is incapable of possessing what has been specified to be a Woman’s Property. হাস্যকরভাবে বিধবাদের ‘সতীত্ব’রক্ষা করার নিখাদ পুরুষতান্ত্রিক অছিলায়, সম্পত্তির ক্ষেত্রে মহিলাদের বঞ্চিত করার প্রথা শুরু হয়। হয়তো একই কারণে এই ঔপনিবেশিক আইনে সতীপ্রথার ওপর অভূতপূর্ব গুরুত্ব আরোপ করে লেখা হয়: ‘It is proper for a Woman, after her Husband’s Death, to burn herself in the Fire with his Corpse’ (দেবোত্তম চক্রবর্তী, বিদ্যাসাগর নির্মাণ বিনির্মাণ পুনর্নির্মাণ)। শাসক হেস্টিংস, বাংলা না জেনে বাংলা ব্যাকরণ রচনা করা প্রাচ্যবিদ হ্যালহেদ (যেমন সংস্কৃত প্রায় না জেনে ঋগ্বেদ অনুবাদ করা মুলার), বিচারক জোন্স এবং সিভিলিয়ান কোলব্রুক মহিলাদের সম্পত্তির অধিকার কেড়ে নিতে ব্রিটিশ-ভদ্রলোক যৌথ উদ্যোগে বাংলায় সতীদাহ উৎসব শুরু হল। বাংলার বিকেন্দ্রিত উৎপাদন ব্যবস্থার অন্যতম ঘটক মহিলাদের রোজগার কেড়ে, তাদের অধিকাংশের জমিদারির অধিকার কেড়ে, সতীদাহ করে সামাজিক ক্ষমতা নিশ্চিহ্ন করার কয়েক দশকের মধ্যে মসিহা সেজে সতীদের বাঁচাতে ঔপনিবেশিক শাসকদের উদ্যোগে রামমোহন রায় আসরে নামলেন। ক্রমশ উদ্যমী হয়ে ইংরেজি শিখে ইওরোপীয় সমাজে সুদে টাকা খাটিয়ে প্রাধান্য পেতে শুরু করলেন জমিদার পরিবারের সন্তান ‘ডিগবির দেওয়ান’ রামমোহন রায়। রামমোহনের সঙ্গে জুটলেন পৌত্তলিক শিষ্য দ্বারকানাথ ঠাকুর এবং তার পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁদের হাত দিয়েই গোড়াপত্তন হবে ব্রাহ্ম সমাজের। ইতিমধ্যে মিশনারিরা উপনিবেশের সহায়ক হয়ে উপনিবেশে ধর্ম প্রচারে বাংলায় আসতে শুরু করেছে। অষ্টাদশ শতাব্দের প্রথম দিকে কলকাতার বিখ্যাত কিছু পরিবারের সন্তানেরা খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করল।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে গড়ে ওঠা এজেন্সি হাউসগুলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষ নিয়ে ইংরেজ বাণিজ্যবিশ্বে ব্যবসা চালাত। এদের ব্যবসার কর্মকাণ্ড নির্ভর করত এদেশে ব্যবসায়ী ইংরেজদের লাভের বিনিয়োগের ওপর। নীল ব্যবসাকালে এজেন্সি হাউসগুলো নীলকরদের ১০ শতাংশ হারে টাকা ধার দিত। ১৮২৩-এর সরকার নতুন ধার নীতি প্রণয়ন করায় নীলকরদের ধার পেতে বেশি সুবিধে হয়। এই নীতি বাংলার নীলচাষকে আরও কয়েক দফা এগিয়ে দেয়। ১৮২৪-এর ইঙ্গ-বর্মা যুদ্ধে সরকারের কোষাগারে টান ধরল। ইংলন্ডে বাংলার কাঁচামালের দাম দারুণভাবে পড়তে শুরু করায় দেশীয় নীল (ইংরেজদের) ব্যবসার ওপর চরম আঘাত নেমে আসে। ব্যবসায় মন্দা শুরু হয়। এজেন্সি হাউসের একটি বড় অংশ অর্থ নীলচাষে খাটছিল ১০ শতাংশ বাৎসরিক সুদে। এজেন্সিগুলোর অনেকেই বিনিয়োজিত অর্থ ফেরত দিতে পারছিল না। একের পর এক এজেন্সি হাউসে তালা ঝুলতে শুরু করে। নীলকরেরা বিপদ অনুভব করে সরকারের কাছে দাবি জানায়, দাদন নিয়ে যেসব চাষি নীল সরবরাহ করার শর্ত পূরণ করছে না, তাদের বিরুদ্ধে সরকারকে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। নীলকরদের দাবি মেনে নেয় সরকার।
