মৌসুমী বিলকিস— আপনার ফিল্মে দেখি বিশাল এক গাছ দাঁড়িয়ে আছে ফ্রেম জুড়ে, যেন সে নিজেই এক চরিত্র। তার নীচে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে ঠিক চোখেই পড়ছে না বা আপনার সব ফিল্ম জুড়েই ফোকাস, ডেপথ্, আলো-ছায়া যেভাবে ব্যবহার করেছেন…
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত— আপনি যে কথাটা বললেন সেটা হল দৃশ্যপট। আমি দৃশ্যপট বার বার নতুনভাবে সাজিয়েছি; লেন্সিং-এর মধ্য দিয়ে, মুভমেন্টের মধ্য দিয়ে… একটা কথা আমার বার বার মনে হয় যে… যদি সময়কে ছাপিয়ে না যেতে পারি তাহলে কিন্তু মুশকিল। সময়ের ভেতর থেকেই সময়ের বাইরে চলে যেতে হবে আমার সিনেমাকে। সেটাই আমি চেয়েছি। (চুপ করে গেলেন। গলা শুকিয়ে গেছে। একটা লজেন্স নিলেন। অসুস্থতার জন্য জল খাওয়া বারণ। ছোট ছোট লজেন্স সারাক্ষণ মুখে রেখেই কথা বলছেন।)
মৌ. বি.— ‘উড়োজাহাজ’-এর গল্প কীভাবে পেলেন?
বু. দা.— একটা ছোট্ট খবর থেকে। কত খবরই তো বেরোয়- ছোট, বড়, হেডলাইন, তলার খবর- সেরকমই ছোট্ট খবর। একজনকে গ্রেফতার করেছে সে একটা স্বপ্ন দেখছে বলে, যে স্বপ্নটা স্টেটের কাছে বিপজ্জনক বলে স্টেট মনে করছে। মানুষটা কিন্তু স্বপ্নই দেখছে। সে স্টেটের বিরুদ্ধে যাবে বলে ভাবছে না। কিন্তু স্টেট ভেবে নিচ্ছে। এটা সব জায়গায় ঘটছে- আমেরিকায় ঘটছে, রাশিয়ায় ঘটছে, আমাদের দেশেও ঘটছে- রাজ্যের সব জায়গায় ঘটছে, কেন্দ্রীয় স্তরে ঘটছে।
মৌ. বি.— এই প্রসঙ্গে জানতে ইচ্ছে করছে, শিল্পী-সাহিত্যিকদের জায়গাটা কি সংকুচিত হয়ে আসছে?
বু. দা.— শিল্পী-সাহিত্যিকের জায়গা কমে আসছে না, সেটা কখনও কমে না। যেটা কমে আসছে... শিল্প-সাহিত্য করলেই হয় না, একটা মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানো মানুষ হওয়া চাই যে মানুষ প্রতিবাদের কথা বলে এবং মানুষকে প্রতিবাদ করতে বলে, একই সঙ্গে গভীর থেকে গভীরে যেতে বলে।
মৌ. বি.— একটা নিরস খবরকে রক্ত-মাংস দিয়ে চিত্রনাট্যে পরিণত করাটা আপনার কেমন মনে হয়?
বু. দা.— এটা আমি একা করিনি কিন্তু। অনেকেই করেছেন পৃথিবীতে। ওশিমা (নাগিশা ওশিমা), পৃথিবী বিখ্যাত জাপানিজ ফিল্মমেকার ‘দ্য বয়’ বলে একটা ছবি করলেন, ‘টোকিও টাইমস’-এ ছোট্ট একটা নিউজ বেরিয়েছিল… আমরা অনেক সময় নিউজকে গুরুত্ব দিই না। কিন্তু নিউজকে যদি একটু পাল্টে, একটু ভেতরে ঢুকে যাওয়া যায় নিউজের মধ্যে ছোট ছোট অসম্ভব কিছু ঘটনা লুকিয়ে থাকে। সেগুলোকে দেখতে জানতে হয়।
মুশকিল হচ্ছে, আমাদের সিনেমা ক্রমশই দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। গল্প খুঁজতে গিয়ে আমরা সেই গতানুগতিক ছকেই বাঁধা পড়ছি। এটা আমাকে খুব বিরক্ত করে, বিষণ্ণ করে, ভাবায়। আমি মাঝে মাঝে নিজেকে খুব একা মনে করি। মনে হয় যে আমার পাশে আরও কিছু মানুষজন থাকলে এরকম ভাবনার মধ্যে জড়িয়ে… তাহলে বোধহয় ভারতীয় সিনেমার আরও বেশি উন্নতি হত, আরও বেশি আন্তর্জাতিক স্তরে নিয়ে যাওয়া যেত ভারতীয় সিনেমাকে।
মৌ. বি.— একটা চিত্রনাট্য লিখতে আপনার কতদিন সময় লাগে স্যার?
