আধুনিক উন্নয়নের ধর্মে বড় বাঁধ যদি হয় মন্দির তাহলে তিনি হলেন সবচেয়ে বড় নাস্তিক। গত একুশে মে ৯৪ বছর বয়সে চলে গেলেন সুন্দরলাল বহুগুণা। তার প্রাণপ্রিয় হিমালয়, বহুবিচিত্র বৃক্ষরাজি, নদী, ঝর্ণা, পশুপাখি, নাম না জানা ফুল সবই রয়ে গেল। রয়ে গেল তার দীর্ঘ জীবনের অসামান্য কর্মকাণ্ড। ১৯২৭ সালে এই হিমালয়েরই কোলে টিহরীর ক্ষুদ্র মারোয়ার গ্রামে জন্মেছিলেন সুন্দরলাল বহুগুণা। তারপর আজীবন এই পর্বতমালার সাথেই সখ্য।
১৯৬৪ সালে দাশোলি গ্রামে গ্রামস্বরাজ্য সংঘ তৈরি করেন চন্ডিকা প্রসাদ ভাট। উদ্দেশ্য ছিল অরণ্যের সাহচর্যে কুটির শিল্পের বিকাশ। কিন্তু তাঁদের লড়তে হলো গাছ কাটার ঠিকাদারদের সাথে। নির্বিচার অরণ্যধ্বংসের ফলে ১৯৭১ সালে ভয়াবহ বন্যা হল অলকানন্দায়। স্থানীয় মানুষ আরো সজাগ হলেন বনরক্ষায়। বৃক্ষনিধনের সাথে ধস এবং বন্যার সম্পর্ক স্পষ্ট হল তাঁদের কাছে। এর পর এলাহাবাদের একটি ক্রীড়াসামগ্রী প্রস্তুতকারী সংস্থা এই এলাকায় তিনশ গাছ কাটতে এলে তাদের বিরুদ্ধে শুরু হলো গ্রামবাসীর আন্দোলন। পরে দেখা গেল অলকানন্দার তীরে রেনি গ্রামে আড়াইহাজার গাছের নিলাম হতে চলেছে। শুরু হল আরো বড় আন্দোলন। ক্ষতিপূরণের গল্প বলে আলোচনার জন্য সেদিন গ্রামের সব পুরুষেরা গেছেন বহু দূরে। হঠাৎ একটি মেয়ে দৌড়ে এসে খবর দেয় রেনি গ্রামের মহিলা মঙ্গল দলের নেত্রী গৌরাদেবীকে যে ট্রাকভর্তি ঠিকাদারের লোক আসছে গাছ কাটতে। সাতাশটি মেয়ে দৌড়ে যায় অরণ্য রক্ষায়। ঠিকাদারের লোক তাদের গালি দেয়, ভয় দেখায় ,চূড়ান্ত অপমান করে। তবুও তারা সারারাত গাছগুলিকে জড়িয়ে থাকে। অতি প্রিয়জনকে সুরক্ষিত রাখতে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে। চিপকো। বিশ্ব বিখ্যাত এই আন্দোলনকে দেশ এবং আন্তর্জাতিক স্তরে তুলে ধরেছিলেন সুন্দরলাল বহুগুণা। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী বিমলা বহুগুণা হিমালয় বাঁচানোর সমস্ত আন্দোলনে বরাবর সক্রিয়। কত কত বছর আগে ১৭৩০ খ্রিস্টাব্দে রাজস্থানের বিষ্ণোই গোষ্ঠীর মেয়েরা অমৃতা দেবীর নেতৃত্বে তাদের পবিত্র খেজরি গাছগুলোকে বাঁচাতে প্রাণ দিয়েছিলেন। রাজার প্রাসাদ তৈরির জন্য গাছ কাটতে এসেছিল রাজার লোক। অমৃতা দেবী তাঁর তিন মেয়ে সমেত প্রাণ দিয়েছিলেন, তারপর মোট ৩৬৩ জন গাছের জন্য শহিদ হয়েছিলেন। সেই যে আন্দোলন হিমালয়ের চিপকো আন্দোলনের পূর্বসূরী, দুটি আন্দোলনেই মহিলাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একসময় গাছের সাথে সখ্যবোধে গাছকে রাখি পরিয়ে রাখিবন্ধন পালিত হত এখানে।