আর্মহার্স্ট-এর ষষ্ঠ নিয়মে আসল সুদ-সমেত ফেরত পেতে নীলকরদের আইনের দ্বারস্থ হওয়ার অনুমতি মিলল। এতেও অত্যাচারী নীলকরদের মন ওঠে না। চাই আরও কড়া নতুন আইন। তারা আর দাদন দিতে চায় না। ভারতে জমি কিনতে চায় – যার নাম কলোনাইজেশন আন্দোলন। এই দাবিতে বহুদিন ধরেই আন্দোলন করছিল ব্রিটিশাররা। ১৮৩৩-এর সনদে ব্রিটিশ নাগরিকদের ভারতে জমি কেনার অধিকার দেওয়ার অনেক আগে থেকেই রামমোহন রায়, প্রসন্ন কুমার ঠাকুর, দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রভৃতি বড় জমিদারদের একাংশ এই আন্দোলনের পক্ষে সওয়াল করছিলেন। যুক্তি ছিল, অবোধ, অসভ্য ভারতীয়রা সুসভ্য ইংরেজদের সংস্পর্শে এসে সভ্য হয়ে ওঠার সুযোগ পাবে, আর ব্যবসায়ী ইংরেজদের ব্যবসার দক্ষতার মাধ্যমে দেশের সম্পদ বৃদ্ধি হবে। অথচ ভারতীয় অধিকাংশ ছোট জমিদার এই দাবির বিরোধী। কলোনাইজেশন আন্দোলনের সফল হওয়ায় নব্য নবজাগরণী মহাতেজেদের প্রতিষ্ঠিত নতুন ধর্ম, উপনিবেশের শাসকদের কাছে অতিরিক্ত গুরুত্ব অর্জন করে।
নেপোলিয়নের পতনের পর ইওরোপের বাইরে থাকা প্রায় প্রত্যেকটি মহাদেশের বড় অংশ ইংরেজদের পদতলে। ১৭৮০-তেই ইউনিটেরিয়ানদের এডাম স্মিথ ওয়েল্থ অব নেশন-এ মুক্ত বাণিজ্যে ডাক দিচ্ছেন। ইংরেজদের অবাধ বাণিজ্যের অর্থ অন্তত বাঙালিরা জেনে গিয়েছে পলাশির উত্তর ক্লাইভ-হেস্টিংস-কর্নওয়ালিস-এর স্বেচ্ছাচারী লুঠেরা যুগলবন্দিতে। পুরোনো অভিজ্ঞতা নয়, মাত্র সাত দশকও পেরোয়নি। অথচ ইউনিটেরিয়ান রামমোহন-দ্বারকানাথ এদেশে ব্রিটিশারদের বাণিজ্যর জন্য প্রয়োজনীয় জমি কেনার অধিকার দাবির পাশে দাঁড়ালেন। ইংলন্ডে ইউনিটেরিয়ানদের প্রভাব যথেষ্ট ছিল। নতুন শিল্পমালিকদের সামনে ভারতীয় উপনিবেশের ধংস হওয়া বাজারের হাতছানিই মুক্ত বাণিজ্য। ১৮৩২-র নতুন সংস্কার আইন আর ১৮৩৩-র সনদ কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের বিরুদ্ধে ইউনিটেরিয়ানদের সবথেকে বড় জয়। ভারতে নীলকরেরা সরাসরি জমি কেনার অধিকার পেল। ইওরোপীয় ব্যবসায়ীদের নানান ছুতোয় সাহায্য করা রামমোহন, দ্বারকানাথ আর দেবেন্দ্রনাথের চেষ্টায় ব্রাহ্মধর্ম ক্রমশ কলকাতাস্থ অভিজাত ভদ্রলোকদের আকর্ষণ করতে থাকে।
ইংরেজ-প্রভুর পৃষ্ঠপোষকতা পেলে উপনিবেশে এক সাধারণ ভদ্রবিত্তের কোন পর্যায়ে উত্থান ঘটতে পারে – তার প্রত্যক্ষ উদাহরণ ব্রাহ্ম নেতা কেশবচন্দ্র সেনের পূর্বজ রামকমল সেন। রামকমল সেন ১৮০০ থেকে তিন বছর কলকাতার চিফ ম্যাজিস্ট্রেট নেমির অধীন করনিক হিসেবে জীবন শুরু করেন। ১৮০৪ থেকে উইলিয়ম হান্টারের হিন্দুস্থানি প্রিন্টিং প্রেসে কম্পোজিটর, ১৮১১-তে পরিচালক। এশিয়াটিক সোসাইটি (কলকাতা) ও সংস্কৃত কলেজের হিসাবরক্ষক