[অরুন্ধতী রায়ের 'The Pandemic Is a Portal১' প্রথম প্রকাশিত হয় ২০২০ সালের ৪ঠা এপ্রিল, 'Financial Times' পত্রিকায়, কোভিড-১৯ এর প্রথম ঢেউয়ের প্রাদুর্ভাবের কিছুদিনের মধ্যেই। শেষ এক বছর কিছু মাসে মানুষের ইতিহাস আরও গতিময় হয়েছে; এক পরিস্থিতির ভয়াবহতা না কাটতেই আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি এসে উপস্থিত হয়েছে, তারপর আরও। তবে প্যান্ডেমিকের প্রাথমিক পর্বে লেখা এই নিবন্ধের গুরুত্ব আজকের দ্বিতীয় ঢেউয়ের মাঝেও হ্রাস পায় না মোটে। অতিমারীর মুখে প্রশাসনের ভূমিকা কী ছিল, বা কী থেকে যাবে, তা তুলে ধরে। বর্তমানে নিবন্ধটি লেখিকার 'আজাদী ' বইয়ের অন্তর্গত। আজ প্রথম পর্ব এই নিবন্ধের ভাষান্তরের।]
পর্ব - ১
ভয়ে একটুও না কেঁপে উঠে এখন আর কে 'ভাইরাল হয়ে গেছে' কথাটা ব্যবহার করতে পারবেন? কোনও কিছুর দিকে তাকিয়ে -- একটা দরজার হাতল, একটা কার্ডবোর্ডের বাক্স, বা তরিতরকারির একটা ব্যাগ -- কেউ কি কল্পনা না করে থাকতে পারবেন যে ওগুলোর মধ্যে গিজগিজ করে অদৃশ্য, না-মরা-না-বাঁচা কিছু বিন্দু, যারা নিজেদের 'সাকশন প্যাড' নিয়ে তৈরি আমাদের ফুসফুসে গেঁড়ে বসার জন্য? সন্ত্রস্ত না হয়ে কে এখন চুম্বন করবে আগন্তুককে, বা দৌড়ে উঠবে কোনও বাসে, বা নিজের ছেলেমেয়েদের পাঠাবে স্কুলে? অতি সাধারণ সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভাবতে গেলে তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ঝুঁকির কথা কারও মনে পড়বে না, এমন কি সম্ভব? আমরা সবাইই এখন হাতুড়ে মহামারীবিদ, ভাইরোলজিস্ট, সংখ্যাতাত্ত্বিক আর দার্শনিক। কোন বৈজ্ঞানিক বা ডাক্তার একটা মিরাকল হয়ে যাক - মনে মনে এমন প্রার্থনা করছেন না? কোন বিজ্ঞানবিরোধী পুরুত, সবার আড়ালে হলেও, বিজ্ঞানের শরণাপন্ন হচ্ছে না? এবং ক্রমবর্ধমান এই ভাইরাসের মুখেও, শহরে পাখির কলকাকলির তোড়ে, ট্র্যাফিক সিগন্যালে নেচে বেড়ানো ময়ূর দেখে, আর নির্জন নীরব আকাশ দেখে, এমন কে আছে যে শিহরিত হয় নি?
আমি এই লেখা যখন লিখছি, বিশ্বব্যাপী সংক্রমণের সংখ্যা বিপজ্জনকভাবে এগিয়ে চলেছে এক মিলিয়নের দিকে। প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ ইতিমধ্যেই মৃত। অভিক্ষেপ যা বলে, এই সংখ্যা আরও শতসহস্র ছাড়িয়ে যাবে, হয়তো আরও বেশি। বাণিজ্যিক ও আন্তর্জাতিক রাজধানীর পথ ধরে ভাইরাসটি খোলামেলা ঘুরে বেড়িয়েছে, আর এই ভয়ঙ্কর অসুখটি জেগে উঠে মানুষকে বন্দি করেছে তাদের দেশে, শহরে, বাড়িতে।
তবে, মূলধনের প্রবাহের মতো লাভ এই ভাইরাস চায় না, সে চায় প্রসারণ; কাজেই, কিছুটা না বুঝেই, সে এই প্রবাহকে ঘুরিয়ে দিয়েছে উল্টোদিকে। ইমিগ্রেশন কন্ট্রোল, বায়োমেট্রিক্স, ডিজিটাল নজরদারি, আরও অন্যান্য যাবতীয় ডেটা অ্যানালিটিক্সকে সে তাচ্ছিল্য করেছে, এবং পৃথিবীর সবচেয়ে ধনবান দেশগুলিকে এখনও অব্দি সবচেয়ে বেশি বিপাকে ফেলেছে; পুঁজিবাদের ইঞ্জিন একেবারে সশব্দে থেমে গেছে মাঝপথে। সাময়িকভাবে হলেও, এই ইঞ্জিনের খোলনলচে এবার খুঁটিয়ে দেখার সময় পেয়েছি আমরা, এই মূল্যায়ন ও সিদ্ধান্তের সময় পেয়েছি যে আমরা এটাকেই সারাতে চাই, নাকি এর চেয়ে ভালো ইঞ্জিনের খোঁজ করতে চাই।
প্রশাসনের যে-সব নীতিবাগীশরা এই অতিমারী সামলাচ্ছেন, তারা যুদ্ধের কথা বলতে ভারি ভালোবাসেন। যুদ্ধকে তারা আর রূপক হিসেবেও নয়, একেবারে আক্ষরিক অর্থে ব্যবহার করেন। কিন্তু এটা যুদ্ধই যদি হতো, আমেরিকার চেয়ে ভালো আর কারই বা প্রস্তুতি থাকতো? আজ যদি এই প্রথমসারির যোদ্ধাদের মাস্ক, শোয়াব প্যাড, গ্লাভস এসবের বদলে বন্দুক, উন্নতমানের বোমা, বাঙ্কার-বাস্টার, সাবমেরিন, যুদ্ধবিমান, আণবিক বোমার প্রয়োজন হতো, তার কোনও ঘাটতি পড়তো কি?
