দশমীর বিকেল - জেম্মার হাত ধরে আমি চলেছি পাড়ার মোড়ে। ঢাকিরা কুড়কুড় শব্দ তুলেছে ঢাকে, কেমন যেন একটা অন্যরকম সুর কাঠির আগায় সেদিন- শুনলে নাচতে ইচ্ছে করবে, আবার মনও খারাপ করবে...। ঐ ওপরের বেদীটা থেকে নামিয়ে এনেছে দুর্গা ঠাকুর কে। জেম্মা উঠছে মইতে করে - যাতে সিংহ অসুর পেরিয়ে ও-ই উঁচুতে মেয়ের চিবুকখানি ছুঁতে পারে। হাতে থালায় সিঁদুর মিষ্টি, এক টুকরো মিষ্টি ভেঙ্গে মেয়ের মুখে ছুঁইয়ে দিল জেম্মা। আটপৌরে করে পরা শাড়িটা সামলাতে সামলাতে জেম্মা নেমে আসছে একটু দুঃখ দুঃখ মুখ নিয়ে। লাল টকটকে পাড়, ঢালা সাদা জমি - গরদ। পাড়ার মোড়ে দুর্গাপুজো হোক কি ঘরোয়া লক্ষ্মী পুজো, সেই বিশেষ বিশেষ দিনে ওই গরদ শাড়ি বেরোতে দেখি আলমারি থেকে। পুজো মানেই গরদ, গরদ মানেই পুজো - এই এমন একটা ধারণা নিয়ে কচি থেকে বড় হয়ে ওঠা আমি একদিন শুধু শুধুই গরদ কিনতে চাইলাম, এমনি এমনি পরবো বলে। খোঁজ মিলল - আমাদের পশ্চিমবাংলার রেশমের প্রাণকেন্দ্র মুর্শিদাবাদে- গনকড়ের কাছে গ্রাম মির্জাপুর।
কীভাবে কোথা থেকে খোঁজ পেয়েছিলাম সে আর এখন মনে নেই। শুধু মনে আছে গুগল পর্দায় ভাসিয়ে তুলেছিল মির্জাপুর হ্যান্ডলুম ক্লাস্টার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি- সাদামাটা একটি একতলা বাড়ি১ - কালো হলুদে লেখা "গরদ শাড়ি উৎপাদন ও বিক্রয় কেন্দ্র"। আরও কিছু সার্চ রেজাল্ট পাওয়া গেল যেখানে কিছু হ্যান্ডলুম এবং হ্যান্ডিক্রাফটস ওয়েবসাইট (যাদের কথা আগের পর্বে উল্লেখ করেছিলাম, যেমন - gocoop.com ) এই মির্জাপুরের সিল্ক বিক্রি করছে। আজকাল একটা সুবিধে হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া হয়ে - তা হলো কান টানলেই মাথা আসার মত একটা সুতো পেলেই সেটা টেনে টেনে অনেক কিছু খুঁজে পাওয়া যায়। এর কুফলও প্রচুর, তবে সেটা আজকের আলোচ্য বিষয় নয়। সে যাই হোক - এভাবেই অনলাইনে আমার আলাপ হলো এক অমায়িক মানুষের সাথে - সুব্রত কৈল্ঠ্যা । ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে আজকাল অনেক হস্তশিল্পী সরাসরি অনলাইনে তাঁদের শিল্পকলার প্রচার এবং বিক্রি করেন। ভাগ্যক্রমে সুব্রতবাবুর ইন্সটাগ্রাম হ্যান্ডলটি আমি খুঁজে পাই- উনি মির্জাপুর হ্যান্ডলুম ক্লাস্টার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির সাথে জড়িত এবং মির্জাপুর হ্যান্ডলুম সিল্ক প্রোডিউসার কোম্পানি লিমিটেডের ডিরেক্টর।
প্রথম যোগাযোগ ইনস্টাগ্রামের মাধ্যমে হলেও বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই অনলাইনে হ্যান্ডলুমের কোন জিনিস কিনতে গেলে পরবর্তী কথোপকথন সচরাচর হোয়াটস্যাপের মাধ্যমে হয়। সুব্রত বাবুর সাথে এভাবেই হোয়াটস্যাপে কথাবার্তা শুরু হল একদম সাধারণ ক্রেতা হিসেবে- তখন এপ্রিলের গোড়ার দিক। তখন আমি সবে সবে আমার শাড়ির সিরিজটা ধরেছি - অসংখ্য প্রশ্ন