ছিলেন। পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ পরে এশিয়াটিক সোসাইটির সেক্রেটারি, সংস্কৃত কলেজের সেক্রেটারি এবং সুপারিনটেন্ডেন্ট হন। ১৮২১-এ রামকমল হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ পদ লাভ করে এশিয়াটিক সোসাইটির উইলসনের অভয়হস্ত মাথায় নিয়ে প্রথমে ১৮২৮-এ টাঁকশালের দেওয়ান এবং পরে ১৮৩২-এ বেঙ্গল ব্যাংকের দেওয়ান নিযুক্ত হন। ১৮৩৮-তে তিনি ‘জমিদার সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সভাপতি নিযুক্ত হন।
রামকমল যখন কলকাতার শাসক কেষ্টুবিষ্টুদের সঙ্গে দিনরাত ওঠাবসা করছেন, সেই সময় ১৮৩০-এর অগাস্টের গোড়ার দিকে কলকাতায় পাদ্রি হিলের প্রথম বক্তৃতা। বক্তা একে প্রণম্য ইওরোপীয় পাদ্রি, তায় বক্তৃতার বিষয় রাজার ধর্ম, [কলকাতার] হিন্দু সমাজের পাঁজর পর্যন্ত কেঁপে উঠল। কলকাতার সমাজ কাঁপল ইয়ং বেঙ্গলিদের নতুন খাদ্যাভ্যাসে। রায়বাহাদুর প্রমথনাথ মল্লিক, কলিকাতার কথায় লিখছেন,
‘... হিন্দু কলেজের ছেলেরা হেনরী ভিভিয়ান ডিরোজিও এবং হেয়ার সাহেবের শিক্ষায় প্রকাশ্যভাবে অখাদ্য খাইতে আরম্ভ করিয়াছিল ও হিন্দুধর্মের প্রতি অনাস্থা দেখাইতে লাগিল। মহেশচন্দ্র ঘোষ ও কৃষ্ণ[মোহন] বন্দ্যোপাধ্যায় খৃষ্টান হইল। রামমোহন ব্রাহ্মধর্ম (তখনও ধর্ম হয়নি) প্রচার করিলেন। সমাজে ও কলিকাতার হিন্দুধর্ম গেল গেল রব পড়িয়া গেল। রামকমল সেন হিন্দু কলেজ হইতে উক্ত ডিরোজিওকে ছাড়াইতে গেলেন, কিন্তু উইলসন, হেয়ার ও শ্রীকৃষ্ণ সিংহের (কালীপ্রসন্ন সিংহের পিতামহ) জন্য তাহা পারিলেন না। উক্ত সেনকে মিন্টের ও ব্যাঙ্কের দেওয়ান করিয়া কোম্পানি বশ করিয়া ফেলিল। ডিরোজিও নিজে ইহাদের ধন্যবাদ দিয়া চাকরি ছাড়িয়া দিলেন। ... ডিরোজিওর ছাত্রেরা সকলেই কোম্পানির বড় চাকরীয়া ডিপুটি কলেক্টর হইল’।
সেন পরিবারের হরিমোহন সেন, কেশব সেন, মাধব সেন প্রভৃতি বাংলার ভাগ্যাকাশে বহুদিন রাজত্ব করেছেন। বিশ্বম্ভর সেনও ২০টি কুঠির বেনিয়ান হন আর মৃত্যুর পর ২ লক্ষ পাউন্ড সম্পত্তি রেখে যান। রামকমল সেনের উদ্যম এবং কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতা সঙ্গে নিয়ে কেশব সেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্যতম দেশীয় খুঁটি হিসেবে পরিগণিত হবেন।
ব্রাহ্মসমাজের প্রত্যেকটি ভাগই ছিল ব্রিটিশ পৃষ্ঠপোষক, ইংরেজি-শিক্ষিত, ধনী, অভিজাতদের সংগঠন। সংগঠনের একেশ্বরবাদের সঙ্গে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ধার্মিকভিত্তি একেশ্বরবাদের তত্ত্ব মিলে যাওয়ায় ব্রাহ্মসমাজের সদস্যদের উপনিবেশের প্রত্যক্ষ সাহায্য পাওয়া তুলনামূলকভাবে সহজ হয়ে যায়। ব্রাহ্মসমাজ অসম, বম্বে (আধুনিককালের মহারাষ্ট্র আর গুজরাট), মাদ্রাজ, হায়দারাবাদ, পাঞ্জাব ইত্যাদি অঞ্চলে শাখা বিস্তার করতে থাকে।