রাতের পর রাত, পৃথিবীর এই প্রান্ত থেকে আমরা অনেকে দেখি প্রেস-বিবৃতি দিচ্ছেন নিউ ইয়র্কের গভর্নর; বিবৃতিতে তাঁর সেই মুগ্ধতা ব্যাখ্যা করা কঠিন। সংখ্যাতত্ত্বে চোখ রাখি, যুক্তরাষ্ট্রের বিহ্বল সব হাসপাতালের গল্প শুনি; গল্প শুনি কাজের চাপে পিষে যেতে থাকে, কম মাইনে পাওয়া নার্সদের -- জঞ্জালের ব্যাগ বা পুরোনো রেনকোট কেটে তাঁরা মাস্ক তৈরি করছেন, নিজেদের সবকিছু বাজি রাখছেন রোগীদের শুশ্রূষায়। শুনছি, স্টেটগুলি একে অন্যের বিরুদ্ধে কেমন দর হাঁকছে ভেন্টিলেটরের জন্য, ডাক্তাররা কেমন দ্বিধাগ্রস্থ কোন রোগী ভেন্টিলেটর পাবেন, আর কে পাবে না, সে নিয়ে। নিজেদের মনেই আমরা ভাবছি, "হা ভগবান! এই নাকি আমেরিকা!"
এই ট্র্যাজেডি তাৎক্ষণিক, মহাকাব্যিক, এটিই সত্য; আমাদের চোখের সামনে বিমূর্ত হচ্ছে। কিন্তু এটি এমন কিছু নতুন নয়, অনেক বছর ধরে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে নিচের দিকে ছুটে চলা একটা ট্রেনের ধ্বংসাবশেষ মাত্র। 'Patient dumping'-এর ভিডিওগুলো আমরা নিশ্চয়ই কেউই ভুলে যাই নি -- রুগ্ন, গায়ে তখনও হসপিটাল গাউন জড়ানো, সম্পূর্ণ নগ্ন মানুষগুলো, চুপিচুপি তাদের ফেলে আসা হয়েছে রাস্তায়? যুক্তরাষ্ট্রের অসমৃদ্ধ নাগরিকদের জন্য হাসপাতালের দরজা বন্ধই থেকেছে বেশিরভাগ সময়। তাঁরা কতটা অসুস্থ, বা কিভাবে যন্ত্রণা পাচ্ছে -- এসব প্রশ্নে কারুরই কিছু যায় আসে নি, অন্তত এতদিন অব্দি। কারণ এখন এই 'ভাইরাস' যুগে, একজন দরিদ্রের অসুস্থতা স্বচ্ছল সমাজের স্বাস্থ্য বিঘ্নিত করতে পারে। এবং তৎস্বত্বেও, এখনও, বার্টি সন্ডার্সের মতো সিনেটরকেও -- যিনি নিরন্তন সওয়াল করে গেছেন স্বাস্থ্য পরিষেবার পক্ষে -- হোয়াইট হাউজের রেসে পদবাচ্য মনে করছে না তাঁর নিজের পার্টিই।
আর আমার দেশ, আমার আমির-গরীব দেশ, ফিউডালিজম আর ধর্মীয় মৌলবাদের মাঝে, শ্রেণীভেদ আর পুঁজিবাদের মাঝে কোনো একখানে ঝুলতে থাকা, অতি দক্ষিণপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদ-শাসিত ভারতবর্ষ -- তার কি খবর? ডিসেম্বরে, যখন চীন এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সঙ্গে যুঝছে য়ূহানে, ভারত সরকার সামাল দিচ্ছিল পার্লামেন্টে তার নিজেরই পাশ করানো নির্লজ্জ, বৈষম্যমূলক, মুসলিম-বিরোধী নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে শতসহস্র দেশবাসীর গড়ে তোলা এক গণ-অভ্যুত্থান।
(ক্রমশ)
___________________
১ ভাষান্তরে 'প্যান্ডেমিক' ও 'পোর্টাল' শব্দদুটি অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে, প্রাথমিকভাবে ধ্বনিবৃত্তির কারণে। তা ছাড়াও, মূল নিবন্ধটি একটি বহুলপঠিত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল, অতিমারী প্রসঙ্গে কিছু তথ্য ও তাদের সহজ পাঠ আমাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। সাহিত্যমূল্য নয়, জনসংযোগই তার প্রধান লক্ষ্য। তাই এই ভাষান্তরে কথ্য ভাষার সচলতা বজায় রাখতে একাধিক ইংরাজি শব্দ পরিস্থিতি অনুযায়ী অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। বাংলাভাষার কৌলীন্যরক্ষা এখানে প্রাধান্য পায় নি।