মাথায় কিলবিল করছে। সুব্রতবাবুর পাঠানো ছবিগুলোর মধ্যে থেকে একটা দুটো শাড়ি পছন্দ করে দাম জানতে চাইলাম আর কিন্তু কিন্তু করে ওনাকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম যে- গরদ মানে আসলে কী জিনিস? কড়িয়াল গরদই বা কী বস্তু? ইত্যাদি। সুব্রতবাবু প্রশ্নের আতিশয্যে বিরক্ত তো হননিই - উপরন্তু উনি উৎসাহের সঙ্গে আমাকে জানাতে শুরু করলেন কয়েকশো বছরের পুরনো এই শিল্পের ইতিবৃত্ত।
প্রথমত গরদ শাড়ি হতেই হবে খাঁটি রেশম সুতোয় বোনা। আমাদের ভারতবর্ষে চার রকমের প্রাকৃতিক সিল্ক মেলে - মালবেরী সিল্ক যা রেশম চাষ করে আহরণ করা যায়; এছাড়া তিন রকমের বন্য রেশম - তসর, এরি এবং মুগা। গরদ শাড়ির টানা পোড়েন (আড়ে বহরে) দুদিকেই থাকবে মালবেরী সুতো। মোদ্দা কথা গরদ হল বাঙালিদের আপন হাতে তৈরী "পিওর সিল্ক"। সেই বৈদিক যুগ থেকেই হিন্দুদের মধ্যে একদম খাঁটী রেশমবস্ত্র পরে পুজোআর্চার চল ২,৩। এবার আদিকাল থেকে, ব্রিটিশ আসারও অনেক আগেই রেশম চাষ থেকে শুরু করে সুতো পাকানো, রং করা, কাপড়-ধুতি-উত্তরীয়-রুমাল বোনা ইত্যাদি সমস্তই হত আমাদের অবিভক্ত বঙ্গদেশে; মূলত তৎকালীন মুর্শিদাবাদ-মালদা-বগুড়া-রাজশাহী অঞ্চলে। সে অবশ্য ভারতের আরও কিছু জায়গাতে হত। কিন্তু মুর্শিদাবাদের ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যাপার ছিল ঐ অঞ্চলের রেশম বয়নশিল্পীদের মধ্যে হিন্দু প্রাধান্য আর জলপথে যোগাযোগের সুবিধা। ইসলাম ধর্মে খাঁটী রেশম পরা নিষেধ; কাজেই দেশের অন্য রেশম বয়নকেন্দ্র গুলিতে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা বেশী থাকায় সেখানে পিওর সিল্ক বোনার পরিমাণ ছিল কম, অন্য সুতোর মিশেলে বোনা হত২ । ফলে মুর্শিদাবাদের বোনা গরদের চাহিদা ছিল দেশজুড়ে এবং দেশের বাইরেও। ১৬০০ সালের আশেপাশে ওলন্দাজ ব্যবসায়ীরা প্রথম বাংলার রেশম এশিয়া আর ইউরোপে বিক্রি করতে শুরু করে, তার কিছুদিন পরেই যোগ দেয় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি৪। এইসবই পাই ১৯০৩ সালের এক রিপোর্টে। বর্তমানে মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে হিন্দু তাঁতির সংখ্যা বেশী হলেও তাঁদের পাশাপাশি রেশমগুটি থেকে সুতো বের করার কাজে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন অজস্র মুসলিম ধর্মাবলম্বী মানুষ।
সুব্রতবাবু জানালেন পিওর মালবেরী সিল্ক ছাড়াও আজকালকার গরদ শাড়ির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল ভেলভেট পাড় - সামনের দিকে জেল্লাদার, উল্টোদিকে সামান্য ম্যাট ফিনিশ। এইরকম পাড় বুনতে গেলে ব্যবহার করতে হয় ৪*১ ট্যুইল টেকনিক। মজার কথা হল কোভিড পূর্ব সময়ে যা আমার এবং আরও অনেক মেয়ের প্রায় জাতীয় পোশাক ছিল অর্থাৎ ডেনিম জিন্স- তা বোনা হয় এই ট্যুইল পদ্ধতিতে; আবার পুজোর সময় যখন হাজার আলসেমি অনায়াসে কাটিয়ে