ভারতবাসীর মনে হিমালয় পর্বতমালা এক রোমান্টিক ধারণায় অবস্থিত। আমরা ছোটবেলা থেকেই উত্তরে গিরিরাজ হিমালয় এবং তার ভাবগম্ভীর একটি মূর্তিকে কল্পনা করি ধর্মীয় অনুষঙ্গে। সেখানে দেবতাদের বাস, হিন্দু দর্শনের বহু তীর্থ এই হিমালয়ে অবস্থিত। হিমালয়- যা দুর্গম, যা উচ্চ, যা ভয়ংকর সুন্দর। কিন্তু কয়েক দশক ধরে যেভাবে উন্নয়নের নামে এখানে গাছ কাটা হয়েছে এবং ভয়ঙ্কর সব বাঁধ তৈরি করা হয়েছে তা নিয়ে সমতলের তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। সময়ের সাথে সাথে স্থানীয়দেরও অনেকেই উন্নয়ন মানে চাকরি এই আপ্তবাক্য মেনে নিয়েছেন। কিন্তু সুন্দরলাল বহুগুণার মত মানুষ বরাবর আন্দোলন করেছেন। সুন্দরলাল গোটা বিশ্বের কাছে চিপকো আন্দোলনের মাধ্যমে হিমালয়ের ভয়াবহ পরিবেশ ধ্বংসকে তুলে ধরেছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন কীভাবে অরণ্য ধ্বংসের ফলে জমির উর্বরতা নষ্ট হওয়ায় কাজের সন্ধানে পুরুষদের দূরদূরান্তে যেতে হয়। থেকে যান মেয়েরা, যাদের উপর থাকে সমস্ত দায়িত্ব।
সভ্যতার একটি বড় সমস্যা এই যে সে প্রকৃতিকে প্রতিপক্ষ বলে মনে করে। সে চায় প্রকৃতির ঘাড় ধরে তার সবটুকু নিয়ে নেবে। সে চায় প্রভুত্ব। দখলদারের মানসিকতা নিয়েই সে অরণ্যের দিকে তাকায়। গান্ধীজির যে কথাটি আজ দেশে দেশে পুনর্চর্চিত তা এই যে, পৃথিবীতে সকলের জন্য প্রয়োজন মেটানোর রসদ আছে কিন্তু মাত্র একজন মানুষের অপরিসীম লোভকে পৃথিবী পূরণ করতে পারবেনা। ১৯০৯ সালে লেখা হিন্দ স্বরাজ যে বই একসময় উন্নয়নবাদীরা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন সেই গ্রন্থে গান্ধীজি বলেছিলেন ইংল্যান্ডের মতো একটি ক্ষুদ্র দ্বীপের অধিবাসীদের ভোগের জন্য যদি অর্ধেক পৃথিবীকে শোষণ করতে হয় তাহলে ভারতের প্রতিটি মানুষকে ওই ধরনের উন্নয়ন পৌঁছে দিতে কতগুলো পৃথিবী লাগবে? হিমালয়ে পরপর ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর বিপর্যয় প্রমাণ করেছে বড় বাঁধ এবং নির্বিচার বনধ্বংস কি প্রবল সংকটের মুখে আমাদের ঠেলে দিয়েছে।
সুন্দরলাল বহুগুণা বিমলাকে বিবাহ করেন এই শর্তে যে তারা দুজনে গ্রামে থেকে মানুষের কাজ করবেন। এককালে গান্ধীবাদীদের মধ্যে এটাই স্বাভাবিক ছিল। চিপকো আন্দোলনের অনুক্রমে পরিবেশ ধ্বংস নিয়ে মানুষকে সচেতন করতে বহুগুণা বেশ কয়েকটি বিশাল পদযাত্রা করেছেন। তার একটি ছিল কাশ্মীর থেকে কোহিমা যেখানে দেড় বছর ধরে পাঁচ হাজার কিলোমিটার পথ চলা হয়। অবশেষে ১৯৮০ সালে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা হলে ইন্দিরা ১৫ বছরের জন্য ওই সমস্ত অঞ্চলে গাছ কাটার উপর নিষেধাজ্ঞা দেন। ১৯৯২ সালে টিহরিতে বাঁধ তৈরির বিরোধিতায় মাথা কামিয়ে তিনি অনশন করেন। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শাসক তাকে আশ্বস্ত করেছেন, কখনো নরসিমা রাও, কখনো দেবগৌড়া ,অবশেষে সুপ্রিম কোর্ট। দেবগৌড়ার সময়ে তিনি দিল্লিতে রাজঘাটে অনশন করছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উন্নয়নের মন্দিরের জয় হলে তিনি টিহরি ছেড়ে অবশেষে চলে আসেন দেরাদুনে।
