পর্ব - ২
ভারতে কোভিড-১৯ সংক্রমণের প্রথম ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় ৩০শে জানুয়ারি, প্রজাতন্ত্র দিবসের প্যারেডে উপস্থিত আমাদের প্রধান অতিথি, আমাজনের জঙ্গল-খেকো, কোভিডের অস্তিত্ব অস্বীকার করা জাইর বোলসোনারোর দিল্লি থেকে বিদায় নেওয়ার ক’দিনের মধ্যেই। কিন্তু শাসকদলের ফেব্রুয়ারি মাসের রুটিনে এত কিছু করার ছিল যে ভাইরাসকে আর জায়গা দেওয়া গেল না তাতে। মাসের শেষ সপ্তাহে রাখা হয়েছিল প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকারি সফর। গুজরাটের একটি স্পোর্টস স্টেডিয়ামে দশ লক্ষ জনতার উপস্থিতির প্রতিশ্রুতি দিয়ে লোভ দেখানো হয়েছিল তাকে। এই সব কিছুই টাকা, আর অনেকটা সময় খেয়ে নিল।
তারপর ছিল দিল্লির বিধানসভা নির্বাচন – তাতে, যদি না খেলা ঘোরাতে পারে, ভারতীয় জনতা পার্টির হার নিশ্চিত ছিল। খেলা ঘুরল – কোনও রাখঢাক না রাখা, বিষাক্ত হিন্দু জাতীয়তাবাদী ক্যাম্পেন শুরু হল; শারীরিক নির্যাতন করা হবে, ‘প্রতারক’দের গুলি করে মারা হবে, এসব স্লোগানে ভরে উঠলো সেই ক্যাম্পেন।
যাই হোক, শেষ অব্দি হারল। কাজেই তারপর শুরু হল দিল্লির মুসলিমদের শাস্তি দেওয়ার পালা; পার্টির এই অপমানে১ দোষী ঠাওরানো হল তাদের। সশস্ত্র হিন্দু নজরদারদের দল উত্তর-পূর্ব দিল্লির শ্রমজীবী মুসলিম পাড়াপ্রতিবেশিদের আক্রমণ করলো, পোড়ানো হল বাড়িঘর, দোকান, মসজিদ, আর স্কুল। যেসব মুসলিমরা এই আক্রমণ কিছুটা অনুমান করেছিল, তারা লড়লো। পঞ্চাশেরও বেশি মানুষ – মুসলিম, ও কিছু হিন্দু – নিহত হল। হাজার হাজার মানুষ ঠাঁই নিল স্থানীয় কবরস্থানে তৈরি রিফিউজি ক্যাম্পে। জালের মতো ছড়িয়ে থাকা নোংরা, দুর্গন্ধী নর্দমা-নালা থেকে তখনও টেনে বার করে আনা হচ্ছে পচা-গলা দেহ, যখন সরকারি আধিকারিকরা কোভিড-১৯ নিয়ে তাঁদের প্রথম বৈঠকে বসছেন, এবং বেশিরভাগ ভারতীয় প্রথমবার হ্যান্ড স্যানিটাইজার নামক কোনও বস্তুর অস্তিত্বের কথা শুনছে।
মার্চও কাটল ব্যস্ততার মধ্যেই। প্রথম দু’ সপ্তাহ গেল মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেস সরকারকে উল্টে ফেলে তার জায়গায় বিজেপি সরকারকে নিয়ে আসতে। ১১ই মার্চ ‘ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন’ কোভিড-১৯কে অতিমারী হিসেবে ঘোষণা করলো, আর ঠিক দু’ দিন পর, ১৩ই মার্চ আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রক বললেন, কোভিড-১৯ ‘জরুরি স্বাস্থ্যাবস্থা’ নয়। অবশেষে, ১৯শে মার্চ প্রধানমন্ত্রী বার্তা দিলেন দেশের উদ্দেশ্যে। বিশেষ কিছু হোমওয়ার্ক করেন নি উনি, ফ্রান্স আর ইতালির খাতা থেকে টুকেছিলেন মাত্র। বললেন ‘সামাজিক দূরত্ব’ বজায় রাখতে (জাতিভেদ চর্চায় এতটা নিমজ্জিত একটা সমাজে এই বিষয়টি বোঝা সহজ), আর ২২শে মার্চ একদিনের জন্য ‘জনতা কারফিউ’ ঘোষণা করলেন। তাঁর সরকার এই সঙ্কটমুহূর্তে কী করতে চলেছে – সে নিয়ে কিছুই খোলসা করলেন না, কিন্তু মানুষদের বললেন বারান্দায় বেরিয়ে ঘণ্টা বাজিয়ে, থালা, বাসন পিটিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের স্যালুট জানাতে। অথচ উল্লেখ করলেন না, সেই মুহূর্ত অব্দিও প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জাম এবং শ্বাসযন্ত্র তার নিজের হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য না রেখে ভারত রপ্তানি করে চলেছে।