আলমারিতে মা-জেঠিমার গরদের দিকে চোখ যায়- সেখানেও এই একই বয়নপদ্ধতির ছোঁয়া! আর আজ বলে নয়, ব্রিটিশ যুগে ১৯০৩ সালের এক নথিতেও উল্লেখ পাচ্ছি মুর্শিদাবাদে ট্যুইল উইভিং-এ বোনা গাউনের৩ (ছবি ১, বাঁদিকে)। হালফ্যাশনের জিন্স৭ আর একশো বছরেরও বেশী আগের গাউন- দুটিতেই দেখা যাবে সরু সরু কোণাকুণি দাগ - এই ডায়াগনাল রেখা দেখে চেনা যাবে ট্যুইল উইভিং। ডানদিকে দেখা যাচ্ছে ২*১ ট্যুইল - "ক" সারিতে আড়াআড়ি সুতো গেছে ১-২ এর তলা দিয়ে, আবার ৩ ছেড়ে ৪-৫ এর তলা দিয়ে। আবার "খ" সারিতে পুরো জিনিসটা একঘর শিফট করে গেছে - ২-৩, তারপর ৫-৬ - এইভাবে চলেছে। যার ফলে কোণাকুণি পর পর রেখা তৈরী হচ্ছে কাপড়ে যা নীল দাগ দিয়ে দেখানো হয়েছে। তাহলে যা দেখা যাচ্ছে মুর্শিদাবাদের রেশমশিল্পীদের সেই কবে থেকেই ভারতের হ্যান্ডলুমের ম্যাপে উজ্জ্বল উপস্থিতি।
পুজোর অনুষঙ্গের কারণেই ঐতিহ্যগতভাবে গরদ হয় সাদা। ছেলেদের সাদা গরদের ধুতি; মেয়েদের জন্য সাদা ঢালা জমির শাড়ি, তাতে টকটকে লাল পাড়। এই টকটকে লাল রঙের পাড় হল মির্জাপুরি "কড়িয়াল" গরদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য - এই কড়িয়াল গরদ অন্যান্যদের থেকে আরও একটু আলাদা, আরও বেশী স্পেশাল। আমি আগে কড়িয়াল বেনারসির কথা শুনেছিলাম, কিন্তু কড়িয়াল গরদের কথা আমি সুব্রতবাবুর কাছেই প্রথম জানতে পারি। কড়িয়াল হলো এক ধরণের বয়নপদ্ধতি। সুবিধের জন্য সঙ্গের ২ নম্বর ছবি দেয়া হল।
ছবির বাঁদিকে রয়েছে একটি কাল্পনিক শাড়ি। শাড়ির উপরের অংশে দেখা যাচ্ছে প্লেইন উইভিং-এ পোড়েনের সাদা সুতো শাড়ির পাড়েও উপস্থিত, ফলে লাল-সাদায় মিশে পাড় ফ্যাকাসে লাল। তার একটু নিচে দেখছি যে টানা পোড়েন দুটিতেই লাল সুতো থাকলে পাড় টকটকে লাল, কিন্তু সে ক্ষেত্রে শাড়ির জমিতেও লাল সুতো থাকছে। এইবার ডানদিকে দেখানো হয়েছে কিভাবে ধবধবে সাদা জমিতে টকটকে লাল পাড় হবে? পোড়েনে থাকবে তিনটে সুতো, পাড় আর জমির সীমারেখায় তারা শিকলের মত করে সংযুক্ত থাকবে। ফলে জমির সাদা বা আর যে রঙেরই সুতো হোক - তা পাড়ে মিশবে না - এই হল কড়িয়াল বোনার গোড়ার কথা। দক্ষিণভারতে, তামিলনাড়ুর থাঞ্জাভুরের দিকেও৫ এই ধরণের বয়নপদ্ধতির খোঁজ পেলাম, সেখানে এর নাম কোরভাই।
দক্ষিণভারতে যেখানে নিদেনপক্ষে দুইজন শিল্পীর দরকার পড়ছে পোড়েনের তিনটে সুতো সামলাতে, সেখানে আমাদের বাংলার কড়িয়াল গরদ বুনতে একজনাই যথেষ্ট! কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে মুনশিয়ানার সাথে এইরকম গরদ বুনতে পারেন এমন আর চারজন কারিগরই অবশিষ্ট আছেন মির্জাপুরে- গোরাচাঁদ বৈদপুর আর গোপাল দত্ত এমনই দুই কড়িয়াল শিল্পীর নাম। কোরভাইয়ের মতই বিলুপ্তির পথে পা বাড়িয়েছে বাংলার বয়নশিল্পের এই সম্পদ৬, ৮ । এরই মধ্যে সুব্রতবাবুর মত কিছু মানুষ চেষ্টা করে চলেছেন নানাভাবে - মডেল