মৃত্যু মিছিল
এরকম অকারণে মৃত্যু মিছিল কোনোদিনও দেখিনি। ডাক্তারি পাশ করার পর থেকেই একটানা রোগী দেখে যাচ্ছি। একাধিক সরকারি হাসপাতালে ডিউটি করেছি। মেডিকেল কলেজে মেডিসিনে হাউসস্টাফশিপ বা পোস্ট গ্রাজুয়েট করার সময় অনকলের দিনে চিরকাল নাইট ডিউটি দিয়েছি। এক এক রাতে পাঁচটি থেকে ছটি মানুষের ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে হয়েছে। তবুও এতটা অসহায় কোনদিন বোধ করিনি।
মৃত্যুর আগে পর্যন্ত প্রতিটি মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য আন্তরিক ভাবে লড়েছি। সরকারি হাসপাতালের পরিকাঠামোর অভাব হয়তো ছিল, কিন্তু তা বলে চুপ করে বসে কারও মৃত্যু মেনে নিই নি। অনেক রোগী বেড পাননি। তবু মেঝেতেই রোগীর শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত এমন কী নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও চেষ্টা করেছি। শুধু আমি একা নই, আমার সাথে অন্যান্য চিকিৎসক এবং জুনিয়ার চিকিৎসকরাও আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। নার্সদিদিরা, ওয়ার্ডবয় ভাইরা সাধ্যের বাইরে গিয়েও অনেক সময় সাহায্য করেছেন।
কিন্তু লড়াইয়ের সুযোগ না দিয়েই এতো সহজে প্রাণের অপচয় দেখিনি আমি। এই পৃথিবীতে সবচেয়ে দামি মানুষের জীবন। সেই দুর্মূল্য জীবণ এতো অনাড়ম্বর ভাবে চলে যেতে দেখে স্বব্ধ হয়ে যাচ্ছি।
আমার এক অত্যন্ত পরিচিত ছেলের বাবা কোভিডে আক্রান্ত হলেন। জ্বর, কাশি কিছুতেই কমছে না। স্যাচুরেশনও কমছে। ছেলেটিকে বললাম, ‘হাসপাতালে ভর্তি কর।’
ছেলেটি বলল, ‘দাদা, হাসপাতালে বেড পাওয়া যাচ্ছে না। বাড়িতেই অক্সিজেনের ব্যবস্থা করেছি। তুমি কী কী লাগবে লিখে দাও। আমি সব ব্যবস্থা করছি।’
বললাম, ‘বাড়িতে ম্যানেজ করা যাবে না। তুই সরকারি হেল্প লাইন নাম্বারে ফোন কর। বেড যোগাড় কর। সে সময়টুকু বাড়িতে অক্সিজেন দে। কিন্তু ভর্তি করতেই হবে।’
পরের দিন ছেলেটি আবার এলো। বলল, ‘বাবা কিছুতেই হাসপাতালে ভর্তি হবে না। অক্সিজেন দিলে স্যাচুরেশন ৮৯-৯০% থাকছে। তুমি পরীক্ষা নিরীক্ষা কী কী করতে হবে লিখে দাও।’
নিমরাজি হয়ে লিখে দিলাম। আবার বললাম, ‘তুই বাবাকে ভর্তির চেষ্টা কর।’
রিপোর্ট দেখাতে এলো। সি আর পি, ডি ডাইমার সবকিছুই বেশ বেশি। বললাম, ‘রিপোর্ট ভাল না। ভর্তি কর।’
ও বলল, ‘বাবা বেশ ভালো আছে। অক্সিজেন ছাড়াই ৯২-৯৩% স্যাচুরেশন থাকছে। জ্বরও আসছে না। ভাবছি কালকেই সিটি স্ক্যানটা করে নেব।’
আমিও স্বস্তি বোধ করলাম। এতোগুলো দিন যখন কেটে গেছে, জ্বরটাও যখন কমে গেছে তখন একটু ভরসা করাই যায়। বললাম, ‘তাহলে সাবধানে রাখিস। খুব প্রয়োজন ছাড়া যেন বিছানা থেকে না নামেন।’
দুদিন পর তখন কাকুর দোকানে রোগী দেখছি, ফোন পেলাম, ছেলেটি আকুল হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছে, ‘বাবাকে বাঁচাতে পারলাম না গো। বিকাল থেকে হঠাৎ শ্বাসকষ্ট। যোগাযোগ করে কলকাতার এক নার্সিং হোমে নিয়ে গেছিলাম। কিন্তু পৌঁছানোর আগেই বাবা মারা গেছেন।’