ব্রাহ্ম সমাজের আরেক স্তম্ভ – কোম্পানি-বন্ধু, আফিম ব্যবসায়ী, নীলকর, মদ্য উৎপাদক, বেশ্যা ব্যবসা চালানো পরিবারের কর্তা দ্বারকানাথ ঠাকুরের উত্তরপুরুষ দেবেন্দ্রনাথের তত্ত্ববোধিনী সভা ব্রাহ্মসমাজের প্রচারে সহায়ক হয়। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, নতুন ধর্মবিশ্বাস প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক সংস্কার সাধনের পক্ষেও জনমত গড়ে তোলে। এ সময়ে হিন্দুধর্মের বিপক্ষে খ্রিস্টান মিশনারিরা আক্রমণ চালাচ্ছিল। ব্রাহ্মসমাজের আমূল সংস্কারের সমর্থকেরা বেদের অভ্রান্ততা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন অক্ষয়কুমার দত্ত।
অক্ষয়কুমারের সময় পর্যন্ত বেদের অভ্রান্ততা ব্রাহ্মধর্মীয় বিশ্বাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচিত হত। ১৮৪৭-এর দিকে ব্রাহ্ম নেতৃবৃন্দের একাংশ বেদের অভ্রান্ততায় বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। একেশ্বরবাদী ধারণা সংবলিত উপনিষদের নির্বাচিত অংশসমূহের ওপর ভিত্তি করে ব্রাহ্ম ধর্মবিশ্বাস পুনর্নিমাণের প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। ব্রাহ্মসমাজের সংশোধিত মতবাদটি ১৮৫০-এ ‘ব্রাহ্ম ধর্ম’ অথবা ‘এক সত্য ঈশ্বরের পূজারীদের ধর্ম’ নামে চিহ্নিত হয়। সিপাহি যুদ্ধের পরের ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয়করণের বছরে (১৮৫৮) রামকমল সেনের পুত্র তরুণ কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্ম সমাজে যোগ দিলে একেশ্বরবাদী আন্দোলন জোর পায়। তিনি দেবেন্দ্রনাথের সামাজিক রক্ষণশীলতার প্রশ্নে একমত না হয়ে ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ’ (১৮৬৬) গঠন করেন। দেবেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে ব্রাহ্মসমাজ ‘আদি ব্রাহ্মসমাজ’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
একদিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য – লুঠ, খুন, অত্যাচার চালাতে, গ্রামাঞ্চলে বিদ্রোহ দমন করতে কর্তৃত্বপূর্ণ প্রভাবশালী সাম্রাজ্য-সঙ্গী প্রয়োজন ছিল; একইভাবে খ্রিস্টিয় মিশনারিরা উপনিবেশের মানুষদের ব্যবহার করে খ্রিস্টধর্মের প্রাধান্য প্রচার করতে চরম উৎসাহী। মাথায় রাখতে হবে প্রথমদিকে ব্রাহ্মসমাজ, পরে ব্রাহ্মধর্ম ইওরোপীয় প্রগতিশীলতা এবং মিশনারিদের তাত্ত্বিক অবস্থান থেকে খুব দূরে যে ছিল না, সেটা আমরা আগেই দেখেছি ম্যাক্সমুলারের ব্রাহ্মদের চার্চ অব ইংলন্ডের সদস্যপদ নেওয়ার আহ্বান থেকে। তিন স্বার্থ গোষ্ঠী – শাসক, শাসকদের কোলাবরেটর ভারতবর্ষ লুঠের সম্পদে প্রতিপালিত উপমহাদেশীয় ভদ্রবিত্ত এবং ইওরোপীয় ধর্ম প্রচারকেরা কীভাবে আর্য-আগ্রাসন তত্ত্বের বাহক হয়ে ওঠে, সেটা এবারে আলোচনা করব।
ক্রমশ...
তথ্যসূত্র:
Banerjee, SC (2016) Brahmo Samaj as an Actor in the Dissemination of Aryan Invasion Theory (AIT) in India.
International Journal of Asian Studies 13:19–59