স্বাভাবিকভাবেই, প্রবল উৎসাহ উদ্দীপনায় মানা হল নরেন্দ্র মোদীর অনুরোধ। থালা বাজাতে বাজাতে পদযাত্রা, দল বেঁধে নাচ, মিছিল সবই হল। সামাজিক দূরত্ব অবশ্য রইল না তেমন। তার পরের দিনগুলোয় শুরু হল মানুষের গোবর-ভরা ব্যারেলে লাফঝাঁপ, আর বিজেপি সমর্থকরা গোমূত্র পানের আসর বসালেন। বহু ইসলামীয় সংগঠনও এইসবে পিছিয়ে না থেকে ঘোষণা করলেন, এই ভাইরাসের একমাত্র উত্তর হলেন স্বয়ং আল্লাহ, এবং শয়ে শয়ে ধার্মিকদের জমা হতে বললেন মসজিদে। ২৪শে মার্চ, রাত আটটা নাগাদ আবার টিভিতে দেখা গেল মোদীকে, ঘোষণা করছেন, মধ্যরাত থেকে সারা ভারতে লকডাউন জারি হবে। বাজার দোকান বন্ধ থাকবে, একটি গাড়িকেও – সরকারি হোক বা বেসরকারি – রাস্তায় বেরোতে দেওয়া হবে না। বললেন, এই সিদ্ধান্ত তিনি শুধু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়, আমাদের পরিবারের গুরুজন হিসেবে নিচ্ছেন। নাহলে আর কার পক্ষেই বা সম্ভব, রাজ্য সরকারদের সঙ্গে (এই সিদ্ধান্তের কুফল বহন করতে হবে যাদের) কোনোরকম আলোচনা না করে, একেবারে প্রস্তুতিহীন অবস্থায়, চার ঘণ্টার নোটিসে ১৩৮ কোটি মানুষের একটা দেশকে লকডাউনে পাঠিয়ে দেওয়া? নিশ্চিত, তাঁর পদ্ধতি এই ধারনাই দেয় যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে নিজের শত্রু মনে করেন যাঁদের কেবল আক্রমণ করা যায়, চমকানো যায়, কিন্তু কখনই ভরসা করা যায় না।
অবরুদ্ধ হলাম আমরা। অনেক পেশাদারি স্বাস্থ্যকর্মী ও মহামারীবিদরা এই সিদ্ধান্তের প্রশংসা করলেন। হয়তো খাতায় কলমে তাঁরা ঠিক। কিন্তু, যে উদ্দেশ্যে এতকিছু, তার ঠিক বিপরীত সাধিত করে চলা পৃথিবীর সবচেয়ে বড়, শাস্তির মতো এই লকডাউনের পিছনে যে পরিকল্পনা ও প্রস্তুতিগত বিপর্যয়, খামতি – তাকে নিশ্চয়ই তাঁরা সমর্থন করবেন না।
স্পেকট্যাক্ল্-প্রিয় মানুষটি সবার সেরা স্পেক্ট্যাক্ল্ সৃষ্টি করলেন।
সারা বিশ্ব হতবাক হয়ে দেখল ভারতের এই চরম লজ্জাজনক স্বপ্রকাশ – তার নৃশংস, গঠনগত, সামাজিক, অর্থনৈতিক অসাম্যে, মানুষের ভোগান্তির প্রতি তার নির্বোধ ঔদাসীন্যে। লকডাউন অনেকটা একটা রাসায়নিক বিক্রিয়ার মতো – হঠাৎ করে চোখে পড়তে শুরু করলো এতদিন আড়ালে থাকা বিষয়গুলো। দোকানপাট, রেস্তোরাঁ, কলকারখানা, নির্মাণ সংস্থাগুলি যত বন্ধ হয়ে যেতে শুরু করলো, যত উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী নিজেদের বন্দি করে ফেলল গেটের এ’পারের সব মহল্লায়, আমাদের ছোট-বড় শহরেরা ততই ধাক্কা মেরে পথে নামাল তাদের খেটে-খাওয়া সম্প্রদায়কে – তাদের পরিযায়ী শ্রমিকদের – যেন তারা অযাচিত, বাড়তি। অনেককে তাড়ালেন তাদের মনিব-মালিকেরা; লাখে লাখে দরিদ্র, ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত মানুষ, যুবক থেকে বুড়ো, পুরুষ, মহিলা, বাচ্চা, অসুস্থ, অন্ধ, পঙ্গু মানুষ – আর কোথাও যাওয়ার নেই, যতদূর চোখ যায় কোনও যানবাহন নেই – হাঁটা শুরু করলো দীর্ঘ পথ তাদের গ্রামের বাড়ির দিকে। দিনের পর দিন হাঁটল ওরা, বাদউন, আগ্রা, আজমগড়, আলীগড়, লখনউ, গোরখপুরের দিকে – শ’ শ’ মাইল দূরে। কেউ কেউ মারা গেল পথেই।
