পর্ব - ৩ (শেষ পর্ব)
দিল্লিতে যখন পরিযায়ীদের চলাচল শুরু হলো, আমি প্রায়শই যে পত্রিকার জন্য লিখি, তাদের একটা প্রেস কার্ড নিয়ে, নিজেই গাড়ি চালিয়ে গেলাম উত্তরপ্রদেশ-দিল্লির সীমান্তের গাজিপুরে।
যে দৃশ্য দেখলাম তা প্রায় মহাকাব্যিক১। বা হয়ত নয়। এমন বিপুল পরিমাণ লোক মহাকাব্যেরও কল্পনাতীত। শারীরিক ব্যবধান রক্ষা করার জন্য তৈরি এই লকডাউনের ফল হলো ঠিক উল্টো -- একটা অভাবনীয়, গায়ে-গায়ে চাপাচাপির পরিস্থিতি। বিষয়টা অবশ্য ভারতের ছোট-বড় নানা শহরের ক্ষেত্রেও সত্যি। বড় রাস্তা ফাঁকা হলে কি হবে, ছোট ছোট কোয়ার্টার, বস্তি, ঝুপড়িতে ঠাসাঠাসি করে বেঁচে আছে গরিবরা।
পরিযায়ী এই মানুষদের যতজনের সঙ্গেই কথা বললাম, প্রত্যেকে ভাইরাসটিকে নিয়ে ভীত। কিন্তু তাদের কর্মহীন, ক্ষুধার্ত, পুলিশি-মার খাওয়া যে জীবন, সে তুলনায় ভাইরাসের ভয় যেন কিছুটা কম বাস্তবিক, তার উপস্থিতি যেন কিছুটা কম। মুসলিম দর্জিদের একটি দল, যারা মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই সুসংগঠিত মুসলিম-বিদ্বেষের হাত থেকে বেঁচে ফিরেছে, তাদের এবং আরো যতজনের সঙ্গে সেদিন কথা বললাম, বিশেষভাবে একজনের কথা আমাকে বিহ্বল করে দিয়েছিল। সে কাঠের মিস্ত্রি, নাম রঞ্জিত; ঠিক করেছিল হেঁটে যাবে নেপাল সীমান্তের গোরখপুর অব্দি।
"হয়তো মোদীজি যখন এমন করবেন ভেবেছিলেন, তখন কেউ তাকে আমাদের কথা বলেননি। হয়তো তিনি আমাদের ব্যাপারে জানেনই না", সে বলল। 'আমাদের' বলতে প্রায় ৪ কোটি ৬০ লক্ষ মানুষ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতোই, ভারতের রাজ্য সরকারেরা এই সংকটের মুহূর্তে অনেক বেশি সহৃদয়তা ও সহনশীলতা দেখিয়েছে। ট্রেড ইউনিয়ন, সাধারণ নাগরিকরা এবং অন্যান্য যৌথ উদ্যোগ বন্টন করে চলেছেন খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য আপৎকালীন রেশন। ফান্ডের জন্য তাদের অসহায় আবেদনে সাড়া দিতে কেন্দ্রীয় সরকার যথেষ্ট ঢিলেমি দেখিয়েছে। যা বোঝা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর ন্যাশনাল রিলিফ ফান্ডে কোন 'রেডি ক্যাশ' নেই। তার বদলে শুভাকাঙ্ক্ষীরা টাকা ঢালছেন কিছুটা রহস্যময় PM CARES ফান্ডে। মোদির মুখের ছবিসহ প্রি-প্যাকেজড্ খাবারের উদয় হচ্ছে। এরই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেয়ার করেছেন তাঁর যোগনিদ্রার ভিডিওগুলি, যাতে অ্যানিমেশনের সাহায্যে বিকৃত করা, সুঠাম চেহারার মোদি মানুষকে স্ব-অন্তরণের যন্ত্রণা সামাল দিতে উপকারী যোগাসন প্রদর্শন করছেন।
এই আত্মমুগ্ধতা খুব অস্বস্তিকর। এই যোগাসনগুলির একটা অনুরোধাসন হলে মন্দ হয় না, যেখানে মোদি ফরাসি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করতে পারেন আমাদের সঙ্গে সেই গোলমেলে রুফাল যুদ্ধজেটের চুক্তির পুনর্নবীকরণ করতে। তাহলে ওই ৮.৫ বিলিয়ন ডলার ব্যবহার করা যাবে কয়েক কোটি ক্ষুধার্ত মানুষের সহায়তায়; খুব দরকার। ফরাসি প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই বুঝবেন।