বু. দা.— আমি কিন্তু ‘উড়োজাহাজ’-এর গল্পটা ‘টোপ’ করার সময় থেকেই ভাবছি। গত দেড় বছর… আমার কিন্তু অনেক সময় লাগে… বললেই ছবি করে ফেলতে পারি না। আমার মা একটা কথা বলতেন, ‘ঘড়া উল্টে ফেললে জল ভরতে হয়’। আমার জল ভরতে সময় লাগে। দ্রুত ম্যাজিকের মতো জল ভরতে পারি না। দেড় বছর গেছে ভাবতে। গত ছ’মাস ধরে লিখছি। তার মধ্যে অসুস্থতা গেছে, হাসপাতাল গেছে…
মৌ. বি.— হুবহু চিত্রনাট্যই কি চিত্রায়নের সময় অনুসরণ করেন?
বু. দা.— ছবি করতে করতেও আমি স্ক্রিপ্ট লিখি। স্ক্রিপ্টটাই শেষ কথা নয় আমার কাছে, শুটিং করতে গিয়ে অনেক বদলে যায়, অনেক বদলাই (এই শব্দে বেশ জোর দিয়ে) এবং এই বদলানোটা অনেক ইম্পরট্যান্ট আমার কাছে। স্ক্রিপ্টটা প্রথম ভাগ। শুটিং করতে গিয়ে স্ক্রিপ্টের দ্বিতীয় ভাগ শুরু হয়। যেগুলো ইন বিটুইন লাইনস লুকিয়ে ছিল, ছবি করতে গিয়ে আমি ধরতে পারি, বুঝতে পারি।
যেমন সেদিন আমি শুট করছিলাম… একটা হোল নাইট সিকোয়েন্স ছিল… কলকাতার রাত্রি… তো কলকাতার রাত্রি বলতেই আমার জীবনানন্দ দাশের ‘রাত্রি’ কবিতাটা মনে পড়লো… আমি ‘রাত্রি’ কবিতাটা নিয়ে এলাম… আনার চেষ্টা করলাম… ‘একটি মোটরকার গাড়লের মতো গেল কেশে’… আছে… আরও অনেককিছুই যা জীবনানন্দ দাশের কবিতায় আছে, আমি তুলে আনতে চেয়েছিলাম।
ফলে… স্ক্রিপ্টে সেটা নেই কিন্তু… স্ক্রিপ্টে যা আছে সেটাই শেষ কথা বলে মনে করি না। কোনদিন মনে করিনি। আমি সত্যজিতের মতো ছবি এঁকে ফ্রেম সাজাতে পারি না… পারিনি… চাইনি। কেননা মনে হয় অজানাটা অনেক বেশি মজার।
তাই শুটিং করতে গিয়ে আমি বার বার নিজেকে বদলে দিই। নতুন চরিত্র নিয়ে আসতে চাই। এসে গেছে অনেক ছবিতে।
মৌ. বি.— তাৎক্ষণিক ভাবা, প্রোডাকশনের জায়গা থেকে সমস্যা হয় না?