যখন ডেথ সার্টিফিকেট লিখছিলাম ছেলেটির মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। শুধু মনে হচ্ছিল কেন আমি সেদিন আরো জোড় দিয়ে বলতে পারিনি এনাকে হাসপাতালে ভর্তি করতেই হবে। তাহলে হয়তো ওর বাবা এখনও বেঁচে থাকতেন।
তবে এর থেকেও অকারন মৃত্যু দেখেছি। আমারই এক রোগী পাশের পাড়ায় থাকেন। তাঁর সুগার, প্রেশার, হার্টের সমস্যা, কিডনির সমস্যা সবকিছুই আছে। বাড়ির লোক ওনাকে আনলেন জ্বর নিয়ে। তিনদিন ধরে জ্বর, মুখে কিছুই খেতে পারচ্ছেন না। বাড়ির লোককে বললাম, ‘হাসপাতালে ভর্তি করলে ভালো হয়। অন্তত কাল কোভিড পরীক্ষাটা করবেন। পজিটিভ এলে সরাসরি কোভিড হাসপাতালে ভর্তি করবেন। বাড়ির লোকটি একজন যুবক ছেলে। সম্পর্কে রোগীর নাতি। সে ঘাড় নেড়ে জানালো ঠিক আছে।
যুবকটি আসলো ঠিক আটদিন পর। কাঁচুমাচু মুখে বলল, ‘ডাক্তারবাবু, একবার যেতে হবে। দাদু মারা গেছে।’
গিয়ে দেখলাম, কোভিড টেস্টটাও করা হয়নি। একেবারে বিনা চিকিৎসায় বৃদ্ধ মারা গেছেন। মারা যাওয়ার পরও তাঁর ঘরে কেউ ভয়ে ঢুকছে না।
তবে হাসপাতালে পাঠালেই যে সব সমস্যার সমাধান তাও নয়। একজন পঞ্চাশোর্ধ ভদ্রলোক বাড়ির চেম্বারে এলেন টোটো করে। মাথা তুলে ঠিক করে বসতেই পারছেন না। স্যাচুরেশন ৭৩%। বললাম। ‘এখুনি হাসপাতালে ভর্তি না করলে একে বাঁচানো যাবে না।’
পরের দিন গৌড়ের কাছে খবর পেলাম ভদ্রলোককে নিয়ে ওঁর বাড়ির লোক বারাসতে একটি সরকারি হাসপাতাল সহ আরো তিনটি নার্সিং হোমে ঘুরেছেন। কোথাও ভর্তি নেয়নি। শেষপর্যন্ত তাঁকে বাড়িতে এনে রাখা হয়েছিল। অক্সিজেনেরো ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ভদ্রলোক রাতেই বাড়িতে মারা গেছেন।
রোজই দু’একজন রোগীর মৃত্যু সংবাদ শুনছি। আত্মবিশ্বাস ক্রমশ কমে যাচ্ছে। কি করলে মরণাপন্ন রোগীদের বাঁচানো যাবে বুঝতে পারছি না। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে চেম্বার টেম্বার ছেড়ে ছুড়ে পালিয়ে যাই। কিন্তু মহামারীর মধ্যে সেটাও সম্ভব নয়। মৃতব্যক্তির রোগীর পরিবারের মুখের দিকে তাকালে এক অপরাধ বোধ ঘিরে ধরছে। বারবার মনে হচ্ছে, চিকিৎসক হিসাবে তাঁরা আমার উপর যে ভরসা করেছিলেন, আমি সেই ভরসার মর্যাদা দিতে পারিনি।
কেউ কী সুস্থ হচ্ছেন না। নিশ্চয়ই হচ্ছেন। কিন্তু মুশকিল হলো সুস্থ রোগীদের স্মৃতি বেশীদিন থাকে না। মৃতরোগীরা দীর্ঘদিন হৃদয়ে বেঁচে থাকেন। নির্ঘূম রাতে তাঁদের কথা কেবলই মনে পরে। জয় নয়, মানুষ সারাজীবন কেবল পরাজয়ের স্মৃতিগুলিকেই বয়ে চলে।
খবরে দেখছি, দিনরাত জ্বলছে দিল্লীর মহাশ্বশানের আগুন। দাহ করার লোক নাই, গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে লাশ। আর এপারে ঢাকার রায়েরবাজারে আগাম খুঁড়ে রাখা হচ্ছে সার সার কবর। মৃত্যুর মিছিল চলছেই।
স্রেফ উদাসীনতায় মহামারীতে গতি সঞ্চার হয়েছে! ভাবা যায়?