লকডাউন যতই এগোচ্ছে দ্বিতীয় সপ্তাহে, ততই ভেঙে পড়ছে সরবরাহের সমস্ত সূত্র, ফুরিয়ে আসছে ওষুধ আর প্রয়োজনীয় দ্রব্যের জোগান। হাজার হাজার ট্রাক ড্রাইভার এখনও হাইওয়েতে থমকে, তাদের সঙ্গে খাবার আর জল নেই বললেই চলে। ক্ষেতের পাকা ফসল, রোয়ার অপেক্ষায়, পড়ে পড়ে পচছে। অর্থনৈতিক সংকট উপস্থিত। রাজনৈতিক সংকট চলিষ্ণু। মূলস্রোতের মিডিয়া তার ২৪/৭ বিষাক্ত মুসলিম-বিরোধী ক্যাম্পেনে জায়গা করে দিচ্ছে কোভিডকেও। তবলিঘি জামাত নামের একটি সংস্থা লকডাউন ঘোষণার আগেই দিল্লিতে একটি সভা করেছিল; তারা হয়ে উঠল 'সুপার স্প্রেডার'। এই ঘটনার নিরিখে কলঙ্কিত করা হচ্ছে মুসলিমদের, সবচেয়ে বড় শয়তান ঠাওরানো হচ্ছে তাদের। মূল সুরটা কিছুটা এমন, মুসলিমরাই এই ভাইরাস সৃষ্টি করে, ইচ্ছাকৃত ভাবে জেহাদের একটি রূপে তাকে ছড়াচ্ছে।
কোভিড-সংকট আরও আসা বাকি। বা হয়তো নয়। আমরা জানি না। যদি আসে, যখন আসবে, আমরা নিশ্চিত জানবো, তাকে সামাল দেওয়া যাবে সমস্ত ধর্ম, শ্রেণী ও জাতিবিদ্বেষ বজায় রেখেই। আজ২ ভারতের হাতে প্রায় ২০০০টি নিশ্চিত সংক্রমণের ঘটনা, মৃত্যু ৫৮টি। অবশ্যই এই সংখ্যাগুলি বিশ্বাসযোগ্য নয়, কারণ ভয়াবহ স্বল্পসংখ্যক কিছু নমুনা-পরীক্ষা এদের ভিত্তি। বিশেষজ্ঞদের মতামতে ফারাক অনেক। কেউ বলছেন, সংক্রমণের সংখ্যা লক্ষ ছাড়িয়ে যাবে, অন্যেরা মনে করছেন তার চেয়ে অনেক কমেই বাধা। আমাদের উপর সেটি আছড়ে পড়ার মুহূর্তেও হয়তো আমরা জানতে পারবো না, এই সংকটের সীমা কোথায়। এটুকুই জানি, হাসপাতালে ছোটাছুটি শুরু হয়নি এখনও।
প্রতিবছর ডায়রিয়া ও অপুষ্টিতে মৃত দশ লক্ষ শিশু, তার সঙ্গে টিউবারকিউলসিসে আক্রান্ত কুড়ি লক্ষ মানুষ (সারা পৃথিবীতে এই রোগে আক্রান্তের এক চতুর্থাংশ), এবং রক্তাল্পতায় ভোগা, অপুষ্ট (ফলত যে কোনও ছোটখাটো অসুখেও অসুরক্ষিত) অসংখ্য মানুষ নিয়ে ভারতের সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র এমনিতেই পেরে ওঠে না। ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্রে যে ব্যাপক হারের সংকটকে এই মুহূর্তে সামলাতে হচ্ছে, ভারতের পক্ষে তা একেবারে অসম্ভব হয়ে উঠবে। হাসপাতালগুলো সম্পূর্ণভাবে এই ভাইরাসের মোকাবিলায় নামায় অন্যান্য সব স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রায় থেমে গেছে। দিল্লির কিংবদন্তি 'All India Institute of Medical Sciences' (AIIMS)-এর ট্রমা সেন্টার এখন বন্ধ, ক্যান্সার-রোগীরা এখন ক্যান্সার-রিফিউজি, যাদের হাসপাতালের বাইরে রাস্তায় গরুছাগলের মতো তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, ওখানেই রাত কাটাতে হচ্ছে।
বহু মানুষ বাড়িতেই অসুস্থ হবে, ও মারা যাবে। তাদের কথা হয়তো কোনোদিনই জানতে পারবো না আমরা। হয়তো শুমারির সংখ্যাতেও তারা ধরা পড়বে না। আমরা কেবল আশা করতে পারি, ভাইরাসটি ঠান্ডা আবহাওয়া পছন্দ করে -- এই জাতীয় গবেষণা সত্যি হোক (যদিও অন্যান্য গবেষকরা এই বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন)। ভারতের এই তেতেপুড়ে যাওয়া, অত্যাচারী গ্রীষ্মের জন্য এমন অবাস্তব অপেক্ষা বোধ হয় আগে কেউ কখনও করে নি।