বু. দা.— না। আমার সঙ্গে আমার যে টিম যায়… আমার কোর টিম যারা আমার সঙ্গে এতদিন কাজ করছেন… তাঁরা জানেন… তাঁরা বুঝতে পারেন… হ্যাঁ, আমি শুটিঙের মুহূর্তের চেয়ে এই পাল্টানোর কথা সেদিন সকালে ভাবতে চাই। শুটে গিয়েও পাল্টাই। কিন্তু শুটে গিয়ে পাল্টানোর দায়িত্বটা সম্পূর্ণ আমার।
এই যেমন জীবনানন্দ দাশের ‘রাত্রি’ কবিতার জন্যই মনে পড়ে গেল… সেদিন সকালবেলা… একজন কালো সাহেবের থাকা দরকার… ব্ল্যাক ম্যান যাকে বলি… প্রোডাকশনকে বললাম… আমাদের দেশের কালো মানুষ নয়… বিদেশি মানুষ… আফ্রিকার কালো মানুষ যাকে তাঁর এই কলকাতার রাত্রে ‘লিবিয়ার জঙ্গলের মতো’ মনে হয়… এটাই জীবনানন্দ বলছেন। তো শুটের দিন সকালবেলায় খবর দিলাম। ওরা ধরে বেঁধে নিয়ে এলো। খুব ভাল একজন মানুষ… কলকাতায় ফুটবল খেলতে এসেছে… তাকে দিয়ে আমি অভিনয় করিয়ে নিলাম… অসম্ভব ভাল অভিনয় করলো।
তো… এটা আমার সঙ্গে যারা কাজ করেন তাঁরা জানেন।
মৌ. বি.— ধরুন, আপনি পরেরদিন শুট করবেন, আগের রাতে একটা কবিতা লিখছেন। যদি ধরে নিই কবিতাটা সম্পূর্ণ লিখে ফেললেন। এই কবিতার অনুভূতিটা কি পরের দিনের শুটে প্রভাব ফেলতে পারে?
বু. দা.— না। এমন হবেই এমন কোনও কথা নেই। এমনও হয়েছে, কবিতা লিখেছি। সেই কবিতার সঙ্গে পরের দিনের শটের কোনও মিল নেই। ওইভাবে কিন্তু মেলানো যায় না। কবিতা শেষ পর্যন্ত কবিতাই। সিনেমা শেষ পর্যন্ত সিনেমাই। কিন্তু সিনেমা কবিতা ও সঙ্গীতের মাঝখানে জায়গা করে নিতে পারে… এমন সিনেমা তৈরি করা সম্ভব যা কবিতার কাছাকাছি, সঙ্গীতের কাছাকাছি… সেটাই সিনেমার মহত্ব, বিরাটত্ব।
আমি পড়েছি ইকোনমিক্স… লিখেছি কবিতা… বহু বছর ধরে… চৌদ্দ বছর বয়স থেকে কবিতা লিখছি… কবিতা বেরোচ্ছে… সিনেমা করছি আটাশ বছর বয়স থেকে।
এই দুটোকে আমি বুঝেছি… আমি যখন কবিতা লিখছি তখন আমি কবি। তখন আমার কবিতা কে পড়লেন, কে পড়লেন না, কে ভাল বললেন, কে মন্দ বললেন – আমার কিচ্ছু এসে যায় না। আমি লিখি আমার লেখার তাগিদে। সিনেমা করার সময় ব্যাপারটা সবটাই তেমন কিন্তু নয়। সিনেমা করার সময় ভাবতেই হয় দর্শকের কথা। কারণ দর্শককে আমার দরকার। দর্শক ছাড়া আমি বাঁচতে পারি না। আমি জানি আমার দর্শকের সংখ্যা কম, মাইনরিটি আমার দর্শক। কিন্তু তাঁদেরও আমার চাই। তাঁদের আঁকড়ে ধরেই আমি বাঁচতে চাই এবং তাঁরাও আমার ছবির জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করেন।
তাঁরা বলেন যে আমার সিনেমা ‘কবিতার মতো’। এরকম অনেক কথা আমি বলতে শুনি, এ নিয়ে লেখালেখি হতে দেখেছি অনেক। কিন্তু আমি যখন সিনেমা করি তখন আমি কবিতা লিখি না বা লিখলেও সেটা ক্যামেরা দিয়ে লিখি।
মৌ. বি.— এই প্রসঙ্গে জানতে ইচ্ছে করছে ‘সেলুলয়েডের কবিতা’ আপনার কাছে ঠিক কেমন?