তারা জানত, বাড়ি গিয়েও সম্ভবত অনাহারে মরবে। হয়তো এ’ও জানত, যে তারা এই ভাইরাস নিজেদের সঙ্গে নিয়েই ফিরতে পারে, ছড়িয়ে দিতে পারে পরিবারে, বাবা-মা, দাদু-দিদিমাদের শরীরে, কিন্তু তখন তাদের নিদারুণভাবে দরকার এক টুকরো ঘনিষ্ঠতা, মাথার উপর ছাদ, ন্যূনতম২ সম্মান, এবং ভালোবাসার স্পর্শ না থাক, অন্তত একটু খাবার। চলার পথে, কারফিউ জারি করার দায়িত্বে থাকা পুলিশের হাতে নৃশংস মার খেলেন, অপমানিত হলেন কিছুজন। যুবক যারা, তাদের বাধ্য করা হল উবু হয়ে বসে বড়রাস্তা দিয়ে ‘ফ্রগ-জাম্প’৩ করে করে যেতে। বরেলী শহরের বাইরে এরকমই একদল মানুষকে একসঙ্গে ভিড়িয়ে, হোস পাইপ দিয়ে তাদের গায়ে রাসায়নিক স্প্রে ছেটানো হয়। আরও কিছুদিন পর, এই পালিয়ে বেড়ানো৪ মানুষেরা গ্রামে ছড়িয়ে দিতে পারে ভাইরাস, এই ভয়ে সরকার সমস্ত রাজ্য-সীমানাগুলি বন্ধ করিয়ে দিল, এমনকি পথচারীদের জন্যও। কাজেই, পথ-চলা থামিয়ে মানুষেরা আবার ফিরে যেতে বাধ্য হল সেইসব শহরের ক্যাম্পে, যেখান থেকে বিতাড়িত হয়ে এতদিন ধরে এত পথ পেরিয়ে এসেছিল তারা।
বয়স্কদের মধ্যে জেগে উঠলো ১৯৪৭-এর দেশান্তরের স্মৃতি, যখন ভারত ভেঙে পাকিস্তানের জন্ম হল। তবে বর্তমান সময়ের এই পরিযানের পিছনে কারণ হয়ে রইল – ধর্ম নয়, শ্রেণীভেদ। তবুও বলতেই হয়, এরা ভারতের দরিদ্রতম মানুষেরা নয়। এদের কাছে অন্তত এখনও অব্দি৫ শহরে করার মতো কাজ, আর ফেরার মতো ঘর ছিল। অসহায়, কর্মশূন্য, ঘরছাড়া মানুষেরা যেখানে থাকার, সেখানেই রইল – শহরে, আর গ্রামেও – যেখানে, এই বর্তমান ট্র্যাজেডির বহুকাল আগে থেকেই গভীর এক দুর্দশা বেড়েই চলছিল। আর এই পুরো সময়টায়, ভয়ানক দিনগুলিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে জনসমক্ষে দেখাই গেল না।
(পরবর্তী পর্বে সমাপ্য)
_________________________
১ নির্বাচনের ফলাফলে ভারতীয় জনতা পার্টির যে অপমান, তার কথা বলছেন লেখিকা। প্রসঙ্গত, যে অপমান-জনিত প্রতিশোধস্পৃহা কিছুটা অন্যভাবে ২০২১-এ বাংলার নির্বাচনী ফলাফলের পর আমরা দেখে থাকবো।
২ ‘ন্যূনতম’ কথাটি আমার সংযোজন। ইংরাজিতে এখানে ‘dignity’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। মানুষ হিসেবে যে সম্মান, মর্যাদা তাঁরা পান নি, সেটুকুই এখন চান – এই অর্থে ‘ন্যূনতম’ কথাটি নিয়ে আসা।
৩ পরিচিত ইংরাজি শব্দবন্ধ, তাই অপরিবর্তিত রাখা হল।
৪ সরকারের চোখে ‘পালিয়ে বেড়ানো’ – এক শহর থেকে আরেক শহর থেকে গ্রামে। ইংরাজিতে ব্যবহৃত ‘fleeing’ কথাটি এখানে শ্লেষাত্মক।
৫ ‘এখন’ বলতে ২০২০-র লকডাউনের কথা বলা হচ্ছে।
বোলতার চাকে ঢিল!