আমাদের জীবনে এসে পড়া এই জিনিসটি কী? হ্যাঁ, একটা ভাইরাস, ঠিকই। নিজের মধ্যে, নিজের সম্বন্ধে কোনওরকম নীতিবোধ নেই তার। কিন্তু নিশ্চিতভাবে, এটি একটি ভাইরাসের চেয়ে বেশি কিছু। কেউ কেউ মনে করছেন, ঈশ্বর এইভাবেই হয়তো আমাদের সুবুদ্ধি ফিরিয়ে আনছেন। অন্যেরা ভাবছেন, সারা বিশ্বের উপর কব্জা করতে এটা চীনের একটা ষড়যন্ত্র।
যা-ই হয়ে থাক, কোভিড-১৯ তাবড়দেরও নুইয়ে দিয়েছে, পৃথিবীকে থামিয়ে দিয়েছে এমনভাবে যা আর কেউ কোনোদিন পারেনি। আমাদের মন এখনও আগু-পিছু ছুটছে, আপ্রাণ ফিরতে চাইছে স্বাভাবিকতায়, চেষ্টা করছে বর্তমানের এই ক্ষত অস্বীকার করে অতীত আর ভবিষ্যৎকে এক সুতোতেই বুনে নিতে। কিন্তু এই ক্ষত অনস্বীকার্য। আর এই চরম অসহায়তার মাঝে সে আমাদের সুযোগ দিয়েছে, নিজেদের জন্য নিজহাতে এই যে আমরা কিয়ামতের কল বানিয়েছি, তা নিয়ে ভাবার। স্বাভাবিকতায় ফেরার চেয়ে খারাপ আর কিছুই হতে পারে না এখন। ইতিহাস বলে, অতিমারী মানুষকে বাধ্য করেছে অতীত থেকে নিজেকে ছিন্ন করে নতুনভাবে জগৎকে ভাবতে। এটিও তার ব্যতিক্রম নয়। এই প্যান্ডেমিক একটি পোর্টাল, একটি প্রবেশপথ -- এক পৃথিবী ছেড়ে অন্য পৃথিবীতে যাওয়ার।
আমরা এই পথ হেঁটে পেরোতে পারি, আমাদের বিদ্বেষ, ঘেন্না, লালসা, মৃত ভাবনা, তথ্যভান্ডার, মরা নদী ও ধোঁয়াটে আকাশের শব নিজেদের সঙ্গে টানতে টানতে। বা হালকাভাবেও হেঁটে বেরিয়ে যেতে পারি, সামান্য কিছু মালপত্র সমেত, অন্য এক জগতের কল্পনায় উদ্যত। তার জন্য লড়তে উদ্যত।
(শেষ)
____________________
১ মূল গদ্যে এখানে ব্যবহৃত শব্দটি ছিল 'Biblical'; বাইবেলের আখ্যানে বিপুল migration-এর যে উল্লেখ, অরুন্ধতী সম্ভবত সেদিকে নির্দেশ করেছিলেন। 'Biblical' কথাটি বাংলায় রেখে দেওয়া যেত এই ক্ষেত্রে। তবে বাইবেলের সূত্র টেনে মূল লেখায় যেটা বোঝাতে চাওয়া হচ্ছে, তা হলো জনসংখ্যার ব্যাপকতা, বা যাকে আমরা বলি, 'epic proportions'। তাই, ভাষান্তরে বাঙালি পাঠকের কাছে ব্যাপকতা বোঝাতে পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে প্রোথিত 'Biblical' শব্দটির বদলে 'মহাকাব্যিক' কথাটি ব্যবহার করেছি; যদিও migration-এর নিরিখে 'মহাকাব্যিক' কোনও স্পষ্ট সূত্র বহন করে না।
২২রা এপ্রিল, ২০২০।
অরুন্ধতী রায়ের অন্য দুয়েকটা লেখা পড়েছি, বেশী পড়তে পারিনি (সেই মোটা বইটাও পড়িনি)। অন্য লেখাগুলোর মতো এই লেখাটাও হাইলি কনফিউজড।
'সেই মোটা বই' ?
ছোট জিনিসের ভগবান।
'গড অফ স্মল থিংস ' নভেলটা?
হ্যাঁ রঞ্জন বাবু, উনি ওই বইটির কথাই বলছেন। :)
আমি অরূন্ধতীর লেখা বিশেষ পছন্দ করি। যা যা বেরোয় টপাৎ করে কিনে বা এদিক সেদিক থেকে যোগাড় করে পড়ে ফেলি।
ডিসির বিপরীতে আমার ভয়েসটা রেখে গেলাম।
যাক! ভাগ্যিস ডিসি বাবু আমার লেখাটায় কমেন্ট করেছিলেন। :D সেই সুবাদে আরও কিছু কমেন্ট পাচ্ছি অন্তত।
সবরকম ভয়েস থাকাই তো কাম্য :-)