বু. দা.— আমি যেটা বলতে চাইছি… ক্যামেরা দিয়েও গাঁথা যায় শব্দ এবং অসামান্য একটা দৃশ্য তৈরি করা যায়। মুশকিল হচ্ছে আমরা ক্যামেরাকে ব্যবহারই করতে পারি না। ক্যামেরায় লেন্স আছে, মুভমেন্টস আছে, ডেপথ্ অফ ফিল্ড আছে, ফোকাসিং আছে… অনেক জিনিস আছে।
যেমন পুরুলিয়া… আমার বেশ কিছু ছবির প্রেক্ষাপট পুরুলিয়া… আমার পরেও বেশ কিছু বাংলা ছবি শুট করতে গেছে পুরুলিয়ায়… আমাকে অনেকে বলেছে, ‘পুরুলিয়াকে তো সেভাবে পেলাম না, যেভাবে আপনার ছবিতে পাই?’… আমার বক্তব্য হচ্ছে যে, এটা কিন্তু সবটাই পরিচালকের ওপর। কোন লেন্স ব্যবহার করবেন, কী ডেপথ্ অফ ফিল্ড উনি চাইছেন, কোন অ্যাঙ্গেল উনি চাইছেন… এগুলো জানতে হবে। এগুলো মিলিয়েই কিন্তু দৃশ্যপট তৈরি হল, যা তুমি জানতে চাইছিলে। কিন্তু অনেকেই মনে করেন যে দৃশ্যপট তৈরির দরকার নেই, দৃশ্যপট তৈরিই থাকে। তা কিন্তু নয়।
একটা স্ট্রিম, একটা বহমান জলের স্রোতকে খুব ক্লোজলি দেখাতে পারেন একটা লেন্স দিয়ে, আরেকটু ডিসট্যান্স থেকে দেখাতে পারেন আরেকটা লেন্স দিয়ে। কী আপনি চাইছেন, কীভাবে চাইছেন, শব্দকে কীভাবে ব্যবহার করছেন… শব্দ ভীষণ ইম্পরট্যান্ট।
মৌ. বি.— আপনার ফিল্মে শব্দ ভীষণভাবে অনুভূতিদেশে নাড়া দেয়। একই শব্দ কতরকমভাবে শুনি।
বু. দা.— আমার সিনেমায় শব্দ অসম্ভব ইম্পরট্যান্ট, যে শব্দ কিন্তু শুধুমাত্র পর্দাতেই জেনারেট করতে হয় না, শব্দগুলো অদ্ভুত জায়গা থেকে উঠেও আসে। তো… হাওয়ার চরিত্র… কত রকমের আছে। বৃষ্টির শব্দ, ঝড়ের শব্দ, পা ফেলার শব্দ, নিঃশ্বাসের শব্দ এবং তার সাথে পারিপার্শ্বিক শব্দ কী করে মিলছে… সবগুলো মিলিয়েই একটা বুনট তৈরি হয়… একটা গাঁথা যাকে বলে স্কাল্পটিং… সেটা তৈরি হয়। এই স্কাল্পটিং-টা খুব ইম্পরট্যান্ট।
মৌ. বি.— বুনুয়েল এবং তারকভস্কির ফিল্মের সঙ্গে আপনার ফিল্মের সংযোগ…
বু. দা.— যারা মেলাতে পারেন তাঁরা মেলাতে পারবেন। তবে বুনুয়েল আলাদা, তারকভস্কি আলাদা। দুজনেই আমার খুব প্রিয়। হয়তো একটু বেশি প্রিয় বুনুয়েল। তাঁরা মাস্টারস ফিল্মমেকারস। আমি তাঁদের দ্বারা কখনোই প্রভাবিত নই কিন্তু প্ররোচিত তো বটেই।
ভালো লাগলো ! আমরা যারা অন্য সিনেমায় ( আর্ট ফিল্ম বলছি না ) আকর্ষিত হয়ে ছিলাম বা মজে ছিলাম ।...শুধু ওই চার মূর্তি ( সত্য , মৃনাল , ঋত্বিক , তপন ) সম্পর্কে অবহিত বা জানিত হয়ে এসেছি এতদিন , কিন্তু এই যে আমাদের এতো কাছে হীরের টুকরো পরে ছিল এতদিন , জানলাম না ।..চলে যাবার পর মূল্যায়ন হবে এটাই তো আমাদের ধৰ্ম ।..এই আক্ষেপ !!