বহুগুণা কম বয়সে অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন। প্রকৃতির সঙ্গে বা বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে অর্থনীতির সম্পর্ক বিষয়ক আলোচনায় তিনি মতপ্রকাশ করেছেন যে বাস্তুতন্ত্রই হল অর্থনীতি। এর পাশাপাশি বারবার বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলেছেন। এটা সবাই জানেন জঙ্গলকে বাঁচায় জঙ্গলের সঙ্গে থাকা অধিবাসীরাই। এদের হাতেই জঙ্গল সুরক্ষিত থাকে। কিন্তু কেন্দ্রীভূত শাসনে আমলাতন্ত্র যখন নিয়ন্ত্রণ হাতে নেয় তখন সমস্তই বাজারমুখী হয়ে যায়। গাছ তখন প্রাণ নয়, অক্সিজেন নয়, গাছ তখন কাঠমাত্্ যার দাম বাজারে যাচাই করা হয়। বহুগুণা বলতেন বৃহৎ তেহরি বাঁধ না করে ছোট ছোট জলের উৎস থেকে বিদ্যুৎ তৈরি করলে স্থানীয় এলাকার মানুষ উপকৃত হবেন। বড় বাঁধের অবশ্যম্ভাবী ফল অর্থাৎ উচ্ছেদ ,ডুবে যাওয়া, গাছ কাটা, ভূমিকম্প এসব হবে না তাতে। এমনকী হিমালয়ের মতো পর্বতে পাহাড় কেটে রাস্তা বানানোর অবশ্যম্ভাবী ফল যে বিপজ্জনক ধস, সে কথাও তিনি বার বার বলেছেন। তিনি বলছেন পায়ে চলা পথেই গ্রামের সাথে গ্রামকে যুক্ত করার কথা। তাঁর অন্তর্দৃষ্টিতে চারধাম নিয়ে বর্তমানে যে উদ্যোগ তার বিপদ সহজেই অনুমেয়।
কিন্তু সে কথা শোনে কে? তার চেয়ে সহজ বহুগুণাকে পদ্মভূষণ দেওয়া। বহুগুণার মৃত্যুর পরের দিন গভীর শোক জ্ঞাপন করে দিল্লিতে কেন্দ্রীয় ভবন নির্মাণের জন্য হাজার হাজার প্রাচীন গাছ কেটে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হল। আমাদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন এইরকমই।
তবু আমাদের ভরসা জাগে যখন অন্য দেশের এক কিশোরীর মধ্যে সুন্দরলালের কথা মূর্ত হয়ে ওঠে। পৃথিবীর বহু মানুষ আজ গ্রেটা থুনবার্গ এর কথা শুনছেন। ২০১৭ সালে মুম্বাইয়ে পাতাল রেলের জন্য তিন হাজার গাছ ফেলার প্রতিবাদে চিপকোর মতই আন্দোলন হয়েছে। একই বছরে যশোর রোডেও একই রকম আন্দোলন হয়েছে।
এই অতিমারীর কালে একবার থমকে দাঁড়িয়ে ভাবতেই হচ্ছে যে আজ যে প্রকৃতি বিরোধী সভ্যতা তৈরি হয়েছে তা নিজেই নিজেকে ধ্বংস করছে।
সুন্দরলাল বহুগুণার বিশেষ বৈশিষ্ট্য এই যে তিনি ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কাছে পরিবেশ বিষয়ক আন্দোলনের পথিকৃৎ হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা তো বটেই কমিউনিস্ট ভাবনাতেও পরিবেশ বিষয়টি কখনও যথাযথ গুরুত্ব পায়নি। বৃহতের পূজারী সকলেই, পরিবেশ ধংস করে উন্নয়নের কথাই সব তন্ত্র বলেছে। সুন্দরলাল বহুগুণা এর উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আমাদের দেশে পরিবেশকে নির্ণায়ক ভাবনার প্রান্ত থেকে মূলে আনতে পেরেছেন।
জরুরী লেখা
স্বল্প কথায়, গোছানো প্রতিবেদন। ভালো লাগল পড়ে।
খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় l এরকম প্রতিবাদী আন্দোলন মানুষকে চেতনা বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে এমনই আশা করি