দিয়ে শাড়ির ফোটোশ্যুট করিয়ে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করে বিক্রি বাড়ানোর চেষ্টা, মির্জাপুরের তাঁতশিল্পের উন্নতিকল্পে সরকারি সাহায্য এবং বিনিয়োগের ব্যবস্থাপনা, কড়িয়াল বয়নপদ্ধতির জি. আই ট্যাগের আবেদনের জন্য কাঠখড় পোড়ানো ইত্যাদি। এই জি. আই ট্যাগ বা জিওগ্রাফিকাল ইন্ডিকেশন ট্যাগ হলো কোন বিশেষ দ্রব্য বা শিল্পকে একটি ভৌগোলিক অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য হিসেবে নথিভুক্ত করা, যেমন ধরা যাক- দার্জিলিং চা কিংবা বাংলার নকশিকাঁথার জি আই ট্যাগ আছে। এই অঞ্চলের বাইরে তৈরী অনুকরণকে এই নামে ডাকা বেআইনি। সুব্রত বাবু যে মুশকিলে পড়েছেন তা হল বংশপরম্পরায় চলে আসা এই কড়িয়াল পদ্ধতির কোন প্রামাণ্য ইতিহাসের হদিশ দিতে পারছেন না কেউ। জনশ্রুতি আছে যে মুঘল দরবারেও এই কড়িয়াল গরদের খ্যাতি ছিল, কিন্তু জি আই ট্যাগের জন্য কেবল জনশ্রুতি যথেষ্ট নয়।
লাল-সাদা কড়িয়াল ছাড়াও গরদের অন্য আরও কতগুল নক্সা হল - আঁচলবুটি, টিকি সাটিন, জামদানি, ফাঁকি ইত্যাদি। এখন রঙ্গিন গরদ বোনা শুরু হয়েছে যুগের চাহিদার সাথে তাল মেলাতে। কয়েক বছর হল ঢুকেছে সিংগল জাকার্ড এবং ডাবল জাকার্ড লুম, মিহি সূক্ষ্ম কারুকাজ আর মিনাকারীর কাজ রেশমের ওপর ফুটিয়ে তুলতে। সুব্রতবাবুকে প্রশ্ন করে করে ওনার মাথা ধরিয়ে দেবার পর আমি ওনার থেকে কিনেছিলাম দুটি শাড়ি যা খুব যত্ন সহকারে প্যাক করে উনি পাঠিয়েছিলেন রিষড়ার বাড়িতে। একটি লাল সাদা সাবেকী কড়িয়াল গরদ আমার এবং অন্যটি ডাবল জাকার্ডে বোনা মিনাকারী কাজের একটি নীল আধুনিক গরদ মায়ের জন্য।
নীচে রইলো তার ছবি-
জাকার্ড লুমে কিভাবে কাপড় বোনা হয়, আর মির্জাপুরের রেশমশিল্প নিয়ে পুরনো দিনের পুঁথিপত্র আর কী চমক লুকিয়ে রেখেছে সে গল্প হবে আরেকদিন।
সুব্রত বাবুর ইনস্টাগ্রাম এবং ফেসবুক পেজ :
https://www.instagram.com/kailthyahandloom/
https://www.facebook.com/kailthyahandloom
Whatsapp যোগাযোগ- +91 79087 53198
তথ্যসূত্রঃ
১। মির্জাপুর হ্যান্ডলুম ক্লাস্টার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি
২। Mookerji, Baboo Nitya Gopal, “The Silk Industries Of Moorshedabad”. The Journal of Indian Art, 1886-1916; Jan 1894; 5, 38-45.
৩। Mukerji, Nitya Gopal. A Monograph on the Silk Fabrics of Bengal. India: Bengal secretariat Press, 1903.
৪। Guha, S. C., ‘Silk Industry of Malda and Murshidabad from 1660 to 1833’, N.L. Publishers, Siliguri, 2003.
৫। “The story of revival of Korvai silk saris”, August 2020
৬। “ফুলিয়া থেকে বিষ্ণুপুর, সর্বত্রই শাড়িতে নতুনত্ব”, 17 October 2015
৭। "Understanding Raw Denim: Warp, Weft and Twill", August 2011
৮।লুপ্ত গরদ করিয়াল শাড়ি, Oct 17 2018.